লেখক: অনিন্দ্যসুন্দর চক্রবর্ত্তী

একটি গান। এতই শক্তিশালী, বিশেষ করে সুরে এবং কথায়-ও যে শ্রোতার সমস্ত সত্ত্বাকে ব্ল্যাকহোলের মত আকর্ষিত করে নিতে পারে নিজের ভেতরে। করেও। এতই মায়াবী যে শ্রোতাকে সম্মোহিত করে ফ্যালে মুহূর্তে। একটি গান যা বহুশ্রুত হয়ে-ও ঘষা পয়সার মত অব্যবহার্য হয়ে পড়েনি এখন-ও। কোনদিন হবে ব’লে মনেও হয়না ।

সেই কবে থেকে ইস্কুলের প্রেয়ার এ গেয়ে গেয়ে মুখস্ত করে রাখা একটি গান। অকল্পনীয় সরল কথা আর সুর।

“ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।।”

প্রত্যেক ১৫ই আগষ্ট আর ২৬শে জানুয়ারি সকালে ইস্কুলে সমবেত সঙ্গীতে গলা মেলানো। বাংলার স্যার হারমোনিয়ামে আর এক ছাত্র তবলায়… ধি ধি না। না তি না ঠেকা। সদ্য আড় ভাঙ্গা গলায় দশ বারো জন গাইতুম “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি…”। প্রত্যেকবার ‘সে যে আমার জন্মভূমি’ গাইতে গিয়ে কিশোর গলা তালপাকানো আবেগে ধরে আসত। শুদ্ধ ধা টা নড়ে নড়ে যেতে চাইত বারম্বার। এখনো, এই এতটা বয়সে এসেও দেখছি গলাটা নড়ে যেতে চায়। আর ন’ড়ে যেতে চায় সেই একই কারণে।

এ গান গাইতে তখন আমার কোন অসুবিধেই হয়নি। যেখানে সেখানে গাইতুম। ইস্কুলে, পাড়ায়, কোচিং ক্লাসের বিজয়া সম্মেলনী অনুষ্ঠানে। গাওয়াও সহজ, বাজানো-ও সহজ আর তদুপরি সে গানের অমোঘ মায়া! তখন রাজনৈতিক বোধ খুব একটা না থাকলেও এটুকু বুঝতে পারতুম যে চারদিকে যা দেখছি তাতে হয়ত এ দেশকে ‘সকল দেশের সেরা’ বলা যায় না। তবু সে গান গাইতে বা বাজাতে কোন অসুবিধে হয় নি আমার। ভাবতে অসুবিধে হয়নি ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভুমি।’

জীবনের বেলা যত বাড়তে থাকল ততই ঠোক্কর লাগতে থাকল। এটা ওটা পড়ি আর ঠোক্কর লাগে। ঠোক্কর লাগে নিজের-ই সাথে। নিজের বেড়ে ওঠার সাথে। ক্রমাগত ঠোক্কর। বিলেতি গান আর লেখা পড়তে পড়তে নিজের আজন্ম তথা আ-স্কুল লালিত মূল্যবোধে নাড়া লাগতে শুরু করল। প্রথমবার নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, গানটি কি সত্যিই মানবিক? গানটি কি নৈতিক? গানটি কি প্রয়জনীয়? অন্তত আজকে দাঁড়িয়ে!
সেটা ২০০২।

“সকল দেশের সেরা”! দেশ বলতে যে কি বোঝায় তাই নিয়েই ধন্দ তৈরি হচ্ছিল। আমার ঠাকুরদাদা দেশ বলতে বলতেন বরিশাল, আমি জানতুম ভারত যার বেশীর ভাগটাই আমার অজানা। পাশের বাড়ির লোকেরা বলতেন বর্ধমান। কারোর দেশ খুলনা কারোর শ্রীরামপুর! বিহারি কুলিদের বলা হ’ত হিন্দুস্তানি এবং তারা একদমই আলাদা দেশের লোক যারা ভাতের বদলে ছাতু খায়। থাকি পাশাপাশি কিন্তু সবার আলাদা আলাদা দেশ! ফলে কোন দেশটা যে সেরা সেইটে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মহাশয় জন্মেছিলেন ১৮৬৩ সালে। মারা যান ১৯১৩ সালে। সুতরাং তার দেশ হয় নদীয়া অথবা অবিভক্ত ভারত। তিনি নিশ্চয়ই অবিভক্ত ভারতকেই বোঝাতে চেয়েছেন। ভাঙ্গা ভারতের ধারনা তাঁর ছিলনা। তাই এই ‘সকল দেশের সেরা’ দেশটির গন্ডির মধ্যে বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তান ও ছিল। কিন্তু আজ যাঁরা গানটি গান তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশ বা পাকিস্তান কে সেরা দেশ ভাবেন না। যাঁরা শোনেন তাঁরাও না। যদিও গানটি সাজাহান নাটকের গান, ফলে গানটি নাটকে কি তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়েছে সে ঝামেলায় গেলুম না কেবল যে জাতীয়তাবাদি তাৎপর্যে এত দিন ব্যবহৃত হয়েছে এবং আজও হয় সেইটুকুতেই আমরা সীমাবদ্ধ থাকি।

