লেখক: ঋষভ

ধর্মীয় অনুভূতি জিনিসটি আসলে কি বস্তু? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আসলে কি হয়? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে কি তার ধর্ম চুরমার হয়ে যায়? সে আর ধর্মের পথে, সৎ পথে চলতে পারেনা? নাকি তার দৃষ্টি শক্তি, শ্রবন শক্তি চলে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে হাতে গুনে গুনে হলেও বেশ কিছু মানুষের লেখা বিপুল সংখ্যক মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। কেমন আছে তারা? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবার পর তাদের মধ্যে কতজন পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, অঙ্গহানী হয়েছিল ঠিক কতজনের, কতজনকে নিদেন পক্ষে সাইকিয়াট্রিকের চেম্বারে গিয়ে কড়ি খসিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে হয়েছে? কতজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে?

জানতে ইচ্ছে করে এসব। না জানলে চলেনা, কারন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এরকম কথা বলেই আঘাত প্রাপ্তরা তাদের আঘাতকারীকে কুপিয়ে খুন করছে। ধারালো চাপাতি দিয়ে কোপালেও আঘাত লাগে, মাংস কেটে দরদর করে রক্ত বইতে থাকে। এরকম কয়েকটা কোপে মৃত্যু ঘটানোও কঠিন কিছু নয় এবং তা ঘটছেও। যারা চাপাতির আঘাতে জখম হয়ে মৃত্যু যন্ত্রনায় কোঁকাচ্ছে সে দৃশ্য সবাই দেখছে। যারা নিহত হয়েছে তাদের মৃতদেহও দেখতে হয়েছে সবাইকে। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে যারা আঘাত পেল তাদের অবস্থার কথা, কিভাবে কাটছে তাদের দিন এসব তথ্য সংবাদ মাধ্যমে আসছেনা। চেপে যাওয়া হচ্ছে তাদের কথা। এক্কেবারে সেন্ট পারসেন্ট ব্ল্যাক আউট। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের যন্ত্রনার ছবি কোথাও ছাপা হচ্ছেনা। মনোবিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানীরাও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রাপ্তদের সঠিক চিকিৎসা আর পুণর্বাসন নিয়ে কোন রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ করলেননা। ধর্মীয় অনুভূতিতে হয়তো আঘাত দিয়ে কিছু লিখেছে একটা মাত্র লোক। সে লেখার ফলে কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক মানুষ। লেখককে না হয় দু’কোপে মেরে ফেলা গেল কিন্তু এই আঘাত প্রাপ্তদের কি হলো? তারা কেন সামনে আসছেনা তাদের ক্ষত নিয়ে, তাদের কষ্টের আহাজারী নিয়ে।

সরকার পর্যন্ত যখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নেন অথচ চাপাতির মারন দৈহিক আঘাতকে আমলেই আনেননা তখন বুঝতে পারি ধর্মানুভূতিতে আঘাতকে কোন ক্রমেই ছোট করে দেখা যায়না। যে লেখকটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে আচমকা কয়েকজন ধার্মিকের চাপাতির আঘাতে “হাসতে হাসতে আনন্দের” সাথে পরলোকে পৌঁছে গেল তার কথা আমরা শুনছি কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাওয়া সেই সব অসহায় মানুষের অসহনীয় যন্ত্রনার কথা আমাদের কাছে কিন্তু আড়াল করে ফেলা হচ্ছে। এর পেছনে আবশ্যিকভাবেই যে বিদেশী শক্তির হাত আছে তাতে সন্দেহ করা চলেনা। কিন্তু যতই আড়াল করা হোক আমরা কল্পনা করে নিতে পারি কি হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে।

