প্রধানমন্ত্রী বাঘ কিনেছেন। পুষবেন, তাই।

গৃহপালিত বাঘ, খুব সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট। গায়ের পশমগুলো চিকচিক করছে। হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ। কোনরকম তর্জন গর্জন ছাড়াই ভয়ংকর মিষ্টি দেখায়, দারুণ আকর্ষনীয়। তর্জন গর্জন শুধু তখনই করবে, যখন প্রধানমন্ত্রীর সাহসের প্রয়োজন হবে। এখন থেকে সুদর্শন এই বাঘটি প্রধানমন্ত্রীকে সাহস দিবে।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সব কর্মকর্তা কর্মচারী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাঘ দেখছেন, প্রধানমন্ত্রীর বাঘ। তিনি সবাইকে ডেকেছেন তার ক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক মনযোগের সাথে দেখে তারপর গুণগান গাইবার জন্য। সবাই গুণগান গাইছে।

– আমার জীবনে দেখা সেরা বাঘ, অকল্পনীয় একটা বাঘ।

– আপা, কী বলবো, সবকিছুই অসাধারণ! কিন্তু চোখের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। বাঘের চোখে আপনার ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। সমৃদ্ধি ও সুখ শান্তিতে ভরপুর।

– আমি এত প্রগাঢ় ও বিদগ্ধ থাবার বাঘ এর আগে দেখিনি। যেমন থাবার আকার, তেমন তার আকৃতি। এই থাবার প্রভাব বিশাল ও বিস্তৃত হবে। আমি নিশ্চিত।

– এখনো একটা দাঁতও পড়েনি। একেবারে ভার্জিন বাঘ। বুঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষিপ্র হবে। প্রথম দেখায় আপনার বাঘের ভক্ত হয়ে গেলাম। আমি মুগ্ধ।

– সত্যি কথা বলতে কী, এর আগে এতো কাছ থেকে কখনো বাঘ দেখিনি। বাঘ পোষার সাহস আছে, এমন কোন মানুষকেও চিনতাম না। বাঘের কথা আর কী বলবো, আপনার কথা ভাবছি। আমি খুব ভাগ্যবান, আপনার কর্মচারী হতে পেরে।

– কোন খুঁত নাই। একদম নিখুঁত। এরকম নিখুঁত বাঘ সমাজে বিরল। কী বলবো, বুঝতে পারছি না। বিশ্বে সেরা একশ বাঘের তালিকা করলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাঘ নিশ্চিত এক নাম্বারে থাকবে। এটা হলফ করে বলতে পারি।

– আপা, সবাই বলে ফেলেছে। আমি আর কী বলবো। রহমত ভাই’র কথার সূত্র ধরে বলি, এই বাঘ যদি হয় এতো সাহসী, তাহলে সেই বাঘ যার পোষ মেনেছে, সে না জানি কতো সাহসী!

প্রধানমন্ত্রী সবার কথা শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। তার বাসভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা শুধু বাঘের সাহসের কথা বললো, বুদ্ধির কথা বললো না। একটা বিশেষ ধরনের বাঘ, অর্ডার দিয়ে বানানো। এটা তারা বুঝলোই না! বাঘটি শুধু সাহস ও ক্ষমতার প্রহরী নয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করবে। তিনি সবার উদ্দেশ্য বললেন, “পৃথিবীতে এই প্রথম কোন শাসক তার উপদেষ্টা হিসেবে একজন বাঘ নিয়োগ দিয়েছে।“ শুনে সবাই বললো – বাহ্, কী অসাধারণ! কী সুন্দর! সাবাশ আপা, সাবাশ।

প্রশংসা অনুষ্ঠান শেষে সবাই যার যার কাজে চলে গেলো। শুক্রবার, ঘরে নতুন গৃহপালিত পশু এসেছে। তাও আবার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। এই উছিলায় আজ সবাই একটু ভালোমন্দ খাবে। ওইদিকে কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী আসছেন বাঘের সাথে দুপুরের খাবার খাবেন বলে। তাই দ্রুত রান্না ঘরে গেলো পাচক হোসনেআরা ও রহমত ভাই। কিন্তু হোসনেআরার চেহারায় অনেক সন্দেহ। রান্নায় তার সহকারি রহমত ভাই’র উপরও খানিকটা ক্ষ্যাপা। রহমত ভাই জিজ্ঞাসা করেন – কী হইছে তোর? হোসনেআরা কয় – আপনি যে বাঘের এত প্রশংসা করে আসলেন, বিষয়টা আমার ভালো লাগে নাই। আপনি কি দেখেন নাই বাঘের চোখের চারপাশ কালো করার জন্য বাড়তি কাজল ব্যবহার করা হইছে। এটাতো একটা মেকআপ করা বাঘ। এত প্রশংসার কী আছে!

