হিন্দু ধর্মধারী সুমি আর আমি ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত একসাথে পড়েছি একই স্কুলে একই ক্লাসে। ওর বাপ-দাদা পুরুষাণুক্রমে ঢাক বাজাতো, তাই ঢাকী বলা হতো ওদের পরিবারকে। আমাদের বাড়ির সামান্য পুবে ঠিক নদীর তীরে ছিল সুমিদের বাড়ি। আমি প্রায়ই হাফপ্যান্ট খুলে সুমির ঘরে রেখে নদীতে ঝাপ দিতাম। সুমি আমার প্যান্ট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো নদীতীরে। আমরা ৩/৪-জনে একসাথে স্কুলে যেতাম দলবেঁধে। বর্ষার জলকাদাতে সুমিকে অনেকবার হাত ধরে বাঁশের সাঁকো পার করিয়েছি আমি। কিশোর স্বৈরাচারি আমার কথা না মানাতে দুয়েকবার মেরেছিও তাকে খুব। একবার আমার মার কাছে নালিশ করেছিল সুমি, ওরা গরিব বলে আমি নাকি প্রায়ই মারি তাকে। কেঁদেছিল সে খুব মার আঁচল ধরে। আর কোনদিন মারিনি সুমিকে। সেই থেকে সুমির জন্য পাগল ছিলাম আমি। রাস্তায় প্রায়ই তাকে চিমটি দিতাম কখনো ভালবেসে, কখনো খ্যাপাতে। ক্লাস এইটে উঠেই বন্ধুর সহায়তায় প্রেমপত্র লিখে সুমির হাতে গুজে দেই একদিন। কিন্তু সে দুতিনদিনেও ফেরতপ্রেমপত্র না দেয়াতে আবার ক্ষেপি তার উপর। রাস্তায় একাকি পেয়ে চেপে ধরে বলি গ্রাম্য দৃঢ়তায়, ‘কেন প্রেম করবি না আমার সাথে বল’? চোখ ভিজিয়ে আর গলা কাঁপিয়ে সুমি বলে, আমরা হিন্দু, ঢাকি আর খুব গরিব। তোমার সাথে প্রেম করলে কখনো বিয়ে হবেনা আমাদের। তোমার ধনী মুসলিম পরিবার মারবে আমার মা-বাবাকে। তাই ভয়ে জবাব দেইনি চিঠির। কিন্তু ‘লাভ ইউ’। সুমির ‘লাভ ইউ’ শুনে মনের অলিন্দ ছুঁয়ে সুন্দরের অলিক তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠি আমি মেঘনা তীরে। সারাদিন নদীতে সাঁতার কাটতে থাকি ‘লাভ ইউ’র রোমান্সে! পকেট খালি করে প্রেমপত্রে সহায়তাকারী বন্ধুকে বাজারে “চান বিস্কুট” আর “স্টার সিগারেট” কিনে দুজনে স্টিমারের মত ধোয়া ছাড়তে থাকি স্কুলের মাঠে দুজনে প্রেম পাওয়ার আনন্দে।
:
৯ম শ্রেণিতে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে খবর আসে এক জেলে তরুণের সাথে বিয়ে হচ্ছে সুমির। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলি, ‘মা সুমিকে বিয়ে করবো আমি’। হাসতে হাসতে মা গড়াগড়ি যায় মাটিতে। রাগে মার কাপড় টানতে টানতে খুলে ফেলি আমি। বড়বোন এসে থাপ্পর দেয় গালে জোরে আমায়। রাগে ঘাসকাটা বড় দা হাতে নেই সুমির বাবাকে কোঁপাতে। দুপুরের খোলা ঘরে ঢাকীকে না পেয়ে তার দুটো ‘ঢাক’ ভেঙে ফিরে আসি নিজ ঘরে বীরদর্পে। সিনেমাপাগল আমাকে নিয়ে মা শহরে যায় সিনেমার লোভ দেখিয়ে। মন ভরে সিনেমা দেখে, নতুন জামা কিনে, নানাবাড়ি বেড়ানো শেষ করে, যখন ফিরে আসি গাঁয়ে, সুমি ঢাকী তখন ইলিশ ধরা কুচকুচে কালো দক্ষ জেলে গোপাল জলদাসের স্ত্রী সুমি জলদাস।
