[পটভূমিকাঃ এই কাহিনী যে সময়কার তখন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি। বেশ ক’বার ব্যার্থ হানা দেওয়ার পর আফগানি বংশোদ্ভূত মুইজুদ্দিন মোহাম্মদ, যিনি মোহাম্মদ ঘোরি নামে পরিচিত ১১৯২ সনে তারাই এর যুদ্ধে দিল্লীর শেষ স্বাধীন রাজপূত রাজা পৃথিবীরাজ চৌহানকে পরাজিত ও হত্যা করে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। দিল্লী দখলের পর তিনি তার বিশ্বস্ত তূর্কি বংশোদ্ভূত সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবকের হাতে ভারতের দায়িত্ব ন্যাস্ত করে গজনী ফিরে যান; সূচনা হয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুলতানি আমলের। মূলত এ সময়টা মুসলমান শাসন দিল্লী ভিত্তিক উত্তর পশ্চীম ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল; দক্ষিন ভারত এবং পূর্ব দিকে বাংলা তখনো ছিল অসংখ্য ছোট ছোট স্বাধীন হিন্দু রাজ্যে বিভক্ত। মুসলিম শাসকরা দিল্লী দখলের পর দক্ষিন এবং পূবেও রাজ্য বিস্তারে মন দিলেন। মাঝখানে দূর্লঙ্ঘ বাধার মত দূর্ধষ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত রাজপূত শাসিত রাজস্থান। রাজ্য বিস্তারের এই খেলায় রাজপূতদের সাথে সেই সুলতানি আমল থেকেই মোঘল আমলের শেষ পর্যন্তই ঘটেছে একের পর এক নানান মাত্রায় যুদ্ধ। রাজপূতরা বীর যোদ্ধার জাতি হলেও ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন রাজ্যে বিভক্ত, তাই উন্নততর যুদ্ধ কৌশলের অধিকারী বিশাল মুসলমান বাহিনীর সাথে বীরের মত লড়লেও বারে বারেই হার মানতে হয়েছে। হার মানলেও সুলতানি আমল থেকে মোঘল আমল কোন সময়ই তাদের সম্পূর্ন পর্যুদস্ত করা যায়নি, মুসলমান শাসকদের গলার কাঁটা হিসেবেই তারা রয়ে গেছিল। এই কাহিনী তেমনই এক অস্থির সময়ের কাহিনী, গল্পের থেকেও চিত্তাকর্ষক সে কাহিনী যার যবনিকাপাত ঘটে এক মহা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। যে কোন প্রচলিত ঐতিহাসিক ঘটনার ঠিক কতটা সত্য তার নিশ্চয়তা দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, মিথ এবং ফ্যাক্ট অনেক সময়ই আলাদা করা সম্ভব হয় না। আমার পক্ষেও এই কাহিনীর প্রতিটা অংশ সার্টিফাই করা সম্ভব নয় বলাই বাহুল্য। ঘটনার শেষে এ সম্পর্কিত কিছুটা আলোকপাত করবো। এখানে যা বর্নিত হয়েছে তা ঘটনার ২৪০ বছর পর ১৫৪০ সালে বিখ্যাত কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির লেখা পদ্মাভাত কাব্য অনুসরনে লেখা।]

ঘটনাকাল ১৩০৩ সাল। দিল্লীর মসনদে আসীন তূর্কি বংশোদ্ভূত খিলজী বংশের দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী; ১২৯০ সালে তিনি আপন চাচা এবং শ্বশুড় সুলতান জালালুদ্দিন খিলজীকে হত্যা করে এবং রাজন্যদের ঘুষ প্রদান করে হাত করে সিংহাসন দখল করেন। আলাউদ্দিন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক, দূর্ধষ সেনানায়ক; রাজ্য বিস্তার তার অন্যতম ধ্যানজ্ঞান, রাজ্যজয়ে শুধু শক্তিই নয়, সাথে নিপুন কূটনৈতিক খেলা খেলায়ও দক্ষ। নিজেকে তিনি দিগবিজয়ী আলেক্সান্ডারের সমতূল্য মনে করতেন।

