৩.
আফজাল শরীফ তবুও আশা ছাড়েন না। তাঁর শুধু মনে হয় মধ্যযুগের ভয়াবহ অন্ধকার থেকেও তো বিজ্ঞান বেরিয়ে এসেছে, আলোর রেখা ছুঁড়ে দিয়েছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। তাই তিনি খবিরের ছেলে তালেব ও তাঁর সাথে আসা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঢাকার বাস ধরেন। কয়েকজনকে গাঁয়ে রেখে যান এই ভেবে যে বলা তো যায় না কোথা থেকে কোন আক্রমণ আসে! এমনকি খবিরের বাড়ি পুড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্রও নাকচ করে দেয়া যায় না। তাছাড়া গ্রামের পরবর্তী পরিস্থিতিও ওরা ফোনে জানাতে পারবে। অন্যদিকে ওদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়, যতোটুকু সম্ভব গাঁয়ের দু’একজন কৃষককে বুঝিয়ে খবিরের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলার চেষ্টা চালাতে। ওরা যদি একবার বুঝতে পারে যে খবির যা বলছে তার এক বিন্দুও মিথ্যা নয়, কিম্বা এটাই আসল সত্য তাহলে হয়তো ঝড়ের মতো ছুটে আসা ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়াও যেতে পারে।
ওদিকে ঢাকায় ফোন করে অন্যান্য বন্ধুদের বলে দেন ফেসবুকের মাধ্যমে যতোটা পারা যায় সমমনা শিক্ষিত ভাইবোনদের সন্ধ্যা ছয়টার আগেই শাহবাগে একত্রিত করে খবিরের সমর্থনে মৌলবাদবিরোধী একটা সভা শুরু করে দিতে। আফজাল বুঝতে পেরেছেন এখন তরুণরাই একমাত্র ভরসা।
বিচারকার্য কাভার কারার জন্যে যে সব সাংবাদিকরা এসেছিলেন তাদের থেকে কয়েকটা ছবি নিয়েও নেটে ছেড়ে দেয়া হয়।

আফজালের ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে যায়। সবকিছু দেখে তিনি অভিভূত হয়ে যান। বিশাল গণ-জমায়েতের পশ্চিম পার্শ্বে টানানো ব্যানার, যার একদিক বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা ও অন্যদিকে খোঁয়াড়ে আটকানো খবিরের দু’টি ছবি বসিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা হয়েছে, “এই মধ্যযুগের বর্বরতা থেকে গ্রামের কৃষক খবিরকে বাঁচান।”
সমাবেশ বেশ বড়োসড়ো হয়ে উঠেছে। তরুণদের কারো মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা, কারো হাতে শহীদ মিনারের ব্যান্ড লাগানো, কারো কারো ক্যাপের সামনের দিকে স্মৃতিসৌধের ছবি সেঁটে দেয়া। ক্রমেই সমাবেশ বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে। রাস্তায় গাড়িগুলো আটকে পড়ে ভয়াবহ জ্যামের সৃষ্টি হয়। পুলিশের কর্তব্যরত অফিসাররা এই জ্যাম ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। প্রথমে টিএসসির দিক থেকে আসা রাস্তার অন্যমুখ দোয়েল চত্বর থেকে বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশ পাবলিক লাইব্রেরী ও যাদুঘরের সামনে রাখার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আগত তরুণদের এই জনসমুদ্রের কাছে হার মেনে চারদিকের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাইকে মুহুর্মুহু স্লোগান: “মৌলবাদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও; অন্ধকারের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও; আমার কৃষক আমার ভাই, খবির ভায়ের মুক্তি চাই; খবির ভাই খোঁয়াড়ে কেনো, সরকার তুই জবাব দিবি; এই বাংলা আমাদের, তেঁতুল হুজুর দূর হ; এই বাংলা আমাদের, রাজাকার দূর হ!”
শাহবাগের এই সমাবেশের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন ড. আলিমউদ্দিন ব্যাপারী। এতোক্ষণ খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে মাইকে চলছিলো স্লোগান। ব্যাপারী আফজালকে পেয়ে মাইক নিজের হাতে নেন। বলেন, “সম্মানিত ভাই ও বোনেরা, আপনারা যারা দেশকে আলোর পথে রাখার এই সংগ্রামে আমাদের তাৎক্ষণিক ডাকে ছুটে এসে এই চত্বরে সমবেত হয়েছেন, তাদের জন্যে আছে সুখবর। এই মুহূর্তে মণ্ডল গ্রাম থেকে, হ্যাঁ সেই মণ্ডল গ্রাম যেখানে খবির শিকদার নামে বিজ্ঞানমনস্ক এক কৃষকের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, যাকে খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে, সেই গ্রাম থেকে এই জঘন্য বিচারকার্য স্বচক্ষে দেখে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জনাব আফজাল শরীফ। আরো আনন্দের কথা, আফজাল শরিফের সাথে এসেছে তারই পনেরো বছরের সন্তান। আসুন আমরা প্রথমেই এই নিষ্পাপ সন্তানের কথা শুনি।”
মাইক দেয়া হয় তালেবের হাতে।
