লেখক: দীপঙ্কর কুন্ডু

মাকে খুব ভালবাসতেন তিনি।
মৃত মায়ের স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে মায়ের একটি ছবি তোলাতে গ্রামের মসজিদের ইমাম ফতোয়া দিয়ে বলেছিল-
মৃত মানুষের ছবি তোলা হারাম।তাই তার মায়ের জানাজা আর হয় নি।

অত্যন্ত মনকষ্ট পেয়েছিলেন তিনি।

550855_208079115990061_566505497_n

1455914_794064377347473_4302502159822633878_n(1)

1972338_794049464015631_4315225442889819119_n(1)

10394605_794071170680127_6148403894574497591_n

10440276_794065877347323_9165580640175324236_n(1)

10923294_794048067349104_7773207764433510786_n(1)

12348042_10206859642587466_2426176238727217506_n
শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তিনি মায়ের সৎকার করেন। এই ঘটনা তার ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কার বিরোধিতার এবং সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছিল।
গ্রামের কৃষক ছিলেন তিনি। পড়ালেখা বলতে নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে ‘আদর্শলিপি’ পড়তেন। এছাড়া তিনি মক্তবে কোরআন এবং ইসলামিক ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা গ্রহন করেন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।তারপর আর পড়ালেখা হয় নি।
কিন্তু তাতে কি?
অদম্য আরজ আলী বরিশালের চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রাম থেকে প্রতিদিন ১০-১১ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে বরিশালের লঞ্চঘাট এবং ব্রজমোহন কলেজের লাইব্রেরীতে এসে বই পড়তেন।
তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
৮৫ বছরের জীবনে ৭০ বছরই লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করেন একজন বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে।
তিনি অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন।
225933_208076155990357_627599349_n
তার রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দার্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। মানবকল্যাণ ও বিশ্বধর্ম আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান, পাঠাগার স্থাপন ও রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়াও তিনি নিজ দেহ ও চক্ষু মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন।

তার লিখিত বইয়ের মধ্যে ‘সত্যের সন্ধান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’, ‘সীজের ফুল’, ‘শয়তানের জবানবন্দী’ অন্যতম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)।
তিনি নিজেই তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে। বইটি তাঁকে এলাকায় ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেনঃ “আমি অনেক কিছুই ভাবছি, আমার মন প্রশ্নে ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি তখন প্রশ্নের সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীতে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের মতন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গন্ডি হতে বের হতে থাকি।”
10993423_794060747347836_7625382486739382828_n(1)

তার উত্থাপিত সত্য সন্ধানী প্রশ্নসমূহের কারনে তার নামে মামলা করা হয় এবং পুলিশ হাজতে নেয়া হয়। মামলার জবাবদিহিতার উদ্দেশ্যে তিনি তার প্রশ্নসমূহের কিছু ব্যাখ্যা রচনা করেন এবং পরবর্তীতে মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হন। এই ব্যাখ্যাসমূহই হল তার ‘সত্যের সন্ধান’ গ্রন্থের উৎস।
শত নিপীড়ন তার জ্ঞান সাধনার পথকে রুদ্ধ করতে পারে নি কখনও।
আমাদের সকলের আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন দর্শন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্যপদ (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৭৮) ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর (বরিশাল শাখা) সম্মাননা (১৯৮২) লাভ করেন।
10991216_794063124014265_2927621265149275084_n(1)
তিনি ১৯০০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর (বাংলা ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৩রা পৌষ) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে বরিশাল জেলার অন্তর্গত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। তার মা অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। পরিবারে তারা ছিলেন পাঁচ ভাইবোন।
তিনি ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্ঞানের বাতিঘর স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।