প্রকৃতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আলোর যোগান আসে সূর্য থেকেই । মানুষের জীবন শুধু ‘ধারণ’ এর জন্য নয়। মানুষ করে ‘জীবন যাপন’। যার কিছু নিজস্ব পদ্ধতি আছে, আছে স্টাইল। আর এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যা সময় ও সভ্যতার হাত ধরে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমার এই অতি সাধারণ ‘আমিও’ কবে যেন অন্ধকার থেকে ছুটতে ছুটতে আলোর মিছিলের যাত্রী হয়ে গেলাম সেকথা আজ আর মনে নেই। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়নি বলেই জীবনের পদে পদে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে সবচেয়ে কদর্য রূপ। আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময়ই ছিল মানুষ। মানুষই আমার প্রকৃতি, মানুষই আমার ঈশ্বর, আবার এই মানুষের অবহেলা-ঘৃণাই আমাকে দেখিয়েছে জীবনের অন্য আলোর উৎস। যত বার মানুষ আঘাত করেছে ততবারই আমার প্রতিজ্ঞা আরও দৃঢ় হয়েছে। অন্যের কাছে যে আঘাত পেলাম আমি অন্যকে তা কোনদিনই ফেরত দেব না।
মুক্তমনা নিজের কথা লেখার সুযোগ করে দেওয়াতে খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি । লিখতে ইচ্ছে করছে মনের আগল খুলে। কিন্তু এও ভাবছি অতি সাধারণের জীবন নিয়ে অসাধারণ কিছু লেখার কোন অবকাশ আদৌ আছে কি? শুন্য থেকে যার সূত্রপাত, সে দৌড়ে দৌড়ে বড়জোর তার চারপাশে এক নিজস্ব বলয় তৈরি করতে পারে। হতে পারে এক বৃত্ত, বৃত্তের বাইরে আসার সাহস ও শক্তি খুব একটা থাকেনা তার। তেমনই এক বৃত্তের ভেতরে বসবাস আমার । আর এই বৃত্তের ভেতরে কবে কোত্থেকে আলো এল আজ বলব সেসব কথা। এগুলো ঠিক কতটুকু আলোর কথন হবে তা বিচারের ভার পাঠকের হাতেই রইল। আর এই সুযোগে আমি আমার বাবার কথা দিয়েই শুরু করতে চাই। পৃথিবীর সব বাবাই হয়ত তাদের সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার বাবাও তেমনি।
বাবা কাজ করতেন পশ্চিম পাকিস্তান আর্মিতে । আর্মার কোরের সিকিউরিটি বিভাগে । আইয়ুব খানের শাসনামল তখন, বাবার সাথে তাঁর ঊর্ধ্বতনের দাপ্তরিক দায়িত্ব অবহেলা বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। বাবা খুব দৃঢ়তার সাথে নিজের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন, “আমি যা বলছি সম্পূর্ণ সত্য এবং এখানে আমার কোনই ভুল নেই, সেটা আমি প্রমাণ করে দেব। অভিযোগ মিথ্যে প্রমানীত হলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব।” তথাপিও সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাবাকে বিশ্বাস করলেন না। সেটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে গেল। আপাততঃ বাবাকে অন স্টেশন ডিউটি করে দেওয়া হল। বাবা যা মেনে নিতে পারেননি একদমই। সেই সময়ই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ওদের সাথে আর নয়, তিনি ফিরে এলেন তাঁর মায়ের কোলে, আর ফিরবেন না বলেই। বিভাগীয় তদন্তের ফলাফল হিসেবে বাবা নির্দোষই প্রমানীত হলেন।