স্কুলের কৃতি ছাত্র হিসেবে, বা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার ফলে মানুষের সামনে তার কথা বলার অভ্যেস আছে। কিন্তু এতো বড়ো জমায়েত দেখে সে প্রথমে ভড়কে যায়। তারপর আস্তে আস্তে একটু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করে, “আমার নাম তালেব শিকদার। আমার বাবা খবির শিকদার, গ্রামের একজন সামান্য কৃষক। তিনি কৃষি কাজ করলেও আমাকে ছোটো বেলা থেকে নানা রকম বইপড়ায় উৎসাহ দিয়েছেন। নিজেও পড়েছেন। এইসব বই তিনি কখনো নিজে যোগাড় করেছেন, কখনো আফজাল চাচা ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার বাবা, আমার জানা মতে কখনো কারো ক্ষতি করেন নাই। মানুষের কিভাবে উপকার হবে সেই চেষ্টাই তিনি করে গেছেন। তিনি যতোটুকু পেরেছেন বিজ্ঞানসম্মত ভাবে চাষাবাদ করেছেন, এবং চারপাশের মানুষদেরকে কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার জন্যে আহ্বান করেছেন। চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, এ কথাতো আজ আধুনিক বিশ্বে সবার জানা। চাঁদ, তারা, পৃথিবী, সূর্য, এরা সবাই যার যার কক্ষে নিজের গতিতে ঘুরছে, এটাতো আজ শিশুরাও জানে। অথচ কৃষকদের মাঝে এই কথা বলার জন্যে আমার বাবাকে আজ খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। না খাইয়ে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁকে তিন দিন পর জুতার মালা গলায় দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে। আপনারা আমার বাবাকে বাঁচান। আমি আপনাদের কাছে আফজাল চাচাকে নিয়ে আমার বাবার প্রাণ ভিক্ষায় ছুটে এসেছি।”
এই পর্যায়ে তালেবের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে। একটু সামলে নিয়ে আবার বলে, “চোখের পানি অনেক ঝরিয়েছি। এখন আর কাঁদতে চাই না। আমরা মৌলবাদে আক্রান্ত হয়ে বাঁচবো না। আমরা মৌলবাদ থেকে মুক্তি চাই।”
পনের বছরের সন্তানের মুখে এমন বক্তৃতা শুনে সমাবেশের সমস্ত তরুণ-তরুণী, শিক্ষিত জনগণ অবাক হয়ে যায়। সবাই বুঝতে পারে, এ ছেলে সেই পিতার সন্তান যে শুধু কৃষিকাজই করেনি ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার জন্যে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছে। স্লোগান ওঠে, “পশুর খোঁয়াড় ভাঙবো, খবির ভাইকে আনবো। খবির তুমি ভেবো না, আমরা তোমার শত ভাই।”
আফজাল শরীফ তাঁর বক্তৃতায় সবাইকে এই অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে যেভাবে মৌলবাদ শিকড় গাড়ছে তার বিরুদ্ধে সচেতন থাকার জন্যে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “শুধু সচেতন থাকলেই হবে না। বিজ্ঞান এখন অন্ধকারের হাতে আক্রান্ত। শক্তি এখন মৌলবাদের কাছে পর্যুদস্ত। বাক স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত। আমরা কিছুতেই বসে থাকতে পারি না। আমাদের চারপাশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এর প্রতিবাদ করতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে অপশক্তির বিরুদ্ধে।” তিনি আরো বলেন, “আজ আমি যা নিজের চোখে দেখে এলাম, এখনকার সমাজে, একবিংশ শতাব্দীতে এমন বর্বরতা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অথচ এই খবিরকে সমাজ লেখাপড়া করার সুযোগ দেয়নি। কৃষিকাজ করার পাশাপাশি সে নিজের চেষ্টায় বিজ্ঞান পড়েছে, পড়েছে আমাদের ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্ভার, সংগ্রহ করেছে সেই সব বই যা পড়লে মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে। খবিরের উপর আঘাত মানে আমাদের সবার উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে সভ্যতার উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে আমার দেশের মেহনতি মানুষের উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে আমাদের মানসিক উন্নতির উপরে আঘাত, খবিরের উপর আঘাত মানে এ দেশের প্রতিটি মানুষের উপরে আঘাত। আর এই খবিরকে খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখার অর্থ হলো দেশকে পশুর খোঁয়াড়ে বন্দী করে ফেলা। আমি সরকারের কাছে দাবী করছি, এই মুহূর্তে খবিরকে মুক্ত করে, দোষীদের ঘোরতর শাস্তি দেয়া হোক। বিজ্ঞানকে ভূলুণ্ঠিত করে, খবিরকে ভূলুণ্ঠিত করে, দেশের মেহনতি মানুষকে ভূলুণ্ঠিত করে, সভ্যতাকে ভূলুণ্ঠিত করে, তরুণদের ভূলুণ্ঠিত করে, প্রগতিকে ভূলুণ্ঠিত করে এই দেশে কোনো সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবে না। আজ দিকে দিকে একই স্লোগান, একই দাবী; মৌলবাদকে রুখতে হবে, খবিরকে বাঁচাতে হবে।”
আফজালের বক্তৃতা শেষে জ্বালাময়ী স্লোগান ধরে খবিরের পনের বছরের ছেলের মতোই এক দুর্দান্ত সাহসী, অগ্নিকণ্ঠি লাকি তালুকদার। লাকির স্লোগানে সবাই ইতিমধ্যেই উদ্দীপ্ত হয়ে তাকে অগ্নিকন্যা বলে ডাকা শুরু করেছে। খবিরকে বাঁচানোর ডাক ইন্টারনেটে পেয়ে এই মেয়েও অন্যান্যদের মতো ছুটে এসে এই সংগ্রামকে বেগবান করতে সবার সাথে গলা মিলিয়েছে। লাকি স্লোগান দেয়, “ম-তে মৌলবাদ, থাকবে না থাকবে না; অ-তে অন্ধকার, ঘুচবেই ঘুচবেই; খ-তে খবির ভাই; ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না; দ-তে দালালগুলো, খতম করো খতম করো।”
এইভাবে স্লোগান দিতে দিতে লাকির সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। মাথা থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে।
