লেখকঃ জাবের ইবনে তাহের

আমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে পদার্থবিদ্যা আর গণিত। বিষয় দুটো খুব টানে আমাকে। সেই ছোট্ট বেলার থেকেই মহাবিশ্বের গল্প শুনলে মুগ্ধ হতাম, মহাবিশ্ব সম্পর্কে সেই আলোচনাগুলো ছিল নেহায়াতই কিছু গল্প, তবুও ভালো লাগত। বিশালতায় মুগ্ধ হতাম।

তখন আমার জ্ঞান ছিল অল্প। কিছু না জানা নিয়েই চারিপাশ সম্পর্কে অদ্ভুত প্রশ্ন করে বেড়াতাম। এই প্রশ্নগুলো ছিল মূর্খতার শামিল, যেহেতু একেবারে ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে এই প্রশ্ন, তাই এগুলোকে মনুষ্য জাতির কিছু মৌলিক প্রশ্নও বলা যায়।
হঠাত করে মানুষের কার্যকলাপ আমাকে বিচলিত করে। প্রশ্ন করে করে উত্তর বের করার চেষ্টা করি মানুষের মন সম্পর্কে। সেই আমার করা কিছু অজ্ঞ প্রশ্ন এবং তার উত্তর নিয়েই আজকের এই পেপার, বিজ্ঞানের কি নৈতিকতা সম্পর্কে কিছু বলবার আছে?

আমার পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আমি বুঝতে পারি, আমরা ভালো খারাপের সংজ্ঞা সম্পর্কেই অজ্ঞাত। তারপর আমি আবিষ্কার করি বিজ্ঞান আমাদের ভাল খারাপের একটা সংজ্ঞা দিতে পারে। এবং বিজ্ঞান দিয়ে আমরা কোনও একটি কাজ নৈতিক না কি অনৈতিক তাও বুঝতে পারি।

আমার প্রথম পর্যবেক্ষণ:

ছোট বেলাকার একটা ঘটনা মনে আছে, একবার কি একটা ভুলের কারনে আমার আম্মু আমার ছোট খালাকে মারলেন। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন লাগল। তবে একটা গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় লক্ষ করলাম, আম্মু যে খালামনিকে মেরেছেন এই কারনে আম্মুর মাঝে কোনও অপরাধবোধ নেই, আম্মুর ধারনা তিনি ঠিক ই করেছেন। আবার খালামনি বলছেন, আমার আম্মু ঠিক করেন নি, আম্মু কিভাবে তার ছোট বোন কে মারতে পারে? লক্ষ করলাম, পরিবারের কিছু লোক আমার আম্মুর পক্ষ নিচ্ছেন, আর কেউ কেউ পক্ষ নিচ্ছেন আমার খালামনির ধারনার। আমার প্রশ্ন হল, তবে এই দুই দলের মাঝে কারা সঠিক? কেন প্রত্যেকেই নিজেকে সঠিক ভাবছে?

প্রশ্নের উত্তরটা জানা হল না, অনেক সময় পেরিয়ে যায়। একদিন খবরের কাগজে দেখলাম, চরমপন্থিরা বোমা মেরে অনেক মানুষকে মেরে ফেলেছে। যে বোমা মেরেছে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তার জবানবন্ধি শুনে মনে হল, সে এতটুকুও বিচলিত নয়, তার কোনও অপরাধ বোধ ও নেই। সে এই জঘন্য কাজ করে যেন খুশিই হয়েছে ( কাজটা আমার চোখে জঘন্য কিন্তু তাদের কাছে নয় )।

এখন আমার মনে হল যে, একটা কাজ কিছু মানুষের কাছে ভালো আবার কিছু মানুষের কাছে খারাপ, এমনটা কেন? কিছু কাজকে তো স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ মনে হয়, কিন্তু সেই খারাপ কাজগুলো করেও কিছু মানুষ কিভাবে আনন্দে থাকে?
এবার আমার ভালো আর খারাপ এর সংজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন জাগল। আমরা ভালো কাকে বলি আর খারাপ বা অন্যায় কাকে বলি?