তাঁকে ফিরে গিয়ে কাজে যোগদান করার জন্য নোটিশ পাঠানো হলেও বাবা ফিরলেন না। বাবার আত্মসম্মানে লাগল বড়। যারা সামান্য সন্দেহের বশে বাবাকে কাঠগরায় দাঁড় করালেন তিনি আর তাদের চাকরি করবেন না। পরবর্তীকালে বাবা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন, মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে, সেক্টর ৯ এ। বাবার কাছে ছেলেবেলায় শুনেছি এই গল্প। এই গল্পের মত করে প্রতিদিনের জীবনে যে বাবাকে পেয়েছিলাম তিনি আমাকে ঠাকুমার ঝুলি, ঈশপের গল্প, হ্যারি পটার এসব পড়তে শেখাননি বটে; কিন্তু তাঁর জীবনচরিতের মধ্য দিয়ে একটা মেসেজ আমি পেয়েছিলাম সেটি হল, মানুষ কেবলই মানুষ! শ্রেণীভেদ জাত ধর্ম সকল ভুলে মানুষের প্রথম পরিচয় সে মানুষ। প্রতিটি মানুষের ভেতরে রয়েছে অসীম সম্ভাবনা, তাই মানুষকে কখনো অসম্মান করবে না, করবেনা অবহেলা। বাইরের দৃঢ় কঠিন চরিত্রের বাবার ভেতরে এক মায়া-মমতায় ভরা সলিল হৃদয় ছিল, যা দুঃস্থ-গরীব-এতিমের জন্য কাঁদত। আমাদের শৈশবে এমন কোন ঝাকঝমক না থাকলেও বাবার হৃদয় কাঁদত আমাদের প্রতিবেশিসহ আরো অনেক ছেলেমেয়েদের জন্য। যাদের খেতে পরতেই কষ্ট ছিল অনেক। বাবা আত্মীয়-অনাত্মীয় এমন অনেক ছেলেমেয়েদের পরাশুনার খরচ বহন করতেন, খাবার কিনে দেওয়া, স্কুলের বেতন দেওয়া এসব বাবার নিত্যকার কাজেরই অংশ ছিল।
পরিবারের পরই বাবার মত এক শিক্ষক পেয়েছিলাম যিনি প্রকৃত অর্থে আমার বাবারও শিক্ষক ছিলেন। জ্ঞানের অসীম ভান্ডার ছিল তাঁর। যিনি একাধারে ইংরেজি ব্যকরণ আর গণিতে সমান পারদর্শী ছিলেন। তাঁর অসামান্য মেধা-জ্ঞান-দক্ষতার বাইরেও যে জীবনবোধ ছিল যা আমাকে তাঁর খুব কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই কৈশোরেই যিনি আমার জীবনে মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। যিনি আমার জীবন প্রদীপের পাদপ্রান্তে বসে আলো জ্বালছেন আজো। আজো দূর থেকে সূর্য হয়ে আলো দিচ্ছেন আমায়। আমি পথ চলছি সে আলোয়। তিনি আমার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতেন, “মেয়েরা হল সমাজের ক্রীড়নক; সুযোগ পেলেই সবাই এক দান খেলে নেবে। তাই মেয়েদেরকেও লড়তে শিখতে হবে। দাঁড়াতে হবে মেরুদণ্ড সোজা করে, যাতে প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে খেলাটার জবাব দেওয়া যায়। তোর ভেতরে আগুন আছে বুঝলি। তুই পারবি, কখনো পেছনে ফিরবি না আর। এগিয়ে যাবার আনন্দেই ছুটবি কেবল, আমার আশীস রইল তোর জন্য।” এভাবেই আমাকে সাহস জোগাতেন সবসময়। আমি ভুলে গেলেও তাঁর জীবদ্দশায় আমার খবরাখবর নিতে তাঁর কোন ভুল হতনা। আমার প্রতিটি সঙ্কটে-আনন্দে-বেদনায় পাশে পেয়েছিলাম তাঁকে।
ক্লাশের পাঠের বাইরেও আরো কিছু যে পঠিত বস্তু থাকতে পারে সেসব জেনেছি একটু বেলা করেই; গণ্ডগ্রামের ভূতুড়ে পরিবেশে যেটুকু আলো ছিল তাতো ঐ হ্যারিকেনের চিমনিই একমাত্র ভরসা । গ্রামের একমাত্র পারিবারিক লাইব্রেরি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিজ বাসভবনে। আর সেখানে শিশুতোষ কিম্বা কিশোর সাহিত্য বলতে কিছুই ছিলনা। তবুও কোথায় যেন এক আকর্ষণ অনুভব করি, তীব্র আকর্ষণ! প্রধান শিক্ষকের কন্যা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সেও বইয়ের পোকা। বন্ধুর সুবাদে ওদের আলমীরা থেকে আমিও লুকিয়ে চুরিয়ে বই পড়ি ওর কাছ থেকে নিয়ে। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের বকুনির ভয়ে পাঠ্য বইয়ের তলায় অপাঠ্য বইখানা রেখে পড়া শেষ করে রাত গভীর করেই ঘুমিয়েছি। উপন্যাসের নায়িকার দুঃখে চোখের জলে বালিশ ভিজেছে কত রাত। তখন উপন্যাসের চরিত্রের সাথেই দিনযাপন ছিল; পরের দিন সকালে প্রিয় বন্ধুর সাথে আবার সেই গল্প নিয়ে আলোচনাও করতাম, কেন এমন হল অন্যরকমও হতে পারত শেষটা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার স্বল্প শিক্ষিতা স্নেহময়ী মায়ের কাছেই ছিল লেখালিখির হাতেখড়ি। মা নিজেই লিখতেন ছড়া, কবিতা। আর এসব আমাদের নাম দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন বাংলাদেশ বেতারে। রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটির সকালে মা আমাদেরকে নিয়ে বসতেন রেডিও শুনতে। আমরাও গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ঘোষিত হবে আমাদের নাম । প্রায় সব সপ্তাহেই মায়ের নতুন কবিতা আমাদের নামে পড়া হত। সেসব দিন ছিল কেবল আনন্দ কুড়নোর দিন। মায়ের এই কাজের অন্য কোন মানে খুজিনি সেদিন, কিন্তু আজ মনে হয় মা অন্তরে আলো জ্বালার কাজটিই করেছিলেন ।
বই পড়ার নেশা শুরুর দিকে ফাল্গুনী, নিহাররঞ্জন, শরৎচন্দ্র এদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল, একসময় পাঠের তালিকায় শুধু উপন্যাস নয়; যুদ্ধ, বিপ্লব, বিপ্লবের ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এসবও যোগ হল, তখন কেবল পাঠেই আনন্দলাভ । তাই গোগ্রাসে গিলেছি অনেককিছুই। বই কিনে পড়ার সামর্থ্যও ছিল না তখন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বইয়ের দোকানের ছেলেটি কোন এক অজানা কারণে পছন্দ করে আমাকে। কষ্টেসৃষ্টে দু’পয়সা জমিয়ে দুএকখানা বই কিনি ওর কাছ থেকে আর বাকীগুলো আমার একটু হাসির বিনিময়েই নিয়ে আসি এক রাতের শর্তে। কভার খুলে রেখে পাতা না ভাঙ্গার শর্তে কেমন ভালবেসে ও ও দিয়ে দিত আমাকে অনেক বই। সব বই একরাতে পড়া হয়নি, তবুও দিত। বই পড়ে ঠিক কতটুকু বিদ্বান বনেছি তা জাহির করতে এ গল্পের অবতারণা করিনি । পাঠকের কাছে কেবল বলতে চাইছি আমার ভালবাসার আর বেড়ে ওঠার গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে ছাত্র রাজনীতিতে বাম সংগঠনগুলো ছিল তুঙ্গে, বেশ তারুণ্যে ভরপুর । ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী তখন এদেরই রাজত্ব। বাম ধারার রাজনীতি মানে প্রগতিশীলতা, প্রগতিশীলতা মানেই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে অবস্থান(!) কিন্তু জীবন ও জগতের অনেক কিছুতেই এই দুই জাতের সহ অবস্থান(?)আমাকে রাজনীতি কিম্বা ছাত্র রাজনীতিতে বিমুখ করে রেখেছে সর্বদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে প্রগতিশীলতা শব্দটি একটা ফ্যাশান বই কিছুই নয়। যেহেতু আমি প্রতিক্রিয়াশীল নই তাই বামদের সাথে ওঠাবসাটা সঙ্গতই ছিল। কিন্তু সক্রিয় কর্মী হবার থেকে মৌন সমর্থনই আমার স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা ছিল। দেশে তখন স্বৈরশাসক এরশাদ সাহেবের শাসন; দেশব্যাপী বর্তমান দুই প্রধান দলের অনেক প্রচারণা, তাদের সহ অবস্থান, এরশাদ পতন আর গণতন্ত্র এ দুইই তাদের এক দাবী…। এত কিছুর মধ্যেও আমার কেন জানি মনে হত ছাত্রদের রাজনীতি করারই দরকার নেই। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সার্বিক রাজনীতিতে যে নোংরামীর বিষবাষ্পে ভরে গেছে, তার থেকে ছাত্রদেরও পরিত্রাণ নেই। ছাত্ররা এই রাজনীতির আবর্তে বন্দী না হলেই তাদের মঙ্গল। ছাত্রদের রাজনীতি কোন লেজুড়বৃত্তি সাংগঠনিক রাজনীতি হবেনা। তারা কথা বলবে নিজেদের স্বার্থে। তারা সংগঠিত হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায়। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করবে তারা। যাতে ভবিষ্যতে দেশের ক্রান্তিকালে তারাই কাণ্ডারির ভূমিকায় হাল ধরতে পারে। তাই ছাত্রদের উচিৎ শুধুই পড়াশোনা করা। শুদ্ধ জীবন বোধ তৈরি করা ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শেষ হবার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি সরকারি চাকরি করব না। বাবার বড় সাধ ছিল আমি ডাক্তার হই। যখন সমাজবিজ্ঞান পড়লাম বাবা খুব কষ্ট পেলেন। তবুও বাবা বলতেন, এবার বিসিএস টা দিয়ে দে। কিন্তু আমি যে সরকারের চাকর হবনা, আমি যে এই বুহ্য ভাঙতে চাই, একথা বাবাকে কে বোঝাবে? আমি যে স্বপ্ন দেখি সরকারের ভুলগুলি ধরিয়ে দেবার, কীভাবে আরো বেশি সুশাসন অর্জিত হয়, কীভাবে গণতন্ত্র শুধু কিতাবে নয়, পলিটিক্যাল মেনুফেস্টোতে নয়, মানুষের জীবনযাপনের জরূরী অংশ হয়ে যায়, কীভাবে প্রতিদিনের ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার আমাদের প্রচেষ্টায় জাগ্রত হয়, কীভাবে আমাদের মুখস্থ শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা যায় সেসব চিন্তা আমার রাতের ঘুমকে হারাম করে দিত তখনই। তবুও বাবার ওজর আপত্তির মুখে আমি একটা সরকারি কাজে জয়েন করলাম। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের অধীনে। জার্মান দাতা সংস্থা জিটিজেড এবং ইউনিসেফের যৌথ ব্যবস্থাপনায় দামী সব আসবাব, নতুন চকচকে অফিস, উন্নত সব অফিস সাপ্লাই-ইকুইপমেন্ট; পদমর্যাদা ভালো। সেলামীও মন্দ নয়। সবাই আমাকে স্যার বলেন। প্রতিদিন অনেক লোক আমার কাছে ছবি, সার্টিফিকেট এসব সত্যায়িত করতে আসেন। আমি তখন সরকারের নন ক্যাডার কোটার এক ছোট্ট চাকর। এতো মহা আনন্দের বিষয়! কিন্তু আমার এই সাহেবি জীবন ভাল লাগল না। আমি যে মাটির মানুষ! মাটি আমাকে টানে, মাটির টানে আমি ছুটি শেকড়ের পানে। শেকড়টাকে শক্ত ভিত্তি দিতে আমি আরও শক্ত হই; আমার শপথ হয়ে ওঠে আরও দৃপ্ত কঠিন।
আমার সবচেয়ে বড় কষ্টের কারণ ছিল আমার কোন কাজ ছিল না সেই অর্থে। কাজ না করে সময়গুলো পেপার পড়ে কিম্বা গল্প করে কাটানোটা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিলনা । আর কাজ না করে বেতন নেওয়াও আদৌ যুক্তিযুক্ত মনে হত না আমার। প্রথম প্রথম স্কুল ভিজিট করা আর দু’একটা প্রশিক্ষণ আয়োজন করা ছাড়া কোন কাজই করতে হতনা আমায়। পরবর্তীতে আমার স্কুল ভিজিটও বন্ধ হয়ে গেল হেড অফিসের নির্দেশে। কেন সেটা বলছি; স্কুল ভিজিটে আমি টিচারদের কাছে এক জমদূতে পরিণত হলাম। সারপ্রাইজ ভিজিট করতাম আমি, ব্যস! আমার রিপোর্টের কারণে বেশকিছু টিচারের বেতন বন্ধ ! পর পর কয়েকবার এই ঘটনা ঘটার পরে একবার হেড অফিস থেকে পরিচালক-প্রশিক্ষণ এবং পরিচালক-প্রশাসন দুজনে আমাকে নিয়ে মিটিং করলেন এবং আমাকে নিয়ে একত্রে স্কুল ভিজিটে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত হল । স্কুলে আমি ওনাদের সাথে কেবল অবজারভার হিসেবেই ছিলাম। ফিরে এসে আবার মিটিং হল। আমি আমার প্রতিবেদনের মূল পয়েন্টগুলো উপস্থাপন করলাম। আমার এর আগের ভিজিটগুলোর রিপোর্ট নিয়েও ওনাদের কোন সংশয় রইল না। তথাপি ওনারা আমাকেই কাউন্সেলিং করলেন। বললেন, “সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছ, বাম রাজনীতি করতে? তোমার কথায় কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছি, ছাত্র ইউনিয়ন? গায়ের রক্ত গরম! এত রক্ত গরম ভালো নয়, তাছাড়া তুমি মেয়েমানুষ। অনেক সমস্যাসঙ্কুল হবে তোমার এই পথচলা; আমরা এসেছি তোমার ভাল’র জন্য। তুমি কীভাবে ইন ফিউচার কাজ করতে পার সেই দিকনির্দেশনা দেওয়াই আমাদের দায়িত্ব। আমাদের কথা না শুনলে তুমি শোকজ লেটার পাবে। অকারণ নিজেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে। কী লাভ নিজের ক্ষতি করে? এসব বাদ দাও, একটা ক্লাশ ওয়ান অফিসারের জব পেয়েছ বিনে ঘুষে, বিনে টেলিফোনে। তোমার মেধা আছে, সেটাকে কাজে লাগাও, আরও ভালো কিছু করতে পারবে জীবনে।” এসব কথা হচ্ছিল দিনাজপুর সার্কিট হাউজের গেস্টরুমে। আমি মিটিং শেষে বের হয়ে একটা রিক্সা ডেকে ভাড়া ঠিক না করেই হুড খুলে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে উঠে পড়ি নিজগৃহের ঠিকানায় । যেন মুক্ত বাতাসে কিছুক্ষণ শ্বাস নিতে চাই। বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আর এখানে নয়। আমাকে ফিরতে হবে আপন গন্তব্যে।
এনজিও’র নাম শুনলেই তখনকার প্রগতিশীল সমাজের বড় গাত্রদাহ হত। তাদের গাত্রদাহের নানাবিধ কারণও ছিল এনজিও নিয়ে, এখনো আছে। যেহেতু আমি প্রগতিশীল নই, আর স্বাধীন ব্যবসাও নেই, সরকারের গোলামীও করব না। আমি করবটা কী? আমাকে এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে করে আমি নিজের পেট বাঁচানোর সাথে সাথে মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে ভাবতে পারি। সেক্ষেত্রে এনজিও ভিন্ন আমার কোন গত্যন্তর নেই, ছিলনা। সরকারের গোলামী ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আমি যোগদান করি কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে। এই