কবি আলফা শেখ নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের প্যারোডি করে নিয়ে এসেছেন। সমস্বরে গাওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছে। ঢোলক, ডুগডুগি, বাঁশি বাজিয়ে গানটি গীত হয়:

খোয়াড়ের বাঁশের কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
মৌলবাদের সকল বাঁধের পাষাণ বেদী;
ওরে ও তরুণ সমাজ
সমুখে জমেছে কাজ
খবিরের জন্যে এবার হবি জেদি।।

নাচে ওই মোল্লাগুলো
এ দেখি তাদের ধুলো
আঁধারে ঢেকে দিলো
আমার দেশের স্বাধীন মাটি,
লাথি মার ভাঙরে সবই,
সকলের এই তো দাবী
আলোকে হাতে নিয়ে
এবার হবি পরম খাঁটি।।
এতোক্ষণ একই মঞ্চ থেকে স্লোগানের নেতৃত্ব দেয়া হলেও, সমাবেশ এতো বড়ো হয়ে উঠেছে যে কিছুটা দূরে দূরে জটলা পাকিয়ে তরুণরা নিজেদের মতো করে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। চারিদিক থেকে স্লোগান দিয়ে দিয়ে তরুণদের মিছিল এমন ভাবে আসছে যে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ওদের নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সময় বাড়ার সাথে সাথে এই আন্দোলন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। ওদিকে পাল্টা প্রস্তুতি হিসেবে জায়গায় জায়গায় টুপি-দাড়িসহ তেঁতুল ও এবাদত পার্টির লোকেরাও জটলা পাকিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ওরা জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছে যে শাহবাগে যারা সমবেত হয়েছে তারা আল্লাহ-রাসুল বিরোধী, তারা মুনাফেক, তারা কাফের, তাদের বাংলাদেশের মাটিতে স্থান নেই। মৌলবাদীরা শাহবাগের জমায়েত ভেঙে দেবার নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ, রাত প্রায় নয়টার দিকে দেখা যায় কাঁটাবন মসজিদের কাছ থেকে টুপি-দাড়ির একটি দল, ও শিল্পকলা একাডেমির দিক থেকে আরেকটি দল লাঠিসোঁটা নিয়ে শাহবাগের এই বিশাল জনসমাবেশের দিকে ছুটে আসছে। ওদের ভেতর থেকে ধর ধর মার মার সোরগোলের সাথে ভেসে আসছে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। পরিস্থিতি যেনো নিমেষে পাল্টে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখা যায় বেশ কিছু পুলিশও ওদের সাথে যোগ দিয়েছে, আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রও। ওদিকে শাহবাগের জমায়েতও হটে যাবার নয়, ওরাও পাল্টা আক্রমন চালায়; প্রায় দশ মিনিট দুই গ্র“পের তুমুল মারামারি চলে, বেশ কয়েকটি গুলির শব্দও শোনা যায়। ইতিমধ্যে মানুষ চারদিকে ছোটাছুটি করছে, প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে যে যে দিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। ওদের মাঝ থেকে কয়েকজনের গুলি লেগেছে। লুটিয়ে পড়েছে অগ্নিকন্যা লাকি। আরো লাশ পড়ে আছে এখানে সেখানে।
কিছুক্ষণ গুলি চলানোর পর পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে হয়ে ওঠে। তরুণদের বা টুপি দাড়ির কাউকেই আর দেখা যায় না। শুধু চ্যাং দোলা করে লাশগুলো পুলিশের ভ্যানে তোলার জন্যে আদেশ প্রাপ্ত কনস্টেবলরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আফজাল শরীফ, ড. আলিমউদ্দিন ব্যাপারী, কবি আলফা শেখসহ নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েকজন অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান। আহতদের যতোটুকু পারা যায় তড়িঘড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্যে কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়ে ওঁরা পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন আফজাল শরীফের বাসায়। গ্রাম থেকে প্রথম শহরে আসা খবিরের ছেলে তালেব তখনও ভয়ে কাঁপছিলো। অন্তত এই ধরনের পরিস্থিতির সামনে সে কখনো পড়েনি। এ ছিলো তার কাছে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু আফজাল ও আলিমউদ্দিন ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে ধাতস্থ করে তোলেন। আশ্বস্ত করেন যে তারা বেঁচে থাকতে ওর কোনো ক্ষতি হতে দেবেন না।
তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে তরুণরা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে সমাবেশ করে, এবং যতোদূর পারা যায় দেশের অন্তত বড়ো জেলা শহরগুলোতে এর ঢেউ ছড়িয়ে দিয়ে মৌলবাদ ঠেকাও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। ড. আলিমউদ্দিন ব্যাপারিকে সভাপতি ও কবি আলফা শেখকে সাধারণ সম্পাদক করে তাৎক্ষণিক একটি সংগ্রাম কমিটি করা হয়। নির্ধারণ করা হয় যে কমিটির প্রথম কাজ হবে খবির শিকদারের মুক্তি ও নিরাপত্তা প্রদান। রাতে পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের গায়েবানা জানাজা হবে শহীদ মিনারের সামনে। ক্ষতিপূরণ দাবী করা হবে সরকারের কাছে। শান্তিপূর্ণ এই সমাবেশে গুলি চালানোর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেসগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হলো।

৪.