null
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী

দক্ষিনের গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সীমানায় রাজস্থানের মেওয়ার রাজ্য। রাজা রাজপূত বংশের রাওয়াল রতন সিং। রাজার প্রথম রানী নাগমতি। পার্শ্ববর্তি সিংঘাল রাজ্যের রাজকুমারী পদ্মাবতির সৌন্দর্‍্য তখন কিংবদন্তীতূল্য। সেই পদ্মাবতি সেকালের হিন্দু রাজবংশের ধারা অনুযায়ী স্বয়ংবরা পদ্ধুতিতে বিবাহ করবেন ঘোষনা করেছেন। স্বয়ংবরা পদ্ধুতিতে রাজা রাজকুমারীর বিয়ের ঘোষনা দিতেন, এরপর রীতিমত প্রতিযোগীতার মাধ্যমে রাজকুমারীর কাছে নিজ যোগ্যতা প্রমান করতে হত প্রতিযোগী রাজপুত্র, রাজা মহারাজাদের। তার ভিত্তিতে রাজকুমারী নিজে বর বেছে নিতেন। প্রথম রানী নাগমতি এবং নিজ মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও রতন সিং স্বয়ংবরা প্রতিযোগীতায় আরেক রাজাকে পরাজিত করে রাজকুমারী পদ্মাবতিকে জিতে নেন, রানী হবার পর পদ্মাবতির নাম হয় পদ্মিনী।
রাজা রতন সিং গুনের কদর করতে জানতেন, তার সভায় ঠাঁই পেয়েছিল বহু জ্ঞানী গুন সভাসদ। তাদের একজন বংশীবাদক রাঘব চেতন। সেই রাঘব চেতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেল গোপন তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে লোকজনের অনিষ্ঠ করার; অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেল। রাজা শাস্তি হিসেবে তাকে চুনকালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চালিয়ে রাজ থেকে বের করে দিলেন। এখান থেকেই শুরু হল এক অবিস্মরনীয় ঘটনার।

রাঘব সেই অপমান সহজভাবে নিতে পারেনি, সে পন করে বসল নির্মম প্রতিশোধ নেবার। মনে মনে এক ভয়াবহ পরিকল্পনা এঁটে সে রওনা দিল দিল্লী অভিমুখে; বাঘের ওপর যেমন ঘোগ আছে তেমনি রাজার বড়ও বাদশাহ আছে। দিল্লীর উপকন্ঠে্র জংগলে তখন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী দলবল সমেত শিকারে এসেছেন। রাঘব মওকা বুঝে জংগলের ভেতর কাছাকাছি মায়াবী সুরে বাঁশি বাজাতে থাকলো। তার হিসেবে ভুল হয়নি; সুলতান নিজেও গান বাজনা ভক্ত, তাই রাঘব চেতনের ডাক পড়ল সুলতানের তাবুতে। আলাউদ্দিন তার গুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজ দরবারে যোগ দিতে আহবান জানালেন। এটাই ছিল রাঘবের মতলব। মওকা বুঝে সে সুলতানের কাছে রং চং চড়িয়ে রানী পদ্মীনির রুপের বর্ননা বয়ান করল, এমন রূপবতি মহিলা কেবল সুলতানের হেরেমেই সাজে। রাঘব সম্ভবত আলাউদ্দিনের গুজরাট রাজ্য হানা দিয়ে রানী কমলা দেবী হরন কাহিনী শুনে থাকবে। রাঘবের হিসেবে ভুল হয়নি, সুলতান আলাউদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন মেওয়ার অভিযানের, বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন মেওয়ারের রাজধানী চিতোর অভিমুখে।

