The Usual Suspect সিনেমার একটা সংলাপ খুবই জনপ্রিয়– The greatest trick the devil ever pulled was convincing the world he did not exist.

ছোটবেলা থেকেই সবচেয়ে বড় যে Trick টা আমাদের সাথে করা হয়েছে তা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। যদিও আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, তারপরও এই দেশে একসাথে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকে, প্রত্যেক মানুষ অন্য মানুষের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে—এরকম কথা শুধু আমাদের পাঠ্যপুস্তকেই না, পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন আলোচনা সহ সব জায়গাতেই করা হয়। এবং আমার মনে হয় যে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-এমন ক্লিশেটাই হচ্ছে এই দেশের সাম্প্রদায়িক মানুষগুলার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ধরুণ, কোন লেখক বা বুদ্ধজীবী কোন আলোচনায় দাবি করলেন যে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়-তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারকে বিচ্ছিন্ন ও গুটিকয়েক মানুষের কার্যাবলি দাবি করে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে, বলবে এই ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে খাটো করা উচিত নয়। সাম্প্রদায়িকতার বীজ যে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেইটাকে অস্বীকার করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ট্রিক আমাদের! আমি নিজেও দেখেছি যে আমি যদি কোন পুজা মন্ডপ ভাঙ্গার নিউজ ফেসবুকে শেয়ার দেই তখন অনেক সুশীল চিন্তাধারার মানুষই বলার চেষ্টা করে যে এগুলা আসলে গুটিকয়েক মানুষ করেছে, ঐ গুটি কয়েক মানুষএর কর্মকান্ডের জন্য বাংলাদেশের আপামর জনতাকে দোষী সাব্যাস্ত করা ঠিক হবে না, বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের ‘অনেক দেশের চেয়ে’ অসাম্পদায়িক, কাজেই এতো হতাশ হওয়ার কিছু নেই, ঐতিহাসিকভাবে আমরা অসাম্প্রদায়িক, কাজেই এই ঘটনা দিয়ে পুরো জাতিকে বিচার করা ঠিক হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ধরণের আর্গুমেন্টে কয়েকটি সমস্যা আছে।

১)মূল সমস্যা, এই আর্গুমেন্ট হচ্ছে ডেনায়াল আর্গুমেন্ট, প্রথমত গুটিকয়েক মানুষের কর্মকান্ড বলে ঘটনার গুরুত্ব আপনি কমিয়ে দিলেন, আর এই ডেনায়াল আর্গুমেন্টের মূল বেজলাইন হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত একটি মিথ-বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র।

২) বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের ‘অনেক দেশের চেয়ে’ অসাম্প্রদায়িক—এই কথার মাধ্যমে আপনি বুঝালেন অন্যান্য রাষ্ট্রেও যখন এরকম হয় তখন বাংলাদেশে এরকম ১-২ টা ঘটনা ঘটতেই পারে। বরং বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রয়িক রাষ্ট্র বলে এখানে এই ধরণের ঘটনা কম হচ্ছে। সুতরাং এতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু নাই ভাই, চুপচাপ থাকেন, মুড়ি খান।

অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, এই কথাটা বলে আসলে আপনি কিন্তু একটা বড় অন্যায়ের গুরুত্ব নিমেষের মধ্যে অনেকখানি কমিয়ে ফেললেন। অন্যভাবে বলা যায়, দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতার অত্যন্ত দৃশ্যমান রূপকে আপনি ভুলিয়ে দিতে পারলেন একটা সুন্দর বাক্যের আড়ালে। আর। আর এভাবেই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ এই সুন্দর কথায় সবাইকে খুশি রাখতে রাখতে সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু অগোচরে ঠিকই বিস্তার লাভ করে বসে আছে!! And this devil has spread by making us believe that it does not even exist! ইউজুয়াল সাসপেক্ট সিনেমার কোটেশনটা এখানেই প্রাসঙ্গিক!

