১.

হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যে পাঁচজন আদিম দেবতা রয়েছেন। তাঁর কথাকেই ধার করে বলি, আমাদের বাংলা গানেও রয়েছেন পাঁচজন আদিম দেবতা। এই পাঁচ দেবতা তাঁদের যাদুময় স্পর্শ দিয়ে বাংলা গানকে মুক্ত করেছেন ঘেরাটোপের ঘনায়মান অন্ধকার থেকে। ক্ষীণ ধারায় বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনীতে বর্ষার বাদল ঢেলেছেন তাঁরা অকাতরে। আর এর মাধ্যমে নদীতে যৌবনের স্পর্ধিত কল-কল্লোল এনেছেন তাঁরা। তারপর সেই যৌবনোমত্ত তটিনীকে তরঙ্গায়িত করে মিশিয়েছেন উত্তাল উর্মিমালাময় অশান্ত সাগরের সাথে।

এই পাঁচজন আদিম দেবতা হচ্ছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত এবং নজরুল।

বাংলা গানের শুরু চর্যাপদের যুগ থেকে। চর্যাপদ, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বৈষ্ণব পদাবলী, রামপ্রসাদী, টপ্পা, দাশু রায়ের পাঁচালি, এগুলো দিয়ে গড়ে উঠেছিলো বাংলা কাব্য সঙ্গীতের দেহ। যদিও শুরুতে হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে বাংলা সঙ্গীতের কলেবর। তারপরেও বলা যায় যে, বাংলা গান তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলেছে সবসময়ই। হোক না তা একেবারে টিমটিম করে। তবুও তা ছিল আলাদা।

রামপ্রসাদী গানের পরে কিছুটা বন্ধ্যাত্ব এসেছিলো বাংলা গানে। অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো এর সৃজনপর্ব। রামপ্রসাদ উত্তর বাংলা গানে মহৎ ভাবাদর্শের পরিবর্তে জাগতিক তারল্য ও স্থূল ইন্দ্রিয়তন্ত্র প্রাধান্য বিস্তার করে। গানের বাণীতেও অশালীনতার সংক্রামণ হয়েছিলো তখন। লৌকিকতার প্রতি অতি আনুগত্য অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগ সন্ধিক্ষণের গীতিকারদের আবহমান সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো বেশ খানিকটা। তাঁদের ধাবিত করেছিলো জনমনোরঞ্জনের সরল কিন্তু তরল পথের দিকে। সে কারণে এই সময়ের কবিগান, হাফ-আখড়াই, তরজা, খেঁউড় এই সমস্ত গানে সৃজনের মত্ততা আছে, কিন্তু সৃষ্টির শুদ্ধতা নেই। এই সময়ের গান ভাবের বিচারে নিরাবেগ ও অশালীন, বাণীর বিচারে দুর্বল, জরাগ্রস্ত এবং ক্লান্তিময়। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু। সব গরলকে নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে ছিলেন তিনি।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গান আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে। এ যেন রূপকথার সেই রাজকন্যার মতো। সোনার কাঠির কোমল ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে যে। বাংলা গানের এই জেগে উঠা ঘটলো পঞ্চ পাণ্ডব, পঞ্চ রাজকুমার দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের সঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে। বাংলা গানে দ্বিজেন্দ্রলালই প্রথম পাশ্চাত্য সঙ্গীত রীতি আনলেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতের সুর সংহতির মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল সৃষ্টি করলেন খেয়াল অঙ্গের নতুন কিছু। হিন্দি ঠুংরির সাথে বাংলা গানের ভাব মাধুর্যকে মিশিয়ে সঙ্গীত সৃষ্টি করলেন অতুলপ্রসাদ। রজনীকান্ত এই দুজনের মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করলেন। নজরুল বাংলা গানে আনলেন আরবি সুর, পারসি গজলের রীতি। রাগ সঙ্গীত আর লোক সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করলেন বিভিন্ন ধরণের কাব্যগীতি, বিদেশি সুরের কাঠামোয় বাধলেন বিচিত্র ধরনের গান আর সৃষ্টি করলেন বিদ্রোহ ও সাম্যবাদের গান। এর ফলে বাংলা গানের ভাণ্ডারে পরিব্যাপ্তি ঘটলো বিশাল পরিমাণে। আর এই পরিব্যাপ্তির পূর্ণ রূপ দিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টিতে। ধ্রুপদ থেকে শুরু করে লোকসঙ্গীত ও কীর্তনের ধারাকে এনে মেশালেন তাঁর সুর সৃষ্টিতে। ভারতীয় রাগরাগিনীর এক অপূর্ব মিশ্রণ হলো তাঁর গান। বিদেশী সুরের ধাঁচকে স্বদেশী ছাঁচে ফেলে তিনি সঙ্গীতকে সাজালেন এক নতুন কৌশলের মাধ্যমে।