ঠিক যে সময়ে শাহবাগে সমাবেশ চলছিলো সেই মুহূর্তেই জরুরি অধিবেশন বসেছিলো জাতীয় সংসদে এবং দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে সরকারি ও বিরোধী দল এই প্রথম বারের মতো কোনো একটি বিষয়ে একমত হয়েছিলো; দেশ ও জাতির স্বার্থে খবিরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রার্থনা করেছিলো উভয় দল।
মণ্ডল গ্রামের বিচারকার্য চ্যানেল চুরাশিতে সরাসরি সম্প্রচার ও অন্যান্য চ্যানেলে বিশেষ বুলেটিনসহ ইন্টারনেটে ফলাও করে প্রচারের ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হলে এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণের জন্যে স্পিকার জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকেন। অধিবেশন ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। সংসদ ও বিরোধীদলীয় নেতা দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন, এবং দু’জনেই দীর্ঘ বক্তৃতা রেখেছিলেন। প্রথমে অবশ্য সংসদ নেতা বক্তৃতা করেন। পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিরোধী নেতা সংসদ নেতার থেকে তিন মিনিট তেরো সেকেন্ড বেশী সময় কথা বলেন। সংসদ নেতা বলেন, “মাননীয় স্পিকার, প্রথমেই আপনাকে অন্যবাদ জানাচ্ছি দেশের এমন একটি ক্রান্তিকালে এই জরুরি অধিবেশ আহ্বান করার জন্যে। আপনি যে সুযোগ্য স্পিকার তার প্রমাণ আমরা আগেই পেয়েছি, দেশের জন্যে যে আপনি নিবেদিতপ্রাণ এবং আমার দল যে একজন অত্যন্ত মেধাবী স্পিকার নির্বাচন করতে পেরেছে সেজন্য দেশবাসীও আমার দলের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি সংসদ নেতা হিসেবে বিশেষ গর্ব বোধ করছি। মাননীয় স্পিকার, আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন দেশের নানাদিক দিয়ে সাপ ব্যাঙ কুচে কেঁচোর মতো লাফিয়ে বের হচ্ছে মৌলবাদ, অন্যদিকে একশ্রেণীর মানুষ বিজ্ঞানের নানাবিধ অপপ্রচার চালিয়ে ফায়দা লোটারও চেষ্টা করছে যারপরনেই সুনামির মতো ঝড়ের গতিতে। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। বিরোধী দল সব সময়েই উসকানি দিয়ে আসছে মৌলবাদকে, এখনও তারা ওদের সাথে আছে; আর এই মুহূর্তে মুখে বলছে এক কথা কিন্তু তলে তলে বিজ্ঞানের আজগুবি গুজব ছড়ানোর জন্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত যে মণ্ডল গ্রামের খবিরও ওদের এজেন্ট। খবিরকে দিয়ে ওরা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় যাতে সরকারকে উৎখাত করা সহজতর হয়। কিন্তু আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি, আমরা জাতির ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি, আমরা সামরিক বাহিনীর উপর ভর করে রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখল করিনি, আমার দল সর্বদা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে আসছে, এখনও করছে; অতএব এই সরকারকে অতো সহজে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। মাননীয় স্পিকার, আপনার মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা খবিরের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। আমাদের চাঁদ, আমাদের সূর্য আমাদেরই আছে, ছিলো এবং থাকবে। আমি যতোদিন ক্ষমতায় আছি চাঁদের আলো আর সূর্যের কিরণ থেকে দেশবাসীকে এতোটুকু বঞ্চিত হতে দেবো না। আর, যারা চক্রান্ত করে চাঁদ ও সূর্যের আলো কেড়ে নিতে চায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবো। এই দেশের মাটিতেই খবিরের যথোপযুক্ত শাস্তি হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই উন্নয়নের সরকার, দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখবে, কেউ চেষ্টা করেও আমাদেরকে এই বিপুল উন্নয়নের ধারা থেকে পিছিয়ে দিতে পারবে না। উন্নয়নই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র উদ্দেশ্য।”
সংসদ নেতার বক্তৃতা শেষ হলে, স্পিকার উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সেল্যুট দেন। তারপর নিজের আসনে বসে বলেন, “মাননীয় সংসদ নেতা, আপনি এই দেশের জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ। আপনার দয়া না হলে এই দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারতো না। আপনার প্রতিটি বক্তৃতায় আমি নতুন দিক নির্দেশনা পাই, দেশবাসী নতুন দিক নির্দেশনা পায়, আমাদের উন্নয়ন নতুন দিক নির্দেশনা পায়। আপনার এই বক্তৃতায় খবিরের উত্থানপর্বে কারা দায়ী তার সূত্র নির্ণয় ও শাস্তি বিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, এই মহান সংসদ আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।”