রহমত ভাই যতটুকু পেরেছেন হোসনেআরাকে সাবধান করে দিয়েছেন। এসব কথা আপার কানে গেলে চাকরি চলে যাবে। এই আরামের কাজ হারাম হয়ে যাবে। বাঘ নিয়ে কারো কোন অসন্তুষ্টি আপায় সহ্য করবেন না। সাফ বলে দিয়েছেন তিনি।

বাঘকে গোসল করাতে হবে। এই পদে গণভবনে কোন কর্মচারী ছিলো না। গতকাল দু’জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। হাশেম আর কাশেম নামে দুই সুঠামদেহী সহোদর যুবক বাঘকে গোসল করাতে নিয়ে গেলো। অসম্ভব খুশী দু’জন। জীবনে বহুবার গরু ছাগল গোসল করিয়েছে, কিন্তু বাঘকে গোসল করানোর সুযোগ পাবে ভাবেনি। একটা বাঘকে গোসল করানোর জন্য কত প্রসাধনী, কত সুগন্ধি, কত আয়োজন! হাশেম কাশেম দেখে আর অবাক হয়।

নাচতে নাচতে জল ঢেলে তোয়ালেতে প্রসাধনী মেখে বাঘের গায়ে ঘষা দিতেই “আল্লাহগো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো কাশেম। বাঘের গায়ের রং উঠে যাচ্ছে! হলুদ রং উঠে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। চিৎকার শুনে প্রধানমন্ত্রী চলে আসলেন।

– কী হয়েছে, এত জোরে চিৎকার করো কেন?

– আপা সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাঘের গায়ের রং উঠে গেছে। এটাতো সাদাকালো বাঘ!

– তাতে কী হয়েছে? সাদা আর কালো দু’টোই পবিত্র রং। ভালোই হয়েছে।

– কিন্তু আপা, আমার মনে হয় এটা নকল বাঘ। রং করে তেল মেখে পশমগুলো চিকচিকে করে আপনার কাছে বিক্রি করেছে।

– এই কে কোথায় আছিস? এই মূর্খটাকে কে নিয়োগ দিয়েছে? এর চাকরি নট করে দাও। সাহস কত আমার বাঘের গায়ের রং নিয়ে কথা বলে!

কাজের প্রথম দিনই চাকরি খোয়ালো কাশেম। কী দরকার ছিলো অযথা গায়ের রং নিয়ে এত কথা বলার। তাছাড়া গায়ের রং সাদা হলেই কী আর বেগুনী হলেই কী, বাঘটাতো প্রধানমন্ত্রীর। ভাইয়ের জন্য মনের ভেতর খুব দুঃখ অনুভব করলো হাশেম। একা একা পবিত্র বাঘটাকে গোসল করালো। গোসল শেষে দেখে বাঘের গায়ে কালো ডোরাকাটা দাগও নেই। পুরো বাঘ সাদা হয়ে গেছে। এটা দেখে হাশেম আর ভয়ে কিছু কয় না। প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঘের গোসল করানো দেখছিলেন। হাশেমকে জিজ্ঞাসা করলেন – কী হাশেম, কী বুঝলে?

হাশেম কয় – আপা, বাঘ এবার পুরোপুরি পবিত্র হয়ে গেছে। আর কোন কালো দাগ নাই। কী যে সুন্দর লাগতেছে!