আমরা যারা সেকুলার চিন্তাধারার মানুষ তারা কখনও কখনও একটু জোর দিয়ে বলবার চেষ্টা করি যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক, এটাই গণমানুষের চাওয়া পাওয়া ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামের যে নিরীহ কৃষকটি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহনের পেছনে ‘একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ গড়ার চেতনা কতখানি কাজ করছিল তা আমরা জানি না। সবাই কিন্তু অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করার জন্য যুদ্ধ করেন নি। তারা যুদ্ধ করেছিলেন কারণ তারা নিজেরা আক্তান্ত হয়েছিলেন বলে। এতে আমি নেতিবাচক কিছু দেখি না, আমার পয়েন্ট হচ্ছে, যুদ্ধের মোটিভেশন একেকজনের কাছে একেক রকম ছিল। বঙ্গবন্ধু তার পুরো ছাত্রজীবনে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করে গেছেন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হোক আর যে কারণেই হোক, সে সময় ছাত্ররাজনীতিতেও সেকুলার চর্চার প্রাধান্য ছিল, দেশে একটা শক্তিশালী বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ছিল যারা অসাম্প্রদায়িকতার চর্চাকে প্রমোট করত, অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে এসে একটা সেকুলার রাষ্ট্র নির্মাণ করার মোটিভ হয়তো এই শ্রেণীর ছিল, তার মানে কিন্তু এই না যে দেশের আপামত জনগোষ্ঠী এই ইস্যুতে এক ছিল। তারপরও বঙ্গবন্ধু সকলকে একই দন্ডে দন্ডায়মান করতে পেরেছিলেন কারণ জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি দরকার, অর্থনৈতিক সাম্য, সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়াটা দেশের একটা বড় অংশের মানুষের কাছেই প্রায়োরিটি ছিল না, ছিল না বলেই যে বীর বাঙালি পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হল, সংবিধানের সুন্নত-ই-খাৎনা করার পর তাদের সেরকম কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। অনেকে বলবেন সেসময় দেশের বিরাজমান অবস্থা তো প্রতিকুল ছিল, জনগণকে একতাবদ্ধ করার জন্য কোন রাজনৈতিক শক্তি ছিল না-কথাটা যৌক্তিক, কিন্তু সেটা পুরোপুরি বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা নয়, রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা এবং সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহিম সংযুক্ত করা বিষয়ে যদি দেশের মানুষের কাছে বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা না থাকতো তাহলে জিয়া-এরশাদের পতনের পর, বিশেষত আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর খুব সহজেই সেই ভুলগুলো শুধরে নেয়া যেতো। আর এই ২০১৫ তে এসে আওয়ামীলীগ তো আরও অনেক চালাক হয়ে গেছে, আগে যে তাও নীতিগতভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দূরে রাখার চেষ্টা করত এখন সেটাও করে না, বরং দেশের মানুষের কাছে কিভাবে আরও বেশি টুপি পড়ে হাজির হওয়া যায় সেই চেষ্টায় লিপ্ত। কাজেই জাতিগতভাবে আমরা কখনই খুব একটা অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না অনেক আগে থেকেই, আর এখন বেশ দ্রুতগতি সাম্প্রদায়িকতার চরম দিকে ধাবিত হচ্ছি।

প্রকাশ্যে হোক অপ্রকাশ্যে হোক, ধর্মীয় নীচতা থেকে আমরা যে কখনই বাইরে ছিলাম না তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে খুব শক্তভাবে বলেছিলেন—আমি বাঙালি, আমি মুসলমান!! কেন বলেছিলেন তিনি ঐ কথা? উনার রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে তো আমরা তার রাজনৈতিক নীতির উপর ধর্মের খুব একটা প্রভাব তো দেখি না। উনার অসমাপ্ত আত্মজীবনীও সাক্ষী দেয় উনি সেকুলার রাজনৈতিক চর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন, তারপরও কেন তাকে বলতে হল এই কথা? কারণ এই দেশের মানুষের কাছে তার প্রমাণ করবার দরকার হয়ে পড়েছিল যে তিনি একজন মুসলমান। এদেশের মানুষ যদি অসাম্প্রদায়িকই হবে তবে কেন জাতির জনককে পর্যন্ত মুসলমানিত্বের প্রমাণ দেখাতে হবে??

আরেকটি উদাহরণ দেই। সম্প্রতি জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় লিটন দাস ফেসবুকে পুজার শুভেচ্ছা জানিয়ে সাম্প্রদায়িক কটুক্তির শিকার হয়েছিল। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই যে সে খুব কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল এবং বলেছিল-আমি আগে বাংলাদেশি, তারপর হিন্দু। ‘আগে বাংলাদেশি পরে হিন্দু’ এই কথাটাকে স্যেলুট দেয়া উচিত। কিন্তু ব্যাপারটাকে যদি একটু অন্যভাবে দেখি, একজন হিন্দু হয়ে তাকে প্রমাণ দিতে হচ্ছে যে সে আগে বাংলাদেশি, তারপর তার ধর্মবিশ্বাস। কিন্তু এই দেশের কয়জন মুসলমান জোর গলায় বলবেন, আমি আগে বাংলাদেশি, তারপর মুসলমান?? ধর্মীর পরিচয়ের আগে আমার দেশের পরিচয়?? কেউ বলবে না। প্রথমত, কেউ এটা বিশ্বাসই করে না, ২য়ত কেউ বিশ্বাস করলেও সেটা বলার সাহস করবে না। এমন কথা কিন্তু পাকিস্তানি দানিশ কানেরিয়াকে বলতে হয়েছিল, তাকে বলতে হয়েছিল সে আগে পাকিস্তানি, তারপর হিন্দু। যদিও এতে তার গালি খাওয়া কিছুই কমে নাই। লিটন দাসও তাই আমাদের দেশের মানুষের কাছে হিন্দু হিসেবেই থেকে যাবে, বাংলাদেশি হয়ে থাকবে তার ২য় পরিচয়। এই দেশে সংখ্যালঘুদেরই প্রমাণ করে যেতে হয় যে তারা এই দেশকে ভালবাসে, সংখ্যাগুরুদের সেই বাধ্যবাধকতা নেই।

