আমরা জানি, আমরা বুঝে গেছি, বাংলাদেশে এপর্যন্ত যতজন নাস্তিক লেখক ও প্রকাশক খুন হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের খুনের বিচার চাওয়া মানে বৃথাই বাক্য ও সময় ব্যয়। বাংলাদেশ সরকার ইসলামিস্টিদের দাবীতে বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করেছে ইসলামিস্ট খুনিদের প্রত্যক্ষ প্রকাশ্য সমর্থক ও উৎসাহদাতা হিসেবে। এ পর্যায়ে এই ব্যাপারে ভিকটিমদের সরকারের কাছে সাহায্য চাওয়া মানে শেয়ালের কাছে মুরগির বাচ্চার আশ্রয় প্রার্থনা।

ইসলামি সন্ত্রাসীদের হাতে প্রকাশ্য জনতার ভীড়ে, পুলিশের উপস্থিতির অদূরে অভিজিৎ রায় খুন হবার পরে প্রগতিশীল মুসলমান আব্দুন নূর তুষার লিখেছিলেন, ” সন্ত্রাস কি শুধুই শারীরিক? সন্ত্রাস মানসিকও হতে পারে।” তার মানে হচ্ছে অভিজিৎ বিজ্ঞানের কথা লিখে, মানবতার কথা লিখে, সাহিত্যের কথা লিখে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখে, ধর্মগুলির বিরুদ্ধে লিখে সন্ত্রাস করেছিলেন! আর এজন্যই তাকে হত্যা করা জায়েজ? অভিজিৎ কি জীবনে কাউকে হত্যা করেছিলেন? কিংবা তার কোনো লেখায় কাউকে হত্যা করার কথা লিখেছিলেন? কিংবা হত্যা করার জন্য উসকানি দিয়েছিলেন? সাবা জীবন তিনি মানুষের অধিকারের পক্ষে লিখেছেন, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন লেখালেখির মাধ্যমে। এজন্যই কি ইসলামি সন্ত্রাসীদের তাকে হত্যা করা ফরজ হয়ে গিয়েছিল?

এপর্যন্ত বাংলাদেশে যতজন নাস্তিক লেখক ও প্রকাশককে খুন করা হয়েছে তাদের কেউ কি জীবনে খুন করেছিলেন? কিংবা খুন করার কথা বলেছিলেন? কেন তাদেরকে খুন করা হলো? তারা ধর্মের, বিশেষ করে ইসলামের সমালোচনা করেছিলেন বলে? ইসলামের সমালোচনা কেন করা যাবে না? ইসলামের কেতাবে বলা হয়েছে, চুরি করলে মানুষের হাত কেটে ফেলতে, বলা হয়েছে – প্রেম করলে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে, বলা হয়েছে – অবাধ্য হলে বৌকে পেটাতে, বলা হয়েছে – অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব না করতে, বলা হয়েছে – দাসীদেরকে সম্ভোগ করতে, বলা হয়েছে – শিশুবিবাহের পক্ষে, মসলিম পুরুষদের বলা হয়েছে- বহুবিবাহ করতে, বলা হয়েছে – কন্যাসন্তানদের সম্পদ কম দিতে, বলা হয়েছে – সাক্ষীর ক্ষেত্রে একজন পুরুষের সমান দু’জন নারী। তাও যদি দুইজন পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায়। এরকম আরো অজস্র অজস্র। যারা কেতাবের অনুবাদ পড়ে জানতে পেরেছে এসব অমানবিক অন্যায় কথায় কেতাব পূর্ণ তাদের অনেকেই কর্তব্য অনুভব করে, যারা এসব জানতে পারেনি তাদের জানানোর।
তারা কর্তব্য বোধ করে মানুষকে বলার ঃ চুরি করলে মানুষকে হত্যা করা অমানুষিক। তার জেল-জরিমানা হতে পারে চুরির মাত্রা ভেদে। একটা অঙ্গ কেটে ফেলে দিয়ে তাকে পঙ্গু করে দেওয়া কোনো সভ্য বিচার নয়।

দু’জন মানুষের মধ্যে প্রেম একটি অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার। এজন্য তাদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা অমানবিক।

স্বামী-স্ত্রী সরস্পরের জীবনসাথী, বন্ধু। এই সম্পর্কে একে অপরকে সম্মান করবে সমানভাবে। এখানে বাধ্যতা-অবাধ্যতার প্রশ্ন কেন? স্ত্রীকে সবসময় স্বামীর একান্ত বাধ্যগত হয়ে থাকতে হবে কেন? সে কি নিষ্প্রাণ যন্ত্র? মনোমালিন্য সব সম্পর্কেই হতে পারে। সেজন্যও স্বামীকে কেন বলা হবে অবাধ্য হলে স্ত্রীকে পেটাতে? মনমালিন্য হলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত, পেটানো নয়। আল্লা কিংবা কোনো ধর্মের প্রবর্তক কিভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে উৎসাহ দেয় আরেকজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে পেটাতে?

