প্রায় মাসখানেক আগে হিজাব নিয়ে একটা খবর দেখেছিলাম। তেহরানের কোর্টে দুইজন নারীকে হিজাব ঠিকমতো না পরার কারণে নব্বুই লাখ রিয়াল জরিমানা করেছে। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় বিশ হাজার টাকার সমান। ১৯৭৯ সালের মুসলিম বিপ্লবের পর থেকে ইরানের নারীরা বাইরে বের হলে হিজাব করা বাধ্যতামূলক। সম্প্রতি এরকম অনেকগুলো মামলা হয়েছে হিজাব ঠিকমত না করার অভিযোগে, যার প্রায় প্রতিটাই দোষী নারীকে জরিমানা বা অন্যান্য শাস্তি দেয়া হয়েছে। যেমন পুলিশ যদি গাড়ি চালানোর সময়ও কোন নারীকে ধরে, যার হিজাব খোলা বা ঢিলেঢালা, তাহলে তার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

এটা তো গেল ইরানের কথা। বাংলাদেশে নারীদের হিজাব করার ব্যাপারে এমন কোন আইন নেই। যদিও সামাজিকভাবে অনেক নারীই স্বেচ্ছায় বা পরিবারের পুরুষদের চাপে পড়ে হিজাব করেন। আবার পশ্চিমা বিশ্বে, ইউরোপ বা আমেরিকায় মুসলমানরা হিজাব করতে গিয়ে সামাজিক নিগ্রহের শিকার হন। ফ্রান্সের মত কিছু কিছু দেশে যেমন জনসমক্ষে হিজাব পরা নিষিদ্ধ। একমাত্র তিউনিশিয়াতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জনসমক্ষে হিজাব করা নিষিদ্ধ।

হিজাব নিয়ে নানারকম ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামত আছে। দেশ, জাতি, ও সংস্কৃতিভেদেও নানাবিধ যুক্তি ও পাল্টাযুক্তিও শুনেছি। হিজাব নিয়ে নারীবাদ এবং সেক্যুলার মতধারা থেকে শুরু করে শরিয়া এবং ইসলামিক মতধারা পর্যন্ত বিভিন্ন ‘স্কুল অফ থট’ বিভিন্ন কথা বলে থাকেন। তাই এই বেলা বলে রাখছি এই লেখার উদ্দেশ্য সেই নানা কথার ভেতরে না ঢোকা, বরঞ্চ সমাজে নারী ও পুরুষের মাঝে হিজাবের প্রভাব নিয়ে একটু চিন্তা উস্কে দেয়ার প্রচেষ্টামাত্র।

হিজাবের প্রবক্তাদের প্রধান যুক্তি এই পোশাক নারীর শালীন আব্রু হিসেবে কাজ করে। একই সাথে তা মুসলিম পুরুষকেও পর্দা করতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। হিজাব নারীর সৌন্দর্যকে আড়াল করে পুরুষের কামনাকে প্রতিহত করে। পুরুষের চোখে নারী জনসমক্ষে হয়ে ওঠে কামনারহিত অবয়ব, নারীর প্রতি তার আচরণ হয় সুসভ্য। কিন্তু আসলেই কি তা ঘটে? ইরানের এক নারীর বয়ানে জানা যায়, “আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশকে ঢেকে রেখেও যৌন-লাঞ্ছনা কমে না, …বরং বাড়ে।” রাস্তায় হিজাব পরে বের হলেও চারপাশ থেকে ভেসে আসে অশ্লীল হিসহিস শব্দ, টিটকারি, ইঙ্গিতপূর্ণ শিসের ধ্বনি।