এই পাঁচজনের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলালের আগমন প্রথম। একমাত্র নজরুলকে বাদ দিলে বাকি তিনজনই প্রায় সমসাময়িক দ্বিজেন্দ্রলালের। কিন্তু, বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনিই ছিলেন সবার মধ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয়তাতে দ্বিজেন্দ্রলালকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পরে, আগে নয়। সৌমেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘স্বদেশী আন্দোলন এবং বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,

“রবীন্দ্র সমসাময়িক কবিদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। নাট্যকার হিসাবে প্রাধান্যলাভ করলেও, বিশ শতকের সূচনায় তাঁর কবিতা ও হাসির গানগুলি অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল কখনোই নিছক হাস্য-রস সৃষ্টি করেন নি। তাঁর হাস্য-রস সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক এবং তীক্ষ্ণ-চিন্তাশীলতার মধ্যেই এ রসের ভাণ্ডার। স্বদেশের অবস্থা ও স্বজাতির আচার-আচরণকে কেন্দ্র করেই তাঁর চিন্তাশীলতা গড়ে উঠেছে। তাই তাঁর কবিতা পড়ার সময় হাসতে হাসতে গিয়ে ভাবতে হয়; আর স্বজাতিকে হাসিয়ে ভাবিয়ে তোলাই কবির উদ্দেশ্য। হাসির অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে কবি গদ্যের বলিষ্ঠতাকে কবিতায় আমদানি করেছেন।“

রবীন্দ্রনাথ নিজেও দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভা এবং সৃষ্টিতে মুগ্ধ ছিলেন। সেই মুগ্ধতাকে তিনি গোপন করেন নি। তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ বইতে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আর্য্যগাথা’, ‘আষাঢ়ে’ ও ‘মন্দ্র’ কাব্যের অন্তর্নিহিত রসধারা বিশ্লেষণ করে বাঙালি পাঠককে একদিন দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যে অবশ্য সেই মধুর সম্পর্ক আর থাকে নি, অহেতুক তিক্ততায় পর্যবেসিত হয়েছিল।

দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর জীবিত থাকার একটা সময়ে যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে অবশ্য সেই জনপ্রিয়তা আর থাকে নি। অনেকখানিই কমে গিয়েছিল। তাঁর কাব্য প্রতিভারও যথাযথ সমাদর হয় নি পরবর্তীতে। এর প্রধান কারণও রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথ একদিন দ্বিজেন্দ্রলালকে জনপ্রিয় করতে চেয়েছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথই নিজের অজান্তে তাঁকে অজনপ্রিয়তার অন্ধকারে নিক্ষেপ করে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের আকাশে এমনই সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলেছে যে, শুধু একা দ্বিজেন্দ্রলালই নয়, এমন অনেক স্নিগ্ধদীপ্তির জ্যোতিষ্কই আড়ালে চলে গিয়েছে দৃশ্যমান আকাশের পটভূমি থেকে। বাংলা সাহিত্যে তাঁরা তাঁদের যথাযথ মর্যাদা এবং গুরুত্ব পান নি। দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য শুধু এই কারণেই অনাদর পান নি তা নয়, অনাদরের পিছনে তাঁর নিজেরও বেশ বড়সড় একটা ভূমিকা ছিল। বড় বেশি ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন তিনি। সত্য প্রকাশে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠা ছিল না তাঁর। স্বদেশ এবং সমাজ সম্পর্কে তিনি যা ভাবতেন, যা অনুভব করতেন, যা দেখতেন, সেগুলোকে অকপটে বলে ফেলতেন। অপ্রিয় সত্য বলায় তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ, কারও সাথে আপোষ মীমাংসায় যাওয়া বা কারো তাঁবেদারি করা তাঁর ধাতে ছিল না। ঋজু মেরুদণ্ডের মানুষ ছিলেন তিনি। নতজানু আচরণ এবং ন্যাকামিকে মোটেও বরদাস্ত করতে পারতেন না তিনি। এগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন হাতে বিদ্রূপ আর ব্যঙ্গের চাবুক চালিয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুত গতিতে। লোকে তাঁকে দাম্ভিক এবং অহংকারী, এই অপবাদ দিয়ে প্রায় এক ঘরে করে ফেলেছিল।