যদি সংবাদ মাধ্যম গুলো টাকা খেয়ে সত্য চেপে না যেত তবে খবরে আসতো, নিশ্চয়ই আসতো আজ নিশিপুর গ্রামের আজমত আলী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। খবরে প্রকাশ থাকে মাঠে খড়ের আাঁটি বাঁধার সময় আচমকাই এই আঘাত আসে এবং সেখানেই তিনি পড়ে গিয়ে গোঙাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তার মুখে ফ্যাঁপড়া উঠতে শুরু করলে গ্রামবাসী তাকে নিকটস্থ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিংবা ধরুন তুফান শেখের কথা, বাজারে চা খেতে খেতে একটা পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন সেই সময় তার চোখে পড়ে নাস্তিকদের একটা লেখা। লেখার কয়েকলাইন পড়া মাত্র তাঁর ধর্মীয় অনুভূতিতে এত প্রচ- আঘাত লাগে যে তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যান। কাটা মুরগির মত তিনি ছটফট করতে থাকেন, তখন পার্শ্ববর্তী সহৃদয়রা তাঁকে নিকটস্থ ডিসপেন্সারীতে নিয়ে যায়। অথবা মরিয়ম বেগম, যিনি টিভিতে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা কোন মেগা সিরিয়াল দেখছিলেন হঠাৎ করেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে তার হাত থেকে টিভি রিমোট পড়ে যায়। চোখ কপালে তুলে তিনি সোফার উপরেই এলিয়ে পড়েন আর তার মুখ দিয়ে ফেনা কাটতে থাকে। বাড়ীর মেয়েরা কলসি কলসি পানি মাথায় ঢেলেও জ্ঞান ফেরাতে পারেননা। ক্রিকেট খেলছিল স্বপন, সেঞ্চুরী করবার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সে আচমকা হাত থেকে ব্যাটটা খসে পড়ে, হাঁটু ভেঙ্গে সে পড়ে যায় পিচের ওপর। সবাই ভাবে বল লেগেছে কোথাও কিন্তু না তার কচি তরুণ মনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতেই সে জখম হয়ে পড়ে যায়। তার আর সেঞ্চুরী করা হলোনা। এখন এই আজমত আলী, তুফান শেখ, মরিয়ম বেগম আর স্বপনের পরিবারের উপর নেমে এলো শোকের কালো ছায়া। আজমত আলী খেটে খাওয়া মানুষ ধর্মীয় অনুভ’তিতে আঘাতের ফলে সে পঙ্গু হয়ে পড়ায় আর খাটতে পারেনা। আজমত আলীর পরিবারকে রীতিমত ভিক্ষা করে দানাপানি জোটাতে হয়। অবস্থা একই তুফান শেখের বাড়িতেও, তার ব্যবসা বানিজ্য দেখভালের অভাবেই লাটে উঠেছে, অসুস্থ তুফানকে চিকিৎসার খরচ দেবারও কেউ নেই। মরিয়ম বেগম পক্ষাঘাতে স্থবির হয়ে গেছেন আর বসে টিভি দেখতে পারেননা। সাত ছেলে মা মা করে বিস্তর কান্না কাটি করেছে, ছোট ছেলেটা মাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু অন্য ভাইরা মনে করে এ অবস্থায় মায়ের জার্নির ধকল সইবেনা। আর স্বপন, সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। স্বপন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনর্গল অশ্রু বিসর্জন করে সে আর কখনওই মাঠে নামতে পারবেনা। জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার স্বপ্নটা স্বপ্ন মাত্রই থেকে গেল স্বপনের। এ খবর গুলো আসেনি আমাদের টিভিতে বা খবরের কাগজে কিন্তু কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। ধর্মীয় আঘাতের পরিনাম ঠিক এই রকম বা আরো ভয়াবহ না হলে কি কেউ কুপিয়ে মানুষ মারতে যায়।

সবাই বলেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া উচিত নয়, বলেন ধর্ম নিয়ে হাসি ঠাট্টার পরিনাম ভালো হয়না। বলেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলে সহ্য করা হবেনা। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে আহত মানুষ গুলোর ভয়াবহ যন্ত্রনার ছবি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেননা, চেপে যান। কেন এই চেপে যাওয়া? তবে কি এই আঘাত টাঘাত বানোয়াট কথা? অন্তত দৈহিক ভাবে এই আঘাত কেউ অনুভব করেছেন এরকম দৃষ্টান্ত এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কি এই আঘাতটা মানসিক একটা আঘাত? মানসিক আঘাত হলে তার গভীরতা কতখানি? এ আঘাতে কি স্মৃতি শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথবা আহত ব্যক্তি কি মানসিক প্রতিবন্ধীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়?

