লেখকঃ আকতার হোসেন
কূটনৈতিক নিয়ম ভঙ্গের দায়ে আবারো ফিরিয়ে নিতে হল আর একজন পাকিস্তানি কূটনীতিককে। এই নিয়ে এক বছরের মধ্যে মোট দুজন কূটনীতিককে ফিরে নিতে বাধ্য হল পাকিস্তান। ফারিনা আরশাদ এবং মাযাহার খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তারা জঙ্গিদের অর্থায়নের সাথে জড়িত ছিল। একজন কূটনীতিককে তখনই সেই দেশের সরকার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় যখন তার নামে বড় ধরনের অভিযোগ ওঠে। পরপর দুজন কূটনীতিকে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে সেটা পাকিস্তান সরকারের জন্য মোটেও সম্মান জনক নয়। সাধারণত এই ধরনের পরিবেশে পাল্টা প্রতিশোধ নেয়া হয়। অর্থাৎ এখন যদি বাংলাদেশের কোন কূটনীতিককে পাকিস্তান ফেরত পাঠায় তবে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মোট কথা কূটনৈতিক টানাপোড়নে চলছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন দুই দেশের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যার মানে, ভাল-মন্দের হিসাব নতুন করে কষা হচ্ছে। ফলাফল যেদিকে লাভজনক হবে সরকারের অবস্থান সেদিকেই যাবে। তবে লাভ-ক্ষতির ব্যাপারটা আপেক্ষিক কাজেই অনেক লাভের মধ্যে কিছু ক্ষতি থেকে যাওয়া অমূলক নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না এখনই বড় রকমের কোন পরিবর্তন আসবে তবে পাকিস্তানকে কিছুটা টাইট দেয়া হবে সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। ইতিমধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেখা যাক কি হয়।
পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্ক সব সময় ঝুলন্ত রশির উপর দিয়ে এগিয়েছে। এর বড় কারণ দুদেশের সম্পর্কের গোড়াতে রয়েছে প্রচণ্ড রক্তপাত আর উত্তাপ। সরকার আসে সরকার যায়, মাঝেমধ্যে মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে বন্ধুত্বের আলো কিন্তু আবারো আড়ালে চলে যায় সেই শুভদিন। এত সবের পরও দু’দেশ আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমঝোতা ও সহমতে দাঁড়িয়ে কিছু কাজ করেছে। বিষয়ভিত্তিক ঐক্য এবং সাফল্যের কিছু ঘটনাও লিপিবদ্ধ আছে সরকারি নথিতে। তবুও বিষফোঁড়ার মত মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে সম্পর্কের উৎস মুখ। তাই প্রয়োজন দেখা দেয় নতুন করে মূল্যায়নের। যেমন এবার পাকিস্তানের পার্লামেন্ট এবং সে দেশের কিছু রাজনৈতিক দল একাত্তরের গণহত্যায় তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে বিবৃতি দেয়ায় পুনরায় মূল্যায়নের টেবিলে বসতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।
কেন বারবার এই টানাপোড়ন? তার কারণ যথেষ্ট পরিষ্কার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি হল একাত্তরে কৃতকর্মের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে ১৯৪৭ এর পর থেকে শুরু করে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাঙালির উপর চালানো সব জুলুম-অত্যাচারের ভুলে গিয়ে সত্যিকারের বন্ধুদেশের মত চলা যেতে পারে। সহজ কথায় ১৯৪৭ সাল থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ভুলে যাওয়া হবে শুধু ১৯৭১ সালের জন্য ক্ষমা