স্পিকারের স্তুতি বাক্য শেষ না হতেই মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে যান। তিনি বলেন, “মাননীয় স্পিকার, আপনার তারিফ না করে পারছিনা, আপনার মতো এমন তোষামোদি নেতা পৃথিবীতে খুব কমই পাওয়া যাবে। আপনি পুরোপুরি আপনার নেতার মতোই তোষামোদি, আপনার নেতার মতোই আলুপোটলের ব্যবসায় পারদর্শী। সে যাই হোক, মাননীয় স্পিকার, আপনার সংসদ নেতা এতোক্ষণ যেসব কথা বলে গেলেন, যেসব দোষারোপ তিনি আমার দলকে করলেন, তার কোনোটাই সত্য নয়, এমনকি সত্যের সাড়ে পঞ্চাশ মাইল দূর দিয়েও হাঁটার ক্ষমতা নেই ওইসব ব্যক্তিগত বাহাসের। তিনি মনে করেছেন দেশের মানুষ বোকা, ওরা গাধার মতো ঝোলানো মুলোর দিকে দৌড়ায়। না মাননীয় স্পিকার, সেই দিন শেষ হয়ে গেছে, গাধার মতো মানুষ এখন আনাদের পিছনে দৌড়ায় না। আপনারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, আর সুযোগ পেলেই ভোট কেটে নির্বাচিত হন। আপনারা দেশে শান্তির কথা বলেন, আর কিভাবে অশান্তি হবে সেই ব্যবস্থা পাকা করে যান, সেই ব্যবস্থা দিনে দিনে পাকা করতে থাকেন। মাননীয় স্পিকার, আমার কাছে তথ্য প্রমাণ আছে যে এই খবির আপনাদের সৃষ্টি। দেশের সমস্ত অরাজকতা ধামাচাপা দেবার জন্যে, আপনাদের মন্ত্রীদের কাঁড়ি কাঁড়ি আত্মসাত করা টাকা হালাল করার জন্যে, আপনাদের কালো বিড়াল সাদা করার জন্যে, আপনাদের ট্রাইবুনাল জায়েজ করার জন্যে, আপনাদের হাজার রকম হাজার রকম হাজার রকম অপকর্মকে তুলসি পাতায় ঢাকার জন্যে, জনগণের চোখ অন্যদিকে সরানোর মহান ব্রত পালন করে আপনারা এই খবির শিকদারের নাটক সাজিয়েছেন। মনে করেছেন যে জনগণ আপনাদের অপকর্ম ভুলে যাবে, না ভুলবে না, আপনারা পালাবার পথ পাবেন না। জনগণ জেগে উঠেছে, দেশের আল্লাওয়ালা আলেম সমাজ জেগে উঠেছে, মাদ্রাসার তালেবানরা জেগে উঠেছে, আপনারা হুঁশিয়ার হয়ে যান, একজনও পালাবার পথ পাবেন না। মাননীয় স্পিকার, আপনার মাধ্যমে আমি এই সরকারকে জানাতে চাই যে খবিরকে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়া হয়, খবিরকে যদি চিরতরে খতম না করা হয়, খবিরের মতো বদমাশদের যদি সমাজে আবারো মাথা তুলে দাঁড়ানোর কায়দা করে দেয়া হয়, তাহলে জেনে রাখুন বাংলার মাটিও আপনাদের গ্রহণ করবে না। আজ গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে যাওয়া আলেম সমাজ, আমাদের তেঁতুল ভায়েরা সময়মতো পদক্ষেপ নিয়েছিলো বলেই খবিরদের আপাতত রোখা গেছে। কিন্তু জেনে রাখুন, এই খবিরের পিছনে যারা আছে, যারা আড়ালে কলকাঠি নাড়ছে তাদের সবাইকে ফাঁসি না দেয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। লোক দেখানো খোঁয়াড়ে আটকিয়ে কাজ হাসিল হবে বলে মনে করেছেন, তা হবে না, ওর ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আপনারা একজনও নিস্তার পাবেন না। আপনাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ঝাঁকাঝাঁকি তত্ত্ব আর কাজে লাগবে না। তাই বলছি, হুঁশিয়ার হয়ে যান, পারলে ভালো ভাবে দেশ চালান, না পারলে ছেড়ে দেন, দেখবেন আমরা কিভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। দেখবেন আমরা কিভাবে চাঁদের স্নিগ্ধতা আর সূর্যের পরাক্রম দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলি। অতএব চাঁদ-সূর্য নিয়ে ছিনিমিনি বন্ধ করুন। নতুবা ভালো হবে না।”
বিরোধী নেতার বক্তৃতার পরে ফ্লোর দেয়া হয় সরকারী দলের প্রবীণ নেতা, কৃষিমন্ত্রী হাজি মো: মোহম্মদ আলীকে। তিনি বলেন, “কৃষক আমাদের স্বপ্ন, কৃষক আমাদের আশা, কৃষক আমাদের আলো, কৃষক আমাদের ভালবাসা। আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল চাবি কৃষকের হাতে। কৃষক না থাকলে আমরা কেউ এই সংসদে বসতে পারতাম না, দেশের একটিও উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হতো না। আমাদের পেটে দানাপানি পড়তো না। আমরা না খেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মরতাম। আজকে আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, সেই কৃষকের উপর কলঙ্ক লেপন করা হচ্ছে। সেই কৃষককে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। একজন পাগলকে নিয়ে এতো মাতামাতি! কে এই পাগল, কে এই খবির, কৃষকের কি হয় সে? লক্ষ লক্ষ কৃষকের মাঝে ওর অস্তিত্ব কোথায়? শুধু ধানের চিটা ছড়িয়ে দিলে তলিয়ে যাবে সে। তার ওই দাম্ভিকতা আসে কি করে! তার সাথে আমাদের কোনে সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমাদের সম্পর্ক কৃষকের সাথে। খবির কৃষক নয়, পাগল। ওর স্থান পাগলা গারদে; ওর স্থান পাবনায়।”
কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হলে স্পিকার বলেন, “হাজি সাহেব একেবারে বাজি মাত করে দিলেন। আমাদের কৃষককে আর কে, কোন কালে এতোটা সম্মান করেছে? আপনাকে অভিনন্দন। কৃষকের জয় হোক। এখন, আমি আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রীকে কিছু বলতে অনুরোধ করছি।”
অনুরোধ করার পরও কেউ কিছু বলেন না বা কেউ উঠে দাঁড়ান না। স্পিকার দেখেন মন্ত্রী মহোদয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফলত, স্পিকার আবারও বলেন, “দুঃখিত, মন্ত্রী সাহেব ঘুমিয়ে পড়ায় তাঁর বক্তব্য বিলম্বিত হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয়, উঠুন উঠুন, আপনার বক্তৃতা দেবার সময় এসেছে।” মন্ত্রীর দুই পাশ থেকে দু’জন সাংসদ তাঁকে জোরে জোরে ডেকে তাঁর ঘুম ভাঙাতে সক্ষম হন। মন্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, “মাননীয় স্পিকার, বিজ্ঞন ও প্রযুক্তি এই দু’টি শব্দ একের সাথে অন্যে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যে ওদের আলাদা করার উপায় নেই, যেমন মানুষের সাথে ঘুম এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে এই দুটোকেও সেপারেট করা যায় না। আসলে সেপারেশান বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হইলো গিয়া মিলন। আর এই মিলনের জন্যে আমরা কি না করি, আমরা পাহাড় কাটি, নদীতে নৌকা চালাই, আকাশে বিমান উড়াই, ঘরে এসি লাগাই। তয়, আমরা চাঁদ ও সূর্য দেখবার খুব একটা সময় পাই না। তাই, ওদের নিয়ে কাড়াকাড়ি বেশী হয়। আমি আপনারে আশ্বাস দিতাছি, এমন একটা প্রযুক্তি বানাইবো যে চান-সূরুজ আলাদা করা যাইবো না। ওরা চিরদিন একসাথে থাকবো। দরকার হইলে কাজী ডাইকা উহাদের বিয়া পড়াইয়া দিমু, সব লেঠা চুইকা যাইবো।”
টেবিল চাপড়িয়ে সাংসদগণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীকে বাহবা দেন। তিনি বসলে, স্পিকার বলেন, “এতোক্ষণ এতো এতো সিরিয়াস কথার পরে মনে হয় একটু হাসির খোরাক পাওয়া গেলো। আসলে এই না হলে বিজ্ঞানমন্ত্রী! আ হা হা, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড সে কথা আমরা যেনো ভুলে না যাই। শিক্ষাগ্রহণ প্রত্যেকের জন্যে ফরজ। আমাদের নবীও শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে চীন পর্যন্ত যাবার কথা বলেছিলেন; তখন অবশ্য আমেরিকা আবিষ্কার হয় নাই, তাই আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন শিক্ষার জন্যে আমেরিকা যায়, ইয়োরোপ যায়। একজন কৃষক যে নিজের চেষ্টায় ঘরে বসে শিক্ষাগ্রহণ করেছে তার জন্যে আমরা গর্ব বোধ করতে পারি। কিন্তু তাকে কে বলেছে আরজ আলী মাতুব্বর আর হুমায়ুন আজাদের বই পড়তে! আমাদের এবাদত পার্টির ভায়েরা যাদের উপর নাখোস তাদের বই কেনো পড়তে হবে! এতোটুকু না বুঝলে কি চলে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জাতিসঙ্ঘের পুরস্কারপ্রাপ্ত, আপনি ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন, আপনি সর্বজ্ঞানী, আপনাকে অনুরোধ করি অতিসত্বর একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করুন, যে কমিটি তালিকা করে দেবে, আমাদের ছেলেপেলেরা, আমাদের কৃষকেরা, আমাদের মা-বোনেরা, ভ্রাতাভগ্নিরা কোন্ কোন্ লেখকের বই পড়বে। আরজ আলী মাতুব্বর, হুমায়ুন আজাদের দরকার নেই, আমাদের পড়–য়ারা নিয়মিত তরফ আলী হাটবাজারি, আর সগির আলী খয়রাতির বই পড়লেই তো চলে। এ ব্যাপারে জাতিকে দিক নির্দেশনা দেয়া আমাদের কর্তব্য, আমরা অবশ্যই তা করবো।”
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বিরোধী দলের নেতা অনেক বাহাস করলেন, দেশ চালানো কি এতো সোজা, দেখি নাই আপনারা কি করেছেন, আমরা কি ভুলে গেছি; এখান দিয়ে উসকে দেন, সেখান দিয়ে উসকে দেন, এখান দিয়ে জ্বালাও পোড়াও, সেখান দিয়ে জ্বালাও পোড়াও; কিন্তু জ্বলেও না পোড়েও না, আমরা সব নিভিয়ে দিয়েছি, আন্দোলনের নামে যা কিছু করছেন সব আমরা নিভিয়ে দিয়েছি, এখন খবিরকে দাঁড় করিয়েছেন, এমন ব্যবস্থা করবো, এমন কৌশল নেবো যে খবিরসহ আপনারা পালাবেন, ক্ষমতার প্রথম অক্ষরও আর দেখা লাগবে না।”
আকাশ মন্ত্রী বলেন, “চাঁদ কি, সূর্য কি, আকাশ কি, বাতাস কি, মানুষ কি, পড়া কি, বই কি, কিতাব কি, কথা কি, বার্তা কি, সত্যি কি, মিথ্যা কি, সেটা একজন কৃষক কি করে বুঝবে? কৃষক যদি বিজ্ঞানী হয়ে যায় তখনই ঘটে বিপর্যয়। আরে বাবা তুমি হইলা কৃষক, কৃষকই থাকো, তোমার বিজ্ঞানী হওনের দরকার কি! এই হইছে একখানা বিপদ, যে যা হইতে পারে না সে তাই হইতে চায়, বলেন তো দেখি। আরে মিয়া তুমি হইলা কৃষক, তুমি যদি বিমান চালাইবার যাও, তাইলে কি অইবো, তাইলে কি বিমান চলবো, না কি মানুষ মুখথুবড়ে পড়ে নাস্তানাবুদ হইবো! আর এই বিরোধী দল, এরা হইলো গিয়া একটা জঞ্জাল, যেখানে যা নয় সেইখানে তা টাইনা আনে, বলে কিনা আমরাই এই খবিরকে তৈরী করেছি। আরে মিয়া, খবির হইলো গিয়া তার বাপের পোলা যে বাপ আগেই মইরা গেছে; আমরা কি কইরা তারে তইয়ার করি? কইলেই অইলো?”
এতোক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন বিরোধী দলের সাংসদরা, তারা সংখ্যায় কম হলেও চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিলো যে তাদের বলবার আছে অনেক কিছু। ফ্লোর চেয়ে চেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে একজন নেতা এবার দাঁড়িয়ে গেলেন, “মাননীয় স্পিকার, আমাদের যদি বলতে না দেয়া হয় আমরা কিন্তু এখনই ওয়াক আউট করতে বাধ্য হবো।” অগত্যা স্পিকার ফ্লোর দিলেন বিরোধী দলের জনাব আদিল উদ্দীনকে। আদিল উদ্দীন বলতে শুরু করলেন, “উপস্থিত ভাই ও বোনেরা, আমাদের মহান নেতা ইতিমধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন, যে বক্তব্যে শুধু জাতির জন্যে দিক নির্দেশনা নয়, আছে ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গড়বার অঙ্গীকার। অথচ, সেই বক্তব্যের উপর কথা না বলে সরকারী দলের নেতারা হাসি তামাশা করে যাচ্ছেন, তারা ভেবেছেন যে সংসদ তামাশা করার জায়গা, এই সংসদ আমাদের গর্ব, আমাদের জাতীয় বিবেকের ঘর, এখানে তামাশা করা যাবে না। পুরো জাতি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কৃষক তাকিয়ে আছে, ব্যবসায়ী তাকিয়ে আছে, মণ্ডল গ্রাম তাকিয়ে আছে, এবাদত পার্টি তাকিয়ে আছে, তেঁতুল পার্টি তাকিয়ে আছে। আসুন, আসল কথা বলুন। খবিরের ফাঁসি হবে কি না তাই নিয়ে কথা বলুন। আমরা আর একটাও বাজে কথা শুনতে চাই না।”
এবার কথা বলতে দাঁড়ান বিরোধী চিপ হুইপ, ফ্লোরও সাথে সাথে পেয়ে যান। তিনি বলেন, “টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পুরো বাংলাদেশ আমাদের, এটা কোনো দালালের নয়, এটা চর দখল নয়; বিদেশী চক্রান্ত আমরা রুখে দেবো। আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবো। তার আগে চাই খবিরের ফাঁসি।”
বক্তৃতা করেন বিরোধী নেতার স্নেহভাজন তরুণ নেতা আকবার কুরাইশি। ইতিমধ্যেই সংসদে তার কথাবার্তা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। কখনো কখনো তিনি টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হন। তিনি বলেন, “আজকের টক অব দা কান্ট্রি হলো খবিরের ফাঁসি, খবির তুমি যেখানেই থাকো না কেনো ফাঁসির দড়ি তোমার দিকে আসছে। তুমি যে অন্যায় করেছো তাতে সরকারি দলও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
এ পর্যায়ে আবারও ফ্লোর দেয়া হয় সরকারী দলকে; প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে আসা এক জরুরি নেতাকে। তিনি উঠে কাউকে কিছু সম্বোধন না করেই বলতে শুরু করেন, “আমি নাচছি আমি খাচ্ছি আমি যাচ্ছি আমি আসছি আমি গিলছি আমি মিলছি আমি দুলছি আমি তুলছি আমি ভুলছি আমি ভুলছি আমি ভুলছি।” স্পিকার তাকে বাধা দিয়ে বলেন, “মাননীয় সাংসদ, দয়া করে বিষয়ের উপর থাকেন। আপনি দেখছি বিষয় থেকে সরে যাচ্ছেন।”
সাংসদ আবারো ছড়া মিলিয়ে বলতে থাকেন, “বিষয় গেছে বিষ হয়ে, নাচছি ছাদে ডিস হয়ে।”
স্পিকার বলেন, “আপনি তো দেখছি কবি আলফা শেখ হয়ে গেছেন। কথায় কথায় কবিতা বেরুচ্ছে। দুঃখিত আপনাকে আর ফ্লোর দিতে পারছি না।”
আবারও পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে যান বিরোধী দলের চীপ হুইপ, “মাননীয় স্পিকার, আমাদের এই কবি সাংসদকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি।”
সবাই হাততালি দিয়ে টেবিল চাপড়িয়ে শিস বাজিয়ে আনন্দ করে ওঠেন।
আনন্দসঙ্গত শেষ হলে তিনি বলেন, “তবে তিনি শুধু বলেননি যে আমি রাগছি, আমি ভাগছি। আমরা বুঝতে পারছি, এই সরকার যে টালমাটাল অবস্থায় আছে তাতে আপনাদের ভেগে যেতে সময় লাগবে না। তাই কবিতায় এই লাইনখানা যোগ করে দেবেন।”