প্রধানমন্ত্রী বললেন- বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার চাকরি পাকা।

২.
কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এসেছেন বাঘের সাথে পরিচিত হতে। পরিচয় পর্ব শেষে এখন দুপুরে সবাই একসাথে খাবেন। খাবার টেবিলে প্রধানমন্ত্রী, বাঘ ও মন্ত্রীবর্গ আছেন। সবাই খুব খুশি। এতজন মন্ত্রীর সামনে বাঘকে কিছুটা লাজুক লাজুক মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন এটা হচ্ছে বিনয়। খুব সাহসী, ক্ষমতাশালী ও বুদ্ধিমান হলেও বাঘটা বিনয়ী। অন্তত মনিবের অতিথিদের সামনে। মন্ত্রীরা সবাই বাঘ দেখে যারপরনাই খুশি। সব মন্ত্রীই স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় থেকে বাঘের জন্য কিছু বরাদ্ধ দিতে চান।

– আমার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাঘের খাবারের জন্য মোরগ, হাঁস ও ছাগল সাপ্লাই দিতে চাই।

– তার চাইতে বরং আপনি আর আমার কৃষি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একটি হাঁস, মুরগি ও ছাগলের খামার করি। আপনার পরিকল্পনার অংশ হতে চাই।

– রেলওয়ের প্রচুর খালি জমি পড়ে আছে। অসভ্য লোকজন বাড়িঘর বানিয়ে দখল করে রেখেছে। আপনাদের খামারের জন্য আমি রেলওয়ের কিছু জমি বরাদ্ধ দিতে চাই।

– এই খামার নির্মাণের জন্য যদি কোন নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে হয়, তাহলে আমি বন্দরের শুল্ক বিভাগকে বলে দিবো যেন কোন শুল্ক আদায় না করে। এটা নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সামান্য কন্ট্রিবিউশন।

– এক্ষেত্রে আপনাদের সবার জন্য ফিন্যান্স মিনিস্ট্রি একটা ডিসেন্সি এ্যালটমেন্ট দিবে। এ্যাজ সুন এ্যাজ পসিবল। আসলে পুরো ব্যাপারটা অ্যামাজিং। আই উড লাইক টু এনশিওর মাই এফোর্ট।

এতসব বরাদ্দের কথা শুনে বাঘ সত্যি সত্যি লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় চোখের পাতা নিচের দিকে নামিয়ে বসে আছে। একেবারে মুখ ফুটে বলেই ফেললো – আপনাদের এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা আমার জীবনকে ধন্য করেছে। এখানে এসে এমন অনেক কিছু পেয়েছি, যা এর আগে কখনো পাইনি। সব মিলিয়ে আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

বাঘের মুখে কথা শুনে সবাই অবাক। তাও আবার অসম্ভব সুরেলা, কানায় কানায় ভরাট দারুন মিষ্টি কণ্ঠ। কী যে ভালো একটা বাঘ কিনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মন্ত্রীরা মনে মনে ভাবছেন, এজন্যই তিনি প্রধানমন্ত্রী আর তারা শুধু মন্ত্রী। পার্থক্যটা যোগ্যতা, মেধা আর দক্ষতার। এমনও হতে পারতো মন্ত্রীদেরকে বাঘ কিনতে পাঠালে তারা বড় সাইজের একটা বিলাই নিয়ে আসতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বকা খেতেন। বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী তাই বাঘ কেনার কথা আগে কাউকে জানাননি। এমন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়ে সবাই মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানালেন।

৩.
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। ফর্সা আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকখানার বারান্দার ছোট্ট বাগানের ফুলগুলো চাঁদের আলোয় হাসছে। সবুজ পাতাগুলো চিকচিক করছে। বারান্দা আলোকিত করে বসে আছেন তিনি ও তার গৃহপালিত বাঘ। তাই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি আলো। নিরব কিন্তু মুখরিত আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন দু’জনে। নিরবতা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী বললেন-কেমন আছো প্রিয় বাঘ?

– আমাদের সামনে বরকতময় ভবিষ্যত। আপনি সমৃদ্ধ হবেন। আপনার জনগণ সুখী হবে।

– তোমার মত বুদ্ধিমান, স্মার্ট ও সাহসী বাঘের সমর্থন আমাকে খুব ক্ষমতাবান করবে। তাছাড়া বেশ সাহস পাচ্ছি।

-আপনার যত সাহস লাগে নেন। আমার কাছে অফুরন্ত সাহস আছে।

– ক্ষমতার কথা কিছু বলো। আমার আসলে ওটাই দরকার।

– শোনেন, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে ঘোরে, বাংলাদেশের ক্ষমতাও এখন আপনার চারপাশে ঘুরবে। আপনি-ক্ষমতা, ক্ষমতা-আপনি, এভাবে একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবেন। আমি যখন আপনার পাশে আছি, তখন আর কোন ভাবনা নেই। আপনিই ক্ষমতার প্রাণ।

