লেখক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

২৬ ফেব্রুয়ারি’১৫ রাত ১০ টা। বাসার ফ্লোরে বসে রতের খাবার খাচ্ছি পাশে টিভি চলছে, রিমোট আমার বন্ধুর হাতে একটু পর পর চ্যানেল পাল্টাচ্ছে, আমিও কিছুক্ষণ পর পর টিভির দিকে তাকাই। আমার এখন মনে নেই কোন চ্যানেলে প্রথম দেখেছি ব্রেকিং নিউজ টা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বিত্তরা এবং তার স্ত্রী’র অবস্থা আশঙ্কাজনক। তখন মনে হয়েছে আমি আকাশ থেকে পরেছি। অভিজিৎ রায় বাংলাদেশে কবে এসেছে তাও জানিনা । পরে বুঝতে পারলাম নিরাপত্তার কারনেই ফেইসবুকে জানায়নি। তখন আমার চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। সঙ্গে সঙ্গে ঢাবি’র এক বন্ধুকে ফোন করলাম সে বই মেলায় থাকার কথা কিন্তু সে ছিল না, সে অন্য একজনের কাছ থেকে ফোনে নিশ্চিত হয়ে আমাকে জানালো আসলেই অভিজিৎ রায় আর নেই! আমার মাথায় তখন কিছু কাজ করছে না, এই খবরটি জানানোর মত আমার অনেক বন্ধু আছে বড় ভাই আছে কিন্তু কারো কথাই আমার মনে আস্তেছিল ছিল না। শুধু চাঁদপুরের এক ছোট ভাইকে ফোনে ট্রাই করছি কিন্তু তার ফোন বন্ধ ছিল, তবুও বারবার চেষ্টা করলাম। টেবিলে মাথা পেলে কতক্ষন নীরবে ছিলাম , চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি কিন্তু পারছি না। মাথায় চিন্তা ও ভয় নিয়ে রাত টা কাটালাম। সকালে কম্পিউটারের সামনে বসলাম কাজ করার জন্য, এক হাত মাউচে এক হাত কিবোর্ডে আর চোখ মনিটরের পর্দায়, কিন্তু আমার মন তো এখানে নেই। শুধু চিন্তা করি অভিজিৎ রায় আর নেই, সে আর লিখতে পারবে না, এই কথাটি’ই ভাবতেই আমার কেমন লাগে। আমি এখন পর্যন্ত এমন কোন দিন নাই যে অভিজিৎ রায় কে মনে করছি না, ফেসবুকে ঢুকলেই দেখাযায় অনেকে এখনো অভি’দার ছবি ফ্রোপাইল পিকচার দিয়ে রেখেছে, বন্যা আপু এখন মাঝে মাঝে ফেইসবুকে আসে পোস্ট দেয়, এবং আমারও ফেইসবুকে ফ্রোপাইল পিকচার অভি’দার মুক্তমনার ফ্রোপাইল পিকচার টা । আমার ল্যাপ্টপের ডেস্কটপের ব্যাকরাউন্ডে অভিজিত’দা বন্যা আপু এবং তাদের সন্তানের একটা ছবি থাকে। অভি’দাকে মনে রাখার অনেক কিছুই প্রতিনিয়ত আমার চোখের সামনে থাকে। অভি’দাকে মনে করার জন্য কিছুই না থাকলেও চলে। আমি পারব, যখন সব কিছু থেকে অনেকদূরে চলে যাবো সেদিনও আমি অভি’দার কথা আমার মনে থাকবে।