:
একবার ইচ্ছে হলো গোপালের নৌকা ফুটো করে রাতে মেঘনাতে ভাসিয়ে দিই সাহসি রাজপুত্রের মতো। কিন্তু ভয়ে তা না করে জালগুলো কেটে দিলাম এক রাতে ধারালো ব্লেড কিনে রাগে। মনে আছে মা নতুন জাল কিনে দিয়েছিল গোপাল জলদাসকে। নদী তীরে গেলে সুমি দৌঁড়ে চলে যেতো ঘরে তার, হয়তো ভয়ে কিংবা ভালবাসায় জানিনা আমি। একসময় এ ভালবাসা বিরক্তি, শেষে ঘৃণায় পরিণত হলো আমার। এসএসসি পাস করে শহুরে হলাম আমি। ঢাবিতে পড়া শেষ করে বিদেশ চলে যাই। তারপর জীবন কবিতার কত পাতা ওল্টালাম। দারুচিনি লবঙ্গি বনের ঘ্রাণতায় কত দেশ ঘুরলাম! কত মানুষ দেখলাম! নুতন প্রেমে পড়লাম, নতুন কষ্টের দহনে সুমি ঢাকির স্মৃতি ধুসর করে দিলো জীবন থেকে। বছর কুড়ি আ্গে নদীগ্রাসে ভেঙে গেলো আমাদের বাড়ি, সুমিদের বাড়ি, আমার অন্য সব স্বজনদের বাড়ি। সব পরিচিত স্বজনরা কে কেোথায় নতুন বাস্তুতে গেল সব জানিনা আমি। ঢাকায় অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আর খোঁজ নিতে পারিনি গরিব স্বজনদের। সুমি জলদাস দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে আছে জলদাস জেলেনি হিসেবে, এটাই কেবল জানতাম বন্ধুদের কাছ থেকে।
:
ফিলিপিনে ১৫-দিনের ম্যানেজমেন্ট কোর্সে অংশ নিতে লিস্টে নাম এসেছে আমার একটা গ্রুপের সাথে। তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ভিসা-টিকেট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন জিও এসবের। হঠাৎ গাঁ থেকে ফোন এলো স্কুলের প্রাক্তন বন্ধু রফিকের। সুমি জলদাস মৃতপ্রায়। থাকে নতুন জেগে ওঠা চর আরেক কেতুপুরে। আমাকে দেখতে চায় সে মৃত্যুর আগে। ছুটি না নিয়েই রাতের লঞ্চে উঠে পড়লাম সুমির নতুন চরে যেতে। ঢাকা থেকে রাঙাবালির দ্বিতল লঞ্চ, যা ঐ চরে স্টপেজ দেয় ভোরের দিকে।
:
জুতো খুলে প্যান্ট গুটিয়ে জলচরে নামলাম আমি আরো অনেক চরজীবি মানুষের সাথে লঞ্চ থেকে। বন্ধু রফিক নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। চারদিকে অথৈ মেঘনার ঘোলা জল। মাঝে মাঝে কেবল মাথা তোলা জেলে কৃষকদের বাড়িগুলো। উজান থেকে আসা জোয়ারের অযাচিত জল পুরো চরকে মিনি সমুদ্রে পরিণত করে রেখেছে। সূর্য ওঠার সাথেই আমরা নৌকো ভেড়ালাম একদম সুমি জলদাসের কাচা ঘরের ভিটির সাথেই।
:
শন-খড়ের ছাউনি আর হোগলা পাতার বেড়া দেয়া সুমি জলদাসের ঘর। চারদিকে খোলা কেবল বেশ কটি কলা আর মাদার গাছ লাগানো। এক চিলতে উঠোন, যা ঘিরে রেখেছে চরের নল খাগড়া জাতীয় তৃণঘাস। তার মাঝে সুপোরি গাছের হাতে বানানো খাটে শুয়ে আছে ঝরা বকুলের চাঁদর গায়ে সুমি নামের মাঝ বয়সি এক নারী। সেবা করছে তার কিশোরি মেয়েটি পাশে বসে। অনেক বছর পর দু:খের কফি রঙের ফিঙে পাখির মতো দেখলাম সুমিকে। বনস্পতির সুষমায় নিটোল ভরাট শরীরের অষ্টম শ্রেণির সুমির বদলে, এক ক্ষয়িষ্ণু ধুসরতার জীবন বয়ে জল চাতকের প্রতীক্ষায় মুখ তুলে চাইলো সুমি আমার দিকে। মেঘরাজ্যের আনন্দ বৃষ্টির দেবতার মতো সাহস দিয়ে সুমিকে বললাম, ‘কেন এতোদিন জানাওনি আমায়? এতো ঘৃণা কেন পুষলে তুমি এতো বছর? ঢাকায় কিংবা ভারতে চিকিৎসা করাতে কেন দিলে না আমায় তুমি’? কিছুই বললো না সুমি, গর্ভিণী ধৃত মৃতপ্রায় মাছের ঘোলাটে চোখের মত কেবল তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। দহনের জলচর মাঝে সজাগ হয়ে এবার হাত ধরলাম সুমির। অর্ধোস্ফূট সত্যের মুখোমুখি হয়ে সুমি কেবল চোখ ঝড়ালো ক্রমাগত। আমি বুকের কষ্টকে আটকে বৃদ্ধ ধ্যানী জারুল গাছের মত প্রজ্ঞাময়তায় বলি, ‘তোমার চিকিৎসার কাগজপত্র সব দেখি’? বন্ধু রফিক আর কিশোরি সুতপা বিছানার নিচ থেকে পুরণো সব কাগজপত্র বের করে। কিশোর ছেলে আর স্বামী সাগরে গেছে মাছ ধরতে দিন পনেরো আগে, কোন খোঁজ নেই তাদের। কিশোরি মেয়েটিই মুখে জল দিচ্ছে, দেখভাল করছে শূন্য একাকি ঘরে মা সুমিকে। মৃতলোকের প্রত্নঘোরের দরজায় দাঁড়ানো সুমির কাগজপত্র নিয়ে নৌকোযোগে যাত্রা করি শহরের পথে। প্লান, পরিচিত এক ডাক্তারের সাথে কথা বলবো আগে, তারপর দেখি সে কি বলে?
:
কোন সুখ কিংবা আশার কথা বললো না ডাক্তার বন্ধু। ব্লাড ক্যান্সারের শেষ পর্যায় সুমির। রক্ত দেয়া দরকার ছিল মাঝে মাঝে কিংবা বোনমেরু ট্রান্সফার। যা করতে পারেনি সুমি জলদাসের পরিবার।এ খারাপ খবর বয়ে শহর থেকে ছোট লঞ্চে ফিরতে বিকেল হলো আমার। ভাটার টানে জল নেমে গেছে, তাই ভেজা শুকনো ডাঙায় নামলাম লঞ্চ থেকে। ঘাটে দাঁড়ানো বন্ধু রফিক চোখ মুছে বললো, একটু আগে মারা গেছে সুমি। সুতপা মেয়েটি কাঁদছে একাকি। এখানে হিন্দু পরিবার আর নেই, সব ভারত চলে গেছে পরিজায়ী পাখি হয়ে। কি করবো আমরা? স্বামী ছেলেও সাগরে। তাদের কোন মোবাইলও নেই যে খবর দেব।
:
স্কুল সময়ের পুরণো জীবন সন্তরণে অপূর্ণতার আঁধার ঘরে দাঁড়াই সুমির লাশের পাশে। মার মৃত জীবনের কষ্টকর বাতি হাতে সুতপা মেয়েটি জড়িয়ে ধরে আমায়। রফিক আর আগত প্রতিবেশিরা বলে, মারা যাওয়ার প্রাকমূহূর্তে কথা বলেছিল সুমি, মেয়েটিকে যেন দেখি আমি এ অনুরোধ করেছিল সে। ইঞ্জিনচালিত নৌকো পাঠিয়ে পাশের গাঁ থেকে হিন্দু জেলেদের ডেকে আনি সুমির শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে। সব আনুষ্ঠানিকতা করাই পাশের সব মানুষদের ডেকে। ভরা দশমীর শরমী চাঁদের মত সুমির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে ওর কপালে শেষ সিঁদুর পরাই আমি। কিন্তু অধীর হিংসায় মহাকম্প ভয়ের ধর্ম জননী হাত চেপে রাখে আমার। সুমিকে যখন চিতায় তোলে সবাই হরিনাম জপে, কান্নার নিশুতি হাওয়ায় চরের বৃক্ষ আর ঘাসফুলেরা ঘুরতে থাকে চারদিকে আমার। সুপান্থের জালে আটকে পরা ইলিশের মত, সপ্তরঙা নগ্ন দু:খরা ভেসে বেড়ায় মেঘনার ঘোলা জলে। বৃহন্নলা অশ্বথ গাছ হয়ে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি সুমির দিকে চোখ রেখে। এ কাকদ্বীপের গুবরে শালিকেরা আষাঢ়ের জলবন্দী গেরস্থের ঘরে কাঁদে সুমি আর তার কন্যা সুতপার দু:খে।
:
জীবন বেহালার বারোয়ারি মানব জমিনের করুণ ধ্বনিতে চিতায় আগুন দেয় হিন্দু জেলে জলদাসরা। গোধূলির প্রাকসন্ধ্যায় ব্যথাতুর ঘুঘু ডাকা সময়ে আমার চোখের সামনেই জ্বলতে থাকে, আমার প্রথম প্রেমপত্র গ্রহণকারী সুমির শীর্ণকায় দেহ। জ্বলতে থাকা আগুনে নিঃশব্দ লিপ্তির বিষাদে মন কাঁদতে থাকে আমার। হাটুভাঙা কষ্টের কান্না দমাতে আমি ৮-বছরের সুতপাকে নিয়ে ৭-টা চক্র দেই জ্বলন্ত চিতার চারদিকে। ক্ষীয়মান নক্ষত্রের কান্নার মতো সুমির দেহ এক সময় লিন হয় বাতাস আর অগ্নিদহনে। জীবন নাচনের বায়বীয় সুড়ঙ্গে ঢুকে আমি সুতপাকে নিয়ে নামি মেঘনার ঘোলাজলে। যেখানে ফেলা হয়েছে সুমির দেহজ ভস্ম। মৌলিকতার দুঃখবোধসমগ্র ধুয়ে দিতে, ডুব দিতে থাকি আমি ক্রমাগত সুতপার হাত ধরে। পৃথিবীর সকল ভোগবাদি জ্যামিতির হিসেব ফেলে আমি শ্বাশত গাংচিলের ডানায় উড়তে থাকি তখন। জীবনের গভীরে থাকা রুদ্ধ ঘ্রাণ এবার বেড়িয়ে আসে কান্নার জলতলে।
:
অন্ধকার রাতে চোখ ঝলসানো সপ্তরঙা সার্চলাইট ফেলে ঢাকাগামি লঞ্চ থামে সুমির গাঁয়ে। আমার জ্বলন্ত মেটামরফসিস জীবন ট্রাকে সুতপা জলদাসকে নিয়ে পা রাখি লঞ্চের সিঁড়িতে। অন্ধকার রাতের মেঘনার জলত্রাসের অনাগত রুপকথার মাঝেও সুতপার হাত ধরে আমি দেখতে পাই, আগামির আনন্দময়তার প্রসন্ন তারারা হাসছে আকাশে। জীবনের শুকনো পাতারা কান্না ছেড়ে স্বশব্দে বের করছে তাদের নতুন কুঁড়ি। ঘোর রাত্রির মেঘনার জনকল্লোলে স্বচ্ছতায় দেখতে পাই আমি সুমিকে চিঠি হাতে। আমার জীবনের বুকপকেটে ৮ম শ্রেণি থেকে রক্ষিত ছিন্নতর শ্বাশত প্রেমপত্রের জবাব নিয়ে সুমি হাত জাগিয়ে জলমাঝে এবার। দুর্বোধ্য কবিতার অনন্য বোধের মত সুমি বলছে তার ফেরত চিঠিতে, আমার কন্যা সুতপাকে দেখো রেখো তুমি। ওতো তোমারই প্রথম প্রেমের সন্তান। তাকে দিয়ে গেলাম তোমার হাতে।