লেখকঃ পলাশ পাল

‘উৎসব’ শব্দটির মধ্যে একটি সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের সেখানে অংশগ্রহণ হবে স্বতঃস্ফূর্ত। পরিসর বা ব্যাপ্তি ছোট কিংবা বড়ো যাই হোক না কেন, সকল মানুষের কাছে তা হতে হবে সমান গ্রহণযোগ্য। যদিও ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান উৎসবের সর্বজনীনতাকে অনেকটাই ব্যহত করে। ধনীর গৃহে যেভাবে উৎসবের আয়োজন জাঁককমকপূর্ণ হয়, দরিদ্রের কুটিরে তা থাকে যথেষ্ঠ ম্রিয়মান। সুবিধাভোগীরা উৎসব নিয়ে যতটা আমোদিত হয় সুবিধাবঞ্চিতরা ততটাই নিস্পৃহ। ঈদ, দুর্গাপুজো কিংবা বড়োদিন সমস্ত সম্প্রদায়গত অনুষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। তাই উৎসবের সর্বজনীন আবেদন এখানে কতটা ধরা দেয়, সেটা নিঃসন্দেহে একটি বিতর্কের ব্যাপার।

দুর্গাপুজো, ঈদ কিংবা বড়োদিন যে কোনো সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সর্বজনীন উৎসব বলার একটা প্রবণতা বহুদিন ধরেই প্রচলিত। ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে, সম্প্রদায়গত অনুষ্ঠানকে উৎসব হিসাবে মান্যতা দেওয়ার মধ্যে এক ধরণের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে। কেননা- কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের পরিচয় দিয়ে কোনো জাতির পরিচয় নির্ধারণ হয় না। একটি জাতির মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান থাকে। তাই একটা সম্প্রদায় কোনোভাবেই গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এবং করা উচিত-ও নয়। বরং এই প্রবণতা অতি বিপজ্জনক। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অলিখিতভাবে মান্যতা দেওয়া হয়। ফলে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা অধিক সুবিধা পায়, অন্যদিকে সংখ্যালঘুরা পড়ে থাকে পিছনের সারিতে। যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরোধী। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উৎসব বলার মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষকে একাত্ম করার একটা শুভ প্রচেষ্টা থাকলেও এই অনুষ্ঠান আবার মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের প্রাচীর তৈরি করে। পুজো, ঈদ বা বড়োদিন এলেই সকলের মধ্যেই সম্প্রদায়গত অনুভূতিগুলি ফিনকি দিয়ে ওঠে। জাতিগত পরিচয় নয়, সম্প্রদায়গত পরিচয় তখন অধিক প্রকট হয়।

বলা হয়ে থাকে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল শারদীয়া উৎসব তথা দুর্গাপুজো। প্রশ্ন থেকে যায়, হিন্দু আর বাঙালির সংজ্ঞা কী অভিন্ন? ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন চরমপন্থী রাজনীতিবিদ্‌দের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন, দেশমাতৃকাকে দেবি হিসাবে বন্দনা এবং তাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মুসলিম নেতাদের হিন্দু বিদ্বেষনীতি দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভ্রুন প্রসব করেছিল। জন্ম নিয়েছিল হিন্দু মহাসভা কিংবা মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ। হিন্দুত্ববাদ ও দ্বিজাতি তত্ত্ব তারই উর্বর ফসল। একই কথা খাটে ঈদ বা বড়োদিনের ক্ষত্রেও। অনেক দেশেই এগুলিকে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা সকল দেশের ক্ষত্রেই এই দুষ্ট প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে ধর্মীয় অনুভূতিগুলিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ততটা গুরুত্ব না দেওয়া হলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে একরকম উৎসবের স্বীকৃতি দেওয়ার রীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে।

অথচ যে কোনো দেশের স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস কিংবা সংহতি দিবস— অনেক বেশি পরিমানে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার। এই ধরনের অনুষ্ঠান বা উৎসবের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের পরিবর্তে জাতিগত চেতনা জেগে ওঠে। ধর্মীয় সংহতির বদলে জাতীয় সংহতি প্রকাশ পায়। দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্যবোধ তৈরি হয়। উৎসবের সর্বজনীন আবেদন-ও বহুলাংশে সার্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও সত্যি, দেশে দেশে সম্প্রদায়গত উৎসব নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যতটা মাতামাতি হয়, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে ততটা নয়। নাগরিকদের ব্যক্তিগত খরচের কথা না-হয় বাদ দিলাম, আধুনিক রাষ্ট্রগুলি সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পশ্চাতে যতটা তার জাতীয় সম্পদের অপচয় করে তার সিকিভাগ এই সমস্ত জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রচারে ব্যায় করতে আগ্রহ দেখায় না। ভারত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই সম্পদ সার্বিক জনকল্যানে ব্যায় করলে রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক দূরাবস্থা অনেকটাই বদলে যেতে পারত। নৈতিকতা ও আইনগত দিক থেকেও প্রশ্নটা উঠতে পারে—রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজে লাগানো বা ব্যায় করার নীতি কী আদৌ গ্রহণযোগ্য?
যদিও আধুনিক রাষ্ট্রগুলি আবার খুব জোরের সঙ্গেই দাবি করে—রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার। কথাটা যে একধরনের ভরং তাতে সন্দেহ কিছু নেই। ধর্ম যদি যার যার হয় তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বেলায় রাষ্ট্রের এতো মাতামাতি কেন? বরং রাষ্ট্রের উচিত ধর্মকে নিরুৎসাহিত করা। কোনো ধর্মীয় কাজে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করলে তার ওপর কর আরোপ করা। ইদানিং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রহ বাড়ছে। পুঁজি লগ্নির অন্যতম আকর্ষনীয় কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি। উদ্দেশ্য, বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন। তথাকথিত সর্বজনীন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও সেই লগ্নির অন্যতম অংশীদার। উভয়ের এই আঁতাতের ফলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে এক ধরণের বানিজ্য। এতে লাভবান হচ্ছে দুপক্ষ-ই। অথচ উভয় ক্ষত্রেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের যতেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই বানিজ্য করের আওতায় আসা একান্তভাবে প্রয়োজন। ধর্ম যদি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার হয় তাহলে ধর্মীয় আচরণ ও তার পালন ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকা উচিত। তা যদি না-হয়, ধর্মীয় আচরণকে বিনোদনের পর্যায়ে নিয়ে এসে বানিজ্যকীকরণ করা হয় তবে সে কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় করের বাইরে থাকতে পারে না।