পদার্থ বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে গিয়ে কেউ যদি বলে আইনষ্টাইনের থিয়োরীটা আগা গোড়াই ভুল, এটা যারা মানে তারা বোকার হদ্দ, তাদের মাথায় ঘিলুর জায়গায় গোবর। বিজ্ঞানীরা কি করবে? কেউ কেউ হেসে উঠবে এটা নিশ্চিত কিন্তু আর সবাই ভেবে পাবেনা একটা পাগল কিভাবে এখানে ঢুকে পড়লো। সিকিউরিটি ডেকে লোকটাকে সম্মেলন কক্ষ থেকে বের করে সম্মেলনের কাজ আগের মতই চালিয়ে যাওয়া হবে। কেউ কিন্তু বলবেনা বাঁধো অবিশ্বাসীকে, কেউ বলবেনা লোকটা আমার বিজ্ঞানানুভূতিতে আঘাত করেছে তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। চিত্রশিল্পের সমঝদারের কাছে গিয়ে কেউ কিন্তু বলতেই পারে পিকাসোর এই কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং এর আসলে কোন মানেই হয়না আপনি পিকাসোর ছবির ব্যাখ্যায় যে লেকচার ঝাড়ছেন সে আপনার নিজের মনের কল্পনা। চিত্র সমঝদার যথেষ্ট বিরক্ত হবেন এই লোকটা অজ্ঞতায় কিন্তু লোকটার গলা কাটতে যাবেননা। রবিঠাকুরের, জীবনানন্দ দাসের বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কাব্যিক লাইন গুলোর কোনই অর্থ হয়না বলে কেউ দাবী করলে অন্তত এটুকু বোঝা যাবে যে এ দাবী করছে তার সাহিত্যবোধ নেই। সাহিত্যরসিক এ লোকটার কথায় বিরক্ত হলেও এটা বলবেননা এই লোকটা আমার সাহিত্যবোধে আঘাত করেছে একে কতল করা উচিত।

এরকম ভিত্তিহীন উক্তি ছাড়াও বিজ্ঞানীদের, শিল্পিদের, কবি-সাহিত্যিকদের কাজের সমালোচনা হয়। অনেক সময় কঠোর সমালোচনার মুখেও পড়েন তারা। প্রতিষ্ঠিত বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী তরুন বিজ্ঞানীর করা তার থিয়োরীর সমালোচনা সহজভাবে নিতে পারেননা। নিজের থিয়োরীর প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব থাকেই তা সত্ত্বেও সমালোচনাটা তিনি পড়ে দেখেন মন দিয়ে, সম্ভব হলে উত্তরদেন আঁটঘাট বেঁধে। যদি দেখেন তার থিয়োরীটাই ভুল, কষ্ট হলেও সেটাই মেনে নেন। শিল্পি সাহিত্যিকরাও কঠিন সমালোচনায় বিচলিত হন, সম্ভব হলে লিখেই জবাব দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু সহিংস হয়ে ওঠেননা। যে কোন কাজের ক্ষেত্রেই মানুষকে সমালোচনার সামনে পড়তেই হয়। ভিত্তিহীন সমালোচনা আপনা আপনিই মিলিয়ে যায়, বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা লেখক, শিল্পি সহ পাঠক, দর্শকদের বোধও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এই সমালোচনা গুলোকে কেউই কখনও সাহিত্যবোধে, বা শৈল্পিকবোধে মারন আঘাত হিসেবে বিচেনা করবেননা। আর তাই সাহিত্য সমালোচককে, বা শিল্পের সমালোচনাকারীকে অন্তত শিল্প-সাহিত্যের সমালোচনা করার জন্য কখনও জীবন হারানোর ভয় নিয়ে চলতে হয়না। ধর্মের সমালোচনা যারা করেন তারা অতটা সৌভাগ্যবান নন। কারন সেই সমালোচনা ধর্মীয় অনুভূতিতে গিয়ে আঘাত হানে।