আমার তখন আস্তে আস্তে মনে পরেছিল কাকে কাকে ফোন করা দরকার, প্রথমে ফোন করলাম চাঁদপুরের এক বন্ধুকে সে জানালো সে রাতেই শুনেছে সে বলল আমি এতো কষ্ট পেয়েছি যে আমার মা-বাবার মৃত্যুও মনে হয় আমাকে এতো কষ্ট দেবে না। তারপর সিলেটে ফোন করলাম আরেক বন্ধুকে সে বলল সে জানে। তখন ফোন টা রেখে চিন্তা করলাম সেই ৪/৫ বছর আগের কথা কবে থেকে অভি’দাকে চিনি তার নাম শুনি। ‘শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ’ নামে একটা পত্রিকা ছিল সেখানে অভিজিৎ’দা লিখতো, সেই প্রথম দেখেছিলাম অভিজিৎ’দার নাম সাথে বন্যা আপুর নামও ছিল। তারপর ফেইসবুকে আসি কিছু দিন পরে। নিজে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারনে সহজেই মুক্তমনাদের চিনতে পারি, তখন আমি শুধু সামু ব্লগ এবং মুক্তমনা ব্লগে ঢুকি। সামুতে লিঙ্ক আসলে জেতাম এভাবে বেশি যাওয়া হত না, কিন্তু মুক্তমনায় আমার যাওয়া হত কারন সেখান থেকে ই-বুক ডাউনলোড করতাম, পড়তাম এবং আরও কয়েকজনকে দিতাম। আমি মুক্তমনাকে নিয়ে গল্প করতাম , মুক্তমনাকেই আমি সবার কাছে সেরা ব্লগ বলতাম এখনো বলি। সেখান থেকেই আমার ভিন্ন কিছুতে ভিন্ন চিন্তার সাথে পরিচয়। তখন নিজের ভিতর আস্তে আস্তে প্রশ্নও আসতো সমাধান হত, ধর্মীয় দ্যান ধরনা মাথা থেকে চলে গেল। এভাবেই পরিবর্তন হতে শুরু করলাম। বিজ্ঞানের প্রতি প্রেম জন্মালো, বই পড়া বেড়ে গেল, এমনকি আস্তে আস্তে কয়েকটা বাংলা ব্লগে লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু মুক্তমনার আমি শুধুই পাঠক। কারন আমি দেখলাম সেখানকার লেখকরা অনেক উচ্চশিক্ষত এবং সেখানে সাধারণ লেখা খুব কমই থাকে। প্রত্যেক টা লেখারই কোয়ালিটি আছে। তাই আমি মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলাম। ফেইসবুকে অভি’দার সাথে এড হলাম, ছোট বড় সব লেখাই তখন চোখে পরত এমনকি কোন পত্রিকায় লেখলেও পড়া হত। এভাবেই খুব ধীরে ধীরে অভি’দাকে চিনেছি। সে জন্যই চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না।

অভি’দার লেখা ই-বুক গুলো আমি যাকে পেরেছি তাকেই দিয়েছি, একবার ‘সমকামিতা কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ?’ লেখাটি দিলাম এক বন্ধুকে সে মুক্তমনাই ছিল কিন্তু অভি’দার লেখা আগে কখনই পড়ে নাই, এই লেখাটি পরে সে আমাকে বলল ‘আমি তো অভিজির রায়ের একটি লেখা পড়েই ফ্যান হয়ে গেলাম’, এই লেখাটি আমাকেও অনেক প্রভাবিত করেছে ১৬ পৃষ্ঠার একটি লেখা দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ না। আমার আরেক বন্ধু বলেছে তার সবথেকে ভালো লেগেছে ‘মহাবিশ্বের প্রান ও বুদ্ধিমত্তার খোজে’। এক ছোট ভাই বলেছে তার ভালো লেগেছে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। এভাবে অনেকের সাথেই আমার অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আলোচনা হত। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাস করতো বাংলাদেশে এই মুহুর্তে বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে কে বেশি এগিয়ে আমি অভিজিৎ রায়ের কথা বলতাম, খুব সচেতন ভাবেই বলতাম। মনে পড়ছে অভি’দার লেখা মার্ক্সবাদ কে নিয়ে লেখা সেখানে তিনি মার্ক্সবাদ এবং সমাজতন্ত্রের সমলোচনা করেছে, কিন্তু আমি নিজে মার্ক্সবাদী হয়েও সেটি পড়ে অভি’দার প্রতি ঘৃণা জন্মায় নি। কারন সেখানে তিনি তার মত করে যুক্তি দিয়ে লিখেছিলেন। সেই লেখার ৫ বছর পর কলকাতার অশোক মুখার্জি নামে একজন মুক্তমনাই এই লেখার জবাব দিয়েছেন বিস্তারিত ভাবে আমি সেটাও পড়েছি তিনিও অভি’দাকে আক্রমণাত্মক কিছু বলেনি অথচ তিনি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক। সেই লেখার কমেন্ট বক্সে আবার অভি’দার জবাব দেখলাম অভি’দা তাকে প্রথমে এই বিস্তারিত লেখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন। এখান থেকে শিখলাম কাউকে গালি কিংবা অবহেলা না করেও যুক্তি তর্ক চালানো যায় যদি দুজনেরই সমলোচনা সহ্য করার ক্ষমতা থাকে।

এক ছোটভাই একদিন আমাকে বলে ভাই আমি অভিজিৎ রায়কে কিছু প্রশ্ন করতে চাই করবো কিনা বুঝতে পারছি না। আমি বললাম প্রশ্ন কর দেখো না একবার, সে করলো এমনকি খুব ভালো ভাবে তাকে উত্তরও দিয়েছে অভি’দা। সে আমাকে ফোন করে বলে ভাই এতো বিখ্যাত মানুষ হয়েও আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে আমিতো অবাক। আমি বললাম হ্যাঁ অবাকই হওয়ার কথা কারন ফেসবুকে অনেকে সেলেব্রিটি হওয়ার পড়ে পাল্টিয়ে যায় এবং অবহেলা করে তার মাঝেও কয়েকজন ভালো মানুষ আছে তাদের দেখে তো অভাক হয়াই ভালো। এমন ছোট খাটো অনেক আড্ডা আলোচনার সাথে জড়িয়ে আছে অভিজিৎ রায়ের নাম। যে নাম কোন দিন মাথা থেকে যাবে না।