যোগদান প্রসঙ্গে আরেকটি মজার গল্প পাঠকদের কাছে না বললেই নয় । আমি কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এ সিলেক্টেড হয়েছি জেনেই আমার রেজিগনেশন পত্র সাবমিট করি মন্ত্রণালয়ে। যা দীর্ঘদিন ফাইল বন্ধী হয়েছিল তৎকালীন শিক্ষা সচিব এ এইচ কে সাদেক সাহেবের টেবিলে। আমি একের পর এক ফোন করছি, আর না সূচক জবাব পাচ্ছি। আরে বাবা! আমি তোমার চাকরি করছি না, সেটা গ্রহণ করে আমাকে মুক্তি দিতে তোমার এত সময় নিতে হচ্ছে কেন? এদিকে কেয়ার আমাকে মাত্র এক মাস সময় দিয়েছিল। আমার সময় প্রায় শেষ, আমি তখনো ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ পাইনি মন্ত্রণালয় থেকে। অগত্যা নিজেই তখন সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করার পরিকল্পনা করি। আর তখনই দৈব বাণীর মত শুনতে পাই আমাকে শিক্ষা সচিব মহোদয় দেখা করতে বলেছেন। সেই মত দেখা করলাম ওনার সাথে। বাপরে বাপ! সে আরেক বিশাল ইন্টারভিউ। কেন চাকরি ছাড়ব এই প্রসঙ্গে ওনার প্রশ্নের অন্ত নেই এবং আমার চাকরিটা কি কি কারণে ছাড়া উচিৎ নয় সে নিয়ে ওনার দীর্ঘ বক্তৃতা ধৈর্যধারণ করে শুনতে হয়েছিল। চাকরি ছাড়াও যে পাওয়ার মত কম কঠিন কাজ নয় সেদিন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
তারপর কেটে গেল অনেক বছর। যাত্রা শুরুর পরে প্রায় ১৬ বছর একসাথে পথ হাঁটলাম দুঃস্থ নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত মানুষদের সাথে। উপলব্ধি করলাম জীবনকে, জানলাম অবস্থা ও অবস্থানের নিবিড় সম্পর্কগুলো। দেখলাম ক্ষমতা কাঠামো কীভাবে শোষণ করছে নীরিহ জনগণকে, রাষ্ট্রের আইনী কাঠামো কীভাবে দুর্নীতিবাজদেরকে আরও দুর্নীতি করার সুযোগ দিচ্ছে। মানুষ কীভাবে কর ফাঁকি দিয়ে গড়ছে সম্পদের পাহাড়, প্রশাসন কীভাবে অন্যায়–অবিচারের জাঁতাকলে পিষে মারছে পিপীলিকাসম এই বাংলাদেশী মানুষদের । এসব দেখে শুনে নীরবে চোখের জল ফেলিনি, গর্জে উঠেছিল কলম! প্রতিবাদই ছিল একমাত্র পন্থা; সাংগঠনিকভাবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে, আর কলমই ছিল যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার! পেশাগতভাবেই আমার কাজটি ছিল লেখাজোঁখা । মানুষের নীল দুঃসময়ে মানুষেরই পাশে ছিলাম, আজো আছি। আজ যখন আয়লান বালুচরে ভেসে থাকে, যখন রাজনের, রাকিবের আর্ত চিৎকার বাতাসে ভাসে, যখন অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত নিলয়ের রক্ত বিদীর্ণ করে আকাশের বুক, ওদের হত্যার দায় এড়িয়ে যায় রাষ্ট্র আমি যন্ত্রণা পাই। আমি দগ্ধিভূত হই। নিজেকে অসহায় মনে হয়। ক্ষমতাহীন মনে হয় । মনে হয় আমি কোন এক অন্ধকারে ডুবে আছি। নিমজ্জিত হয়ে আছি বিশাল আঁধার কোন এক কূপে। আবার আমি জেগে উঠি, আপন আলোয়, ছুটি… দাঁড়াতে মানুষের পাশে, মানুষ হয়ে! প্রতিদিন একটু একটু করে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াইটা নিয়ে। কেন্দ্রেই ধাবিত হই আবার। বৃত্তের ক্রমাগত যাত্রা তো কেন্দ্রাভিমূখেই !
……। জানি, আলো আসবেই।