আবার সেই প্রথম বাক্যেই ফেরা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেলে কি অনুভব হয়? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কেনইবা এতখানি গুরুত্ব পাচ্ছে? আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দৈহিক আঘাতের সম পর্যায়ে পড়ছেনা। এই আঘাত পেলে শরীরে কালশিরে পড়েনা, চামড়া কেটে বা থেতলে রক্তক্ষরণ হবার সম্ভাবনাও নেই। এই আঘাতের ফলে শরীরে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত প্রমানিত হয়নি। থাকে মানসিক আঘাত এবং সেই আঘাতে আগের চিন্তাধারায় একটা পরিবর্তন আর সেই সূত্রে কিছুটা মানসিক অস্থিরতা, মানসিক কষ্ট। আমি এতদিন যা বিশ্বাস করে এসেছি তাকে ভুল বলতে চাইছে একজন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে এর বেশি কিছু পদার্থ নেই। প্রথমত কেউ বলা মাত্র কারো বিশ্বাস উবে যায়না। সুতরাং ধর্মের সমালোচনা কোথাও দেখা মাত্র সে ধর্মীয় বিশ্বাস খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে এমনটার সম্ভাবনা নেই। বিশ্বাস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে নিরপেক্ষ যুক্তিবাদী চিন্তার প্রয়োজন। এমনও দেখা গেছে অনেক যুক্তিবাদী লেখা পড়েও কেউ কেউ বিশ্বাসীই থেকে গেছে। যথেষ্ট বিজ্ঞান পড়েও জ্বীনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষ খুঁজতে বাংলাদেশে দুই পাও হাটতে হবেনা। অলৌকিকে বিশ্বাসও ভাঙ্গতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়। দুই যোগ দুই চার এর মত নিখুত অঙ্কে প্রমান করে দিলেও বেশিরভাগ মানুষই ঈশ্বর বিশ্বাস ভাঙ্গতে চায়না। একজন সহৃদয় শক্তিমান অদৃশ্য থেকে তার বিপদে আপদে সাহায্য করবে, তার প্রাপ্যেরও অতিরিক্ত তাকে পাইয়ে দিবে এই ধারনাটা মনকে একটা স্বস্তি দেয়। সাধারন মানুষ এই স্বস্তি থেকে বঞ্চিত হতে চায়না। শুধু যুক্তি নয় আত্মশক্তিতে নির্ভরশীল না হলে এই বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। লেখায় যুক্তি প্রমান অজ¯্র প্রয়োগ করা যায় তাতে দৈবশক্তি নির্ভরদের মোহচ্যুতির সম্ভাবনা ক্ষীণ। সাধারন মানুষ জানে কিভাবে যুক্তি দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলতে হয়। ধর্মের সমালোচনা কারো ব্যক্তিগত জীবনের ঈশ্বর বিশ্বাসকে শুধু যুক্তি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে পারবেনা। পারবে যদি তার নিজস্ব চিন্তা বিচার-বিবেচনা নিজের বিশ্বাসকে পরখ করে দেখতে চায়। যা বেশিরভাগ মানুষই চায়না। তারা ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের রাজত্বে বাস করতে চায়, সেই ঈশ্বরের অনুগ্রহ পেতে চায়। ধর্মের সমালোচনা পড়লেই যে মানুষ ঈশ্বরহীন হয়ে পড়বে আর তাকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নাম দিয়ে মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ বানিয়ে ফেলতে হবে এটা সম্পূর্ণই একটা অযৌক্তি ধারনা।