ব্যাপারটা কি উলটপুরাণ মনে হচ্ছে? অস্বাভাবিক হলেও একটু ভেবে দেখলে এর কারণ বুঝতে পারা যায়। এক মুহূর্তের জন্য হিজাবের ধর্মীয় পটভূমির কথা ভুলে যান। ধরুন, এটি শুধুই একরঙা একটি কাপড়ের অংশ। হিজাব একজন মানুষের শরীরকে ঢেকে দিয়ে প্রকারান্তরে তার মানবিক অবয়বটাকে আড়াল করে। হিজাব-পরিহিতের বিমানবিকীকরণ (dehumanization) ঘটে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমরা সকলেই জানি যে প্রতিটি হিজাবের নিচে রক্তমাংসের একজন মানুষ আছেন। কিন্তু এমনভাবে ঢেকে দেয়ার কারণে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের আড়ালে চলে যায়। ঠিক একই ধরণের বিমানবিকীকরণ ঘটে সামরিক বাহিনীতে, পুলিশ বাহিনীতে, জেলখানায়, কল-কারখানায়। মূলত যে কোন উর্দি-পরিহিত ‘মানুষ’কে আমরা আর “স্বতন্ত্র মানুষ” বলে চিন্তা করি না। তারা হয়ে ওঠে ‘বস্তু’। সামরিক বাহিনী হয় হাঁটু-বাহিনী, পুলিশ হয় ঠোলা। মুখাবয়ব দেখা যাওয়া সত্ত্বেও স্রেফ উর্দির আড়ালটুকুতেই বিমানবিকীকরণ সহজ হয়ে ওঠে। তাহলে হিজাবের মত সর্বাঙ্গ ঢাকা কাপড়ের নিচে মানুষকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়? দর্শকের চোখে তাই হিজাব-পরিহিত নারী হয়ে ওঠে চলমান কাপড়ের ঢিবিবিশেষ। এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হিজাবের আড়ালের মানুষটির সুখ-দুঃখকে অনুধাবনের সুযোগটুকুও খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে ভয়াবহ যে ব্যাপারটি ঘটে, তা হলো হিজাব-পরিহিতাকে লাঞ্ছিত ও নিপীড়ন করার সুযোগ করে দেয়, কারণ ‘ওটা’ তো কাপড়ের ঢিবি, কোন জলজ্ব্যান্ত মানুষ না!

বাংলাদেশে নারীশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের নারীর অংশগ্রহণের কারণে এই প্রতিবন্ধকতাকে কিছুটা হলেও সীমিত করা গেছে। তবে ইরানের মতো দেশে যেখানে নারীর হিজাব বাধ্যতামূলক এবং আইনের চোখে হিজাব না করা অপরাধ, সেখানে পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। নারী পুরুষের মাঝে সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে যোজন যোজন দূরত্ব। ছোটবেলায় স্কুলে শিশুরা একসাথে পড়াশোনা করলেও বড় হবার পরে নারী ও পুরুষের গণ্ডি আলাদা হয়ে যায়। কিছুদিন আগেই ইরানি পুলিশ কফিশপ আর রেস্তোরাঁয় নারীদের কাজ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তেহরানের মিউনিসিপ্যালিটিতে কোন পুরুষ কর্মকর্তার সেক্রেটারি নারী হতে পারে না। এর কারণে গুরুতর একটা প্রভাব পড়েছে সমাজে। ইরানের এক নারীর মতে, নারী ও পুরুষ যেহেতু একেবারেই পাশাপাশি কাজ করে না, সেহেতু হুট করে কোন পরিস্থিতিতে একজন নারী ও একজন পুরুষকে কোন কাজ করতে হলে খুবই জড়সড় এবং বিদ্ঘুটে মিথস্ক্রিয়া ঘটে। যেন প্রতিটা আলাপই কোন না কোনভাবে প্রচ্ছন্ন যৌনতার সাথে জড়িত। স্বাভাবিকভাবে নারী বা পুরুষ কেউই কাউকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না, তাদের চোখে শুধুই বিপরীত লিঙ্গের পরিচয়টা প্রকট ও মুখ্য হয়ে ওঠে।

ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা মিথস্ক্রিয়ার কারণে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মানুষ পরিচয়ের লঘুকরণ ঘটে। তারা একে অপরকে লিঙ্গপরিচয়ে সনাক্ত করে, আর হাজার বছর ধরে বয়ে চলা সংস্কৃতির থাবার নিচে বেড়ে চলে প্রেজুডিস। হিজাবের অন্যতম উদ্দেশ্য নারী ও পুরুষের মাঝে লৈঙ্গিক রাজনীতি ও টানাপোড়েন কমানো। কিন্তু প্রকারান্তরে হিজাব, হিজাবের সামাজিক ভূমিকা ও নারী-পুরুষ গণ্ডি আলাদা করার মাধ্যকে লৈঙ্গিক টানাপোড়েন বেড়েই চলে। সমাজে হিজাব ও পর্দাপ্রথার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে হিতকর ও গঠনমূলক করে তোলার কথা ছিল। কিন্তু দিনশেষে সেই সম্পর্ক পুরুষ নারীকে কী চোখে দেখছে (না-মানুষ, নাকি মানুষ) তার ওপরেই নির্ভর করে।