কিন্তু চিতোরের কাছে এসে সুলতান বুঝতে পারলেন কাজটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলেন আদতে ততটা সহজ নয়। ছোটখাট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ৭ম শতকে নি চিতোরগড়ের কেল্লা এক দূর্ভেদ্য দূর্গ, সেটা বাইরে থেকে আক্রমন করে ধ্বংস করা সোজা কথা নয়। সুলতান আশ্রয় নিলেন এক কৌশলের। রাজা রতন সিং এর কাছে দূত পাঠালেন। তার দূর্গ দখল কিংবা রাজ্যহরনের কোন মতলব নেই; তিনি কেবল রানী পদ্মিনী্কে বোনের মত দেখেন, তাকে এক পলক দেখেই চলে যাবেন। রতং সিং পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে; একদিকে মান ইজ্জতের প্রশ্ন, অন্যদিকে সুলতানের বিশাল বাহিনীর হুমকি। চিতোরগড় দূর্ভেদ্য হলেও দূর্গ অবরোধ করে বসে থাকলে এক সময় না এক সময় সরাসরি লড়াই এ যেতেই হবে, বিশাল সুলতানি বাহিনীর সাথে পারা সম্ভব নয়। তাই রাজাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হতে হল, এতে করে যদি প্রজাদের প্রানরক্ষা করা যায়। রানী পদ্মিনী শর্ত দিলেন যে তিনি সরাসরি সুলতানকে দেখা দেবেন না, সুলতান আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখবেন।


চিতোরগড় কেল্লা

সুলতান আলাউদ্দিন এই শর্ত মেনে কিছু সংগীসাথী সহযোগে অতিথি বেশে কেল্লায় প্রবেশ করলেন। কথামত রানী পদ্মিনীও তার মহলে আয়নায় দেখা দিলেন। সেই দেখাই হল কাল। এ যে কল্পনারও অতীত, সুলতান যা বর্ননা শুনে এসেছেন বাস্তবের রানী পদ্মিনী আর অনেক রুপবতি। একে ছাড়া সুলতানের চলবে না। কেল্লা থেকে অতিথিদের বিদায় দিতে রাজা রতন সিং সৌজন্য বশতঃ সুলতানের সাথে কিছু পথ এগিয়ে দিতে এলেন। সুলতান এটাকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহন করে আচমকা রতন সিংকে বন্দী করে তার শিবিরে নিয়ে গেলেন। এরপর চিতোরগড় কেল্লায় খবর পাঠালেন কাল সকালের মধ্যে রানী পদ্মিনীকে তার শিবিরে পাঠিয়ে দিলে তিনি রাজা রতন সিংকে মুক্তি দেবেন এবং আর কারো কোন ক্ষতি না করে দিল্লী ফেরত যাবেন।

চিতোরগড় কেল্লা মহা সংকটে। একদিকে খোদ রাজার প্রান যায়, আরেক দিকে তার প্রান রক্ষা করতে গেলে মহা অসম্মানজনক প্রস্তাবে রাজী হতে হয়। এই মহা সংকটে এগিয়ে এলেন রাজা রতন সিং এর দুই বীর সেনাপতি চাচা-ভাতিজা বাদল এবং গোরা। তারা একটি পরিকল্পনা ফাঁদলেন, দূত মারফত সুলতানের শিবিরে খবর পাঠালেন যে তারা সুলতানের প্রস্তাবে রাজী, রানী পদ্মিনী পরদিন ভোরেই সুলতানের শিবিরে হাজির হবেন, কিন্তু রাজরানী বলে কথা, তিনি একা যেতে পারেন না, তার সাথে থাকবে আর দেড়শো সখী।

