ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর দুই দেশের মানুষকে শুধু ধর্ম পরিচয়ের কারণে প্রায় ২০ মিলিয়নের অধিক মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এতো বেশি মানুষের দেশ ত্যাগের রেকর্ড পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পূর্ব বাঙলা বর্তমানে যা বাংলাদেশ সেই অঞ্চলের একটি বড় অংশ ৪৭-এ দেশ ত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয় নেয়। অদ্ভুত বিষয় হল, পূর্ব বাঙলা থেকে আগত শরণার্থীর সুযোগ-সুবিধার প্রতি কংগ্রেস সরকার ততটা আন্তরিক ছিল না। যতোটা ছিল পাঞ্জাব কিংবা পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থী মানুষগুলোর প্রতি। এ কথা সত্য পূর্ব বাঙলার মানুষ পাঞ্জাবের মতন এতো রক্ত দিতে হয় নি। তবে পূর্ব বাঙলায় যে রক্তপাত হয় নি তা বলা যাবে না। কারণ কলকাতার বিভিন্ন ঘটনা কিংবা গুজবের জের ধরে কয়েক লাখ মানুষের উপর দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়েছে। যেমনটা হয়েছে পশ্চিম বাঙলার মুসলিমদের উপর। বাংলাদেশের ৭১স্বাধীনতা যুদ্ধে ১০ মিলিয়নের উপর মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সবাই নিজের বাস ভূমিতে ফিরে আসে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ত্যাগের স্রোত ৪৭ থেকে শুরু হলেও সেই স্রোত আজও থামে নি। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের নীরব দেশ ত্যাগে তা প্রমাণ হয়। এছাড়া ভারতে কিছু হলে এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় এই দুই দেশের সংখ্যালঘুদের উপর দিয়ে যায়। যেমন-ভারতের এক বাবরি মসজিদের বিপরীতে বাংলাদেশে কয়েক হাজার মন্দির ভাঙার ঘটনা ঘটে।

গত সপ্তাহে বিবিসি’র খবরে পড়লাম স্লোভাকিয়া মুসলমান শরণার্থী গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।তাঁরা সিরিয়া থেকে শুধুমাত্র খ্রিস্টান শরণার্থী গ্রহণ করবে। স্লোভাকিয়া জানিয়েছে যে, মুসলমানরা যে দেশে থাকে সে দেশকে নিজের মনে করতে পারে না। আরও ব্যাখ্যা চাইলে জানিয়েছে যে, স্লোভাকিয়ায় মসজিদ নেই তাই মুসলমানরা কমফোর্ট ফিল করবে না। স্লোভাকিয়া এই সিদ্ধান্ত অমানবিক। কারণ বিপদগ্রস্ত কোন মানুষকে ধর্ম দেশে আশ্রয় দেওয়া একটি অমানবিক পন্থা। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আলোকে কেন এমন পথে স্লোভাকিয়া হাঁটল তা কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। মাস তিনেক আগে যুক্তরাজ্য নতুন আইন ঘোষণা করে। এই আইনের ফলে অনেক বাংলাদেশীর যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বার্ষিক ১৩ হাজার পাউন্ডের পরিবর্তে যুক্তরাজ্যে কাজ করবার ভিসায় দেখাতে হবে ৩৫ হাজার পাউন্ড। এছাড়া বর্তমান আইনের ফলে যুক্তরাজ্যে পড়তে গিয়ে থেকে যাওয়াটাও এখন কঠিন হয়ে পড়বে!

কয়েক মাস আগে বাংলাদেশীসহ আট হাজার রোহিঙ্গা সাগরে ভেসে মারা যাচ্ছিল। ফিলিস্তিন, ইরাকের মানুষগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত কান্নাকাটি করলেও এই অসহায় মানুষগুলোকে আশ্রয় দেয় নি ইন্দোনেশিয়ার সরকার। এমনকি জাতিসংঘের আহ্বানে করবার পরও অস্থায়ী ভাবে নিজ ভূখণ্ডে একটু মাথা গোঁজার ঠাই দিতে তাদের আপত্তি ছিল! সাহায্যে হাত প্রথম বাড়ায় ফিলিপাইন। ঠিক একই সময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কয়েকদিন আগে ঘোষণা দিয়েছে আগামী দুই বছরে প্রায় ২০,০০০ শরণার্থীকে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিবে । এর জন্যে তাঁরা বাজেট বরাদ্দ রেখেছে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর। এইখানে উল্লেখ্য যে এই শরণার্থীদের একটা বড় অংশ আসছে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলি হতে ।

ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি, সুইডেন। এখনো দিচ্ছি। জার্মানি আশ্রয় দেয় প্রায় দশ লাখ! দুই দিন আগে জার্মানির একটি আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে সারা মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে। কোন এক মুসলিম শরণার্থী তার সঙ্গে একটি কোরান নিয়ে এসেছে। সেই একই আশ্রয়কেন্দ্রের ভিন্ন কোন ধর্মালম্বীদের কেউ একজন সেই কোরান নিয়ে টয়লেটে রেখে এসেছে। এরপর মুসলিম শরণার্থীরা সেই আশ্রমে থাকা ভিন্ন ধর্মালম্বী শরণার্থীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের নাজেহাল করছে, পেটাচ্ছে, ভাংচুর করছে- তথ্যসূত্র- সেটডিএফ টিভি চ্যানেল। এই ঘটনা প্রচার হওয়ার পর থেকে এসব শিশুদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে, জার্মানিতে শান্তিতে থাকার দিন শেষ হয়েছে। এসব শরণার্থীরা জার্মানিকেও সিরিয়ার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে পরিণত করবে।

জার্মানির জার্মানদের মতন ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও এই শরণার্থী মানুষগুলোর উপর ভেতরে ভেতরে রুষ্ট হচ্ছে। এর মূল কারণ- যারা আসে তাদের বড় অংশটি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম। এদের মধ্যে প্রচণ্ড ধর্মানুভূতি বিদ্যমান এবং বেশির ভাগই ধর্ম-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করে। এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে লেখে একটা সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয় তাহলো বেশির ভাগ মানুষ ভাবে শুধু বদনাম করার জন্য এই লেখার অবতারণা। যারা এমনটি ভাবছেন তাদের স্মরণে রাখা ভাল যে, যুক্তরাজ্যে নতুন আইনের ফলে ভুক্তভোগী শুধু ধর্মান্ধরা নয় ভুক্তভোগী হবো ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই। চিন্তা-চেতনায় পিছিয়ে পড়া, অনুন্নত চিন্তা ভাবনার সাথে জিহাদি জোশের সংমিশ্রণে এদের একটা গ্রুপ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টি করে। সবাই যে অপরিবর্তিত হয় না তাও না। অনেকে ইউরোপিয়ানদের মতনই জীবন-যাপন করেন। কিন্তু একটা বড় অংশ কখনো নিজেদের পরিবর্তন করতে চায় না। উল্টো সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে।

এক সাংবাদিকের মুখে সুখে শুনলাম ৭১ সালে নরওয়েতে অনেক পাকিস্তানী আশ্রয় পায়। সে সময় নরওয়েতে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যাচ্ছিল। অন্যদিকে তাদের অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। ৭১এর যুদ্ধ ও পাকিস্তান সেনা বাহিনীর অত্যাচার বর্ণনা করে নিজেদের পশ্চিম পাকিস্তানের আটকে পড়া বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। নরওয়ের সরকারও তাদের নিয়ে আসে। এছাড়াও এই দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষগুলোকেও অতীতে আশ্রয় দিয়েছে। মজার বিষয় হল গত বছর নরওয়েতে ধর্ষকের তালিকায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থান সবচেয়ে উপরে।

‘রেড ক্রস’ সংস্থাটির সাহায্য সবচেয়ে বেশি নেয় আশ্রয়প্রার্থী মুসলিমরা। অথচ এই রেড ক্রস সংস্থাটি মুসলিম দেশগুলোতে ‘রেড ক্রিসেন্ট’ নামে কার্যক্রম চালাতে হয়। ক্রস যেহেতু খ্রিস্টানিয় প্রতীক সুতরাং অনুভূতি প্রবণ মুসলিম দেশগুলো ক্রস নামটি ঢুকতে দেয় নি। অথচ এই রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠানগুলোতে খ্রিস্ট ধর্মের কোন প্রচার কখনো দেখি নি। যাই হোক আমাদের ক্ষুদ্র মনের প্রতিফলন রাষ্ট্রীয় আইনেও প্রতিফলন হয়। সুইজারল্যান্ড-এর পতাকায় ক্রস আছে। সৌদি আরবের পতাকায় একটি বড় তলোয়ার আছে। তলোয়ার কতোটুকু মানবিকতার প্রতীক হয়ে উঠে তা জানা নেই। এছাড়া সৌদি আরবে কোন অমুসলিমদের উপাসনালয়, স্কুল প্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে নিষেধ আছে। এই নিয়ে কারো কোন আপত্তি নেই। যাই হোক আশ্রয় প্রার্থী মুসলিম জনগোষ্ঠীর এক অংশ দাবী করে বসল সুইজারল্যান্ডকে তার পতাকা বদলাতে হবে! কারণ এতে ক্রস আছে যা তাদের ধর্মানুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক! এই ঘটনায় লন্ডনের এক মেডিক্যাল স্কুলের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। মেডিক্যাল স্কুলে ১৩জন মুসলিম ছাত্র বিবর্তনবাদ পড়ানোর প্রতিবাদে ক্লাস করবে না। তিন বছর আগে এমন একটা নিউজ দেখেছিলাম। সম্ভবত ২০১২ সালে কানাডা ঘোষণা করল যে, নাগরিকত্ব নেওয়ার সময় অবশ্যই মুখ দেখাতে হবে। লক্ষ্য করুণ এখানে কানাডা বোরকা, হিজাব কোন কিছুই নিষিদ্ধ বা নিষেধ করে নি। শুধু বলেছে, নাগরিকত্ব নেওয়ার সময় মুখ প্রদর্শন করতে হবে। এর প্রতিবাদে অনেকে জিহাদি জোশে সমালোচনায় ফেটে পড়লেন।