অমুসলিমদের সাথে কেন বন্ধুত্ব করা যাবে না? সেই যুক্তিতে ত এই বিশ্বায়নের যুগে মুসলিম দেশগুলির কোনো অমুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। সকল মুসলিম পিতামাতার উচ্চিত তাদের সন্তানদের বলে দেওয়া, কোনো অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করবি না খবরদার!

একজন মেয়ের কেন তার কর্মক্ষেত্রে সম্মান থাকবে না? কেন সে তার সম্ভ্রম রক্ষা করে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারবে না? কেন কেতাবে লেখা আছে, দাসীদের সম্ভোগ করতে? ইসলামে দাসীদের মানবাধিকার কোথায়? দাসী বলে কি তার মানবাধিকার থাকবে না? তাহলে ইসলামে শ্রমের বা শ্রমিকের মর্যাদা কোথায়? দাসীর মর্যাদা কোথায়?

একটা শিশু হেসে খেলে বড় হবে। পড়াশোনা করবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ে করতে চাইলে করবে। তাকে শিশুবয়সে বিয়ে দেয়া হবে কেন?

পুরুষরা এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় অরো বিয়ে কেন করবে? এতে করে বর্তমান স্ত্রী’র উপর অন্যায় করা হয় না? এতে পরিবারের শান্তি বিনষ্ট হয় না?

কন্যাসন্তানরা কেন পুত্রসন্তাদের অর্ধেক সম্পদ পাবে? কেন একজন কন্যা একজন পুত্রের সমান সম্পদ পাবে না?

সাক্ষীর ক্ষেত্রে কেন একজন নারী একজন পুরুষের অর্ধেক? তাও দুইজন পুরুষ না পাওয়া গেলে!

একথাগুলি মানুষকে লেখালেখির মাধ্যমে মানুষকে জানাতে গেলেই খুন হয়ে যেতে হবে? বাংলাদেশে ধর্ম প্রচারের অধিকার আছে। নাস্তিকতা প্রচারের কেন অধিকার নেই? তাবলিগে গিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য কি কাউকে খুন হতে হয়েছে আজ অবধি? তাহলে নাস্তিকদের কেন খুন করা হচ্ছে? যে মানুষ ইসলাম প্রচার করে সে মূলত কী প্রচার করে? বৌ পেটাও, দাসী সম্ভোগ করো, মানুষের হাত কাটো, পাথর ছুঁড়ে মানুষ মারো ইতাকার এসবই তো? নাকি অন্য কিছু? এসবে বিশ্বাস ও সম্মান আছে বলেই ত সে ধর্ম প্রচারে যায়। এসব ওরা নিজেরা বিশ্বাস ও পালন করতে পারে এবং অন্যান্যদেরও তাদের বিশ্বাসে সামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারে স্বাধীনভাবে। একজন নাস্তিক কেন প্রচার করতে পারে না এসব অমানবিকতার প্রতি তার অবিশ্বাস ও অনাস্থার কথা?

ধর্মের সমালোচনার জন্য লেখকদের খুন করা হচ্ছে। শুধু ইসলামিস্টরাই এই খুন করছে। অন্যান্য ধর্মেরও তো সমালোচনা করেছেন এসকল লেখকরা। অন্য কোনো ধর্মালবম্বী তো খুন করছে না? শুধু ইসলামিস্টরাই কেন খুন করছে?

অনেক শিল্প-সাহিত্যানুরাগী ও স্বঘোষিত প্রগতিশীলকে বলতে শুনি, ব্লগাররা দেশের আর কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবে না কেন? আর কোনো সমস্যা নিয়ে লিখে না কেন? শুধু ধর্মের পিছনে লেগে আছে কেন? ধর্মে বিশ্বাস না করলে না করে কিন্তু তার অবিশ্বাসের কথা মানুষকে বলতে যায় কেন? আমি তাদের বলি, নাস্তিক ব্লগারেরা ধর্ম ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও অন্যান্য সমস্যা নিয়েও লিখেছে অনেক অনেক। তাদের সবগুলি লেখা কি আপনারা পড়েছেন? অথবা অন্য কোনো বিষয়ে না লিখলেই কি তাদের কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে? অবিশ্বাসের কথা কেন বলা যাবে না, কেন প্রচার করা যাবে না যদি বিশ্বাসের কথা বলা যায় ও প্রচার করা যায়? অবিশ্বাসীরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলেই কি?