চলুন ভালো কি আর খারাপ কি এটা বুঝাতে একটা উদাহরণ দেয়া যাক –
রহিম আর করিম নামে দুই ভাই ছিল। একবার দেশে যুদ্ধ শুরু হল। রহিম যুদ্ধে গিয়েছে। কিন্তু করিম যুদ্ধে যায় নি। বলুন তো এই দুই ভাইয়ের মাঝে কে ভালো মানুষ? বেশিরভাগ মানুষ ই কিন্তু বলবেন, রহিম ভালো। কারন সে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। আর করিম ভীরু।

কিন্তু না। আসলে করিমের ধারনা, যুদ্ধ মানেই খারাপ, যুদ্ধ মানেই অশান্তি। সে মনে করল, যুদ্ধে যাওয়া মানেই তার অশান্তিকে উস্কে দেয়া। অনেকে আপত্তি তুলে বলতে পারেন, যুদ্ধে না যাবার জন্য এটা করিমের একটা উছিলা। কিন্তু আমরা ধরে নিলাম, করিম আসলেই মনে করে যুদ্ধ মানে অশান্তি। এবার আপনি কি বলবেন? কাকে ভালো বলবেন? প্রশ্নটা আরেকটু জটিল করে দেই।
ধরুন করিম আসলেই ভয় থেকে বলেছে যে, সে যুদ্ধে যাবে না। তার ভয় এই কারনে যে, সে যদি যুদ্ধে যায় তবে তার ছোট ছেলে, অবলা স্ত্রীকে কে দেখবে? এই স্ত্রী পুত্রকে বিপদে ফেলে সে কি করে যুদ্ধে যায়, এই যুদ্ধে যাওয়া কি তার জন্য নৈতিক?

বলুন এবার ও কি তাকে খারাপ সংজ্ঞা দেয়া যায়? যায় না।
করিম যদি যুদ্ধে নাও যায়, প্রতিবারই তার না যাবার পেছনে কিছু আপাতদৃষ্টি নৈতিক কারন থাকবে। আবার রহিমের যুদ্ধে যাবার পেছনেও কিছু আপাতদৃষ্টি নৈতিক কারন থাকবে। যা তারা পরস্পর নিজের কাজের কৈফিয়ত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারব।

একটা স্বাভাবিক বিষয় দেখা যায় প্রতিটি ঘটনাতেই, প্রত্যেকেই নিজের কাজ কে নৈতিক মনে করছে, এবং এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ও রয়েছে। তবে কি জগতের সব কাজ ই ভালো? কোনটাই কি আসলে খারাপ নয়? শুধু আমরাই একেক দৃষ্টিতে দেখছি ………

একারণেই বোধয় পৃথিবীতে কিছু মানুষ অনেক বড় অপরাধী, অন্তত আমার কাছে, কিন্তু সেই বড় বড় অপরাধীরা অপরাধ করেও অপরাধ বোধে ভুগছে না। কারন তারা মনে করে তারা কোনও কিছুই খারাপ করে নি। ধরি, আমি অনেক বড় একজন মাফিয়াকে ধরে বেঁধে ( একটি অসম্ভব কাল্পনিক ঘটনা ) আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। তার হাত পা বাধা। এখন তাকে আমি বুঝালাম যে, সে অনেক খারাপ একজন মানুষ, যার বেঁচে থাকবার কোনও অধিকার নেই।