সঙ্গীতের বরপুত্র ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তাঁর পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন সুবিখ্যাত গায়ক। গান তাই তাঁর রক্তে এসে গিয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রেই। গান রচনা এবং তাতে সুর দেওয়া তাই শুরু হয়ে গিয়েছিল নিতান্ত বাল্যকাল থেকেই। বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম সুরস্রষ্টা তিনি। তাঁর সঙ্গীতকে বাদ দিলে বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দ্বিজেন্দ্র প্রতিভার যে তীব্র স্বকীয়তা এবং মৌলিকত্ব সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তার ব্যতিক্রম সঙ্গীতেও নেই। সুরসৃষ্টিতেই বরং তাঁর প্রতিভার মৌলিকতা বেরিয়ে এসেছে আরও সহজ সরলভাবে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেম মুক্তপন্থী। সুরবিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন সুরবিহারের উন্মুক্ত আকাশ তাঁর গানকে সহজ, সরল, স্বচ্ছন্দ এবং লীলায়িত করে তুলেছে। বাংলা কাব্যসঙ্গীতকে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন তিনি। কাব্যসঙ্গীত শুধু কণ্ঠের কাজ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কাব্য সৌন্দর্য এবং কথারস সৃষ্টির লাবণ্য। এর কোনোটারই ঘাটতি ছিল না তাঁর সঙ্গীতে।

রথীন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘দ্বিজেন্দ্রলালঃ কবি ও নাট্যকার’ বইতে দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীত জীবনকে চারটি স্তরে ভাগ করেছেন। ‘আর্যগাথা’-র প্রথম পর্ব রচিত হয়েছিল বারো থেকে সতেরো বছরের মধ্যে। এটাই তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার প্রথম স্তর। এরপর তিনি বিলাতে চলে যান। সেখানে টাকা-পয়সা খরচ করে বিলাতি সঙ্গীত শেখেন, চর্চা করে। দেশে ফিরে এসে পাশ্চাত্য সঙ্গীত রীতির সাথে মিলিয়ে বাংলা গান রচনা করা শুরু করেন। যদিও পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে তিনি মিশিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা গানের সাথে, এই মেশানোটা আরোপিত ছিল না। গানের সাথে দেশজ টান থেকে গিয়েছিল অবিকৃত। কিন্তু, এটাকে অনেকেই সুনজরে দেখেন নি। তখনকার দিনে অভ্যস্ত রীতি ভেঙে , চিরাচরিত পথ ছেড়ে দিয়ে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব সঞ্চার করা সহজ কাজ ছিল না। এর জন্য তাঁকে বিরুদ্ধ সমালোচনা এবং বহু কটূক্তিও সহ্য করতে হয়েছে। ‘আর্যগাথা’-র দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি অনেকগুলো ইংরেজি, স্কচ এবং আইরিশ গানের অনুবাদ করেন। এটাই তাঁর সঙ্গীত জীবনের দ্বিতীয় স্তর।

এরপর সরকারী কাজে মুঙ্গেরে থাকার সময়ে আবার ভারতীয় সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার তখন ছিলেন মুঙ্গেরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ইনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন গায়ক। তিনি আবার দ্বিজেন্দ্রলালের আত্মীয় ছিলেন। এই সুরেন্দ্রনাথই দ্বিজেন্দ্রলালকে আবার ভারতীয় সঙ্গীতে ফিরিয়ে আনেন। সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন ‘টপ-খেয়ালের’ অদ্বিতীয় স্রষ্টা। সুরেন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলালের মনে শুধু নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন নি, দ্বিজেন্দ্রলালের বেশ কয়েকটি এই ধরনের গানে তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের ছেলে দিলীপকুমার রায় তাঁর ‘উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে, “কবি হিন্দুস্থানি গানের মর্মে প্রবেশ করেন কৈশোরে তাঁর পিতৃদেবের খেয়াল শুনে শুনে। কিন্তু, তারপর তিনি খুব ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন বিলিতি গানের। সুরেন্দ্রনাথই তাঁকে ঘরের ছেলে করে ঘরে ফিরিয়ে আনেন – অর্থাৎ ভারতীয় গানের নিজস্ব ক্ষেত্রে।“

এই সময়েই তাঁর সুবিখ্যাত ‘হাসির গান’ রচিত হয়। এটাই দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনের উজ্জ্বল এক সময়। এই সময় থেকে শুরু করে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত সময়টাকে তাঁর সঙ্গীত রচনার তৃতীয় স্তর হিসাবে বিবেচনা করা যায়। এই স্তরেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সুরসরস্বতীর সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।

স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, সেই দশ বছর সময়টাকে তাঁর সঙ্গীত জীবনের চতুর্থ স্তর বলা যেতে পারে। এই পর্যায়ের কাব্যে এবং নাটকে যে ভাবগাম্ভীর্য লক্ষ্য করা যায়, তার ছাপ সঙ্গীতের মধ্যেও পূর্ণভাবে দৃশ্যমান। এই সময়ে তিনি মূলত নাটকই রচনা করেছেন। তাঁর নাটকগুলির পটভূমিকায় আছে তৎকালীন রাজনৈতিক জীবনের উত্তেজনা। ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যেও সমসাময়িক দেশকালের আকাঙ্ক্ষাকে মিশিয়ে তিনি তাঁর নাট্যরোমান্সগুলি রচনা করেন। স্ত্রী বিয়োগের পর শূন্য হৃদয়কে দেশকালের তৎসাময়িক উত্তেজনার দ্বারা হয়তো কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। দেশপ্রেমমূলক ঐতিহাসিক নাটক রচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বদেশপ্রেম সম্পর্কিত সঙ্গীতগুলি রচনা করেছেন।

