লেখক: সম্বিত

আপনার ধর্মই শ্রেষ্ঠ। হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আমি মেনে নিচ্ছি আপনার ধর্মই এ পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এবং আমি এসব কথা সব কিছু বিচার বিবেচনা করেই বলছি। এতদূর শুনে আপনার মনে বেশ একটা ফুর্তির ভাব হয়েছে তো? সে তো হওয়ারই কথা।  এই ফুর্তির ভাবটা বজায় রাখতে বাকি লেখা না পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ুন ও চিৎকার করে বলতে থাকুন আপনার শ্রেষ্ঠত্বের কথা। আর সেই সময়ে আমরা একটু বিচার করে দেখি আপনি কোন ধর্মাবলম্বী । 

আপনি যদি হিন্দু হন, এই ভারতে সংখ্যাতত্বের বিচারে যেটা হওয়ার সম্ভবনাই বেশি, তাহলে বলব, একটু বুজরুকি ছেড়ে খোলা মনের আলোচনায় আসুন। আগে ঠিক করুন, প্রাচীন হিন্দুত্ব নিয়ে বড়াই করবেন না বর্তমান নিয়ে। কারণ আপনারা এতটাই জগাখিচুড়ি গোত্রের ধর্ম যে আপনারা নিজেরাই বোঝেন না নিজেদের ধর্মকে। হিন্দু ধর্মের বর্তমান রীতিনীতি, আচার আচরণ নিয়ে বললে আপনারা দোহাই দেন অতীতে এই ছিল, ওই ছিল, বস্তুত ‘আপনাদের ব্যাদেই সব আছে’! আর প্রাচীন যুগের অপকর্মের প্রসঙ্গ তুললে যেসব কতিপয় জিনিস পাল্টে নিয়েছেন বা পাল্টানোর চেষ্টা করেছেন (সতীদাহ, বাল্য বিবাহ ইত্যাদি) সে সব প্রসঙ্গ তোলেন। আপনারা নিজেরাই ঠিক করে উঠতে পারেন না আপনাদের ঈশ্বর নিয়ে ধারণা। বহু ধরনের মূর্তি পূজা নিয়ে বলতে গেলে, এক ঈশ্বর – পরমেশ্বর এর উদাহরণ দিয়ে উপনিষদ টানেন – আবার ধেই ধেই করে ভূত চতুর্দশী থেকে দুর্গা ভাসান সবেতেই  নেত্য করেন। এই সব শুনে আবার কিছু সনাতনপন্থী যাঁরা ইতিহাসটা একটু আধটু জানেন আবার হিন্দুত্বের গোঁড়ামি থেকে বেরোতেও পারেননি তাঁরা  বলবেন, আপনাদের ধর্ম কেউ সৃষ্টি করেননি, এটা একটা জনজাতির  জীবন জীবিকা অভ্যাস থেকে তৈরী হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে কেন এত পুরনো জিনিসপত্র নিয়ে পরে আছেন? এখনকার জীবনাভ্যাসকে মেনে নিন,  বর্তমানকে গ্রহণ করুন, মেয়েদের জিন্স পরতে দিন, সবাইকে রুচিমত গরু শুয়োর খেতে দিন,  বিজ্ঞানকে খোলা মনে গ্রহণ করুন, কারণ নেই অকারণ নেই একটা করে পুজোর দোহাই দিয়ে অপচয় বন্ধ করুন। আসলে, আপনাদের মত ঝালে-ঝোলে-অম্বলে, প্রসাদে ও বিষ্ঠায় (যারা বুঝলেন না, তাদের জন্যে বলি গো-বিষ্ঠা) থাকা  বহুচারী (দ্বিচারিতা বললে অনেক কম বলা হয়) ধর্ম, সত্যি বলছি, ভূভারতে আর একটিও নেই। এরপরেও যদি নিজেকে হিন্দু বলে শ্রেষ্ঠ ধর্মকারী মনে হয়, আপনি আপনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে পিছন চুলকান, আমি পরবর্তী ধর্মের দিকে নজর দিই। 