প্রথমে সে স্মার্ট নেস প্রকাশ করবার জন্য এই বিষয়টা নিয়ে গর্ব করবে। কিন্তু যখন আমি তার কাজগুলো উল্লেখ করে অনেক কঠিন যুক্তি দিয়ে তাকে বুঝানর চেষ্টা করব যে, সে আসলেই অপরাধী। তখন সে হটাত করে বলা শুরু করবে – আমি কি খারাপ মানুষ ছিলাম? মানুষ কি জন্ম থেকেই খারাপ হতে পারে? আমাকে খারাপ বানিয়েছে এই সমাজ। এই সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত আমি অবজ্ঞা শিখেছি। তাই আমি এই সমাজের ঐ সমস্ত মানুষকে শাস্তি দেই যারা, মানুষকে অবজ্ঞা করে। অনেকটা হুমায়ন আহমেদের বাকের ভাইয়ের মত। ( যদিও কারো অন্যায়ের শাস্তি দেবার অধিকার কারো নেই )। এ ক্ষেত্রে সে নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য অন্য কোনও অজুহাত ও দিতে পারে। এই কারনেই কিছু মানুষ সমাজের প্রতি ঘৃণা থেকে বাসে নিয়ত পেট্রোল বোমা মেরে যাচ্ছে। পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষকে দেখেও তাদের মায়া হয় না। তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। এই কাজ কে কি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আমরা পৈশাচিক আনন্দ বলতে পারি?

( এই সমস্ত অন্ধকার জগতের মানুষ যে প্রকৃতই নিজের অন্যায়ের পেছনে যুক্তি দাঁর করায় মানুষের অবজ্ঞা, সমাজের দোষ,কিংবা অন্য কিছু তা আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। এই পর্যায়ের কিছু মানুষের ভালবাসা আমি অর্জন করি এবং তাদের কে মানুষিক দিক থেকে আমার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল করে আমি এই সমস্ত কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝাই যে তারা আসলেই অপরাধী। তখন তারা আমাকে বলে এর জন্য আসলে তারা দায়ী নয়, বরং দায়ী তাদের সমাজ ও আশেপাশের মানুষ। কিংবা অন্য কোনও অজুহাত, কিন্তু সে মূল কারন হিসেবে কখনই নিজেকে দায়ী করছে না। একটি ঘটনা না উল্লেখ করে পারছি না যে, যাদের উপর আমি এই পরীক্ষা করি তারা সবাই এখন নৈতিক মানুষ। অন্তত আমার আজকের নৈতিকতা সম্পর্কিত উপসংহার অনুসারে )

অনেক সময় দেখা যায় কিছু মানুষ সমাজ থেকে অবজ্ঞা পেয়ে এক সময় সমাজটাকে পরিবর্তন করার কথা ভাবে। এই ভাবনা থেকেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ কিছুর। আমরা সক্রেটিস, নিউটন, আমাদের আরজ আলি মাতব্বর এরকম আরও অনেকের কথাই বলতে পারি। যারা আসলে মানুষের চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছে।

এই যে আমরা দেখতে পাই, কিছু মানুষ সমাজ থেকে অবজ্ঞা পেয়ে, যারা অবজ্ঞা করে তাদের কে শত্রু মনে করে দমন করে। আর কিছু মানুষ, যারা অবজ্ঞা করে তাদেরকে বন্ধু বানানোর চেষ্টা করে, বোঝানর চেষ্টা করে যে, কাউকে যেন অবজ্ঞা না করা হয়। এখানে আমরা অধিকাংশের অধিকাংশই বলব সক্রেটিসের দল ই ভালো।

আমিও মনে করি সক্রেটিস এর দল ই ভালো, কিন্তু কেন? সেটাই আমি আজ বৈজ্ঞানিক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করব।
আমার দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণঃ
একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লক্ষ করেছিলাম কিছুদিন আগে, আমার খুব কাছের কিছু মানুষ সবসময় আমাকে বলত – তারা না কি আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসে। আমি ভালো করি এটাই তারা চায়। আমার থেকে তাদের কিছু চাইবার নাই, তাদের ভালবাসা স্বার্থহীন। এমনকি তারা আমার জন্য বিনা স্বার্থে জীবন ও দিতে পারে!