তবে, এই পর্যায়ে এসে হঠাৎ করেই তিনি দেশপ্রেমিক হয়ে গিয়েছেন, সেটা ভাবলে ভুল হবে। তাঁর দেশপ্রেম আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। দেশপ্রেমের সাথে তাঁর ব্যঙ্গ এবং বিদ্রূপাত্মক কবিতাগুলোরও একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর অনেক বিদ্রূপাত্মক কবিতাই আসলে দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত। রথীন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘দ্বিজেন্দ্রলালঃ কবি নাট্যকার’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে,

“দ্বিজেন্দ্রলালের কবিমানসের মধ্যে মিশ্র উপাদান আছে। রোমান্টিক ‘লিরিসিজম’ ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের ধারা তাঁর মনোজীবনকে বিচিত্র করে তুলেছিল – প্রথম ধারাটি অন্তর্মুখী, দ্বিতীয় ধারাটি বহির্মুখী সামাজিক। দ্বিজেন্দ্রলালের এই বহির্মুখী সামাজিক মনই স্যাটায়ার রচনা করেছিল। দেশপ্রেমের সঙ্গেও তাঁর বিদ্রূপাত্মক রচনাগুলির একটা আন্তরিক সম্পর্ক আছে। তাঁর অনেকগুলি বিদ্রূপাত্মক কবিতার মূলেও দেশাত্মবোধ। ‘আর্যগাথা’ প্রথম ভাগে ও ‘বিলাতপ্রবাস’ পত্রগুচ্ছে তাঁর দেশপ্রেমিকতা ও পরাধীনতার জন্য গ্লানিবোধ আত্মপ্রকাশ করেছিল। সমাজবিধাতাদের নির্মম লাঞ্ছনার প্রত্যুত্তর দিতে গিয়েও, নিজের দেশের সঙ্কীর্ণতা ও দুর্বলতার কথা মনে হয়েছে। তাই তাঁর ব্যঙ্গ-কবিতাগুলির অনেকগুলির মূলেই তাঁর দেশপ্রেমের ভাবসূত্রটি লক্ষ্য করা যায়। ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও দেশপ্রেম একই সামাজিক মনের সৃষ্টি”।

তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং হাসির গানের মধ্য দিয়েই যে প্রবল দেশাত্মবোধকে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ করে দিতেন, সে বিষয়ে সজনীকান্ত দাসের মনোভাবও রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতোই। ভৈরব শারদীয় সংখ্যায় ‘কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’ নামের প্রবন্ধে তিনি এই দেশাত্মবোধ কোথা থেকে উৎসারিত, সেটা নিয়ে তাঁর মতামত দিয়েছেন এভাবে।

“দ্বিজেন্দ্রলাল সবল সুস্থ পৌরুষের উপাসক ছিলেন, বিলাতে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তিনি যখন দেশে ফিরিয়া সমাজপ্রভুদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিলেন, তখন তাঁহার মনে একটি সুগভীর ধিক্কার জন্মিয়াছিল। ইহার সহিত মিলিত হইয়াছিল তাঁহার অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ, বিলাতে যাত্রা করিবার দিন হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি মনে মনে পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করিয়াছিলেন। আইনের বাধায় উহার সহজ প্রকাশ সম্ভব ছিল না। সুতরাং স্বাভাবিক হাসির সহিত তাঁহার মনের এই ধিক্কার ও গ্লানিসঞ্জাত তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গরসের সংযোগ হইল। এই ত্রিবেণী সঙ্গমের ফলে বাংলা সাহিত্যে যে অমৃতধারা প্রবাহিত হইল, তাহা সম্পূর্ণ নূতন, অভিনব।“

দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকে যে দেশপ্রেম, পরহিতব্রত, আদর্শবাদকে উজ্জ্বল করে তুলতে চাইতেন, তাতে দেশপ্রেমমূলক গান সংযোজন করায় এক নতুন মাত্রা পেয়ে যায়। নাটকের প্রয়োজনেই তিনি অনেক দেশপ্রেমমূলক গান লিখে ফেলেন। দেশপ্রেমের গান অবশ্য তিনি আগেও লিখেছিলেন। কোলকাতা থাকার সময়ে। কিন্তু, ভয়ার্ত আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে এবং চাপে পড়ে স্বহস্তে সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নাটকের এই সমস্ত গানে দেশপ্রেমকেও এক নতুন অর্থে মণ্ডিত করে তুলেছিলেন তিনি। দ্বিজেন্দ্রলালের পরিণত প্রতিভায় দেশপ্রেমের গানগুলো অভিনব ধরনের, দেশকে অবলম্বন করে নতুন এক ভাবসত্যকে তিনি আবিষ্কার করেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বহু অখ্যাত গ্রাম্য কবিরাও স্বদেশী গান রচনা করেছেন। কিন্তু, দেশকে কেন্দ্র করে উচ্চতর ভাবলোক সৃষ্টি করা রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হয় নি। দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশী গান তাই শুধু বীররসেরই প্রকাশভঙ্গী না, শুধু চিত্ত আলোড়নকারী উল্লাসমাত্র নয়, এক গভীর ভাবসত্যের অবিচল উপলব্ধি। তাঁর স্বদেশপ্রেমমূলক কোরাস-সঙ্গীতগুলি তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দান। এই ধরনের গানে আজো তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই সব গানে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সুর বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন তিনি। এগুলোতে দ্বিজেন্দ্রলাল ভারতীয় রাগরাগিণীকেই আশ্রয় করেছেন, আবার সেখানে ইউরোপীয় সুরের ভঙ্গিটিও অনুপস্থিত নয়।

২.

১৯০৬ সালে গয়ায় ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বদলি হন দ্বিজেন্দ্রলাল। এর পরের বছর গয়ায় বেড়াতে যান বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্রের সাথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পূর্ব পরিচয় ছিল, কিন্তু সেরকম কোনো ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্ব ছিল না। এখানেই তাঁরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। দ্বিজেন্দ্রলাল, জগদীশ বসুকে নানা ধরণের গান গেয়ে শোনান। এই সময়ই দ্বিজেন্দ্রলালের অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা জন্মায় জগদীশচন্দ্র বসুর। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হন তিনি। দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনী লেখক দেবকুমার রায়চৌধুরীকে তিনি চিঠি লিখে জানান,

“কয়েক বৎসর পূর্ব্বে একবার গয়ায় বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে দ্বিজেন্দ্রলাল আমাকে তাঁহার কয়েকটি গান শুনাইয়াছিলেন। সেদিনের কথা কখনও ভুলিব না। নিপুণ শিল্পীর হস্তে, আমাদের মাতৃভাষার কি যে অসীম ক্ষমতা, সেদিন তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলাম। যে ভাষার করুণ ধ্বনি মানবের অক্ষমতা, প্রেমের অতৃপ্ত বাসনা ও নৈরাশ্যের শোক গাহিয়াছিলেন, সেই ভাষারই অন্য রাগিণীতে অদৃষ্টের প্রতিকূল আচরণে উপেক্ষা, মানবের শৌর্য ও মরণের আলিঙ্গন-ভিক্ষা ভৈরব নিনাদে ধ্বনিত হইল।

ধরণী এক্ষণে দুর্ব্বলের ভার-বহনে প্রপীড়িতা। রুদ্র সংহার মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন। বর্ত্তমান যুগে বীর্য্য অপেক্ষা ভারতের উচ্চতর ধর্ম নাই। কে মরণ-সিন্ধু মন্থন করিয়া অমরত্ব লাভ করিবে। ধর্ম্ম-যুদ্ধের এই আহবান দ্বিজেন্দ্রলাল বজ্র-ধ্বনিতে ঘোষণা করিতেছেন।“

এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেও দেবকুমারকে চিঠি লিখেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের কিছু গান শুনে জগদীশচন্দ্র বসু মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই মুগ্ধতা থেকেই তিনি চেয়েছিলেন যে দ্বিজেন্দ্রলাল এই ধরনের গান আরও লিখুক। তবে তা হোক বাংলার জল, মাটি সিক্ত। সে কারণে তিনি বলেছিলেন যে,

“আপনি রাণা প্রতাপ, দুর্গাদাস প্রভৃতির অনুপম চরিত-গাথা বঙ্গবাসীকে শুনাইতেছেন বটে; কিন্তু তাঁহারা বাঙ্গালীর সম্পূর্ণ নিজস্ব সম্পত্তি বা একেবারেই আপন ঘরের জন নহেন। এখন এমন আদর্শ বাঙ্গালীকে দেখাইতে হইবে- যাহাতে এই মুমুর্ষ জাতটা আত্ম-শক্তিতে আস্থাবান হইয়া আত্মোন্নতির জন্য আগ্রহান্বিত হয়। আমাদের এই বাঙ্গালাদেশের আবহাওয়া জন্মিয়া, আমাদের ভিতর দিয়াই বাড়িয়া-উঠিয়া, সমগ্র জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করিতে পারিয়াছেন, – যদি সম্ভব হয়, যদি পারেন ত’ একবার সেই আদর্শ এ বাঙ্গালী জাতিকে দেখাইয়া, আবার তাহাদিগকে জীয়াইয়া, মাতাইয়া তুলুন।“