যুক্তরাজ্যের পর সুইডেন হল দ্বিতীয় দেশ যেখান থেকে অধিক সংখ্যক তরুণ-তরুণী সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গেছে। সুইডেনের পতাকা নিয়েও কিছু জিহাদি গ্রুপের আপত্তি আছে। এছাড়া সুইডেনের শহরগুলোতে মুসলিমরা মসজিদগুলোতে ইউরোপের সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা করতে শেখায়। ইংল্যান্ডের মতন জার্মানির পুলিশ অফিসেও অসংখ্য নিখোঁজ তরুণ, তরুণীর ছবি ঝুলছে। যারা জার্মানি থেকে মিসিং। মজার বিষয় হল সবাই জানে এরা সিরিয়ার আইএসআইএল এ যোগ দিতে গিয়েছে কিন্তু এরা যখন ফিরে আসছে তখন বাঁধা দিতে পারছে না। কারণ আইনগত-ভাবে আপনাকে বাঁধা দিতে হলে রাষ্ট্র বা পুলিশকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি ISIL এ যোগ দিয়েছেন। সে সুযোগ যেহেতু নেই (তদন্ত করতে তো আর সিরিয়ায় যাবে না কেউ) সেহেতু তারা ফিরে আসার সুযোগও পাচ্ছে। আইএসআইএল হুংকার দিয়েছিল যে, আশ্রয়প্রার্থী মানুষগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের সদস্য ইউরোপের দেশগুলোতে ঢুকিয়ে দেবে। মজার বিষয় হল ইউরোপেই এখন আইএস-পন্থী তরুণ-তরুণীর জন্ম হচ্ছে। আর এতে সহায়তা করছে মসজিদ ও বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থা। ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতেও জিহাদি পন্থীদের কারণে সামাজিক সংকট শুরু হয়েছে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম ইতালি। যেখানে খ্রিস্টানদের চার্চ আক্রমণের মতন ঘটনাও ঘটেছে।

মুসলিম দেশগুলো কোনটাই মানুষের বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। এছাড়া লেখালেখির কারণে অসংখ্য মানুষকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, হত্যা করা হয়, লেখা-লেখির কারণে জেল খাটানো হয়। পিছিয়ে পড়া ধর্মান্ধ-গোষ্ঠী যখন ইউরোপ কিংবা অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয় তারা ত্যাগের সাথে সাথে নিজেদের ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি কোনটাই ত্যাগ করে আসতে পারে না। ফলে ইউরোপের রাস্তায় মাঝে মধ্য শরিয়া আইন চাই, গণতন্ত্র মানি না! এমন পোস্টারের দেখা মেলে। এছাড়া রাস্তায় রাস্তায় অনেকে ধর্ম প্রচার করে বেড়ায়। এই সংকটটি যুক্তরাজ্যে আরও বেশি মাত্রায় জেঁকে বসেছে। সেখানে কিছু এলাকায় জোর করে বোরকা পরা ও এই এলাকায় মদ খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে! ফলে ভবিষ্যতে একটা বড় আকারে সংকট হিসেবেও এরা হাজির হচ্ছে।

লেখাটা পড়ে অনেকের হয়তো মনে আসতে পারে লেখাটা মুসলিম বিরোধী লেখা। এখানে মূলত আশ্রয় প্রার্থীদের চিত্রটা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। দশ লক্ষ কেন এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিলেও কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। যদি তারা মানুষের স্বাধীনতা, সহনশীলতা বিশ্বাসী হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিছু অংশের জন্য বদনামের ভাগীদার হচ্ছে সবাই। আজ যুক্তরাজ্য, স্লোভাকিয়া তার নীতি পরিবর্তন করেছে হয়তো এমন সংকটের মুখোমুখি হয়ে অন্য দেশগুলো তাদের নীতির পরিবর্তন আনবে। কারণ স্থানীয় মানুষের মধ্যে আশ্রয়প্রার্থী মানুষগুলোর প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারনা জন্ম নিচ্ছে এবং এই দায় আশ্রয়প্রার্থীদের। ভোটের রাজনীতির কারণে, উদারনীতির সুযোগ নিয়ে একটা অংশ জিহাদে নেমে পড়ছে কিন্তু এর দায় নিতে হচ্ছে সবার। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভুক্তভোগী হচ্ছে সবাই। ইউরোপের সাগরে ভেসে শুধু মানুষ আসছে না সাথে আসছে সংকট,আসছে অন্ধকারও।