আপনি যদি ইসলাম ধর্মাবলম্বী হন, সংখ্যাতত্বের বিচারে সে সম্ভবনা ভারতে দ্বিতীয়, তাহলে তো আপনার মত “শান্তি”প্রিয় ধর্মকারী এই মুহূর্তে এই বিশ্বে আর একটিও নেই। স্বীকার করুন আর নাই করুন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটে চলা ধর্মজনিত হত্যার বেশির ভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা সংঘটিত এবং বেশিটাই পরিকল্পিত হত্যালীলা। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ছোটবেলায় পড়েছিলাম ইসলাম শব্দের অর্থ “শান্তি”, সেটা কি সত্যিই পড়েছিলাম? নাকি যাঁরা এই নাম দিয়েছিলেন তাঁরা শ্লেষার্থে এই নাম রেখেছিলেন। কেননা ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায় শুরুর থেকেই এই ধর্মের সাথে জড়িত নানা হত্যাকান্ড। এই অশান্তির ধর্ম শুধু অশান্তিতেই সীমায়িত নয়, নারীদের বোরখা পরিয়ে রাখতে বাধ্য করা, শিক্ষার থেকে সকলকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা এবং সংঘবদ্ধ ভাবে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আটকে রাখার জন্যে মধ্যযুগীয় বর্বরচিত পন্থা অবলম্বন করা কোন কিছুতেই পিছু পা নয়। দেড় হাজার বছরের পুরনো একটা বইকে সর্বস্ব মেনে আজকের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতাকে অস্ত্র নিয়ে মোকাবিলা করে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা এখনও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা করে যাচ্ছে। আর সব থেকে আশ্চর্য লাগে, তথাকথিত মডারেট ইসলামীরা এর বিরুদ্ধে চুপ থাকে। আর তাই, যুগ যুগ ধরে নিজেদের ধর্মকে সংখ্যাতত্বের বিচারে (দশ বারোটা করে বাচ্চা পয়দা করে)বিশ্বে এক নম্বর করার চেষ্টা করে গেলেও ইসলামকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলতে পারব না। আপনি বরং চাপাতি নিয়ে তৈরি হন আমাকে হত্যা করার, এর বেশি কিছু আপনার ধর্ম করতে পারেও নি, পারবেও না।

খৃষ্টান – ভারতীয় বিচারে তিনে আনলেও আপনার ধর্ম এই মুহূর্তে বিশ্বে এক নম্বরে। এবং আপনারাও ভারতে দম নেই বলে চুপ করে আছেন এবং বিশ্বে এক নম্বরে বলে কিছুটা ভাইরা যা করছে করুক টাইপের মনোভাব; “আমি তো সেরা বলে কিছু বলছিনা”র ভাণ করছেন! কিন্তু একটু গায়ে আঁচড় পড়লেই আপনারা যেভাবে ক্ষেপে ওঠেন তার হাতের সামনে উদাহরণ একটা দেশকে শ্মশানে পরিণত করে দেওয়া থেকেই বোঝা যায়। আপনাদের একটা বিল্ডিং জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় ধর্মের লোকেরা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ঘোষণা করে দিলেন ক্রুসেডের। হ্যাঁ, জর্জ বুশের ক্রুসেডকে সমর্থন করলেন পোপ জন পল-২ – ফলত একটা দেশ প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল! আরও পিছনে তাকাতে গেলে লক্ষাধিক মানুষ এবং নারীকে হত্যা করেছেন আপনারা আপনার ধর্মকে মহান করে তোলার জন্যে। আধুনিক যুগে ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করে গেছেন সারা বিশ্বে। খুব সুন্দর – কর্পোরেট স্টাইলে এমন ভাবে নিজেদের দলে লোক বাড়িয়ে গেছেন যে কেউ কিছু বুঝতেও পারেনি। সাবাশ বিশ্বের এক নম্বর ধর্ম! আপনি খুশি, আপনার ধর্মের অনুগামীরা খুশি- আমরা শুধু জানি আপনার ইতিহাস। আপনি বরং আর কয়েকটা বছর বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার গর্ব অনুভব করুন আমরা যাই পরবর্তী ধর্মে।