পরদিন প্রত্যুষে কেল্লা থেকে রওনা হল পঞ্চাশ পালকীর বহর। দেড়শো সখী সমেত রানী পদ্মিনী চলেছেন সুলতানের শিবিরে নিজকে সমর্পন করে রাজা সিং এর জীবন রক্ষা করতে। আসলে সেসব পালকির ভেতর রানী বা সখী কেউই নেই; আছে সেনাপতি গোরা ও বাদলের নের্তৃত্বে বাছা বাছা সবচেয়ে দূর্ধষ দেড়শো রাজপূত যোদ্ধা। সুলতান শিবিরে পৌছে তারা অপ্রস্তুত সুলতান বাহিনীকে চমক সামলে ওঠার সময় দিল না, দ্রুততার সাথে সুলতানের দেহরক্ষীদের কচুকাটা করে হতবিহবল রাজা রতং সিংকে দ্রুত মুক্ত করে ফেলল। সেনাপতি গোরা দ্রুত রাজা রতন সিংকে সুলতান শিবির থেকে কব্জা করা একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে কেল্লার দিকে রওনা করিয়ে দিল।

কথিত আছে গোরা সুলতানের শিবিরে ঢুকে সুলতানকে হত্যা করার চমতকার সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু সুলতান সে সময় তার রক্ষিতাকে সামনে বর্মের মত ঠেকে দেন। বীর যোদ্ধা গোরা মহিলাকে আঘাত করতে পারবেন না সেটা সুলতানও জানেন। এই অবস্থায় সুলতানের দেহরক্ষীদের হাতে গোরার প্রান যায়। বাদল নিরাপদেই রাজা রতন সিংকে উদ্ধার করে কেল্লায় পৌছে গেলেন। কিনতি রাজপূত শিবিরের আনন্দ ফূর্তির তেমন অবকাশ নেই, বিপদের সবে শুরু। স্বাভাবিকভাবেই সুলতান আলাউদ্দিন ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তার বাহিনীকে কেল্লা আক্রমনের সর্বাত্মক হুকুম দিলেন।

দূর্ভেধ্য চিতোরগড় হামলা করে দখল করা খুব সহজ কাজ নয়, সুলতানের বিশাল বাহিনীও সেটা টের পেল। দিনের পর দিন আক্রমন করেও কোন ফল না আসায় সুলতান বাহিনী দূর্গ অবরোধ করে চারদিক ঘিরে থাকলো। যতই দূর্ধষ যোদ্ধা আর দূর্ভেদ্য হোক, এক সময় দূর্গের ভেতরের খাদ্য সরবরাহ ফুরিয়ে যাবেই, বার তাদের হতেই হবে, হলও তাই। দূর্গের ভেতরের সরবরাহ ফুরিয়ে এলো, সরাসরি সম্মুখ সফর ছাড়া আর গত্যন্তর নাই, যার ফলাফল অত্যন্ত পরিষ্কার, পুরুষরা সব হয় নিহত এবং বন্দী হয়ে দাসত্ব বরন; এবং মহিলাদের হতে হবে দাসী।

সে সময়কার রাজপূত রাজপরিবারে্র মহিলাদের জন্য এমন পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন অবস্থায় জওহর নামক এক প্রথা প্রচলিত ছিল। এই অবস্থায় মহিলারা শত্রুর হাতে বেইজ্জত হবার চাইতে আত্মহনন করা শ্রেয় মনে করতেন। চিতোরগড় কেল্লার ইতিহাসে এটাই প্রথম জওহরের ঘটনা। রাতের বেলা দূর্গের ভেতর বিশাল এক অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হল। রাজপরিবারের সব মহিলারারা রানী পদ্মিনীর নের্তৃত্বে তাদের বিয়ের পোষাক গয়না পরে শিশু সন্তানদের সহ সেই অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে আত্মহুতি দিলেন।