২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের সময় অভি’দাকে দেখেছি নিয়মিত খোজ খবর রাখতে এই নিয়ে ফেইসবুকে ব্লগে লিখতে, তিনি দেশে নেই কিন্তু ঐ সময় মনটা ছিল শাহবাগে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। কয়েকদিন পরে ‘শহীদ রুমি স্কোয়াড’ জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে আমরন অনশন করেছিলো। তখন অভি’দা একটা ব্লগ লিখেছিল শিরোনাম ছিল এমন “যারা ভোর আনবে বলে কথা দিয়েছিল” সেখানে তিনি লিখেছিলেন তাদের অনশন দেখে সেদিন তিনি লাঞ্চ করেনি কাজের কথা বলে কম্পিউটারের সামনে ছিলেন কলিগরা জাতে না বুঝতে পারে, এমনকি রাতেও খাওয়ার ঠিক আগে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। আমি লেখাটি পড়ে নীরবে কতক্ষন ছিলাম এবং ভাবলাম দেশর জন্য মানুষের জন্য ভালোবাসা থাকলে যে যেখানেই থাকুক সেই ভালবাসার এতটুকুও কমে যাবে না।

২০১৪ সালের দিকে আমি ভেবেছিলাম অভি’দাকে ফেইসবুকে ম্যাসেজ করবো মুক্তমনায় লিখতে চাই বলে। কারন এখন আমার নিজের উন্নতি হয়েছে, একটু বেশি সময় নিয়ে লিখলে মুক্তমনায় প্রকাশ করা যাবে। এই ভাবনাটা আমার মাথায় ছিল এমনকি আমি দুজনের সাথে বলেছিও কিন্তু আমার ম্যাসেজ দেওয়ায় আগেই চলে গেলেন অভি’দা আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম, কেন এতো দিন করলাম না। অভি’দা যদি একাউন্ট খুলে দিয়ে যেতো আমি গর্বিত হতাম । কিন্তু তা তো আর হল না!

অভি’দার মৃত্যুর পর যখন শুনলাম তার লাশ হসপিটালে দান করে দিয়েছে তখন অভি’দার প্রতি আরও সম্মান বেড়ে গেল। তিনি দেহ দান করে আরও অনেককেই উৎসাহিত করে গেল। আহমদ শরীফ, আরজ আলী এবং অভিজিৎ রায় এখন একি জায়গায় পৌছে গেল।

অভি’দা বাংলাদেশের তরুণদের একটি আদর্শের নাম, তিনি বেঁচে নেই কিন্তু তার সমস্ত লেখা সংরক্ষন আছে যা আরও হাজার পরেও এর প্রাসঙ্গিকতা যাবে না। যেমনটা যায় নি সক্রেটিস, ব্রুনো এবং গ্যালেলিও’র প্রাসঙ্গিকতা। ব্যাক্তি অভিজিৎ রায় কে হত্যা করলেও তার আদর্শ কে কি মৌলবাদীরা হত্যা করতে পেরেছে? না, পারেনি । পারবে না। অভি’দা বেঁচে থাকলে হয়তো আরও ২০/৩০ টা বই বের হত, কিন্তু এখন আর হবে তবে কি সব থেমে যাবে? না, আরও নতুন নতুন অভিজিৎ আসবে অনন্ত আসবে তারাই আলো চড়াবে সেই আশাই আজ বুকে ধারন করি।

অভি’দা একটা লেখার শেষে মাহমুদুজ্জামান বাবুর একটা গানের কয়েকটা লাইন লিখেছিলেন…

‘ভোর হয়নি, আজ হলনা কাল হবে কিনা তাও জানা নেই
পরশু ভোর আসবেই
এই আশাবাস তুমি ভুল না’।

আশাবাদ ভুলি না। আশাবাদ ভুললে তো আর কিছুই থাকবে না। মনে পড়ছে V For Vendetta মুভির একটি কথা “We are told to remember the idea and not the man. Because a man can fail. He can be caught, he can be killed and forgotten. But 400 years later an idea can still change the world.”

অভিজিৎ রায় নিজেও জানতেন না তিনি আমাদের কাছে কতটা উঁচুতে পৌছে গিয়েছিলেন। যে মানুষ একাধারে ধর্ম-জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য – রাজনীতি ও ধর্মীয় গোঁড়ামি এতসব বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন , সে আর যাই হোক সাধারণ মানুষ না। যে এতো মানুষের মন জয় করতে পারে। যে বিদেশে থেকেও সারাক্ষন ভাবতেন নিজের দেশের কথা। যার এতো প্রতিবা তার শুধু জন্ম দিনই স্মরণ করতে চাই । আর কিছুই মনে আনতে চাই না।

শুভ জন্মদিন
শ্রদ্ধেয় অভিজিৎ রায়।