কিন্তু সেই অযৌক্তিক ধারনার সাহায্যে এই অযৌক্তিক দাবীই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞান বুঝুক আর নাই বুঝুক বিজ্ঞানের অজ¯্র আবিস্কারে সাধারন মানুষও মোহিত। সাধারন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার এতই বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিজ্ঞানকে না জেনেই অনেকদিন থেকেই মানুষ শ্রদ্ধা করতে শুরু করে দিয়েছে । ধর্মীয় বিষয়ে বিজ্ঞানের সাক্ষ্য-সমর্থন খোঁজার চেষ্টাতেই দেখা যায় এই প্রবনতা। আর জীবন সংগ্রামের প্রতিকুলতায় জর্জরিত সাধারন মানুষ অলৌকিকে বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলছে একটু একটু করে। জীবন যুদ্ধ যত কঠোর হচ্ছে সহৃদয় ঈশ্বরও ততই দুরে সরে যাচ্ছে। যুগের হাওয়াতেই এই বস্তুবাদিতার রেশ ভাসছে। মনের গহীন কোনায় অলৌকিক পরমেশ্বরের ধারনা আর শক্তিশালী নেই। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই নিজেকে আস্তিক দাবী করলেও অলৌকিক শক্তিতে ভরসাটা এখন অনেকখানিই নড়বড়ে। নিজের কাছেই নিজের ধর্মবোধে খাদ দেখতে পাচ্ছে মানুষ। বিশ্বাস আর দৃঢ় থাকছেনা, টলে যাচ্ছে প্রায়শই। এরকম অবস্থায় কোন যুক্তিবাদীর লেখায় ধর্মের অসারত্ব বিষয়ক প্রসঙ্গটি অস্বস্তিকর বোধ হবে। কেননা সাধারন মানুষ চায় একজন সহৃদয় ঈশ্বর তার ও তার পরিবারের দেখভাল করুক, উটকো বিপদ থেকে উদ্ধার করুক। এই অস্বস্তির বোধকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নাম দিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে। একটা বাচ্চা তার পুতুলটাকে সেধে সেধে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সেই পুতুলটাকে সে নিজের সঙ্গী ভাবে, জীবন্ত একটা সত্ত্বা ভাবতে চায়। যখন কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ বলে এটাতো জীবনহীন একটা পুতুল এটা কিছুতেই ভাত খাবেনা, তখন বাচ্চাটা কিন্তু দুরে আড়ালে চলে যাবে যেখানে এই কল্পনা ভেঙ্গে দেওয়া যুক্তির কথা তাকে শুনতে হবেনা। অথবা সেই প্রাপ্ত বয়স্ক লোকটাকেই সেখান থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। লোকটার কথায় শিশুটি যত খানি আঘাত পেল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত তার চেয়ে কোন অংশেই বড় মাপের কিছু নয়।

ধর্মীয় অনুভূতির আরেকটা দিক হলো সাম্প্রদায়িক অহঙ্কার। আত্ম অহঙ্কার মানুষের মধ্যে থাকেই কিন্তু সমাজে মানুষ একে অন্যের শ্রেষ্ঠতা এবং তা নিয়ে অহঙ্কারকে মেনে নিতে চায়না। কিন্তু দলবদ্ধভাবে অহঙ্কারের যে বোধ, তাতে দলের সবাই পুষ্টি যোগায়, সমর্থন দেয়। আমি মুসলমান সমাজের সদস্য সুতরাং আমি একমাত্র সঠিক যে ধর্ম সে ধর্মের অনুসারী। মৃত্যুর পর মুসলমান ছাড়া আর কোন ধর্মের অনুসারীকেই বেহেস্তে প্রবেশ করতে দেওয়া হবেনা, সুতরাং শ্রেষ্ঠত্বে মুসলমানদের ওপরে কেউ নেই। এই ধারনা প্রসুত সাম্প্রদায়িক অহঙ্কারের জন্য কেবল সামাজিক ভাবে মুসলমান সম্প্রদায়গত সদস্যপদ থাকলেই চলে। ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, প্রার্থনা ও সংশ্লিষ্ট আচার কতখানি পালন করা হলো তা জরুরী নয়। আমি মুসলমান সুতরাং আমি একজন হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইহুদীর চেয়ে বেশি সম্মান পাবার দাবীদার। কেউ দান খয়রাত না করেই দাতা হিসেবে অহঙ্কার করলে বিদ্রুপের মুখে পড়ে। কেউ যথেষ্ট শিক্ষিত না হয়েও শিক্ষার অহঙ্কার করলেও তার কপালে হাসি-ঠাট্টার বেশি কিছু জোটেনা। কিন্তু মুসলমানিত্বের অহঙ্কারের জন্য তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়না। এই সাম্প্রদায়িক অহঙ্কারের এই হলো সুবিধার দিক। কিছু কষ্ট, পরিশ্রম, সাধনা না করেই সম্মান পাবার এই সুযোগ যে ধর্ম তাকে দিচ্ছে তাই আঁকড়ে থাকবার চেষ্টা করা, সেই ধর্মকে যে কোন আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য প্রাণপন করা তাই প্রতিটি মুসলমানই ফরজ বলে গন্য করে। কারন এ ধর্ম তাকে বিনা খরচায় সম্মানিত হবার, অহঙ্কারী হবার একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। কেউ যখন এই ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লেখে বা এই ধর্মের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন এই অহঙ্কারে আঘাত পেয়েই সাধারন মুসলমান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মীয় অনুভূতি বলতে একটা কোমল অনুভূতি বলে যাকে জাহির করা হয় তা অনেকাংশে এই অযৌক্তি সাম্প্রদায়িক অহঙ্কার যা অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে পুষ্টি পায়। আমার মনে হয়না এহেন অহঙ্কারে আঘাত করতে কেউ বিচলিত হবে কিংবা এরকম অযৌক্তিক অহঙ্কারকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মনে করবে।