স্বজনহারা রাজপূত সৈনিকদের জন্য এরপর আর বেঁচে থাকার তেমন মানে রইল না। তারাও সাকা প্রথা (যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেওয়া) পালনের জন্য তৈরী হয়ে গেল। পরদিন প্রত্যুষে জাফরান রাংগা পোষাকে রনসাজে সজ্জিত হয়ে তারা দূর্গ থেকে বের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতানের বিশাল বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে। চুড়ান্ত ফলাফল যা হবার ছিল তাই হল। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী অবশেষে বিজয়ীর বেশে কেল্লায় প্রবেশ করলেন। কিন্তু যার মোহে তিনি এত লোকক্ষয় ঘটালেন সে আগেই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। কথিত আছে যে সুলতান বাহিনী কেল্লার ভেতর প্রবেশের পর তখনো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে মহিলাদের পোড়া হাঁড়গোড় দেখতে পায়। কথিত আছে আলাউদ্দিন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কেল্লায় আশ্রয় নেওয়া ৩০ হাজার রাজপূতকে হত্যা করেন। খিজির খান বছর দশেক মেওয়ার শাসন করার পর আবারো ক্ষমতার পালাবদল ঘটে রাজ্য চলে যায় রাজপূতদের হাতে।


রানী পদ্মিনী মহল (১৮৪৬ সনে পূন:নির্মিত) – কথিত আছে এ স্থানেই ঘটেছিল সেই জওহরের ঘটনা। উপাখ্যান অনুযায়ী আলাউদ্দিন এই চাতালেরই কোন অংশে দাঁড়িয়ে মহলে দন্ডায়মান রানীর প্রতিবিম্ব দেখেন।

আলাউদ্দিন খিলজী তার ছেলে খিজির খানকে নুতন শাসক হিসেবে বসিয়ে বিফল মনোরথে দিল্লী ফেরত গেলেন। চিতোরগড়ের নাম নুতন শাসকের নামানুসারে করা হল খিজিরাবাদ। চিতোরগড় কেল্লায় ক্ষমতার পালাবদলে রাজপূতরা আবারো ক্ষমতা পায়। এরপর আরো দুইবার চিতোরগড়ে জওহরের ঘটনা ঘটে, দ্বিতীয়বার ১৫৩৫ সালে রানী কর্নাবতি গুজরাটের রাজা বাহাদুর শাহের কবল থেকে রেহাই পেতে দলবল সমেত এই পথ বেছে নেন। রানী কর্নাবতি বাহাদুর শাহের কবল থেকে তাদের রক্ষা করতে মোঘল বাদশাহ হুমায়ুনকে ভাই ডেকে হাতের রাখী পাঠিয়েছিলেন। হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নিতে বা রওনা দিতে দেরী করে ফেলেন। এরপর ১৫৬৭ সালে তৃতীয় জওহরের ঘটনা ঘটে মহামতি আকবরের চিতোরগড় দখলকালে।

এই কাহিনীর কতটা মিথ এবং কতটা সত্য তা আজ আর নির্নয় করা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলে আলাউদ্দিনের চিতোরগড় দূর্গ দখল ঘটেছিল, তা তার দরবারের ইতিহাসবিদ এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমির খসরুর লেখনিতে আছে। যদিও তার লেখনিতে রানী পদ্মিনীর কোন কথা নেই। এই কাহিনী প্রথম লিখিত আকারে বের প্রকাশ হয় ঘটনার প্রায় ২৪০ বছর পর ১৫৪০ সালে বিখ্যাত মধ্যযুগীয় কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির লেখা পদ্মাভাত কাব্যে। এই ফাঁকের কারনে অনেকে সন্দেহ পোষন করেন যে রানী পদ্মিনী বলেই আদতে কেই ছিল না, এটা নেহায়েতই কবির কল্পনা। অর্থাৎ পুরো কাহিনীটাই বানোয়াট। মালিক মুহম্মদ জায়সি ইতিহাসবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন কবি; তাই তার রচনা ইতিহাস বলে পুরোপুরি গ্রহন করা যায় না।

জায়সির লেখার পর এই কাহিনী কিছুটা বিবর্তিত রূপে সে কালের আরো ক’জন বিখ্যাত ইতিহাসবিদের লেখায় স্থান পেয়েছে যাদের ইতিহাসবিদ হিসেবেই পরিচয় আছে; যেমন আকবরের বিখ্যাত সভাসদ আবুল ফজল, বিখ্যাত মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদ ফিরিশতার লেখনীতে। যদিও জায়সী, আবুল ফজল, ফিরিশতা এদের বর্নিত কাহিনীতে কিছুটা ভিন্নতা আছে।