– তা জানি প্রিয়। আমি আর আমার প্রিয় বাঘ একসাথে থাকলে সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসবে।

– ঠিক তাই। আমি বলি কী, আপনি একটা সিংহাসন বানান। স্বর্ণের কাঠামোর উপর হীরক খচিত। বাঘ, সিংহ, সূর্যসহ বিভিন্ন শক্তি ও ক্ষমতার আকৃতি আঁকা থাকবে সিংহাসনের গায়ে। সেই সিংহাসনে আপনি বসবেন। আমি বসবো নিচে আপনার পায়ের কাছে। বসে সবার দিকে চোখ রাঙিয়ে করে তাকাবো, আপনি সিংহাসনে বসে মন্ত্রীদেরকে দিক নির্দেশনা দিবেন। দেখবেন কাজ কর্মের গতি পাল্টে যাবে। সবাই খুব কর্মমূখর হয়ে উঠবে। একটা চঞ্চলতা দেখা দিবে। আপনি বলবেন এটা হয়ে যাক, মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যাবে। জাস্ট বলার দেরি আর হওয়ার দেরি। কারণ আপনার পায়ের কাছে বসে থাকবে দুর্নিবার দুর্ধর্ষ, ভয়ংকর ক্ষিপ্র, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন পৃথিবীর সবচে সাহসী বাঘ।

– আহা! সিংহাসনের ডিজাইনটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। দারুণ হবে।

– অনেক রাত হয়েছে। আমি ঘুমোতে যাবো। প্রতিদিন রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আমার। আপনিও ঘুমোতে যান।

ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাঘ দেখে একটি রুমের দরজা খোলা। সেই রুমে থাকে পিয়নদের কো-অর্ডিনেটর হারুন। কানে কম শোনে, তাই রাতে দরজা খোলা রাখে। যেন কোন প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী ডাকলেই সাড়া দিতে পারে। হারুনের রুমের সামনে চারটি ফুল গাছের টব। একটি গাছে অনেক ফুল ধরেছে। সাদা গোলাপ। বাঘটি সোজা গিয়ে সেই টবে ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করে দিলো। প্রস্রাবের বিশ্রি শব্দে কানে কম শোনা হারুনের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখে এই তামাশা। রাগে তার পুরো শরীর গরগর করে কাঁপছে। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলো। প্রস্রাব শেষ করে বাঘ চলে যাওয়ার পর হারুন গেলো সিনিয়র কর্মচারী শমসের আলীর রুমে। গিয়ে ঘটনাটি বললো। এরকম বিচ্ছিরি ঘটনা শুনে শমসের খুব হতাশ হলেন। প্রধানমন্ত্রী কেন এমন বাঘ কিনলেন, যে বাঘ গাছ দেখলেই কুকুরের মত ছ্যার ছ্যার করে মুতে দেয়! একজন সিনিয়র কর্মচারী হিসেবে এটা কিভাবে মেনে নিবেন, তাই ভাবছেন।

শমসেরের রুমে তার সাথে ভাতিজা সম্পর্কের এক পিয়ন থাকে। নাম জহির। ঘুমের ভান করে সবকিছু শুনেছে। তার সাথে হারুনের সম্পর্ক ভালো না। হারুন অনেক বকাবকি করে জহিরকে। তাই হারুনের উপর রাগ আছে তার। পরদিন সকালে জহির সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, “হারুন ভাই’র ফুল গাছে আপার পবিত্র বাঘ প্রস্রাব করেছে। আর এটা উনি সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছেন। হারুন ভাই কি কাজটা ঠিক করলেন?” ব্যস, দুই কান চার কান করে এটা প্রধানমন্ত্রীর কানেও গেলো। তিনিতো মহা ক্ষ্যাপা। কীসব বাজে ব্যাপার। এরা বাঘের নামে কানাঘুষা করে! এটা চলতে দেয়া যাবে না। হারুন, জহিরসহ দশ জনকে ছাঁটাই করে দিলেন। সিনিয়র হিসেবে শমসের আলীকে সতর্ক করলেন। বাগানের মালিকে ডেকে বললেন বাঘের ঘরে এটাচ বাথরুমে অনেকগুলো ফুল গাছের টব দিয়ে দিতে। তার প্রিয় বাঘ যেন প্রকৃতির কাছে গিয়েই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারে।