আমিও মেনে নিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে একটা জিনিস চোখে আটকাত। আমার খুব কাছের একজন মানুষ, হটাত করে আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে ব্যথা পেল। তারা হটাত করে রেগে যেত, এবং মুহূর্তের ব্যবধানে আমাকে মারতে উদ্যত হয়। আবার পরে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে – দেখে চলতে পারিস না। কিন্তু আমি তাদের মুহূর্তের অগ্নিমূর্তি, আর আমাকে মারার জন্য তৈরি অস্থায়ী ক্রোধটুকু ভুলতাম না।

আমার মনে তখনি সন্দেহ হত আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই নিঃস্বার্থ হতে পারে না। সব কিছুর পেছনেই স্বার্থ রয়েছে। নিজে ব্যথা পাবার কারনে আমার কাছের মানুষ গুলো মুহূর্তে আমার প্রতি তাদের ভালবাসাটুকু ভুলে যেত, নিজেকে রক্ষার এক আদিম স্বার্থপর তাড়না থেকে, কিন্তু মুহূর্ত পরে তার ভেতরের দীর্ঘ যাত্রায় তৈরি হাওয়া নৈতিকতা তাকে থামিয়ে দেয়। এরপর থেকে আমি খুঁজে খুঁজে প্রতিটা কাজের পেছনে মানুষের স্বার্থটা বের করতাম।

আমার আবিষ্কৃত মানুষের কিছু আপাত নিঃস্বার্থ কাজের পেছনের স্বার্থ –
১। মা – বাবার ভালবাসার পেছনের স্বার্থ – আমি তাদের অস্তিত্ব পরবর্তী প্রজন্মে টিকিয়ে রাখব। বৃদ্ধ বয়সে তাদের অসহায় অবস্থায় এক মাত্র সম্বল হতে পারব।
২। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার পেছনের স্বার্থ – তারা একে অপরকে বিয়ে করবে। তাদের বাচ্চা হবে। তারা বাবা-মা হবে, এরপর তো প্রথম নিয়ম ই প্রযোজ্য।
৩। আমি আর আমার এক বন্ধু, মনে করি তার নাম ফাহিম, আমরা দুই জন আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছাত্র। আমি পরীক্ষায় সবাইকে দেখাই। কিন্তু আমার বন্ধু কাউকেই দেখায় না। যার জন্য আমাকে সবাই বলে ভালো আর আমার বন্ধু ফাহিম কে সবাই স্বার্থপর বলে। কারন ফাহিম কাউকেই দেখায় না, সে একাই ভালো করতে চায়। আচ্ছা তবে কি আমি স্বার্থহীন একজন ভালো মানুষ?
না, আসলে আমি স্বার্থহীন কোনও মানুষ নই। আমার ও স্বার্থ রয়েছে। আমি নিজের কাজের পেছনে নিজেই একটি স্বার্থ খুঁজে বের করেছি। তা হচ্ছে – আমি পরীক্ষার সময় তাদের এই কারনে দেখাই যে, পরে আমি বিপদে পরলেও যেন তাদের থেকে দেখতে পারি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় – আমার আসলে তাদের থেকে দেখার কোনও প্রয়োজন হয় না। তবে আমার স্বার্থ কই? আসলে পরীক্ষায় সাহায্য করবার কারনে যে আমি পরীক্ষার হলেই সাহায্য ফেরত পাবার কামনা করি এমনটা নয়, তা জীবনের অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেও হতে পারে। হয়ত অন্য কোথায়, আমি যাকে দেখিয়েছি তার থেকে সাহায্য পেতে পারি।
এরকম উদাহরণ দিয়ে আমার পক্ষে শেষ করা সম্ভব না। সারসংক্ষেপে পৌছতে পারি, আসলে আমাদের প্রত্যেকের কাজের পেছনেই রয়েছে স্বার্থ।
আমরা সবাই স্বার্থপর এবং আমাদের প্রতিটি কাজের পেছনেই রয়েছে স্বার্থ, এই কথাটুকু যে জীববিজ্ঞান সিদ্ধ তা আমি পরবর্তীতে জানতে পারি।

জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে স্বার্থপরতা:

১৯৩৭ সালের কথা। জীববিজ্ঞানী ডব্জাবনস্কির একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের নাম – ‘Genetics And Origin of Species’। আধুনিক বংশগতিবিদ্যা আর ডারউইন বাদের এক অপূর্ব সমন্বয়। উদ্ভব হয় আধুনিক বিবর্তন তত্ত্বের।
এই বইয়ের মূল কথা ছিল অনেকটা এরকম, আমাদের জিনগত স্তরে কাজ করে কিছু সস্বার্থপরতার নীতি। যেই স্বার্থপরতা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার স্বার্থপরতা, নিজের জিন কে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যাওয়া, বিস্তার করা।
জীবনের পেছনের স্বার্থপরতার এই মূল কারন।

জীবের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে যেমন কাজ করে স্বার্থপরতা, তেমনি ভাবে নিজের জিন কে টিকিয়ে রাখবার জন্যও সে জীবন দিতে পারে । এ কারনেই আমরা অনেক সময় দেখতে পাই, শুধু মানুষ ই নয়,সব প্রাণীই নিজের সান্তানের জন্য, পরিবারের জন্য, আত্মীয়স্বজনদের জন্য এক ধরনের জৈবিক টান অনুভব করে, তাদেরকে রক্ষা করবার চেষ্টা করে। এই জীবেরা চায় বিবর্তনের পথে নিজের জিনের মধ্য দিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। এই বিষয়ে জীববিজ্ঞানী রিচারড ডকিন্সের একটি উক্তি উল্লেখ না করে পারছি না –

‘আমরা সবাই একেকটি টিকে থাকবার যন্ত্র। অন্ধভাবে প্রোগ্রাম করা একটি নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক বাহন মাত্র। যার উদ্দেশ্য কেবল স্বার্থপরভাবে এক ধরনের জীব অণুকে সংরক্ষণ করা । তারা আমাদের ভেতরে আছে, তারা রয়েছে আপনার ভেতরেও ; তারাই আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের দেহ আর আমাদের মন ; আর তাদের সংরক্ষণশীলতাই আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত মৌলিকত্ব। ঐ অনুলিপিকারকেরা এক দীর্ঘ পথ পারি দিয়েছে। এখন তাদের কে জিন বলে ডাকা হয়, আর আমরা হলাম তাদের উত্তরজীবিতার যন্ত্র’

অতএব আমরা বলতেই পারি যে, প্রাণী জগত প্রকৃত অর্থেই স্বার্থপর। এবং কিছু সেলফিশনেস তার মূলনীতি।
তাহলে আমার চারিপাশের জগত দেখে আমি যেই সিদ্ধান্ত গুলোতে পৌঁছে ছিলাম তা মোটেই ফেলে দেবার মত নয়। ফেলে দেবার মত হবে কি করে? আমার সিদ্ধান্ত অর্জনের সময় তো আমি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিলাম।

এখন আমরা একটা জিনিস নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পেরেছি যে, প্রাণী জগতের মৌলিক নীতি হচ্ছে নিজেকে, নিজের জিনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা, যেখানে তাদের স্বার্থপর না হয়ে উপায় নেই।
সমস্ত জীব ই স্বার্থপরতার সিল মেরে জন্মগ্রহণ করে ।

আমি আমার পরীক্ষা থেকে দেখেছি যে, স্বার্থ, আমি আর আমার বন্ধু ফাহিম দুজনেই অর্জন করি। কিন্তু পদ্ধতি আলাদা, এই কারনে একজন কে সবাই ভালো বলে আর অন্যজন কে সবাই খারাপ বলে। কিন্তু আমাদের দুজনের উদ্দেশ্য মূলত একই। অথচ শুধু কাজের পদ্ধতির কারনেই দুজন দুই উপাধি পাচ্ছি। কিন্তু কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে চলুন, গণিতের একটি মজার বিষয় গেম থিওরি সম্পর্কে আলোচনা করি।

গেম থিওরি:
গেম থিওরি কিংবা ক্রীড়া তত্ত্ব ফলিত গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং চমকপ্রদ বিষয়। সহজ কথায় যদি আমরা বুঝতে চাই, তবে গেম থিওরি হচ্ছে – একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলায় এমন কিছু পরিস্থিতির অধ্যায়ন যেখানে খেলোয়াড়রা সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারে।
শুধু গণিত ই নয়, এই তত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে – অর্থনীতি, বিবর্তনবাদ, পদার্থবিদ্যা, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কূটনীতি সমস্ত জায়গায়।
একটা উদাহরণ দিয়ে গেম থিওরি এর ব্যপারটা বুঝানো যাক –
কোকাকলা কোম্পানির একটি পণ্য থেকে মাসিক মুনাফা হয় – ১০০০০০০০০ টাকা
আবার একই ধরনের আরেকটি পণ্য উৎপাদন করে পেপসি কোম্পানি। তাদের আয় ও – ১০০০০০০০০ টাকা।
এখন কোকাকলা কোম্পানি ভাবল যে, তাদের পণ্যটুকুর দাম খানিকটা কমাবে, তবে তাদের লাভ অনেক বেশি হবে।
দাম কমানোতে বিক্রি বেশি, সুতরাং লাভ ও অনেক বেশি।
তখন লাভ হবে – ১২০০০০০০০ টাকা।
কিন্তু কোকাকলা কোম্পানি দাম কমালে তাদের বিক্রি বেশি হবে আর অন্য দিকে কমে যাবে পেপসি কোম্পানির আয়। কারন তখন তাদের পণ্যের বিক্রি কমে যাবে। কে চাইবে বেশি দামে কোনও জিনিস কিনতে?
দাম কমিয়ে কোকাকলা কোম্পানি লাভবান আর অন্যদিকে পেপসি কোম্পানির লোকসান।
কিন্তু পেপসি কোম্পানি ও কিন্তু বসে থাকবে না। সে ও তখন তার ঐ পণ্যটার দাম কমিয়ে আনবে। তখন দুই দলের ই আয় হবে – ৯০০০০০০০ টাকা।
তবে এবার বলুন কোকাকলা কোম্পানি দাম কমিয়ে কি লাভ করল? কচু! তারা কোনও লাভই করতে পারে নি, বরং দুই কোম্পানি ই আগের থেকে লোকসানে পরে গেল। বাংলায় যাকে বলা হয় অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।
এখন এই দুই কোম্পানির যদি গেম থিওরি সম্পর্কে ধারনা থাকত তবে এরকম সমস্যায় কখনই পরতে হত না। গেম থিওরি আসলে কিভাবে আমরা অন্য খেলোয়াড়কে রাগিয়ে না দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারি তাই নিয়েই আলোচনা করে ( অন্য খেলোয়াড়কে রাগিয়ে দিলে আপনার লোকসান হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় )।

এবার আমরা আমাদের ভালো খারাপের সংজ্ঞা গুলো একটু গেম থিওরির আলোকে পর্যালোচনা করি। কিভাবে আমরা এগুলোকে গেম থিওরির আলোচনার ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে পারি তাই দেখব এখন –
মনে করুন, আমি যেকোনো একটি কাজ করলাম। একটি মানুষের যেকোনো কাজের সাথেই অন্য মানুষরাও কোনও না কোনো ভাবে জড়িয়ে পরে। তাই আমার কাজের সাথেও নিশ্চয় অনেক মানুষ জড়িয়েছে। আমার কাজের দ্বারা যদি কারো উপকার হয় তবে তারা আমাকে ভালো বলবে। আর যাদের কিছুই হয় নি তারা কিছুই বলবে না। আর যাদের অপকার হয়েছে তারা খারাপ বলবে। এখন গেম থিওরি কিভাবে নির্ধারণ করবে কাজ টি ভালো না কি খারাপ?
গেম থিওরির আলোচনা অনুসারে যদি আমার কাজের দ্বারা মানুষের ক্ষতির থেকে উপকারই বেশি হয় তবে আমার কাজটি আসলে ভালো, কিন্তু এটা ঐ পরিস্থিতিতে যখন আমি ঐ কাজটা না করে পারি না।
শেষের কথা টা একটু বেশি কঠিন হয়ে গেল তাই না? সহজ ভাবে বলছি –
ধরুন, আপনি আর আপনার পরিবার জঙ্গলের বন মানুষের হাতে পরেছেন, তারা সবাইকে বন্দি করে রাখল। এরপর তারা আপনার বাধন খুলে আপনাকে দৌড় দিতে বলল। তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে। আপনি শুধু ডান, বাম, এই দুই দিকের যেকোনো একটি দিকেই দৌড় শুরু করতে পারেন।
আপনি ডান দিকে গেলে,আপনার ১০ জন পরিবারের সদস্যদের মাঝে ৩ জন টিকে থাকবেন, আর ৭ জন মারা পরবেন।
আর আপনি বাম দিকে গেলে ৭ জন টিকে থাকবে আর ৩ জন বেঁচে যাবেন।
এই ক্ষেত্রে আপনার পথ শুধু দুটোই ডান আর বাম। আপনি আর অন্য কিছুই করতে পারছেন না। গেম থিওরি অনুসারে আপনার এখন বাম দিকে দৌড়ানটাই ভালো। আর ডান দিকে দৌড়লে তা অনৈতিক।
কিন্তু যদি তিনটি রাস্তা থাকে, এর মাঝে একটি হচ্ছে সামনের দিকে, এবং মজার বিষয় আপনি সামনে দৌড়লে পরিবারের সবাই বেঁচে যাবে আর তখন ও যদি আপনি সামনে না যান তবে আর কি বলব ?

গেম থিওরি কিভাবে একটা ঘটনা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে বেশি লাভবান কাজটুকু নির্ধারণ করেছে তা আমরা দেখেছি। এবং সেই সূত্রে আমরা কোনও কাজকে ভালো বা খারাপ বলতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমি উপরে একটা সহজ উদাহরণ দিয়েছি, কিন্তু বাস্তবে যেকোনো ঘটনা অনেক বেশি জটিল হয়। সেখানে আমরা কিভাবে গেম থিওরি ব্যবহার করে ভালো খারাপ নির্ধারণ করব?

আরেকটা উদাহরণ দেই – মনে করুন, কোনও একটা দেশে একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হবে। দেশে বিদ্যুতের এমনিতে কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু অতিরিক্ত আয়েশের জন্য তৈরি করা যায়, যেমন – ১৫০ বর্গ ফুটের একটি ঘরে তিনটি এসি ব্যবহার করা।

এখন যদি এ থেকে মানুষের শুধু লাভ ই হয় তবে আমরা বলতে পারি কাজটি ভালো।এখানে ভালোর পরিমাণ বেশি না কি খারাপের পরিমাণ বেশি তা থেকে কাজটির মূল্যায়ন করা যাবে না। সামান্য ক্ষতি হলেও আমরা কাজটিকে আর ভালো হিসেবে বিবেচনা করতে পারব না। কারন যখন আপনার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল না, তখন বিশেষ কোনও ক্ষতিও কিন্তু হয় নি। আপনি সেধে পরে যদি অতিরিক্ত লাভের আশায় সামান্যতম ও ক্ষতি করে বসেন তবে সেই কাজকে ভালো কি করে বলা যায়?

আমাদের জীবনের নৈতিকতা কিংবা ভালো খারাপের মূল্যায়নে আমরা গণিতের গেম থিওরি ব্যবহার করেছি। সেটি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেই ক্ষেত্রে দুটো উদাহরণ ও দিলাম।

এরকম উদাহরণ লিখে শেষ করা সম্ভব না। আমি আমার জীবনের সব ক্ষেত্রেই চমৎকারভাবে এই থিওরিটি ব্যবহার করে ভালো খারাপের মূল্যায়ন করি। এই থিওরিটি ফিল করা কিংবা ভালো করে বুঝতে পারলে যেকোনো মানুষই তার জীবনে এই থিওরি ব্যবহার করতে পারবেন। আমি এটি ব্যবহার করি, কিন্তু কিভাবে এর প্রয়োগের সাধারণীকরণ করব তা নিয়েই চিন্তা করছি।

আসলে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এই গেম থিওরি ব্যবহার করলেই বুঝতে পারব কোন কাজটি নীতিগত দিক থেকে বেশি ভালো, সবচেয়ে বেশি মানুষের স্বার্থ রক্ষা পায়।
স্বার্থ রক্ষা আমাদের প্রাণী জগতের মূলনীতি। এটিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের এই স্বার্থ এমনভাবে রক্ষা করতে হবে আমার কাজের দ্বারা যেন মানুষের এবং আমার ক্ষতির পরিমাণ শুন্য কিংবা সবচেয়ে কম করে, বেশি লাভবান হওয়া যায়।

শেষে আরেকটা উদাহরণ দেই –
ধরুন আপনার ৫০ জন শত্রু, আর ৫০ জন সহচর আছে। এখন আপনি যদি আপনার শত্রুদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন তখন আপনার অস্তিত্ব হুমকির মুখে গিয়ে পরবে। ৫০ জন বন্ধুর জায়গায় দেখবেন পরে ৪-৫ জন পরে থাকবে!!! আপনি নিজেও মারা পরতে পারেন।
আর যদি আপনার সেই শত্রুদের বন্ধুতে পরিণত করতে পারেন কত ভালো হয়, তাই না? গেম থিওরির দিক থেকে এই কাজটাই ভালো। আসলে শুধু গেম থিওরি না, সাধারণ ভাবনায়ও এটা অনেক বড় একটা নৈতিক কাজ।
কিন্তু যদি আপনার শত্রুরা গভীর রাতে আপনার আর আপনার সহচরদের উপর আক্রমণ করে তখন আবার তাদের বন্ধু বানাতে যাবেন না। ঐ সময় আপনার পক্ষে তাদের বন্ধু বানানো সম্ভব নয়। তখন আপনার নিজের আর নিজের সহচরদের বাঁচাতে হবে। সে সময় তাই নৈতিক।
আপনার যে ৫০ জন শত্রু আছে, তা হয়ত আপনাদের মধ্যকার মতের অমিল কিংবা চিন্তা দ্বারার পার্থক্যএর জন্য, আপনার চিন্তা দ্বারা ভুল ও হতে পারে, তা যে সঠিক হবে এমনটা নয়। গেম থিওরি আর বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করেও কাজটির মূল্যায়ন করা যায়। এরপরে আপনি নিজেই ভালো খারাপ বুঝতে পারবেন।

বিজ্ঞান আমাদের হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ, নৈতিকতা কি, কিভাবে আমাদের লাভ বেশি তাও দেখিয়ে দিচ্ছে। হয়ত ভালো খারাপ কোনটা করা উচিত সেই উপদেশটুকু দিচ্ছে না। কারন বিজ্ঞান শুধু প্রকৃতি কেমন তাই নির্দেশ করে। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নিতে বলে না।

তথ্যসূত্র:
(1) Understanding Psychology – Robert S. Feldman
(2) Religion and Science – B. Russell
(3) Psychology – J.C. Ruch
(4) A little History of Philosophy – Nigel Warburton
(5) Psychology Classics – Tom Butler Bowdon.
(6) টোটেম ও টেবু – সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড
(7) মনঃসমীক্ষণের ভূমিকা – সিগ্মুন্ড ফ্রয়েড
(8) The Interpretation of Dreams – Sigmund Freud
(9) মনোবিজ্ঞান ও জীবন – নীহার রঞ্জন সরকার।
(10) উচ্চ মাধ্যমিক মনোবিজ্ঞান (১ম পত্র) – যোগেন্দ কুমার মণ্ডল।
(11) উচ্চ মাধ্যমিক মনোবিজ্ঞান (২য় পত্র) – যোগেন্দ কুমার মণ্ডল।
(12) প্রাণের প্রাণ জাগিছে তোমারই প্রাণে – অভিজিত রায়।
(13) https://en.wikipedia.org/wiki/Game_theory
(14) https://en.wikipedia.org/wiki/Evolution
(15)The Origin of Species – C. Darwin
(16) Selfish Gene –Richard Dawkins