চাইলে। একই সাথে নতুন কৌশলে যেন একাত্তরকে পুনরায় আঘাত করা না হয় সে প্রতিশ্রুতিও চায় বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের পক্ষে বড় বাধাটা আসে বীরত্বের দিক থেকে। পাহাড়-মরুভূমি-নদীতে ঘেরা দেশটির বীরত্বের প্রতি খুব মোহ। উঁচু জাত, উন্নত শির এসব নিয়ে রয়েছে তাদের সীমাহীন অহমিকা। ইতিহাস সাক্ষী দেয় একমাত্র বাংলাদেশের কাছেই তাদের সেই অহমিকা চূর্ণ হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে টুকরো টুকরো হয়েছিল তাদের অহংকার। কাজেই বাংলাদেশকে মেনে নেয়া মনস্তাত্ত্বিক দিকে থেকে তাদের পক্ষে সম্ভব না। রাজনৈতিক পরাজয় এমনকি সামরিক পরাজয় হলেও হয়তো মেনে নিতে পারত কিন্তু দম্ভ রক্ষা পায় নি বলে জন্ম থেকেই বাংলাদেশ তাদের চক্ষুশূল হয়ে আছে। মানেটা দাঁড়াচ্ছে একদিকে বাংলাদেশের জনগণ স্বজন হারিয়ে ব্যথিত কিন্তু পাকিস্তানীরা হত্যা করেও অনুতপ্ত নয়। ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না। বাংলাদেশের মা-বোনেরা অপমানিত হয়ে আজও ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। ওরা বলছে ওসব একটু-আধটু হয়েই থাকে, বীরের পদতলে কে দলিত হল সেটা বড় কথা নয় বীরের বীরত্ব বজায় থাকটাই বড়। বাঙালি দেখতে কালো, আকারে ছোট, বাঙালি ভাত-মাছ খায়, মশা-মাছি আর পানির বেষ্টনীতে বাস করে, পারিবারিক এসব শিক্ষা থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক পাকিস্তানীও মনে করে একাত্তরের তাদের পূর্বপুরুষ দ্বারা সামরিক বল প্রয়োগ ছিল যুক্তিসঙ্গত। মানবতা এবং সমঅধিকারকে সম্মান করার শিক্ষা দেয়া হয় না অনেক পাকিস্তানি পরিবারে বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে তারা আলোচনা করে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তাদের দৈনন্দিন কারবার। বড়ভাইসুলভ আচরণ থেকে কক্ষনো ছোটভাই হতে রাজি নয় তারা। শুধু মিডিয়া খ্যাত হাতে গোনা কিছু লোক এবং ব্যক্তিগত পরিচিত কিছু ব্যক্তির মুখে শোনা যায় সত্য ও বাস্তব কথা। যে যেমন তেমন করে ভাবতে বলেন তাঁরা। অন্যের উন্নয়নকে তাঁরা প্রশংসা করেন কার্পণ্য ছাড়া। ভালকে ভাল মন্দকে মন্দ বলতে পরোয়া করেন না সেই সমস্ত মানবতাবাদী পাকিস্তানী নাগরিক। এছাড়া বেশিরভাগ পাকিস্তানী নাগরিকই জন্ম সার্টিফিকেটে ১৯৪৭ সালের সিল লাগিয়ে বসে আছে। তা তার জন্ম সত্তর-আশির কিংবা নব্বইয়ের দশকে হোক না কেন। এমন কি বিদেশে জন্ম নেয়া কিছু কিছু পাকিস্তানী সন্তানেরা স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার করেও সত্য অনুসন্ধানের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিদেশের বাড়িতে জন্ম নেয়া পাকিস্তান পরিবারের একটি মেয়ে (আমার সহকর্মী) যখন প্রশ্ন করে “ও তুমি বাংলাদেশী আমি মনে করেছিলাম তুমি বুঝি মুসলমান” তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না পাকিস্তানী মানেই মেইড ইন সাতচল্লিশ। কে এদের বোঝাবে গাধার পিঠে বসে হাইওয়েতে চলা সম্ভব নয়। তা না হলে এই যে এত ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে তাদের দেশ তারপরও শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ নিয়ে ওরা একশ মাইল বেগে দৌড়াতে চাইবে কেন!