পশ্চীমের একজন ইতিহাসবিদ ফ্রান্সের বিখ্যাত সরোবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক রজার্স সাহেবের এ সম্পর্কিত গবেষনা বেশ তথ্যবহুল [৩], যদিও আমার কাছে তাতেও কিছু ফাঁক আছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ওনার মূল সূর বিভিন্ন ভার্ষনের অসামঞ্জস্যতা দেখানো এবং তার ভিত্তিতে সংশয় প্রকাশ। তবে তিনি নিজেও একটি কাঁচা ভুল করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি সম্ভবত রানী পদ্মিনীর জন্মস্থান সিংঘালকে সিংহল (বর্তমানের শ্রীলংকা) এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। আদতে সিঙ্ঘাল এবং সিংহল বা শ্রীলংকা এক নয়। সিঙ্ঘাল নামে উত্তর ভারতেই হরিয়ানার কাছাকাছি একটি রাজ্য সে সময় সত্যিই ছিল।

এই কাহিনী যারা কল্প কাব্যের চেয়ে বেশী কিছু বলে মনে করেন না তারা দাবী করেন যে রানী পদ্মিনীর অস্তিত্বের কথা ইতিহাস স্বীকৃত নয়, আলাউদ্দিনের ইতিহাস লেখক (যেমন আমির খসরু) কিংবা রাজপূত ইতিহাস কোথাও তার নাম পাওয়া যায় না। এই তত্ত্বও আসলে পুরো তথ্যভিত্তিক নয়। আমির খসরু সেকালের বেশীরভাগ ইতিহাসবিদের মতই নিয়োগকর্তার মন রাখা ইতিহাস লিখতেন, তদুপরি তিনি বেশীরভাগ সময়েই ব্যাবহার করতেন ঘোরানো প্যাঁচানো সাংকেতিক ভাষা। তার লেখনীতে আলাউদ্দিনের চিতোরগড় বিজয়ের কাহিনীতে রানী পদ্মিনীর নাম না থাকলেও সেখানে কোন রকম যোগসূত্র ছাড়াই অনেকটা অপ্রাসংগিকভাবে আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্থ সমূহে বর্নিত বাদশাহ সোলায়মান, রানী বিলকিস/সেবার রানীর কথা আছে। এই রেফারেন্স অনেকে মনে করেন রানী পদ্মিনী এবং তার প্রতি আলাউদ্দিনের লোভের ইংগিতময় ভাষ্য। উনি তার সুলতানের চরিত্রে এত বড় কালিমালিপ্ত অধ্যায় সরাসরি সেই আমলেই লিখে যাবেন এতটা আশা করাও যায় না।

রাজপূত ইতিহাসে পদ্মিনীর নাম নেই এটাও পুরোপুরি সঠিক নয়। রাজপূত ইতিহাস গ্রন্থ খুমান খায়সায় এই কাহিনী স্থান পায় রানা প্রতাপের আমলে ১৫৭২-১৫৯৭ এর কোন এক সময়। এর আগে স্থান না পাবার সহজ ব্যাখ্যা আছে। কারন এই ইতিহাস গ্রন্থ লেখা শুরু হয় ৮২৮ সালে, ৮৫৩ সালের পর দীর্ঘ ৭৫০ বছর লেখা বন্ধ ছিল। রানা প্রতাপের আমলে আবারো এটা লেখা শুরু হয়। অর্থাৎ আলাউদ্দিন যে সময়ে চিতোরগড় আক্রমন করেন সে সময়ে এর লেখনী বন্ধ ছিল।