ন্যাশনালিস্‌ম বা প্যাট্রিওটিস্‌ম যাই বলুন না কেন, এই ধারনা গুলো নিয়ে সেই ২০০২ থেকে আমার অশান্তি। দেশের ধারনা একটি ভুখন্ডের ধারনা যা রাজনৈতিক ভাবে ঠিক করে দেওয়া। আমার আপনার মশাই তাতে কোনই হাত নেই। যুগ যুগ ধরে তাই-ই হয়ে এসেছে। অশোকের ভারত আর বাবরের ভারতের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। ফলে একটা গোলযোগ তইরি হয় বইকি! যে ঢাকার বনানীর দিকে তাকিয়ে ’৪৭ এর আগে চমৎকার গাওয়া যেত “পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখি, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি…সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”, সে বনানী ’৪৭ এর পরে না বদলালেও গানটা আর আমরা গাইতে পারলুম না। বনগাঁ, কি রানাঘাট, কি লালগোলায় আমাদের দৃষ্টি, আবেগ, রোমান্টিসিস্‌ম, দেশাত্মবোধ সব কাঁটাতারে আটকা পড়ে গ্যালো। আর আমরাও মুখ ফিরিয়ে আমাদের দৃষ্টি ইডেন গার্ডেন, রবীন্দ্রসদন, দক্ষিণাপণে আটকে রেখে কান ঝালাপালা গাড়ির শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে চমৎকার গাইলুম, ‘ও তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি, পাখির ডাকে জেগে।’ আর বললুম, “বাংলাদেশটা জঘন্য বুঝলে। দ্যাখোনা হাড়হাভাতে বাঙ্গালগুলো কেমন বেড়া টপকে আসচে। আমাদের দেশের সবথেকে বড় সমস্যা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ।”

ভাবতুম আমার ঠাকুরদাদা যদি গানটি গাইতেন তবে কোন দেশের কথা ভাবতেন! তাঁর জন্মভূমি যে অন্য দেশ, সে দেশের নাগরিক তিনি নন।

আমার আপত্তি তৈরি হচ্ছিল ওই ‘সকল দেশের সেরা’ বা ‘সকল দেশের রানী’ শব্দবন্ধে। আমার দেশ বা তার সংষ্কৃতি বা তার ইতিহাস ভাল এ কথা আমরা বলতেই পারি। তাকে নিয়ে গর্বিত হওয়াও কোন সমস্যার নয়। কিন্তু যেটা বলা অনৈতিক তা হল, আমার দেশ বা তার সংষ্কৃতি বা তার ইতিহাসই শ্রেষ্ঠ। কারণ তাতে অপরকে হীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা থাকে। হয়ত প্রচ্ছন্ন কিন্তু বিদ্যমান। তা যতই মধুমাখা হোক, ভিতরে তার প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ। হয়ত আমারা টেরই পাচ্ছিনা।

এটা কেবল এই গানটির সমস্যা নয়। এটি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। ন্যাশানালিস্‌ম এর সমস্যা। আমি শ্রেষ্ঠ, আর বাকিরা নগন্য এই অহম বোধের সমস্যা। কেবল একটি গান নয় বার বার ন্যাশনালিস্ট গান বা অন্যান্য সাহিত্যে বা দলিলে এর প্রতিফলন দেখতে পাই ও শুনতে পাই। ধরুন পাড়ায় বাচ্চারা গাইছে “সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা”। সেই এক অহম বোধ। যার সাথে ফান্ডামেন্টালিস্‌ম এর ফারাক খুব ই কম। কথায় কথায় বার্নাড শ’ র দুটো লাইন মনে পড়ে গেল, “Patriotism is, fundamentally, a conviction that a particular country is the best in the world because you were born in it….”