জগদীশ চন্দ্র বসুর এই উপদেশই হয়তো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্তরে কাজ করেছিল। এর তিনমাস পরের ঘটনা। পূজো সময়ে দেবকুমার গয়ায় বেড়াতে এসেছেন। উঠেছেন দ্বিজেন্দ্রলালের বাড়িতেই। বন্ধুর সাহচর্যে প্রতিমুহূর্ত সময় কাটান তিনি। এরকমই একদিন হুট করে দ্বিজেন্দ্রলাল বলে উঠেন যে, তাঁর মাথার ভিতরে কিছু লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেগুলোকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই। দেবকুমার রায়চৌধুরীর নিজ ভাষ্যেই শুনিঃ-

“এক দিন – বোধ হয় অষ্টমী পূজার দিন – দুপুরবেলায় আহারান্তে দু’ জনে চুপচাপ বসিয়া আছি, কবিবর হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন – “দেখ, আমার মাথার মধ্যে একটা গানের কয়েকটা লাইন আসিয়া ভারি জ্বালাতন করিতেছে। তুমি একটু বোসো ভাই, – আমি সেগুলো গেঁথে নিয়ে আসি।“ অর্দ্ধ ঘণ্টা বা তাহারও কিছু অধিককাল একাকী বসিয়া-রহিলাম। দ্বিজেন্দ্রলাল তখন দূর হইতে হাত-তালি দিয়া, গুণ-গুণ করিয়া গাইতে-গাইতে, আমার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; আমাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিয়া কহিলেন, -“উঃ, কি চমৎকার গানই লিখেছি! শুনবে? শুনবে নাকি? আচ্ছা তবে শোনো।“ এই বলিয়া গাহিয়া উঠিলেন, –

“বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ।“

গান শুনে দেবকুমার স্তম্ভিত হয়ে যান। চোখে জল এসে গেছে তাঁর। নীরবে, নত শিরে বসে থাকেন তিনি। কী এক অপার্থিব অনুভূতির আবেগে, আনন্দে, উৎসাহে, গৌরবে কিছুক্ষণের জন্য আত্মবিস্মৃতি হয়ে পড়েন তিনি। গান শেষ করে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী? কেমন?’ উত্তরে দেবকুমার বলেন যে, ‘ধন্য আপনি।‘ বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল সামান্য একটু হাসেন। তারপর কিছু না বলে, হাত তালি দিতে দিতে, সারাটা ঘরময় ঘুরে ঘুরে, নেচে-নেচে, আবার গাইতে থাকেন।

লোকেন্দ্র পালিত গয়ায় জজ ছিলেন। উঁচু বা মধ্যমশ্রেণীর রাজকর্মচারীরা প্রতিদিন কাজের শেষে স্থানীয় ক্লাবে মিলিত হতেন। কিন্তু, পালিত সাহেব সহকর্মীদের আগ্রহ সত্ত্বেও ক্লাবে না গিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়িতে। ক্লাবের হৈ হট্টগোল আনন্দের চেয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গ সুখ তাঁর কাছে অনেক বেশি আরাধ্য ছিল। ইনি অত্যন্ত সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেই এঁর সম্পর্কে বলেছেন যে, “এখানে সাহিত্যিক-মণ্ডলীর পরিধি বড়ই অল্প। এক লোকেন পালিত। তবে সে একাই একশ।“

সেদিন সন্ধ্যায়ও প্রতিদিনের মতোই পালিত মশায় হাজির হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়িতে। দ্বিজেন্দ্রলাল গেয়ে শোনাচ্ছেন্ন বঙ্গ আমার জননী আমার। এই বজ্র-গর্ভ গান শুনে আনন্দ, উল্লাস ও উৎসাহে পালিত মশায় প্রমত্ত হয়ে উঠলেন। তিনি গান গাইতে পারেন না। তাল বোধও একেবারেই নেই। কিন্তু তাতেও তাঁর উত্তেজনার কোনো কমতি নেই। দ্বিজেন্দ্রলাল সারা কক্ষে ঘুরে ঘুরে গাইছেন আর পালিত মশায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে দ্বিজেন্দ্রলালকে অনুসরণ করে চলেছেন। দেবকুমার রায়চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার দেশ গানটি শুনিয়া, পৌঢ় পালিত সাহেবের সেই যে অপূর্ব্ব উন্মাদনা দেখিয়াছি, এ জীবনে তাহা কখনও ভুলিতে পারিব না।‘

শুধু পালিত সাহেবই নন, এই গানটি শুনে একদিন যে পুরো বাঙালি জাতিই যুগে যুগে উন্মাদনায় মেতে উঠবে, সেটা হয়তো দেবকুমার সেই মুহূর্তে ভাবতেও পারেন নি।