ধর্মীয় আচারকে সর্বজনীন উৎসব হিসাবে বিপনন করার ক্ষত্রে নাগরিক সমাজ বিশেষত সুশীল সমাজ-ও কম দায়ি নয়। পুজো কিংবা ঈদ এলেই তারা নানারকম কর্মকান্ডে মেতে ওঠেন। মিডিয়ার প্রচার তো রয়েছেই। এই সঙ্গে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বিজ্ঞাপন, জলসা’য় ঈদ, পুজো বা বড়োদিন শব্দের আগে পড়ে ‘উৎসব’ শব্দটিকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এবং সেটা সচেতন ভাবেই করা হয়ে থাকে। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। সমাজ যাদের বিবেক বলে মনে করে, যারা সমাজের মুক্ত কন্ঠস্বর, তাদের কাছ থেকে এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না। বরং এই সুশীল সমাজকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সাদামাটা অনুষ্ঠানের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত। পাশাপাশি জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিকে প্রচারের অধিক আলোয় নিয়ে এসে সত্যিকারের উৎসবের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাও নেতিক ও সামাজিক কর্তব্য। তা না-হলে দিন দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জৌলুশ যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির শিকর আরো গভীরে গ্রোথিত হবে। ফলে ভেদাভেদ মুছে যাবার পরিবর্তে তা আরো গাঢ় হবে।

সাহিত্য সাময়িকীর ক্ষেত্রে ঈদ সংখ্যা, পুজো সংখ্যা বা বড়োদিনের সংখ্যার যে ঘনঘটা দেখা যায় তা স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, শিশু দিবস সংখ্যা, মানবাধিকার দিবসে মোটেও দেখা যায় না। পুজোর গান, ঈদের গান নিয়ে যে উন্মাদনা থাকে স্বাধীনতা দিবসের গান, প্রজাতন্ত্র দিবসে আর আর তেমন করে গান রচনা বা প্রকাশ হয় না বললেই চলে। সাহিত্যিক, শিল্পিদের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। প্রতিবাদটা আসা উচিত যুক্তি ও বাস্তবতার দিক থেকেও। কারণ, ধর্ম তো বিভাজন, হিংসা, বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু সভ্যতাকে দিতে পারেনি। তার সে ক্ষমতা কোনো কালেই ছিল না, আজো নেই। ধর্মবাদীদের একথা ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

ধর্মবাদীরা অবশ্য খুব জোরের সঙ্গেই মানব সভ্যতার পশ্চাতে ধর্মের অবদানকে বড়ো করে দেখাতে ভালোবাসেন। তারা মনে করেন— এই সভ্যতার যা কিছু মহান তা ধর্মের অবদান। বাস্তবে একথা শূন্যগর্ভ জ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু তো নয়। ধর্ম সভ্যতার ভিত্তি কোনোদিন ছিল না। বরং উল্টোটাই ঠিক। ধর্ম সভ্যতর গতিকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। মানবতার গলা টিপে ধরেছে।

ধর্মবাদীরা অনেক সময় ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতাকে গুলিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। সত্যিটা হল– ধর্ম আর নৈতিকতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। নৈতিকতার পরিসর অনেক বড়ো। সে মানুষকে মহান করেছে। সভ্যতাকে দেখিয়েছে উন্নয়নের পথ। আর ধর্ম সেখানে মানুষকে বেধে রেখেছে কিছু চিরাচরিত অসার নিয়ম-বিধি এবং বিশ্বাসে। যার বাস্তব ভিত্তি নেই। এই নিয়মের বাইরে সে কিছু ভাবতে নারাজ, অন্যের ভাবনাকে দমিয়ে রাখতে-ও সমান তৎপর।
সভ্যতা আর মানবতার সম্পর্ক এক সূতোয় বাঁধা। ধর্মের সেখানে কোনো স্থান নেই। ধর্মের কোনো অনুশাসন হয় না, যা হয় তা অপশাসন মাত্র। সেই খ্রিষ্টেয় যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে এই কথাটি স্পষ্টত ভাবেই দৃশ্যমান হবে। তাই ধর্মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্মীয় উৎসব নিয়ে মাতামাতি করা মানেই যে কোনো দেশের বহুত্ববাদকে অসম্মান করা। সভ্যতা, মানবতা কিংবা নৈতিকতা বহুত্ববাদকে শ্রদ্ধা জানাতে শেখায়। আর ধর্ম শেখায় বিভাজন। অন্য কিছু নয়।