স্বাভাবিকভাবেই যে কোন ঐতিহাসিক কাহিনীর মতই বিভিন্ন জনের ভাষ্যে এই কাহিনী কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এসেছে। যেমন জায়সির ভাষ্যে আয়না আলাউদ্দিন নিজেই দিল্লী থেকে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেটা ব্যাবহার করে গোপনে রানীকে দেখেন। দিল্লী থেকে আয়না বহন করে আনার এই অংশ তেমন বিশ্বাস্য মনে হয় না। কেউ কেউ দাবী করেন যে এটা যে সময়ের ঘটনা সে সময় ভারতবর্ষে আদৌ আয়নারই চল শুরু হয়নি, আয়না আসে আরো পরে। এটা অবশ্য আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। জয়সির ভাষ্যে অবশ্য জওহরের ঘটনাটাও কিছুটা ভিন্নভাবে এসেছে। তার কাব্যে আলাউদ্দিন রতন সিংকে বন্দী করে দিল্লী নিয়ে যায়। এই সুযোগে পাশের কোন এক রাজ্যের রাজা দেবপাল রানী পদ্মিনীর দিকে দৃষ্টি দেয়। গোরা এবং বাদল দিল্লী থেকে রতন সিংকে মুক্ত করে আনার পর রতন সিং সেই দেবপালের রাজ্যে হানা দেন এবং দেবপালকে হত্যা করে নিজেও যুদ্ধে নিহত হত। এই সংবাদ শোনার পর রানী পদ্মিনী জওহরের পথ বেছে নেন। এই কাহিনীও বেশ ফাঁকে ভরা। গোরা এবং বাদল দিল্লী হানা দিয়ে রতন সিংকে উদ্ধার পর্ব সত্য হবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীন। রাজপূত শক্তির সেই ক্ষমতা ছিল না। সেই কথিত যুদ্ধে দেবপালের নিহত হবার পরেও শুধু স্বামী শোকে দলবল সমেত পদ্মিনীর জওহরের মত চরম পথ বেছে নেওয়াও তেমন যুক্তিসম্মত মনে হয় না।

অনেকে আবার মনে করেন রক্ষনশীল রাজপূত রাজপরিবার নিজের ঘরের মহিলাকে বাইরের লোক, তাও আবার মুসলমান সুলতানকে দেখাবে এটাও সম্ভব না।

মোদ্দা কথা সকলের জবানীতেই কিছু না কিছু ফাঁক আছে। আসলেই কি হয়েছিল তা নিশ্চয়তাসহ বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন রাঘব চেতনের অংশ, আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখা এসবই পরবর্তিকালে জুড়ে দেওয়া লোককাহিনীর অংশ হতে পারে। রতন সিং উদ্ধার পর্বও বেশ নাটকীয় বলে মনে হয়, যদিও অসম্ভব নয়। সব মিলিয়ে বলা যায় যে আলাউদ্দিনের চিতোরগড় বিজয় ঐতিহাসিক সত্য। এর পেছনে মূল কারন স্রেফ রাজ্য জয় নাকি নারী লিপ্সা তা বলা শক্ত; খুব সম্ভব দুয়ের মিশ্রন। জওহরের ঘটনা হয়ত যেভাবে বর্নিত হয়েছে হুবহু সেভাবে হয়নি; কিন্তু ঘটতেই পারে না এমন মনে করার কোন যুক্তিসংগত কারন নেই। এমনো না যে সেটা সেকালে এই একবারই ঘটেছিল। আগেই বলেছি চিতোরগড় দূর্গেই এটা ছাড়াও আরো ২ বার জওহরের ইতিহাস পাওয়া যায়। এমনকি আলাউদ্দিন খিলজীও এই ঘটনার আগে ১২৯৪ সালে রাজস্থানেরই জয়সলমীরের দূর্গ দীর্ঘ ৭ মাস অবরোধ করে রাখলে ২৪,০০০ নারী জওহরের পথ বেছে নেয়।

তথ্যসূত্রঃ

১। Rani Padmini
২। Alauddin Khilji
৩। Mystery Woman of Mewar