একসাথে দশ জনের চাকরি চলে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক দেখে বাকিদের নিয়ে মিটিং করলেন শমসের আলী। সবাইকে খুব ভালোভাবে বুঝালেন বাঘের বিষয়ে মুখে তালা লাগাতে। এই জিনিস নিয়ে কোন কথা বলা যাবে না। বাঘ যা খুশি তা বলে বেড়াবে, করে বেড়াবে। সবাই বাঘের কৃতকর্মে সমর্থন জানাবে। কেউ যেন কোন আপত্তি না করে। আপত্তি করলেই চাকরি চলে যাবে। চাকরি বাঁচাতে চাইলে মুখ বন্ধ। সবাই শমসের আলীর পরামর্শ মেনে চলার বিষয়ে সম্মতি দিলো।

কর্মচারীদের মিটিংয়ের কথা জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী খুব খুশি। তার পোষা বাঘ নিয়ে কথা যত কম হবে, ততই ভালো। তিনি চান না তার পছন্দের কিছু নিয়ে খুব বেশি ওজর আপত্তি চলুক। এটা খুবই বিরক্তিকর। তাই এরকম একটা মিটিংয়ের আয়োজন করার জন্য শমসেরকে ধন্যবাদ ও কিছু বকসিশ দিলেন।

৪.
প্রধানমন্ত্রীর জন্য সিংহাসন বানানো হয়েছে। ঠিক যেমনটি চেয়েছেন, তেমন। ক’দিন হলো সিংহাসনে বসে দাপ্তরিক কাজকর্ম করার প্র্যাকটিস করছেন। বাঘ তখন তার পায়ের কাছে বসে থাকে। চোখ রাঙানোর রিহার্সাল দেয়।

বাঘের বলে বলীয়ান প্রধানমন্ত্রীর সাহস বেড়েছে কয়েকগুন। চারদিকে সংস্কার চালাচ্ছেন নিজের ইচ্ছেমত। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে কথা বলেন। অনেক দেশের তুলনায় তার দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সব ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে তিনি অন্য সবার চেয়ে দ্রুত দৌড়াচ্ছেন।

দেশে এখন প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীপক্ষ বলে কিছু নেই। সব শালা কুপোকাত। তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনরকম আন্দোলন সংগ্রাম নাই। সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। যাদের সুখ নাই, শান্তি নাই, তারা চুপ থাকে। কথা কয় না। চোখ তুলে তাকায় না। গোঁ গোঁ করে না।

এই সুযোগে দেশের সব সুখী মানুষ মিলে প্রধানমন্ত্রীর বিশাল এক ভাবমূর্তি নির্মাণ করছে। এই মূর্তি মহাকায়, বিশাল। তার নিচে সবাই তুচ্ছ, ছোট্ট, পতঙ্গসম। দেশের ইতিহাসে তিনি হয়ে উঠলেন এক মহাপরাক্রমশালী অধ্যায়। নিজের ক্ষমতার বাহার দেখে নিজেই হাততালি দেন। হাসেন।

৫.
কিন্তু অবস্থা আসলে খুব একটা ভালো না। যেই বাঘের বলে প্রধানমন্ত্রী আজ ব্যাখ্যাতীত বলীয়ান, সেই বাঘ অসহ্যকর একটা বাঘ। এটাকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কর্মকচারীরা। করবে কিভাবে? সে কাউকে গান শুনতে দেয় না, বই পড়তে দেয় না, কবিতা আবৃত্তি করতে দেয় না। এমনকি রাতের বেলা জানালা খুলে একটু আকাশের তারা গুনতেও দেয় না। সবকিছুতে তার আপত্তি। বাঘের অত্যাচার সইতে না পেরে কয়েকজন কর্মচারি চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে চাকরি হারিয়েছে। সর্বশেষ পুরো বাসভবনে শুধু শমসের আলী ও পাচক হোসনেআরা ছিলেন। আজ সকাল থেকে হোসনেআরাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বললেন, জাহান্নামে যাক সবাই। একটা পোষা বাঘ যারা সইতে পারে না, তাদের কারোরই এখানে থাকার দরকার নাই। আমি নিজেই রান্না করতে পারি। নিজের ভাত নিজে রেঁধে খাবো। কোন রাধুনি লাগবে না।

এই অবস্থায় শমসের আলী খুব একা হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়িতে দুইজন মানুষ ও একটি পশু। অথচ কিছুদিন আগেও এখানে দুই ডজন কাজের মানুষ ছিলো। তাদের পায়ের শব্দে সারা বাড়ি কাঁপতো। কত মানুষ, কত কাজ, কত কথা। আজ মানুষ নাই, কথা নাই, কাজও নাই। একটি বাঘ একা একা সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কী অশ্লীল, কী নোংরা তার চলাফেরা!