তারা আরো বলে থাকে, নাস্তিক ব্লগারেরা বাংলাদেশের কি কি বৈষয়িক উন্নতিতে অবদান রেখেছে? অভিজিৎ একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বাংলাদেশের কি কি বৈষয়িক উন্নতি সাধন করেছে? আমি তাদের বলি, অভিজিৎ ও অন্যান্য নাস্তিক ব্লগারেরা বাংলাদেশের মানুষের মানসিক উন্নতি সাধন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে লেখার মাধ্যমে। একেকজন মানুষ একেক ভাবে কাজ করে, একেকভাবে অবদান রাখে সমাজে। ব্লগাররা লেখার মাধ্যমে কাজ করে। তাই বলে আমরা বাংলাদেশের বৈষয়িক উন্নতি চাই না – তা তো নয়। অন্যান্য সমস্যা নিয়েও তো আমরা লিখি। মানুষকে বিজ্ঞানের কথা বলা, মানবতার কথা বলা, সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা – এগুলো কি সমাজের ও মানুষের মঙ্গলের জন্য নয়? এগুলো কি কোনো অবদান রাখা নয়? আর একজন মানুষ দেশের বৈষয়িক উন্নতিতে অবদান না রাখলেই কি তাকে মেরে ফেলতে হবে? পৃথিবীতে অবদান রাখেন দু-একজন। আমরা বাকিরা তাঁদের অবদানের সুফল ভোগ করি। বিদ্যুৎ আবিস্কার করেছেন একজন আমরা বাকিরা তার সুফল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন একজন আমরা বাকিরা এর সুফল ভোগ করছি। অবদান যারা রাখেনি, রাখতে পারেনি তাদেরকে কি খুন করে ফেলতে হবে?

কেউ অন্যায় দেখে চুপ করে থাকতে পারে। কেউ পারে না। প্রতিবাদ করে। চুপ করে থাকা ভালো আর প্রতিবাদ করা, আওয়াজ তোলা অন্যায়? ধর্মগ্রন্থের অন্যায় কথাগুলি পড়ে নীরবে ধর্মত্যাগ করে চুপ করে থাকলে অন্যায় না। কিন্তু ধর্মগ্রন্থের কথাগুলি মানুষকে বললেই অন্যায়? এজন্য খুন করা জায়েজ? তাও ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে দেশে?

একেকজন লেখক খুন হয়ে যায়। সরকার, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, বড় বড় লেখকদের অনেকেই সবই সকলেই নির্বিকার। অনেকেই খুশি। একেকটা রক্তে লেখা ইতিহাস রচিত হয়। কলমের কালির আর দরকার নেই বাংলাদেশে। নাস্তিকদের রক্তের সাগরে কলম ডুবিয়ে বাংলাদেশ লিখে যাবে তার রক্তে ডোবা ইতিহাস। বৃষ্টির আর দরকার নেই বাংলাদেশে। নাস্তিকদের রক্তে ফসল ফলবে বাংলার মাটিতে। উৎপাদিত হবে আরো অজস্র অজস্র অজুত নিজুত খুনি। জলের নদীর আর দরকার নেই বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পান করবে নাস্তিক লেখকদের রক্ত। বাংলাদেশ এখন নাস্তিক লেখকদের রক্তপায়ী, নাস্তিক লেখকখেকো ভূখণ্ড।

মুক্তমনার ইংরেজি সাইটে যারা লিখেন, এবং যাদের ইংরেজি ভাষায় দখল আছে তাদের কাছে আমার অনুরোধ, বাংলাদেশে আমাদের অবস্থা ও এই ঘটনাগুলি লিখে পৃথিবীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দিন। দিতে থাকুন, লিখতে থাকুন। সারা পৃথিবীর মানুষের নজরে আনতে থাকুন। আমাদের এখন আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকা্র সংস্থাগুলির সাহায্যের প্রয়োজন। তুষার কি বলল, শেখ হাসিনা কি বলল, সৈয়স শামসুল হক কি বলল, ফারুকি কি বলল তা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। যতক্ষণ সময় পান এই ঘটনাগুলি সবার কাছে ছড়িয়ে দিন। সাহায্য প্রার্থনা করুন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাছে।