সস

প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ বৈশ্বিক বিবরণীতে মানবতাবাদী, নাস্তিক এবং নির্ধার্মিকদের উপরে বছর জুড়ে চলমান বৈষম্য তুলে ধরা হয়। ২০১২ থেকে প্রতিবছর এই বিবরণী তৈরি করে আসছে জাতিসংঘ স্বীকৃত মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট এন্ড এথিক্যাল ইউনিয়ন (IEHU)। এ বছরের বিবরণী তৈরির সময় আমরা মুক্তমনার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সাথে একত্রে কাজে করেছি, বিবরণীর মুখবন্ধ লিখেছেন বন্যা আহমেদ। “রাষ্ট্র তার আলোকিত এবং মুক্তমনাদের বাক স্বাধীনতা হরণ করলে, তাদের আক্রমণ করলে তা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটাবেই”। বিবরণীর ওয়েবসাইটে বন্যা আহমেদের মুখবন্ধ থেকে এ লাইন উদ্ধৃত করে বলা হয় “এমনটা কখনই কাম্য হতে পারে না”। মুক্তমনার পক্ষ থেকে মুখবন্ধটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।

চিন্তার স্বাধীনতা বিবরণীর মুখবন্ধ

আমার প্রয়াত স্বামী, অভিজিৎ রায় ছিলেন একজন বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার, যিনি শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সূচনা থেকে শুরু করে লিখেছিলেন সমকামিতা নিয়ে, লিখেছিলেন ভালোবাসার বিবর্তনীয় বিজ্ঞান নিয়ে, লিখেছিলেন সাহিত্য নিয়ে। অভিজিৎ ছিলো একজন মানবতাবাদী লেখক। প্রশ্ন, তা সে যতো কঠিনই হোক না কেনো, উত্তর সন্ধান ছিলো অভিজিৎ এর লেখালেখির প্রেরণা। ওর আগ্রহের বিষয় ছিলো অনেক। যদিও উদারবাদী চিন্তা এবং বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে লেখালেখির কারণে অভিজিৎ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। আমিও নিজেও ওর সাথে লিখতাম, ব্লগিং করতাম এবং প্রকাশ করেছিলাম জৈব বিবর্তনের উপর একটি বই। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে আমাদের জবাই করার চেষ্টা করা হয়। অভিজিৎ আঘাতের কারণে ওর জীবন হারায়। মাথায় চারটি আঘাত, হাতের একটি আঙ্গুল হারিয়ে হলেও বেঁচে যাই আমি।

তরুণ ব্লগার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ছিলো পরের আক্রমণের লক্ষ্য। বাবুকে আক্রমণ করা হয় মার্চ মাসে। নারী অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে বাবু নিজকে পরিণত করেছিলো ইসলামপন্থীদের শত্রু হিসেবে। আমাদের খুব কাছের বন্ধু এবং লেখক অনন্ত বিজয় দাশ এই সময়টায় ছিলো প্রতিবাদে মুখর, ছিলো রাস্তায়, ছিলো সুষ্ঠু বিচারের দাবীতে সরব, বাবুর পরে মে মাসে যাকে জবাই করে হত্যা করে ইসলামী জঙ্গিরা। অগাস্টে নিজের গৃহে, নিজের কাছের মানুষের চোখের সামনে আক্রমণের স্বীকার হয় ব্লগার নীলয় নীল। অক্টোবর শেষ হতে না হতেই একই দিনে আক্রমণ করা হয় অভিজিৎ এর দুই প্রকাশককে। জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন, যে প্রকাশ করেছিলো বিশ্বাস, অবিশ্বাস নিয়ে অভিজিৎ এর দুইটি জনপ্রিয় বই, চাপাতির আক্রমণে প্রাণ হারায় তার নিজের অফিসে। অপর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলকে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ এবং গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয় একইদিনে এবং মুমুর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয়। টুটুলের সাথে অফিসে অবস্থান করা আরও দুইজন ব্লগার এবং লেখকেও আক্রমণ করা হয়।

কয়েকটি ব্যাপার আমরা বুঝি: এই মানুষেরা প্রত্যেকেই দেশের আলোকিত বুদ্ধিদীপ্ত সন্তান ছিলেন, একই সাথে ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী। কারণ বেঁচে থাকতেই তারা জানতেন একটি ভুল কথার জন্যও তারা যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের স্বীকার হতে পারেন, প্রাণ হারাতে পারেন। তারপরও অনেক মানুষ এখনও লিখে চলছেন, লিখে চলছেন মৌলবাদ নিয়ে, মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাচ্ছেন মানবতাবাদের শিক্ষা, এবং তা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন মৃত্যু পরোয়ানা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যেভাবে আগাচ্ছে তাতে করে যেকোনো দিন এই বেঁচে থাকা লেখকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন হতে পারেন পরের আক্রমণের লক্ষ্য। এই ঘটনাগুলো যারা ঘটাচ্ছে তাদের একজনকেও এখনও বিচার না করে সরকার উলটো আক্রান্ত লেখকদের গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাদের মানা করে যাচ্ছে “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” না দিতে, যদিও নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করার জন্য তাদের গলার জোর কমে না।

মৌলবাদী জঙ্গিদের এই হত্যাকাণ্ডগুলো বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার একটি রূপ মাত্র, আমাদের চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার অধিকার আক্রান্ত হচ্ছে নানা ভাবে, নানা প্রান্তে। বাংলাদেশের এই উদাহরণগুলো দেখে সারা বিশ্বের মানুষেরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন তা হচ্ছে- আমরা যদি ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদের বৃক্ষকে বড় হতে দেই তাহলে তার ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী, আক্রান্ত হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা যদি মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য মানবতাবাদীদের জেল আর ফাঁসির দাবীকে মেনে নেই, তাদের গ্রেফতার করি তাহলে তা এই বিষবৃক্ষকে আরও ফুলে ফেঁপে বড় হতেই কেবল সহায়তা করে। আমাদের উচিত এমন নিকৃষ্ট, অসভ্য দাবী-দাবার স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ করা, আমাদের উচিত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে লড়া। যখন রাষ্ট্র তার আলোকিত এবং মুক্তমনাদের বাক স্বাধীনতা হরণ করে, তাদের আক্রমণ করে তখন মৌলবাদের ও জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটাই স্বাভাবিক। ঠিক যেমনটা আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ সময়ে, যখন নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিলো আমাদের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, মুক্তমনাকে, একই মৌলবাদী গোষ্ঠীর মাধ্যমে। বাংলাদেশ এখনও তার সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি, কারণ এমন শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।

সম্পূর্ণ রিপোর্টটি ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে
http://freethoughtreport.com/download-the-report/