শমসের আলী প্রথম বাঘ দেখেছিলেন ছোটবেলায় ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানায়। তারপর যৌবনে এসে সুন্দরবন গিয়ে বাঘ দেখেছেন। চিড়িয়াখানার ওই রোগা বাঘটিও অনেক স্মার্ট। আর সুন্দরবনের বাঘেরতো কোন তুলনা নেই। দেখলেই বুকটা সাহসে ভরে যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ কেমন বাঘ কিনে আনলেন। গায়ের রঙ উঠে যায়, গাছের গোড়ায় প্রস্রাব করে, পঁচা-বাসি মাংস খায়। অলক্ষ্মী অপয়া বাঘটি আসার পর থেকে এই বাড়িতে যেন অন্ধকার নেমেছে। কোন আলো নেই। সব আলো এই ভয়ংকর বাঘ একা গিলে খেয়েছে। এসব আর ভালো লাগছে না শমসের আলীর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তার অনেক মায়া। অনেক শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শমসেরের অনেক ভয়। নিজের সন্তানের প্রতিও এত খেয়াল রাখেন না, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যত খেয়াল রাখেন।

মন ভরা বিষন্নতা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে শুয়ে আছেন। ঘুম আসছে না। খাঁ খাঁ বাড়িতে রাতের বেলা খুব ভয় লাগে। তাই আলো জ্বালিয়ে রাখেন শমসের আলী। হঠাৎ খেয়াল করলেন প্রধানমন্ত্রীর পোষা বাঘ তার ঘরে। বিছানার পাশে বসে আছে। কখন এসেছে, টেরই পাননি। ভীষন চমকালেন। কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। বাঘটি উঠে দাঁড়ায়।
– তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি যা বলি শুনে যাও। বুঝতেইতো পারছো এই বাড়িতে আর থাকতে পারবে না। সবাই চলে গেছে, তুমিও যাবে। এই বাড়ি সাহসীদের, ক্ষমতাবানদের। তুমি শমসেরের কোন সাহস নাই, ক্ষমতা নাই। মাথায় দুই এক ফোটা বুদ্ধিও নাই। তাহলে এখানে তুমি কিভাবে থাকবে? একদিন না একদিনতো যেতেই হবে। তারচে ভালো আজ রাত পোহানোর সময় চলে যাও। নিজে থেকে না গেলে অপমানিত হয়ে যেতে হবে। এটা কি ভালো হবে? তাছাড়া আমার স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো না। কোন সময় দুই চার ঘা বসিয়ে দিই, তার ঠিক নেই। এই বুড়ো বয়সে বাঘের ঘা সইতে পারবে না। একদম মরে যাবে।

৬.
রাত পোহানোর আর বেশি দেরি নেই। শমসের আলীর চোখে জল। এভাবে এই বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হবে ভাবেননি। এমনিতেও আর বেশিদিন চাকরি করতে পারতেন না। বড়জোর এক বছর। কিন্তু সেই বিদায় এমন হতো না। এখন এই বাড়িতে শমসের আলীকে বিদায় দেয়ার জন্য একজন মানুষও নেই। প্রধানমন্ত্রী ঘুমে। তার পোষা বাঘ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে শমসের আলী বেরিয়ে যাচ্ছে কিনা। বিদায় বেলায় এমন একটা বিশ্রি বাঘ সাক্ষি হিসেবে দাঁড়িয়ে রইলো, মেনে নিতে পারছেন না তিনি। জীবনে এমন কোন পাপ করেননি, যে পাপের ফল এত নির্মম হতে পারে।

সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সবচে প্রবীণ এবং সর্বশেষ কর্মচারী শমসের আলী বিদায় নিলেন। এখন পুরো বাড়িতে মহাপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী ও তার পোষা বাঘ ছাড়া আর কেউ নেই।

