বামপন্থীদের একটা অতিপ্রিয় বুলি হচ্ছে, দেশভাগ ইংরেজরা করেছিল | এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মানেটা দাঁড়ায় যে ভারতে হিন্দু আর মুসলমান পরস্পর মিলেমিশে বাস করত | ইংরেজরা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং পরিনামে দেশভাগ হয়েছিল | কোনো কোনো বামাতি তো আবার এটাও বলে যে মিল সাহেব তাঁর ইতিহাসে প্রথম হিন্দু আর মুসলমানকে দুই পৃথক জাতি হিসেবে দেখিয়েছিলেন | ইটা তারা বলে আগের মতটাকে জাস্টিফাই করতে | ইংরেজরা কিভাবে ডিভাইড এন্ড রুল করেছিল তা দেখাতে | আমি এর বিরোধিতা করি |

আমার মতে দেশভাগের মূল কারণ ছিল ধর্ম | হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি | তারা দুই পৃথক জাতির মতই ছিল | ইংরেজদের কোনো দোষ নেই | তারা যেমনভাবে হিন্দু আর মুসলমানকে দেখেছিল, তেমনভাবেই তারা ইতিহাস লিখেছে | এই লেখায় আমি এইগুলি প্রমান করব |

এই লেখায় আমি দেখাবো যে ভারতে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে কতগুলি দাঙ্গা হয়েছিল, সেসব দাঙ্গার কারণ কি ছিল, ইংরেজরা হিন্দু আর মুসলমানকে কি চোখে দেখত এবং কেন |আরেকটা কথা | সবিনয়ে বলি যে ইতিহাসে লিখা থাকলেই কোনো কিছু সত্যি হয়ে যায় না আর লিখা না থাকলেই কোনো কিছু মিথ্যা হয়ে যায় না | যেসব দাঙ্গার কথা বলতে যাচ্ছি সেগুলো ইস্কুলের ইতিহাস বইতে লিখা নাই কিন্তু সত্য ঘটনা | এই তথ্যগুলি চেপে যাওয়া হয়েছে | উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবেই চেপে যাওয়া হয়েছে | যাতে করে দেশভাগের আসল কারণ আমরা কোনদিন বুঝতে না পারি | আসল কালপ্রিটকে জানতে না পারি | উদ্দেশ্য ১০০% সফল হয়েছে | আজ অব্দি সেই ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে আমরা সযত্নে বয়ে চলেছি যা দেশভাগের জন্য দায়ী |

সর্বপ্রথমে হিন্দু ও মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক | হিন্দু ও মুসলিম পরস্পর এই ভারতে লড়াই করেই এসেছে | দুজনের মধ্যে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক | দুই সম্প্রদায়ই পরস্পর বহু দাঙ্গা করেছে |

মুঘল আমলে ছোটখাটো কারণে দাঙ্গা হত | দাঙ্গাগুলি একতরফা হত | হিন্দুদের বিরুদ্ধে | কারণ তখন মুসলিম আমল | শাসিত চিরকালই শাসকদের দ্বারা লাঞ্চিত হয় | ১৭১৯-২০ সালে কাশ্মিরে এক মুসলমানের প্রতিহিংসাবশত দাঙ্গা হয় | ১৭২৯ সালে দিল্লিতে এক মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হয় | ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে মুসলিমরা হিন্দুদের মহরমের সময় তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলে | হিন্দুরা অসম্মত হয় | পরিনামে দাঙ্গা | ১৭৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ার জেলায় মুসলিমরা হিন্দু ধর্মীয় উত্সবে সশস্ত্র হামলা করে | ১৮০৯ সালে বারানসিতে হিন্দুরা একটা বাড়ি বানাচ্ছিল মসজিদ আর বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের মাঝে | তাই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয় | ১৮৭৪ সালে বোম্বেতে এক পার্সি প্রফেটদের উপর এক বই লিখে | সেই বই নিয়ে দাঙ্গা | ১৮৭৩ থেকে ১৮৮৪ সাল অব্দি মোপলা মুসলমানরা কেরালায় হিন্দুদের কেটেছে |

ততদিনে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে | মুসলিমদের জমানা গেছে | তাই এবার দাঙ্গা গুলোর চরিত্র কিছুটা পাল্টেছে | এবার একতরফা হিন্দুরা মার খায় না | তারা পাল্টা মার দিতে শিখেছে | ১৮৮৯ সালে দিল্লিতে এক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে | ১৮৯১ সালে কলকাতায় মসজিদ বানানো নিয়ে দাঙ্গা লাগে |ওই একই বছরে পলাকাদে হিন্দু ধর্মীয় মিছিলের উপর মুসলিম আক্রমন হয় | ১৮৯২ সালে প্রভাসপাতনে মহরম নিয়ে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগায় | ১৮৯৫ সালে পোরবন্দর-এ হিন্দুর ঘরের পাশ দিয়ে মুসলিম ধর্মীয় মিছিল বেরোলে হিন্দুরা আক্রমন করে | এইরকম হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বহু দাঙ্গা হয়েছে , তাদের বিবরণ নিচের লিঙ্কে পেয়ে যাবেন |

hindu muslim riots a survey

the riot torn history of hindu and muslim relationship

দাঙ্গার তালিকা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগাত গরু কাটা নিয়ে | আজও যেমন লাগায় | মুসলিমরা লাগাত মসজিদের সামনে গান বাজানো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে | আরো অনেক কারণ আছে | আমি কয়েকটা বললাম |

ইংরেজরা এইসব দাঙ্গা প্রবন চরিত্র দেখে হিন্দু আর মুসলিমদের দুই পৃথক জাতি ভেবেছিল | ভাবাই স্বাভাবিক | এর সাথে যদি যুক্ত হয় ছোঁয়া ছুই-জল অচল-ছায়া মাড়ানো ধর্ম , তাহলে দুই জনকে দুই মেরুর বাসিন্দা বলে ভাবাটা কি খুব কষ্টকর ? মিল সাহেব এইসব দেখে হিন্দু ও মুসলমানকে দুই পৃথক জাতি বলেছেন | খারাপ বলেননি |

ইংরেজ আমলে দুই সমাজ সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে | হিন্দুরা বানায় হিন্দু মহাসভা আর মুসলিমরা বানায় মুসলিম লিগ | দুই দলেরই উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের তোষণ করে কিছু সাম্প্রদায়িক সুবিধা ভোগ করা | অর্থাত এখানেও সাম্প্রদায়িকতা চলে এলো | এই দুই দলই আগের মত পরস্পরের সাথে দাঙ্গা করত | দুই দলেরই উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নিজেদের সম্প্রদায়ের হাতে ক্ষমতা নেয়া |

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের আর্থিক ক্ষতি হলে তারা ভারত স্বাধীন করার কথা ভাবতে থাকে | মুসলিম লিগ দেখে ক্ষমতা হিন্দুদের দিকে যাচ্ছে | তখন তারা দেশভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল | হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা প্রবন চরিত্র দেখে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে স্বাধীন হলে ভারতে সিভিল ওয়ার শুরু হয়ে যাবে | তাই তারা দেশভাগের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছিল | এতে ব্রিটিশদের দোষ কোথায় ?

সুতরাং দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা | ইংরেজরা কোনভাবেই দায়ী নয় | বামাতিরা মিথ্যা কথা বলে মুসলিম ভোট পাবার জন্য | আবার হিন্দু ও মুসলিমরা একে অন্যকে দোষারোপ করে | সেটাও সত্যি নয় | আসল কথা হলো তারা দুজনেই দায়ী | বা আরো ভালোভাবে বললে তাদের সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ দায়ী |