অসাম্প্রদায়িকতার ক্যান্সারের বিস্তৃতি বোঝা যায় অভিজিৎ রায় আর দীপন হত্যার ঘটনা থেকে। দুজনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনামধন্য শিক্ষক। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে একেবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই। মুক্তমনা লেখক হত্যার জন্য না হলেও, অন্তত সহকর্মীর সন্তান হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কিন্তু বিক্ষোভে ফেটে পড়বার কথা ছিল। অভিজিৎ হত্যার পর এরকম কিছু হয় নি, দীপন হত্যার পর ঢাবি শিক্ষক সমিতি নামকাওয়াস্তে একটা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে মাত্র। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠের দুজন শিক্ষকের সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করা হল, সেখানকার শিক্ষক কিংবা ছাত্র সম্প্রদায়ের তো বিক্ষোভে ফেটে পড়বার কথা ছিল। উলটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক টকশোকে আয়-রোজগারের প্রধান উৎস বানিয়ে ফেলেছেন তারা উপদেশ দিচ্ছেন কি লেখা যাবে আর কি যাবে না!!! অভিজিৎ রায় বুয়েটের ছাত্র ছিলেন। একজন একাডেমিশিয়ান ও সফল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি বুয়েটের গর্ব। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বুয়েটেই বা সেই রকম প্রতিক্রিয়া কই? প্রতিক্রিয়া যে হয়নি তা না, বেশ কিছু ছাত্র (বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে যে সংখ্যাটা more than usual!!) তারা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে, আমি সিউর এই কয়জন মানুষকেও ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না, কারণ আজকে লেখকের মারা হচ্ছে, কালকে প্রতিবাদকারীদের মারা হবে, আমাদের ফারুকীরা বলবেন প্রতিবাদকারীদের মারা ঠিক হয়নি, কিন্তু তাদেরও প্রতিবাদ করাটাও ঠিক হয় নি!!!! আর অন্যদিকে দেশের সকল আন্দোলনের সূতিকাগার ৪০,০০০ শিক্ষার্থীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা খুজেই পাচ্ছি না এখন। দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণ যদি এমন হয় তাহলে সাধারণ পর্যায়ে মানুষের মনোভাব কি সেটা সহজেই অনুমেয়।

দেশে এখন হুমায়ুন আজাদ নেই, নেই আহমদ ছফা যিনি ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধ হবার পর নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বইটি বিক্রি করেছিলেন। দেশে এখন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নেই, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদদের মত মানুষ যাদের হওয়া উচিত ছিল আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর তারা এখন রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় বন্দী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পেয়েছে তার যোগ্য উত্তরাধিকার-নূড়া ডাক্তার আবদুন নূর তুষার, আর প্রজন্মের কাছে জাতীয় বিবেক হচ্ছে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীরা। যার কাছে প্রজন্ম লিটনের ফ্ল্যাট চিনেছে তার কাছেই এখন ধর্ম শিক্ষা লাভ করে। কারণ এদেশের মানুষেরা তো আসলে শেষমেশ ওই লিটনের ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়া সবচেয়ে বড় ধার্মিক! যে দেশের মানুষেরা লিটনের ফ্ল্যাটেও যায় আবার ধর্ম কর্মও করে সেদেশে হুমায়ুন আজাদরা শুধুই অতীত। সাম্প্রদায়িকতা নেই নেই বলে সকলকে ধোকা দিয়ে প্রকারান্তে সাম্প্রদায়িকতারই চর্চা হয় এই দেশে, হয়ে এসেছে, ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর আকারে হবে।

কাজেই জাতি হিসেবে আমরা কখনই খুব একটা অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না। সংখ্যাগুরুত্বের জান্তব মানসিকতা অনেক আগে থেকেই আমাদের মাঝে ছিল, ‘অসাম্পদায়িক বাংলাদেশ’ হচ্ছে একটা কল্পিত শব্দমালা, একটা মিথ, একটা মিথ্যা সান্ত্বনার বাণী, সত্যকে অস্বীকার করার বাণী।