পরদিন সকালে রাজ কার্য উপলক্ষে জেলা-জজ বরদাচরণ মিত্র মশায় এসে অতিথি হলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। এই বরদাচরণ মিত্র নিজেও একজন সুকবি। সেদিন সন্ধ্যার সময়ে সবাই অনুরোধে জানালেন এই গান গাইতে। দ্বিজেন্দ্রলাল দর্পিতভাবে তাঁর জলদ-গম্ভীর স্বরে সবাইকে গান গেয়ে শোনালেন। লোকেন্দ্রপালিত এবং বরদাচরণ মিত্র, দুজনে স্বদেশপ্রাণ ব্যক্তি। এই গান শুনে বিস্ময়, আনন্দ, গর্ব এবং অকৃত্রিম দেশ-ভক্তিতে তাঁরা দুজনেই একেবারে স্তব্ধ ও অভিভূত হয়ে গেলেন। গান শেষ হয়ে গেলো, তবুও বহুক্ষণ তাঁদের কারোরই কণ্ঠ আর শোনা গেলো না। দেবকুমার রায়চৌধুরী লিখেছেন,

‘গান শেষ হইয়া গেল, তবু, বহুক্ষণ তাঁহাদের কাহারও কোনো বাকস্ফূর্তি হইল না;-তাঁহারা উভয়েই সম্মুখস্থ, মুক্ত গবাক্ষ-পথে সেই নীলাভ-ধূসর, অনন্ত অম্বর পানে এক দৃষ্টিতে চাহিয়া-রহিলেন। কতক্ষণ এভাবে কাটিল, বলিতে পারি না; শেষে সহসা উন্মত্ত উৎসাহে পালিত মহাশয় কবির করদ্বয় উভয় হস্তে সবেগে মর্দ্দন করিতে-করিতে কহিলেন, –

“Oh! How wonderful – how magnificent! Let me confess my dear Dwiju, it’s undoubtedly the very-very-very best and noblest national song that I’ve ever heard or read in my life. It’s indeed a Devine inspiration.”

শুধুমাত্র গানটা রচনার সময়েই যে দ্বিজেন্দ্রলাল সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন, তা নয়, গানটি গাইবার সময়েও সমস্ত হৃদয় দিয়েই তা গাইতেন তিনি। এই গানটা গাইবার সময়ে তিনি অদ্ভুত এক ভাবাবেগে ভেসে যেতেন, তন্ময় এবং গভীরভাবে আত্মহারা হয়ে যেতেন। এই সব আবেগ, একাগ্র উত্তেজনা, তন্ময় ঐকান্তিকতা, দেশের জন্য কল্যাণকর ছিল, মঙ্গলময় ছিল। কিন্তু, এই সুগভীর আবেগ তাঁর জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘আমার দেশ’ গানটা গাইবার সময় তিনি কী রকম উত্তেজিত হয়ে উঠতেন, তা অনেকেই জানেন।দাঁড়িয়ে উঠে, বীরত্ব ও আত্ম-মর্যাদাব্যাঞ্জক নানা অঙ্গভঙ্গি করার সময় উৎসাহ ও উত্তেজনা ও উদ্দীপনার তাঁর চোখ মুখ একেবারে টকটকে লাল হয়ে যেতো। প্রথম প্রথম এই গানটা খুব গাইতেন তিনি। অনুরোধ হলেই এই গান গাইতেন তিনি। অনুরোধ তো দূরের কথা, কেউ একজন যদি আকারে ইঙ্গিতেও গানটা শোনার অনুরোধ জানাতো, তিনি একেবারে লাফিয়ে উঠে ওই গানটা গাওয়া শুরু করতেন।

সব আন্দোলনেরই এক সময় তীব্রতা যেমন কমে যায়, স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে যে তীব্র আবেগ নিয়ে যত্রতত্র আমার দেশ গানটা দ্বিজেন্দ্রলাল গাইতেন, ধীরে ধীরে আন্দোলনের গতি কমে যাবার সাথে সাথে এই গান গাওয়ার পরিমাণও কমে যেতে থাকে। এক সময় যে গান গাওয়ার অনুরোধ পাবার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে থাকতেন, সেই গানই অনুরুদ্ধ হবার পরেও গাইতে চাইতেন না। দেবকুমারের মনেও সন্দেহ জেগেছিল। ব্রিটিশের শক্ত নীতির কারণে স্বদেশী আন্দোলন গতি হারিয়েছিল তখন। সকলের মধ্যেই এক ধরনের ভয়-শঙ্কা কাজ করেছে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার জন্য। দ্বিজেন্দ্রলালও কি সেই দলে পড়লেন কি না? একদিন তিনি সাহস করে দ্বিজেন্দ্রলালকে জিজ্ঞেসও করে বসলেন কথাটা। তাঁর এই কথায় বিরক্ত, আহত এবং ব্যথিত হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল । রাগে, ক্ষোভে দাঁড়িয়ে গর্জন করে বললেন যে,