শেষ স্তবকে এসে গানটি খুব-ই প্রতিক্রিয়াশীল একটি কথা বলে। “ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ…”। মনে পড়ে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় এই গানটা আমাদের বাংলা সিলেবাসে ছিল। হারাধন বাবু, আমাদের বাংলা শিক্ষক, পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন, “ওরা (মানে বিলেতিরা আর কি। চীন-জাপান-আফ্রিকা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা কম, প্রায় নেই বললেই চলে।) বড় হলেই বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যায়, বুঝলে, ভালোবাসা মমতা এসব ওদের মধ্যে নেই। আমাদেরই মধ্যে কেবল এসব মানবিক গুনগুলি বিদ্যমান।“

যখন আমার বোধদয় হচ্ছিল (বোধ আমার এখনও হোল না, জানি) তখন হারাধন বাবুর ওই কথাগুলো আমার খুব আপত্তি জনক মনে হত। পরে দেখেছি তিনি একা নন, অনেক লোক-ই এই রকমটাই মনে করেন। ইউটিউবে পোস্ট করা দেখতে পাচ্ছি, “বিদেশ গিয়ে আরো বুঝতে পারলাম কথাগুলো কত সত্যি!” গোছের কমেন্ট।

প্রশ্ন হল, পৃথিবীর মানুষকে এই রকম প্রেমহীন, স্নেহহীন অদ্ভুত প্রানী হিসেবে দ্যাখার অধিকার কি আমাদের আছে? অনেকে বলেন, “আহা! একেবারেই যে প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ ইত্যাদি নেই সেকথা তো বলেনি। আছে তবে কিনা আমাদের থেকে কম।” এই পরিমাপের অধিকার-ই বা আমাকে কে দিলো?

হতেই পারে ভালোবাসার প্রকাশ আমার যেমন, অন্যের তেমন নয়। তার মানে সেটা নেই বা আমার থেকে কম এটা বলা শুধু অনুচিতই নয়, অন্যায়। আমার ডাল ভাত আলু পোস্ত খেতে ভালো লাগতেই পারে এবং সকাল বিকেল সেদ্ধ সেদ্ধ স্যালাড আর পাউরুটি খেতে ভালো নাই লাগতে পারে। কিন্তু তার মানে এটা কখনই হতে পারে না যে ডাল-ভাত-আলুপোস্তটাই খাবার আর বাকিগুলো অখাদ্য।

এই অন্ধশ্লাঘা যে পথে আমাদের নিয়ে যায় সে বড় সাঙ্ঘাতিক। এই শ্লাঘার দরুন একটা সময় পর্যন্ত শেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের মণুষ্যপদবাচ্য বলে মনে করত না। করত না কি এখন-ও যে তা খুব মনে করে তা-ও নয়। নইলে মায়া আঞ্জেলিউকে কি আর Still I Rise লিখতে হয়?

মজার কথা হল এই যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, পোষাক থেকে শুরু করে ভাষা, স্থাপত্য, পরিবহন, সাচ্ছন্দ্য সবেতেই কিন্তু আমরা সেই সব দেশের কীর্তির ওপর নির্ভরশীল অথবা কৃতজ্ঞ যারা মোটেও ‘সকল দেশের সেরা’ নয়। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সব-ই তো দেখি ধার করা! যদিও নিশ্চিত জানি এটা প’ড়ে জাতীয়তাবাদীরা বলবেন, “আরে বাবা ও সব জ্ঞান তুচ্ছ, আসল যা সব জ্ঞান-বিজ্ঞান সব ব্যাদে (বেদে) আছে।” যদিও বেদ জিনিসটা খুব কম লোকেই পড়ে থাকেন আর খুব কম লোকেই জানেন তাতে সত্যিকারের কি আছে!

অনেকে বলবেন আমি বেরসিক। ওটি আসলে পোয়েটিক এক্সাজারেশান। কাব্যিক ভাবে বলা হয়েছে কিনা তাই আক্ষরিক অর্থে ধরলে চলবে না। ওটা ইমেজারির ভাষা। আমার মেনে নিতে কোন অসুবিধেই ছিল না কেবল সেই একটা খটকা বাগড়া দিচ্ছে। গদ্য বা পদ্য, প্রবন্ধ বা কবিতায় কোনটাতেই কি অপরকে হীন প্রতিপন্ন করার অধিকার আমাদের আছে? কবিতায় ফান্ডামেন্টালিস্‌ম লেখা যায় এই লাইসেন্স কিভাবে দেওয়া যায় এই প্রশ্নের উত্তর আমি পেলুম না। মানে ধরা যাক আমি কাউকে বললুম, ‘আপনি মশাই একটা রামছাগল’। তিনি রেগে গেলে আমি যদি বলি, “ইয়ে! মানে আপনার কন্ঠস্বরটির কথা মাথায় রেখে কাব্যটি লিখেছিলুম কিনা, আপনাকে অপমান করার জন্য মোটেও নয়। ওইটি আক্ষরিক অর্থে নিলে হবেনা ওটি আসলে পোয়েটিক এক্সপ্রেশন, বুঝলেন কিনা।” আমার মনে হয় না তিনি এইরকম সাফাইতে খুব একটা কনভিন্সড হবেন।

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিত শুধি পাঠকবৃন্দ আমাকে স্বজাতি বিরোধী, পাশ্চাত্য পদলেহনকারী, ভারতবিদ্বেষী, রাষ্ট্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন ইত্যাদি ভাবছেন। আমাকে মার্জনা করবেন আমি বলতে বাধ্য যে আমি ঠিক তাও নই। আমি যখন পড়ি,

“কশ্চিত্‌কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকার প্রমত্তঃ।
শাপেনাস্তাং গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেন ভর্ত্তুঃ।।
যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়াস্নান পুণ্যোদকেষু।
স্নিগ্ধচ্ছায়াতর্‌ষু বসতিং রামগির্য্যাশ্রমেষু।।”

তখন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এই শিল্প নিয়ে যদি গর্বিত না হই তবে আমি মুঢ়। মগজে যখন যাদুর মত হঠাৎ হিসেব গুলিয়ে দিয়ে ভেসে ওঠে অমোঘ কিছু লাইন,

“সখি হামার দুখক নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।”

তখন যদি আমি বিহ্বল না হই তবে আমার মানব জন্ম ব্যর্থ। কিন্তু আমি চোখে-কানে-চিত্তে অন্ধ হতে চাই নে। আমি উস্তাদ আমির খানের দরবারি কানাড়া আর হোয়াকিন রড্‌রিগোর কন্‌চেরতো দে আরা্নহুয়েস্‌ শুনে একি রকম কষ্টে ও যন্ত্রনায় অশ্রু সম্বরনের ব্যর্থ চেষ্টা করি। তাতে যে আমাকে যাই ভাবুক, আমার কিছু করার নেই।

সত্তরের দশকে, আমেরিকায় তৈরী দুটি গানের কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। ভীষণ জনপ্রিয় দুটি গান। একটা হল পিট সীগারের বানানো ‘মাই রেইনবো রেস’। সে গানের প্রথম স্তবকে তিনি লিখছেন,

“One blue sky above us,
One ocean lapping all our shore,
One earth so green and round,
Who could ask for more?”

কী সাবলীল ভঙ্গী তে সেই আর্ষপ্রতিম মানুষটি সারা পৃথিবীটাকে আপন করে নেন! ‘One earth so green and round, who could ask for more?’ আহা! মাথার মধ্যে সংক্রমনের মত জাঁকিয়ে বসে এ লাইন। হৃদয় প্রসারিত হতে থাকে, দৃষ্টি চলতে চলতে পেরিয়ে যায় পেট্রাপোল, বেনাপোল, যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রহ্মদেশ… ‘One earth so green and round…’ আমি এক বিরাট ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠি।

কিন্তু গান ওই লাইনেই থেমে থাকে না। অদ্ভুত এক স্বপ্নের মত গানটা চলতেই থাকে।

“And because I love you
I’ll give it one more try
To show my rainbow race
It’s too soon to die.”

সারা পৃথিবীর নানা বর্ণের মানুষকে ‘my rainbow race’ ব’লে সম্বোধন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাতে সেই মিথ্যে অহম ত্যাগ করতে হয়, অন্ধশ্লাঘার নেশা থেকে বেড়িয়ে আসতে হয়। জাতীয়তাবাদের বেড়া ভাঙ্গা সহজ নয়। সবাই তা পারে না।

“Imagine there’s no country” ব’লে সবাই গেয়ে উঠতে আর পারে কই! যেমন ১৯৭৫ এ লেনন সাহেব গেয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দেশের লোককে বেদ-বেদান্তর গর্বান্ধতা থেকে বেড়িয়ে পৃথিবীর পথে হাটতে তো দেখিনা খুব একটা। যা দেখছি তা হয়, ‘এ দেশে কিছু নেই’ ব’লে আমেরিকা, ইউরোপ বা গাল্‌ফে চাকরি করতে যাওয়া, নয় ওই জাতীয়তাবাদী সীমাবদ্ধতা, ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা।’

তবে কিনা গানটির রচনার সময়টিকে আলোচনার বৃত্তে না এনে মন্তব্য করা মোটেও যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গানটি লিখেছিলেন ১৯০৯ সালে। ১৯০৫ এ দারুন নাড়া দিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হয়ে গেছে। স্বাদেশী আন্দোলনে সারা দেশে দানা বেঁধে উঠছে। সেই সময় দাঁড়িয়ে এরকম একটি গান খুব-ই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আর এটাও আমাদের ভাবা উচিত যে সেই ১৯০৯ সালে ভারতবর্ষে ব’সে আন্তর্জাতিক ভাবনা গানে নিয়ে আসার মত কিছু আদৌ সম্ভব ছিল কিনা? যে উদাহরণ গুলো এই মাত্র দেওয়া গেলো সে সবকটাই ৭০এর দশকে তৈরী। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো যে আর কেউ কি অন্যরকম কিছু ভেবেছেন সেই সময়? প্রসঙ্গত মাথায় প্রথমেই এলো রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ। ১৯১০ সালে লেখা।

“এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃষ্টান।”

এই যে গ্রহন করার প্রবৃত্তি,– এইটেই সংকীর্ণ গন্ডি কে ভেঙে ফেলে। এই সুত্র ধরেই ভৈরবীতে বাঁধা একটি গান, ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠলো বেজে যেই।’ গানটির শেষ স্তবকে এসে তিনি গাইছেন,

“দেশ-বিদেশের সকল ধারা সেইখানে হয় বাঁধনহারা
কোনের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতি-সমুদ্রে…।”

সীমিত গণ্ডির অহম ভেঙ্গে নিজেকে এই বিশাল এবং অত্যাশ্চর্য গ্রহটার একটা অংশ হসেবে দেখতে চাওয়ার এই প্রয়াস ও ইচ্ছা সেই ব্যক্তির যার জন্ম ১৮৬১ সালে। কেবল নিজের ছোট্ট পকুরে নন যিনি বিশ্ব-হৃদয় পারাবারে জাল ফেলতে চান আমি তাঁর আশ্রয়প্রার্থী। এখানে বলে রাখি গীতবিতান খুলে স্বদেশ পর্যায়ে একটি গান-ও পেলাম না যাতে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার দেশটি-ই শ্রেষ্ঠ’ জাতীয় কোন দাবী করেছেন। বন্দনা আছে, অহমিকা নেই। শুধু এটুকুই নয়। সেই সময় দাঁড়িয়েই কিন্তু তিনি প্যাট্রিয়টিস্‌ম নামক মোহ থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছেন। বলছেন মানবতার কথা। কেবল দেশ নয় ভালোবাসতে হবে মানুষকে, সে যে দেশেরই হোক না কেন, যে রঙেরই হোক না কেন, যে ভাষারই হোক না কেন। এই দৃষ্টিকোনটি অনেক বৃহত্তর, অনেক মহান। যেমন শ্রী অরবিন্দ মোহন বোস মহাশয় কে ১৯০৮ সালের ১৯শে নভেম্বর বোলপুর থেকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“Patriotism cannot be our final spiritual shelter; my refuge is humanity. I will not buy glass for the price of diamonds, and I will never allow patriotism to triumph over humanity as long as I live. ” – Selected Letters of Rabindranath Tagore. Edited by Krishna Dutta and Andrew Robinson, University of Cambridge Oriental Publication. Page -72.

ওই কাঁচের দরে হীরে কেনার প্রবনতা থেকে বেড়িয়ে না আসলে বিদ্বেষই বাড়বে বলে মনে হয় ভালোবাসা নয়। শেষে সুজিত সরকারের একটা দুলাইনের কবিতা উদ্ধৃতি দেবার লোভ সম্বরন করতে পারছিনা। যে কবিতা এই গানটির থেকেও শক্তিশালী মনে হয়েছে আমার। যে পদ দুটি আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে ভুবনডাঙ্গার মাঠে।

“দেয়াল তুললেই ঘর,
ভেঙ্গে ফেললেই পৃথিবী।”