আপনার শিখ ধর্মালম্বী হওয়ার সম্ভবনা প্রায় দু-শতাংশ। আপনাদের দরাজ দিলের কথা অনেকে বলে থাকেন – তা দিল আছে বইকি! শিখ বললেই যেসব দৃশ্য চোখের সামনে উঠে আসে তা হল তরবারি খুলে কাওকে মারতে যাচ্ছে! এবং এটা নিয়ে তর্ক করার প্রশ্নই ওঠে না কারণ আপনারা নিজেদের সিংহ মনে করেন এবং ধর্মের বিষয়ে চরম অসহিষ্ণু। লড়াই, আরও লড়াই এবং আরও আরও লড়াই আপনার ধর্মের মূল কথা। অন্ততঃ সেরকম কোন ধর্মের কথা আমার সীমিত জ্ঞানে নেই যেখানে সঙ্গে কৃপাণ রাখাটা ধর্ম পালনের একটা মূল নিয়ম! আপনি বরং ঘুরে শুন; দেখবেন আবার ঘুরে শুতে গিয়ে যেন কৃপাণের খোঁচা নিজেই না খেয়ে যান!

বৌদ্ধ এবং জৈন – মাফ করবেন এক সাথে করে দেওয়ার জন্যে। সত্যি কথা বলতে কি আপনাদের কেউ ধর্তব্যেও আনে না। দুই রকম মিলিয়ে আপনারা মেরে কেটে দেড় শতাংশ। তবে সেটা কথা না, কম হলেই যে আপনার ধর্ম শ্রেষ্ঠ হতে পারে না এমন অদ্ভুত লজিকে আমি চলি না। কিন্তু বলছি অন্য কারণে, যখন আপনাদের রমরমা ছিল, তখন আপনারা নিজেদের মধ্যেই লড়াই লাগিয়ে রাখতেন। মুখে শান্তির বাণী – চন্ডাশোক কে ধর্মাশোক বানানোর গল্প, এতোই জীবে প্রেম যে মুখে জীবাণু ঢুকে গেলে তাদের হত্যা হতে পারে ভেবে মুখও বেঁধে রাখতেন, এদিকে একে অন্যকে সহ্য করতে পারতেন না। সেই নিয়ে লড়াইও কম হয়নি! আর হিন্দুদের সাথে তো লেগে ছিলই! আসতে আসতে লোকবল গেল – ফলত হানাহানিও কমল। এখন শিবরাত্রির সলতে হয়ে জ্বলছেন কোথাও কোথাও! জ্বলছেন জ্বলুন, ধর্মের বড়াই আপনাদের মুখে মানায় না!

তাহলে? এতটা পড়ে এসে হতাশ হয়ে পড়লেন? আর মনে মনে আমাকে গালি দিচ্ছেন যে উজবুকটা প্রথমে বলল ‘আপনার ধর্মই শ্রেষ্ঠ’ এদিকে সব কটাকে কাটিয়ে দিল। গালি দেবেন না, আমি এখনও বলছি, হ্যাঁ, আপনার ধর্মই শ্রেষ্ঠ। আপনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন, সেই মানুষের কিছু সহজাত ধর্ম থাকে, যেমন প্রতিটি পদার্থের থাকে, তবে নিতান্তই অপদার্থ হলে আপনার মধ্যে সে ধর্ম থাকবে না। তাই আপনার ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং তা মানব ধর্ম। মানুষের মত আচরণ করুন, পাশের মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়ান, অন্য মানুষের ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, দেশ, ভাষা ইত্যাদি দিয়ে বিভেদের বেড়াজাল না টেনে, পান থেকে চুন খসলেই খুন করতে না বেড়িয়ে ভালবাসুন। নোখ, দাঁত, পেশির শক্তি দিয়ে আক্রমণ তো পশুরাও করতে পারে, আপনার ধর্ম তো পাশবিক নয়। মানবিক হোন কারণ আপনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ‘মানব ধর্মাবলম্বী’-দের একজন।