“বটে! আমাকে এত অধম, এমন হীন ও কাপুরুষ তুমি ভাব? ভয়! কেন, কাকে – কিসের জন্য ভয় করতে যাব? ভারি তো আমার ভয়! অমন ভয়ের মস্তকে এই আমি পদাঘাত করি! মানুষ হয়ে জন্মেছি! যা উচিত বুঝব, ন্যায্য, সঙ্গত ও কর্ত্তব্য বলে মনে করব, একশ’বার তা আমি প্রকাশ্যেই করতে প্রস্তুত। তবে এই গানটা – এটা আর তেমন গাই না কেন, যদি জিজ্ঞেস কর তার উত্তর এই যে, এ গান গাইতে গেলে ‘ঝাঁ’ করে কেন যেন আমার মাথাটা ভয়ানক গরম হয়ে ওঠে; বোধ হয়, যেন সমস্ত শরীরের রক্ত মাথায় গিয়ে জমেছে।“

এর সূত্রপাত হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালের বন্ধু ললিতচন্দ্রের “দীন-ধামে” ‘আমার দেশ’ গাওয়ার সময়। এই গান গাওয়ার সময়ে মাথার ভিতরে এক ধরনের উদ্বেগ অনুভব করতে থাকেন দ্বিজেন্দ্রলাল। গান থামিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন তিনি। বিশ্রামের ফলে শারীরিক অসুস্থতাটা কেটে যায়। ধরে নেওয়া হয় যে, অনেক লোকের ভিড়ের কারণেই হয়তো বা এমনটা হয়েছে।

এর অল্পদিন পরে নিজের বাড়িতেই এরকম ঘটে যায়। সকালবেলায় কয়েকজন অভ্যাগত বন্ধুর অনুরোধে এই গান গাইতে গিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্তু গাইতে গিয়ে চট করে তাঁর মাথা ধরে গেলো। সেই ধরা মাথা থাকলো প্রায় সারাটা দিনই। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, ‘সেবার গাইতে গাইতে, হঠাৎ তাঁহার মনে হইল, কে যেন তাঁহার মস্তকের তালুদেশে সজোরে একটা ‘চাঁটি’ (চপেটাঘাত) মারিল, এবং সেই সঙ্গে-সঙ্গেই সমস্ত মাথাটা ‘চট’ করিয়া ‘ধরিয়া’ উঠিল।

এখানেই শেষ নয়। আরেকবার এরকম ঘটে ডাক্তার কৈলাস বসুর বাড়িতে। দ্বিজেন্দ্রলাল ইভনিং ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে বহু লোকের সামনে এই গানটা শোনাচ্ছিলেন। গান গাইতে গাইতে উত্তেজনায় মাথায় রক্ত উঠে গেলো তাঁর। প্রবল আবেগে তীব্র উত্তেজনা নিয়ে গান গাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই অবসন্ন হয়ে বসে পড়েন তিনি। চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন তিনি। মাথায় এবং চোখে মুখে গোলাপ এবং বরফ জল দিয়ে, বহুক্ষণ বাতাস করার পর ক্রমে তিনি অপেক্ষাকৃত প্রকৃতিস্থ হন। যদিও তাঁর অবস্থা দেখে সবাই আশংকা করছিলেন যে তিনি বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবেন।

দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকার নবকৃষ্ণ ঘোষের মতে এই গান দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনে এসেছিল নিয়তির মতো করে। কেননা এই গান গাইতে গেলেই তিনি আত্মসংযম হারাতেন। আক্রান্ত হতেন উচ্চ রক্তচাপে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

“এই গীতটি গায়িতে গায়িতে একদিন স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু মহাশয়ের বাটীতে দ্বিজেন্দ্রের মস্তিষ্কে রক্তাধিক্য হয়, আর একদিন ইভনিং ক্লাবে এই গানটি শিক্ষা দেবার সময়, পরে পুনরায় একদিন ঝামা-পুকুরে তদীয় মিত্র শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের ভবনে ঐ গানটি গায়িতে গিয়া দ্বিজেন্দ্রের মস্তিষ্কে শোনীকাধিক্য হয় এবং প্রতিবারই তাঁর সংজ্ঞাশূন্য হইবার উপক্রম হয়। ইহাই দ্বিজন্দ্রের প্রানান্তকারী সন্ন্যাস রোগের সূত্রপাত।“

দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেও এই গান সম্পর্কে বলেছিলেন যে, “ও গানটা গায়িতে গেলে আমার কেন জানি না, ভয়ানক মাথা গরম হয়ে উঠে।“ আমাদের হয়তো মাথা গরম হয় না দ্বিজেন্দ্রলালের মতো, তবে রক্ত গরম হয়ে যায় গভীর দেশপ্রেমে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালির শৌর্যবীর্যগাথা নিয়ে এরকম উন্মাদনাময় গান যে খুব বেশি নেই বাংলাতে।