ফিরে আসি মূল্যায়নের বিষয়ে। আন্দাজ করা যাচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে যে সমস্ত বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা হবে তার মধ্যে হয়তো থাকবে;
(১) পাকিস্তান অনেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের সেতু। সেই সেতু বন্ধ হলে লাভ-ক্ষতির পরিমাণ কি দাঁড়াবে।
(২) ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চলমান উৎপাদন প্রক্রিয়াতে কি প্রভাব পড়বে।
(৩) আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত পণ্য যদি অন্যদেশের সাথে করতে হয় বা অন্য দেশ থেকে আনতে হয় তাহলে কি পরিমাণ অর্থনৈতিক চাপ আসবে।
(৫) যে সমস্ত দেশের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই (যেমন ইসরাইল) তাদের থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা ভিন্ন পর্যায় অবস্থান করছে। যেমন দুদেশের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধন আছে (এক পরিবারে সদস্য অন্য দেশে) এই সমস্ত ক্ষেত্রে যেন নতুন কোন সংকট না আসে।
(৬) চলমান আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে অসমাপ্ত বা অমীমাংসিত ঘটনার উপর কি কি প্রভাব আসবে। যেমন পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর কোন খুনি কিংবা একাত্তরের যুদ্ধ অপরাধীকে সেই দেশ থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হয়ে থাকে সেই সাফল্য কি হাত ছাড়া হয়ে যাবে কি না।
(৭) বাংলাদেশের সীমান্তে কিংবা বাজার অর্থনীতিতে অন্যদেশের বাধাহীন অনুপ্রবেশের সুযোগ হয়ে উঠবে কি না
(৯) বকেয়া উদ্ধারের পরিকল্পনা
(১০) সাময়িক ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুনরায় সম্পর্ক পুন-স্থাপনের বাঁধা সমূহ। চীন, জাপান, জার্মানি ইংরেজ আমেরিকান রাশিয়ানরা পুনরায় পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সহ অবস্থানে ফিরে আসতে পারলেও পাকিস্তান বাংলাদেশের মধ্যে কোন অসুবিধা হবে কি না এ ধরনের বিশ্লেষণ। ইত্যাদি।
এসবের বাইরের না না জটিলতা ও ভিন্ন চিন্তাও থাকতে পারে মূল্যায়নের টেবিলে তবে, সত্যিকার এজেণ্ডা শুধু মাত্র সরকারি কর্তৃপক্ষের পক্ষে জানা সম্ভব এবং তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু এইটুকু বলা যায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে ওদের মেইড ইন সাতচল্লিশের ভাবটা হয়তো বদলানো যেতে পারে। অর্থাৎ মিথ্যে অহমিকার উপর বসে থাকা লোকগুলোকে বাস্তবতার আলোতে নিয়ে আসার সুযোগ আসতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের পাকিস্তানী প্রেমিকদেরও ঘরমুখো হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। যেকোনো কারণেই হোক আমরা একাত্তরের সঠিক চিত্র বিশ্ববাসীকে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছি। তা সেটা আমাদের নিজস্ব প্রচারের দুর্বলতা কিংবা পশ্চিমাবিশ্বের বাধা ও অনীহার কারণে হয়ে থাকুক না কেন। মূল কথা হল মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমাদের যে ক্ষত সেই কষ্ট নিজেরা বয়ে বেড়ালেও অন্যের মধ্যে আমরা পৌঁছে দিতে পারিনি। কিছুটা পারলেও যতটা হওয়া উচিৎ ছিল ততোটা পারি নি। এবারই সেই সুযোগ। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা এবং অগুণতি নারীকে ধর্ষণ করার ঘটনা অস্বীকার করার করণে যদি বাংলাদেশ পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় তবে সেটা বিশ্বদরবারে নতুন করে আলোচিত হবে। গণ হত্যার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং সেই হত্যার পরিমাপটাও জানবে বিশ্ব। এমন খবর তথ্য-প্রযুক্তি এবং সোশাল মিডিয়ার চরম ব্যবহারের যুগে যেভাবে বেগবান হবে আগে সেটা সম্ভব হত না। মনে রাখতে হবে এখন খবর পড়ে নতুনপ্রজন্ম কিংবা যুব সমাজ। আগের দিনে যেমন বাবা-চাচারাই শুধু খবর পড়তেন সে যুগ বদলে গেছে। নতুনদের দ্বারে বিশেষ করে পাকিস্তানী নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিন মানবতার চরম স্খলনের খবর দেখবেন তার ফলাফল কি দাঁড়ায়। এবার হয়তো বাংলাদেশের মূল শক্তিটা বিশ্ব বুঝতে পারবে। আমার বিশ্বাস পাকিস্তান বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যদি এই মুহূর্তে ছিন্ন করা হয় তবে সেই সিদ্ধান্তে এটাই হবে সব চাইতে বড় প্রাপ্তি।
কথা হল চরম প্রাপ্তির জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্যাগ স্বীকার করার নৈতিক সাহস বাংলাদেশ সরকারের আছে কিনা? সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়, বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির এই মূল আদর্শে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে ভাল আর সেটা যদি পদে পদে বাধা পায় এবং নতুন করে মূল্যায়নের টেবিলে বসতে হয় তাহলে লক্ষ্যে রাখতে হবে কারোর দম্ভের কাছে যেন নিজেদের গৌরব বাধার সম্মুখীন না হয়। এটা বুঝতে না পারার মানেই হল নতজানু হওয়া।