তবে আঘাত যে কোথাও লাগে এবং তা খুব বড় হয়েই বাজে তা অস্বীকার করা যাবেনা। ধর্মীয় অনুভূতি নয় আঘাতটা লাগে কারো লোভে, কারো অন্যায় স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রচেষ্টায় বাধা পড়ে বলেই। ধর্মীয় অনুভূতি নয় ধর্ম নিয়ে বৈষয়িক ফায়দা লোটার রাস্তায় বাধা পড়াতেই লাগে আঘাতটা। আমাদের মত অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধীর দেশে, যেখানে মেধা বা পরিশ্রম নয় বরং সরকারী দলের অনুগ্রহেই মানুষের রুজি-রোজগার চলে, স্বাধীন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের ব্যর্থতার সম্ভাবনা যেখানে শতকরা একশো ভাগ সেখানে ধর্ম দেশের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের রুজি রোজগারের একমাত্র উপায়। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে একধরনের ভোজবাজির যাদুকর তৈরী করে সমাজে পরজীবি হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হয় এদের। এরা তাদের ধর্মীয় ভূমিকার জোরেই উৎপাদন মুখী কর্মকা-ের সাথে জড়িত না থেকেও তার ফল ভোগ করে । জীবন সংগ্রামে জর্জরিত মানুষেরা উপরওয়ালার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে এদের মাধ্যমেই। এরা ঈশ্বর আর মানুষের মধ্যস্থাকারীর ভূমিকায় নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নেয়। এদের রুজির জন্যই ধর্মকে এরা এদের মনমত করেই প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায় সব সময়। অশিক্ষিত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে এরা যেমন নিজেদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তেমনি তাদেরকে অশিক্ষার শেকলেই বেঁধে রাখতে চায়। একটা মানুষ শিক্ষিত হলেও তাকে যদি হাজার বছরের পুরনো মানসিকতা আর বিশ্ববীক্ষায় ধর্ম পালনের অছিলায় আঁটকে রাখা যায় তাহলে শিক্ষার বারো আনাই নিস্ক্রিয় করে দেওয়া সম্ভব। ঠিক এখানেই এদের স্বার্থের সাথে আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ মিলে যায়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও চায় দেশের মানুষ মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে থাকুক। সমাজে বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে ওঠার চেয়েও জরুরী একান্ত বশংবদ হয়ে থাকা। আর এই জন্যই ধর্মকে ছাড়া এদের চলেনা। ধর্ম আত্ম সমর্পন করতে শিক্ষা দেয় আর এই শিক্ষাটা শাসক শ্রেনীর জন্য প্রতিটি যুগেই লোভনীয় একটা অস্ত্র বলে গন্য হয়েছে।

