বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একবন্ধুর মাধ্যমে প্রথম মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে পরিচিতি হয় এবং এটিই ছিল আমার প্রথম ব্লগ সম্পৃক্ততা। এর আগে কোন ব্লগের সঙ্গেই আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও প্রকৌশল তথা বিজ্ঞানের প্রতি আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। এর চেয়ে যুক্তিবাদ, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস এসবই টানত বেশি। এর বাইরে ক্রীড়াপ্রেমী ছিলাম। অবসর সময়ে ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস এসব নিয়েই থাকতাম। ছোটবেলায় ধার্মিক থাকলেও বয়স যতই বেড়েছে ধর্ম, সৃষ্টিত্বত্ত, আত্মা সহ নানা বিযয় নিয়ে এক ঝাঁক প্রশ্ন কাজ করত মাথায় কিন্ত কোন প্রশ্নেরই গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে পেতাম না। উল্টো প্রশ্ন করলে ধার্মিকদের কাছ থেকে “সব বিষয়ে প্রশ্ন করতে নেই”, “যারা বিজ্ঞান অল্প জানে তারাই হয় নাস্তিক” এই টাইপের কথাও শুনতে হত। মনের গহীনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ দানা বাধলেও তাই একেবারে শৈশব থেকে গড়ে উঠা ধর্মীয় বিশ্বাস গুলোকেও পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারতাম না। মুলত সন্দেহ আর বিশ্বাসের এক ধরনের দোলাচলের মধ্য দিয়ে কাটতো সে সময়ের দিনগুলো।

একদিন কিভাবে কিভাবে যেন আরজ আলী মাতুব্বরের “সত্যের সন্ধানে” বইটি হাতে পাই। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি সেটি। দীর্ঘ দিন ধরে মনের মধ্যে লালিত অনেক ভ্রান্ত বিশ্বাসকে তীব্র ভাবে আঘাত করে বইটি। আরজ আলী মাতুব্বরের লেখা এই বই পড়েই প্রথম ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন একজন মানুষের এত উচ্চমানের দর্শন চিন্তা দেখে সেসময় অবাকও হয়েছিলাম খুব। মূলত এরপর থেকেই তুলনামূলক ধর্মত্বত্ত ও ঈশ্বর দর্শন নিয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। একসময় হুমায়ূন আজাদ, প্রবীর ঘোষ সহ বেশ কিছু মুক্তচিন্তক লেখকদের বই পড়েছি। হুমায়ূন আজাদের “আমার অবিশ্বাস” এবং প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” এই দুটো বই আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো বই আমার চিন্তা ভাবনাকে এক লাফে এগিয়ে নিয়েছিল অনেক দূর। এর বাইরেও মাঝে মধ্যে নিজের আগ্রহেই দর্শন, ধর্মত্বত্ত সহ নানা বিষয়ের উপর বাংলা ভাষায় লেখা বইপত্র খুজতাম। কিন্ত আগ্রহ থাকা স্বত্তেও খুব বেশি বই খুঁজে পাইনি। তাছাড়া সব সময় টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্যও সেসময় ছিল না। ফলে মুক্তমনা ব্লগের সন্ধান পাওয়া ছিল আমার কাছে রীতিমত আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত ব্যাপার। বাংলা ভাষায় এত তথ্য সমৃদ্ধ লেখা আর যুক্তি তর্ক করার এই আদর্শ প্লাটফর্মটির সঙ্গে কেন আরো আগে পরিচয় হয় নি তা নিয়ে সে সময় জন্ম নিয়েছিল প্রচন্ড আফসোস। মূলত এরপর থেকেই মুক্তমনার সঙ্গে নিয়মিত পথ চলা শুরু।

মুক্তমনা ঘাটতে গিয়েই প্রথম এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অভিজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় হওয়া। অভিজিৎ রায়ের কোন লেখাটি সর্ব প্রথম পড়েছিলাম তা মনে নেই তবে এটি মনে আছে প্রথম লেখাতেই মনের মাঝে মুগ্ধতার এক অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে ছিলেন তিনি। দর্শন, বিজ্ঞানের মত কাঠখোট্টা বিষয়গুলো যে এত প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা যায় সেটা প্রথম ধারনা হয় তার লেখা পড়েই। এরপর যতই দিন গেছে তার লেখার প্রতি মুগ্ধতা দিন কে দিন বেড়েছে। বিবর্তনবাদ , মহাবিশ্বের উৎপত্তি, ধর্মের অসারতা , মুক্তিযুদ্ধ , উপজাতিদের অধিকার, মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবতাম কোন বিষয়েই বা তিনি লেখেননি । আত্মা বিষয়ক তার একটি ধারাবাহিক লেখা পড়েছিলাম যেটি ছিল এক কথায় মাষ্টারপিস। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই তার সেই লেখাটির মাধ্যমে। “ডারউইন দিবস”, “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন” এবং “কেন কোন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে” শীর্ষক লেখা গুলোও ছিল এক কথায় অসাধারন। তার লেখা শুধু মনের মাঝে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতেই সহায়তা করেনি, অনেক বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে রীতিমত পাল্টে দিয়েছে। এক সময় অন্য অনেকের মত আমিও সমকামীদের নিয়ে বিরুপ মনোভাব পোষণ করতাম। কিন্ত সমকামীতা যে মোটেও প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিছু নয় , সমকামীদেরও যে আমাদের সমাজে পূর্ণ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে এই বিষয়ে নুতুন করে ভাবতে শেখায় অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলি। দেশপ্রেম বিষয়ক তার একটি লেখার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এভাবেই একটু একটু করে অভিজিৎ রায়ের লেখার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এর বাইরে বিপ্লব পাল, বন্যা আহমেদ , ফরিদ আহমেদের লেখাও ভাল লাগতো। মূলত মুক্তমনা লেখকদের লেখালেখিতেই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়ীকতা, কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিড়ে একটু একটু করে এগোতে থাকি আলোর পথে। এক পর্যায়ে আবিস্কার করি বিজ্ঞানের কাঠখোট্টা বিষয় যেগুলোর প্রতি আমার কোন কালেই আগ্রহ ছিল না, সেগুলোর প্রতিও কিভাবে কিভাবে যেন আগ্রহ ফিরতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয়গুলো পড়তে যেন আবারো আনন্দ পেতে শুরু করি। আজ বিজ্ঞানের প্রতি আমার যতটুকু্ আগ্রহ তার প্রায় অনেকটাই অভিজিৎ রায়ের কৃতিত্ব।

বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মত্বত্ত সহ নানা বিষয়ে অভিজিৎ রায়ের অগাধ পান্ডিত্য যেমন মুগ্ধ করত তেমনি নিজের জ্ঞানের দৈন্যতার কারনে তার সামনে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতাম। এই হীনমন্যতার কারনে মনে অনেক প্রশ্ন থাকা স্বত্তেও সেগুলো তাকে করা হয়নি। এই হীনমন্যতা কাটতে সময় লেগেছিল অনেক দিন। তারপর ওনার কিছু লেখায় মন্তব্য করে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম কিন্ত সেটিও খুব বেশি নয়। ইচ্ছে ছিল তার সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার। কিন্ত কে জানত ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন এই বাংলাদেশে এই মানুষটি অত্যন্ত স্বল্পায়ু নিয়ে জন্মেছিলেন। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত না হওয়ার এই আক্ষেপ সারা জীবনই আমার সঙ্গী হবে।

ব্যক্তি অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আমার খুব একটা জানাশোনা ছিল না। তবে দূর থেকে যতটুকু পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে তার একটি বিষয় আমাকে খুবই অভিভূত করেছে। সেটি ছিল তার নিরহংকার। এত জনপ্রিয় হবার পরও তার মধ্যে কখনো বিন্দুমাত্র অহংকার দেখিনি। জনপ্রিয়তা যে অধঃপতনের পথে প্রথম ধাপ এই বিষয়ে পূর্ণ সচেতন ছিলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অন্তর্জালে দীর্ঘ দিন ধরে চলা বাংলা ব্লগ আন্দোলন রীতিমত লাইম লাইটে চলে আসে এই আন্দোলনের মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে কিছু ব্লগারও রীতিমত তারকা খ্যাতি পায়। বিখ্যাত হবার পর তাদের অনেকের আচরন বদলে যেতে দেখেছি। অনেকে আবার ব্লগ ছেড়ে ফেসবুকে মিনি ষ্ট্যাটাস লেখাকেই তাদের লেখালেখির প্রধান সম্বল বানিয়ে নেয়। কিন্ত অভিজিৎ রায় ছিলেন এদের মাঝে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ফেসবুকের সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ ত্যাগ করে ব্লগে বিস্তারিত লেখা এবং আলোচনাকেই তিনি উপযুক্ত বলে মনে করতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাকে ব্লগে নিয়মিত সময় দিতে দেখেছি, দেখেছি অনেক অর্থহীন তর্ক বিতর্কে ধৈর্য সহকারে অংশ নিতে। ধর্মান্ধদের ব্যক্তি আক্রমন, হুমকি-ধামকি কোন কিছুই তাকে টলাতে পারেনি তার আদর্শ থেকে। তিনি সম্ভবত জিওর্দানোব্রুনো , কোপার্নিকাস সহ যে সকল বিজ্ঞানী, মানবতাবাদীগণ ধর্মান্ধদের অত্যাচার নিগ্রহের শিকার হয়েছেন তাদের দ্বারা প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই প্রবল অনুপ্রেরণাই ছিল তার লেখালেখির অফুরান উৎস। আদর্শিক দৃঢতা, নিরহংকার আর মাটিতে পা রাখার এই আশ্চর্য ক্ষমতাই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। তবে পারভেজ আলমের সঙ্গে তার “সালাফী সেক্যুলার” শীর্ষক বিতর্ক যে কদর্য ব্যক্তি আক্রমনে রুপ নিয়েছিল সেটি মোটেও ভাল লাগে নি। অভিজিৎ রায় যিনি এদেশের অনেক মানুষের কাছে আদর্শ তার কাছে এই জাতীয় আচরন মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না।

মুক্তমনা ব্লগটিই ছিল অভিজিৎ রায়ের প্রধান ধ্যান জ্ঞান। ফলে অভিজিৎ রায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ছিল মুক্তমনার জন্য অনেক বড় আঘাত। সে সময় মুক্তমনার ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবেও কিছুটা সংশয়ের মধ্যে ছিলাম। এরই মাঝে মুক্তমনায় উগ্র নাস্তিকতা বনাম ভদ্র নাস্তিকতাকে কেন্দ্র করে যে বিভাজনটা তৈরী হল সেটিও ছিল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। মানছি যে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে মাননীয় মডারেটর কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা মন্তব্য মডারেশনের ব্যাপারে মডারেটর আরো সহনশীল হবেন বলেই প্রত্যাশা করছি। সেই সঙ্গে অভিজিৎ রায়ের লেখা গুলোকে কি করে আরো বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দেয়া যায় সেটাও ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

গ্যালিলিও বলেছিলেন-” You cannot teach a man anything, you can only help him find it within himself.”
অভিজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এটাই যে তিনি আমার মত হাজারো তরুনের মনের মাঝে জ্ঞানের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সবকিছুকে অবিশ্বাস করতে বলেছেন , প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন, তিনি তার তীক্ষ ভাবনা চিন্তাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন হাজারো মানুষের মাঝে। পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই , দাদা আপনি জানেন কিনা জানি না আপনি আমার মত হাজারো তরুণের জীবন দর্শনকে পাল্টে দিয়েছেন, মন থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতার সর্বশেষ চিহ্নটিকেও মুছে ফেলেছেন, সর্বোপরি এই মহাজগতটাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন নুতুন করে। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় স্বার্থকতা আছে বলে মনে করি না। জেনে রাখবেন ধর্মান্ধতা ,সাম্প্রদায়ীকতা, কুপমন্ডকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমুখী প্রগতিশীল সমাজ গঠনের যে আন্দোলন আপনি শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলন কোন ধর্মান্ধের ক্ষণিকের আঘাতে কখনোই থেমে যাবে না বরং আবারও ফিরে আসবে নুতুন উদ্যমে। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীলতায় আচ্ছন্ন আমাদের এই অন্ধকার সমাজে আপনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক , ছিলেন একজন সত্যিকারের এক আলোক যাত্রী।