প্রধানমন্ত্রী ঘুম থেকে উঠে শমসেরকে না পেয়ে কিছুটা নাখোশ হলেন। মনে মনে বললেন, শমসের তুমিও! তুমিও থাকতে পারলে না!! একটা বাঘ সইতে পারলে না, শমসের!!! শমসেরকে না পেয়ে বাঘের ঘরে গিয়ে দেখলেন বাঘও নেই। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখেন সিংহাসনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে তার গৃহপালিত পোষা বাঘ। দেখে প্রথম ধাক্কায় ব্যাপারটা হজম করতে পারেননি। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে হাসতে হাসতে বলার চেষ্টা করলেন, – বাহ্, তোমাকে খুব মানিয়েছে।

– তাই নাকি! ভালোতো। তো আসো, তুমি আমার জায়গায় বসো। দেখি তোমাকে কেমন মানায়।

“তুমি আমার জায়গায় বসো।“ মানে প্রধানমন্ত্রীকে বাঘের পায়ের কাছে বসতে বলছে! পোষা বাঘের মুখে এমন কথা শুনে এক অচেনা শংকার বিষে নীল হয়ে গেলেন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা মহাকায় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না তার প্রিয় বাঘ সত্যি সত্যি এমন করছে কিনা, নাকি স্বপ্ন দেখছেন। বুঝতে পারছেন না এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। এই বিশাল বাড়িতে আর কেউ নেই। খুব একা লাগছে তার। বাঘের আচরণ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এমনতো হওয়ার কথা ছিলো না।

– এমনই হওয়ার কথা ছিলো। আমি তোমার পায়ের কাছে বসে বসে সাহস দেয়ার চাইতে নিজের সাহসে সিংহাসনে বসা বেটার না? তাছাড়া দেশটাতো আসলে আমরাই চালাই। এই দেশে আমার স্বজাতির শাসন কায়েম হবে, এই স্বপ্নতো আজ কালের নয়।

এই কথা বলে সিংহাসনে বসে খুব ভয়ংকরভাবে হাসছে প্রধানমন্ত্রীর বাঘ। বিদঘুটে গলার স্বর, অচেনা অঙ্গভঙ্গি। এটা বাঘের সাথে যায় না। বাঘের অঙ্গভঙ্গি এমন হয় না। সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে।

– ভালো, ভালো। গোলমেলে ঠেকা ভালো। মাত্রতো শুরু হলো। আরো কতকিছু যে গোলমেলে ঠেকবে! বোকা প্রধানমন্ত্রী!

আবার সেই ভয়ংকর বিদঘুটে হাসি। এবার বিস্ময়ের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো যখন দেখলেন সিংহাসন থেকে উঠে তেড়েফুড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাঘ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা নিশ্চিত আক্রমণের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা। এবার চূড়ান্ত ভয় পেলেন তিনি। কৌশলে পিছু হটে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে যা দেখলেন, তা দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত ছিলেন না। এমদমই না। তার পোষা বাঘ আসলে বাঘ নয়। অন্য কিছু। ছদ্মবেশ ধারণ করে ছিলো। শরীর থেকে এক এক করে ছদ্মবেশ খুলছে আর ভয়ংকরভাবে হাত পা ছুঁড়ে নাচছে। ভয়ে, আতংকে প্রধানমন্ত্রী কাঁপছেন। রাগে ক্ষোভে ফুঁসছেন। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছেন। বাঘের মুখোশ পরা আস্ত একটা হায়েনা কিনে এনেছেন পোষার জন্য। ছদ্মবেশ খুলে হায়েনা এখন পুরো বাসভবনে তান্ডব চালাচ্ছে। সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। উপায় না দেখে ফোন দিলেন তার সেনাপ্রধানের কাছে।

– খুব বিপদে আছি। আমাকে উদ্ধার করুন। আমার অনেক দামে কেনা হায়েনা সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাকে থামান।

– কী বলছেন এসব! হায়েনা পেলেন কোথায়? আমরাতো শুনেছি আপনি খুব সুন্দর, বিচক্ষণ, সাহসী বাঘ কিনেছেন পুষবেন বলে।

– ওটা বাঘ নয়। ওরা বাঘের মুখোশ পরিয়ে আমাকে একটা ভয়ংকর ধুরন্ধর হায়েনা ধরিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি।

ফোন রেখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে একা একা হায়েনার তান্ডব দেখছেন, আর সৈন্যবাহিনীর অপেক্ষা করছেন বিপদগ্রস্থ প্রধানমন্ত্রী। সবমিলিয়ে হয়তো তিনি একা নন, কিন্তু সবাইকে আগেই তাড়িয়ে দিয়েছেন।