আমরা দেখি আমাদের বৃহৎ দুইটি রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই নিজেদের দলের বা দলের নেতাদের কর্মকা- নিয়ে কোন সময়ই কোন ধরনের প্রশ্ন তোলেনা। দলের মধ্যে আত্ম-সমালোচনার কোন চর্চা নেই। যা আছে তা নিখাদ ভক্তি। আমি যে দল করি তার নেতার সমস্ত নির্দেশ আমি মাথা পেতে, বিনা প্রশ্নে মেনে নেব। শুধু সদস্য নয় এই দু’দলের সমর্থকরাও নিজের সমর্থিত দলের কর্মকা-ের ব্যাপারে কখনওই বিচার, বিবেচনার প্রয়োগ করেনা। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নয় এমন একজন বন্ধু বিএনপির সমর্থক। সে কিংবা তার পরিবারের কেউই কখনওই আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়নি, আওয়ামীলীগ ভালো কাজ করলেও তারা কখনওই আওয়ামীলীগকে সমর্থন করবেনা এটা স্পষ্টই বলে। এটাকি রাজনৈতিক বোধ না অন্ধ ভক্তি? এধরনের অন্ধ ভক্তিই আমাদের দেশে রাজনীতির নামে চলছে। এইতো কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের নব্বইভাগ রাজনীতি সচেতন মানুষ আমরা বাঙ্গালী না বাংলাদেশী এই তর্ক করেই বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। কোন দল দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য কি করলো, বা কি করতে পারতো, বা কেন করলোনা এসব প্রশ্নের দিকে তাদের মন যেতনা। দেশের নাগরিক যদি এরকম ভক্তিমান হয় তবেই না শাসক হয়ে মজা। শাসন কর্তার তখন কোন কাজের জন্যই জবাবদিহিতা করতে হয়না। সোনার দেশের সোনার মানুষরা ভক্তিমান হবে রাজনীতি সচেতন হবেনা। এই শিক্ষাটা ধর্মই প্রথম নাগরিকদের মাথার ভেতর পুরে দেয়। আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে ধর্মের প্রতি আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত অসহ্য ঠেকে। চাপাতির কোপে ছিন্নভিন্ন শরীরের কষ্টের চেয়ে বায়বীয় ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাতেই তাই শাসক গোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন দেখি সব সময়।

ধর্মীয় অনুভূতি বা সে অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত বোলচালের মধ্যে মস্ত একটা ফাঁকি আছে তা ভক্তিমানদের উপলব্ধীতে আসেনা। অযৌক্তিক সাম্প্রদায়িক অহঙ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলে সে উপলব্ধী অর্জনও সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের সবাই ভক্তি দিয়ে সমস্ত দেখেনা। অনেক দিন হলো তরুণদের একটা অংশ যুক্তি দিয়ে দেখতে শিখেছে। এরা যখন অন্যকেও যুক্তি দিয়ে দেখতে শেখাতে চায় তখন তা অনেকের পক্ষেই ভালো লাগবেনা। ধর্মীয় অনুভূতিতে এখানেই আঘাত লাগে আর সে আঘাতটাকে নৃশংস মৃত্যুর চেয়েও বড় করে দেখানো হয়। যারা বিশ্বাস করেন তাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম তাদের ভয় পাবার কি আছে। যত সমালোচনাই করা হোক সত্য হলে ধর্মের তাতেতো বিন্দু মাত্র ক্ষতি হবার কথা নয়। একমাত্র একটা মিথ্যাকেই পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। মিথ্যাকে কেউ সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করলে সেই মিথ্যা নিয়ে যে বা যারা প্রশ্ন তোলে তাদের সে সহ্য করতে পারেনা, প্রশ্নকারীদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সত্য ধর্মের অনুসারী তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে বিচলিত হবেনা। সমালোচনাকারীকে বালখিল্য জ্ঞান করে করুণা করবে, ভাববে ধর্ম যেহেতু সত্য সুতরাং আজ যারা ধর্মের সমালোচনা করছে তারাও একদিন তাদের ভুল উপলব্ধী করবে এবং সে সত্যকে তারাও একদিন মেনে নেবে। কিন্তু নিজের কাছেই যদি নিজের বিশ্বাসকে খেলো মনে হয়, নিজের ধর্মের উপর বিশ্বাস করতে নিজেরই মনের জোর আসেনা বা এরকম মনে হয় যে যাতে বিশ্বাস করা হচ্ছে তা একটা কোমল, বায়বীয়, স্পর্শকাতর ধোঁয়াটে একটা বস্তু যা একটুখানি প্রশ্ন বা যুক্তির ফু’য়ের বাতাসেই তছনছ হয়ে যাবে একমাত্র সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেলে আঘাতকারীকে চিরদিনের মত নিশ্চুপ করিয়ে দিতে চাইবে কারন এছাড়া তার ধর্মকে, মিথ্যা বিশ্বাসকে সে কিছুতেই টিকিয়ে রাখতে পারবেনা। যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে এই ওজুহাতে মানুষ খুন করে, যারা খুনের চেয়েও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকেই বড় অপরাধ বলে মনে করেন তারা কোন মতেই নিজের আচরিত ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করেননা, ধর্ম নিজের সত্যের ভরে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে এ ভরসাও তাদের নেই।