সংসদে মোট স্বতন্ত্র সাংসদের সংখ্যা তিন। তারা প্রত্যেকেই অনেকক্ষণ ধরে ফ্লোর পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে একজনকে ফ্লোর দেয়া হলো। তিনি বললেন, “আজ একটা জিনিস অবশ্য ভালো হলো, বিরোধী ও সরকারী দল খবির শিকদারের বিচারের ব্যাপারে একমত হলো। এর কারণ এরা দু’জনেই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একদল হালুয়া রুটির ভাগ নেয়, অন্যদল তাকিয়ে থাকে। আবার সেইদল ক্ষমতায় এসে ভাগবাঁটোয়ারা করে, অন্যরা আঙুল চোষে। এই হলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আজ একজন স্বশিক্ষিত মানুষকে, একজন কৃষককে, পশুর খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। যারা এই অপকর্ম করেছে, যারা দেশের আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে তাদের বিচার হবে কি, এই সংসদ আক্রান্তের বিচার করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। খবির যা বলেছে তাতো বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞান থেকে আমরা জ্ঞান আহরণ করি। বিজ্ঞান বলছে চাঁদ সূর্যের আলোতে আলোকিত। এটা ধ্র“ব সত্য। আর চাঁদ ও সূর্য নিজের কক্ষপথে ঘুরছে সেটাও তো সত্য। ওরা কি মানুষ যে ঘুমিয়ে পড়বে আবার ঘুম থেকে উঠবে। অতএব খবির শিকদার যে কথা বলেছে তাতো সভ্য সমাজের জানা কথা। কিন্তু হায়, আমরা, এই গণ্ডমুর্খের সংসদে সেই জ্ঞানী ব্যক্তিটির বিচার দাবী করে বসে আছি। এ যে অন্যায়, বড়ো অন্যায়।”
ফ্লোর পান লাঙ্গল পার্টির মহাসচিব। তিনি বলেন, “মাননীয় স্পিকার, আপনি যে শেষ পর্যন্ত লাঙ্গল পার্টির কথা মনে করেছেন সে জন্যে কৃতজ্ঞতা। আদতে দেখুন, লাঙল ছাড়া কৃষক হাল দিতে পারে না। লাঙল হলো আমাদের উন্নয়নের চাবি। আমাদের নেতা তাই এই পার্টির নাম লাঙল রেখেছেন। আমার প্রাণপ্রিয় নেতা হোমোলেজো এই মাত্র আমাকে টেস্ক করে বলেছেন যে আজ আমরা সরকারী ও বিরোধী দুই পার্টির সাথেই থাকবো। কি চমৎকার তার ধী শক্তি! ভাবা যায় না! অতএব আমি নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, আমরা খবিরের বিচার চাই।”
কথা বলতে দেয়া হয় আরো একজন স্বতন্ত্র সাংসদকে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “হায় হায় হায়, এ কি দেখছি। আমরা যে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। আমরা কেনো মধ্যযুগে ফিরে যাবো?” তিনি একটু কৌতুক মিশ্রিত গলায় বলেন, “খবির তো ঠিকই বলেছে, চাঁদের নিজস্ব আলো নেই, অন্যের আলো ধার করে চলে। দেখুন আমাদের রাজনৈতিক জীবনেও এ কথা পুরোপুরি খাঁটি। আমাদের সংসদ নেতা ও বিরোধী দলের নেতা দু’জনের কারোই তো নিজস্ব কোনো আলো নেই, এই দেশের দু’জন মহান নেতার থেকে আলো নিয়ে এরা রাজনীতি করেন। তাহলে চাঁদ বেচারার কি দোষ, সে কেনো মহান সূর্যের আলো নিয়ে আলোকিত হতে পারবে না! মাননীয় স্পিকার, আমি আপনার মাধ্যমে এই সংসদকে জানিয়ে দিতে চাই, আপনারা ভুল করছেন, খবির শিকদারকে ছেড়ে দিন, তাকে স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে দিন। আর যারা তার শাস্তির নামে প্রহসন করলো তাদের বিচার করুন। এখনও সময় আছে, জাতিকে ধ্বংস করবেন না।”
অধিবেশন প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরো দু’একজন সাংসদ ছোটো ছোটো বক্তৃতা করলেন। সবাই-ই স্বতন্ত্র দুই সাংসদের ‘অন্ধ’ দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে খবিরের বিচার দাবী করলেন।
স্পিকার তার নিজের বক্তৃতায়ও খবিরের বিচার চাইলেন। তিনি বললেন, “শুধু খোঁয়াড়ে আটকিয়ে রাখলে হবে না। ওকে ধরে এনে দ্রুত আইনের আওয়ায় বিচার করতে হবে।” তিনি আরো বললেন, “মাননীয় সংসদ, আমরা আজ যে বিলটি আনছি তার নাম খবির বনাম রাষ্ট্র। এর মূল প্রতিপাদ্য: দ্রুত বিচার আইনে খবিরের বিচার হবে। যারা এই প্রস্তাবের পক্ষে আছেন তারা ‘হাঁ’ বলুন।” এতো জোরে ‘হাঁ’ শোনা গেলো যে মনে হলো সংসদের দেয়াল ফেটে যাবে। স্পিকার এবার বললেন, “যারা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে আছেন তারা ‘না’ বলুন।” মাত্র তিনটি স্বতন্ত্র কণ্ঠে অতি ক্ষীণ ‘না’ শোনা গেলো। স্পিকার বললেন, “হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে।”
তিনি সংসদ মূলতবি ঘোষণা করলেন।
অধিবেশন শেষে সরকারী দলের বৈঠক বসলো। এরই মধ্যে আইজি ফোন করলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে। তিনি জানালেন শাহবাগের অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ, নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। প্রতিমন্ত্রী আইজিকে নির্দেশ দিলেন কঠোর হবার। বললেন, “দরকার হলে লাশ ফেলে পরিস্থিতি সামাল দেন।” অতএব তারই প্রতিফলন ঘটে গেলো শাহবাগে রক্তের বন্যায়। আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝতেও পারলো না নির্দেশ কোথা থেকে গেলো।
(চলবে)