dialectical materialism শব্দটির প্রচলিত এবং বহু ব্যবহৃত অর্থ হলো দান্দ্বিক বস্তুবাদ। কিন্তু মজার ব্যাপার এটাই যে dialectics একটি গ্রিক শব্দ এবং তার অর্থ হলো সর্বজনগ্রাহ্যতা। গ্রিক দার্শনিকরা dialectics বলতে সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ থেকে যুক্তিচালনা কে বুঝতেন। অ্যারিস্টট্ল নিজের টপিকস বইতে dialectical reasoning বলতে সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তিকে বুঝিয়েছেন।

সুতরাং dialectical materialism হলো এমন বস্তুবাদ যা সবাই সমানভাবে বুঝতে পারে। এই দর্শনের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলি এক এক করে বলছি:

সবার আগে বলছি যে এই বস্তুবাদ সমস্ত তত্ত্ব সর্বজনগ্রাহ্য প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝে। যেটা যেমন টাকে ঠিক তেমনি বোঝে। সাদা কে সাদা এবং কালোকে কালো বোঝে। এই জগতটাকে যেমন দেখা যায় তেমনিভাবেই এর বর্ণনা করেছে বস্তুবাদ:

১] এই জগত পরিবর্তনশীল। এটা সবাই বুঝতে পারে। কোনো জিনিসই চিরস্থায়ী নয় এই জগতে। বুদ্ধদেবও এই কথায় বলেছেন। আমাদের হিন্দু ধর্মেও বলা আছে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়।

২] এই জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত(interdependent)। একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এটাও সবাই মোটামুটি জানে। খাদ্যের ব্যাপারে নিরামিষাশী প্রাণীরা উদ্ভিদের ওপর, মাংসাশী প্রাণীরা নিরামিষাশীদের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ উভয় প্রকার প্রানীদের উপর নির্ভরশীল। এটা একটা উদাহরণ।

৩] তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটা হয়ত সবাই অতটা ভালোভাবে বুঝতে পারে না। পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে হতে হতে হটাত সম্পূর্ণরূপে হয়ে যায়। জল ফুটতে ফুটতে হটাত বাষ্পে পরিনত হয়ে যায়।

৪] চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটা হলো এই পরিবর্তনটা কি কারণে হয়। কোনো বস্তুর বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে কিছু বলবান হয় এবং বাকিরা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন এই দুর্বল আর শক্তিমানের মধ্যে যুদ্ধ চলে। এটাকেই বিপরীতের সংঘাত বলে। এখানে বলবান ক্রমশ বলবান হয় দুর্বল আরো দুর্বল হতে হতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তখনি সম্পূর্ণ পরিবর্তন আসে।

এখন প্রশ্ন এই যে বৈশিষ্ট্য গুলো উপরে বর্ণিত হলো সেগুলি কি সর্বজনগ্রাহ্য? সবাই কি অনুভব করে যে জগত পরিবর্তনশীল? জগতের প্রতিটা বস্তু একে অপরের ওপর নির্ভরশীল? তাই যদি হবে তাহলে পরিবেশ দূষণ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই কেন? শিল্প যে পরিবেশকে দুষিত করছে, বাতাসকে বিষিয়ে দিয়ে, যে বাতাসের ওপর বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর নির্ভরশীল, তা নিয়ে খুব কম লোকের মাথাব্যথা কেন? জগত পরিবর্তনশীল হলে, ক্ষনিকের জাগতিক আনন্দ পেতে এত মারামারি বা হানাহানি কেন? দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ হলো কেন? বর্তমানে সীমিত তৈল সম্পদ নিয়ে মধ্য প্রাচ্যের সাথে এত মারামারি কেন?

এই সব বিসদৃশ লক্ষণ এটাই প্রমান করে যে সর্বসাধারণ জগতকে এই চোখে দেখে না যার কথা মার্কস বা লেনিন বলেছেন। বরং তারা কি চোখে জগতকে দেখে তা নিচে বর্ণিত হলো:

১] জগত চিরস্থায়ী। তার সম্পদ চিরস্থায়ী। মানুষ নিজেও ভাবে যে তার জাগতিক সম্পদ চিরস্থায়ী হবে। তার বাড়ি,গাড়ি চিরকাল থাকবে, সে নিজে চিরকাল থাকবে। তাই সে সম্পদ অর্জনে প্রবৃত্ত হয়। তাই সে চিরস্থায়ী সম্পদের জন্য এত মারামারি, এত কষ্টস্বীকার করে। সে যদি ভাবত যে সম্পদ পরিবর্তনশীল: আজ আমার আছে, কাল অন্যের হয়ে যাবে বা চিরকাল এই সম্পদ থাকবে না এর ধংস অনিবার্য, তাহলে সে এই সম্পদ অর্জনে প্রবৃত্ত হত না।

২] জগতের কোনো বস্তু অন্য বস্তুর ওপর নির্ভরশীল নয়। এই জন্যই মানুষ এত স্বার্থপর। সে নিজেকে জগতের থেকে আলাদা ভাবে। সে ভাবে যে তার ওপর কেউ নির্ভরশীল নয়। পরিবেশ তার ওপর নির্ভরশীল নয়। সে পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। সুতরাং পরিবেশ দুষিত হলে কিছু যায় আসে না। প্রতিবেশীরা তার ওপর নির্ভরশীল নয় , সে প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরশীল নয়, অতএব প্রতিবেশিকে গুলি মার। এইটাই যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান হিংসার কারণ।

আমরা বন্য প্রানীদের উপর আর বন্য প্রাণীরা আমাদের উপর নির্ভরশীল: এটা বোঝে না বলেই মানুষ বন্য প্রাণী হত্যা করে। বন্য প্রাণীরা পৃথিবীর খাদ্য চক্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা না থাকলে যে আমাদেরই খাদ্যে টান পর্বে তা মানুষ বোঝে না।

৩] পরিবর্তন খারাপ। এটাকে যে কোনো উপায়ে বাধা দিতে হবে। স্থিতিশীলতা ভালো। এই রকম ভাবনা থেকেই মানুষ সব সময়ে পরিবর্তনের বিরোধ করে গেছে। রেনেসার সময়ে চার্চ গালিলীয়,ব্রুনোকে এই কারণেই অত্যাচার করেছিল। একই কারণে এখন মুক্তচিন্তকেরা মারা যাচ্ছে।

উপরে বর্ণিত উপায়ে মানুষ দুনিয়া দেখে। সুতরাং এটাই সর্বজনগ্রাহ্য বস্তুবাদ। মার্কস বা লেনিন যে বস্তুবাদের কথা বলেছেন তা শুধু শিক্ষিত মানুষ তথা মনিষীদের বস্তুবাদ। যদিও এই বস্তুবাদ সত্য। ভীষণ সত্য। তবু এটা সর্বজনগ্রাহ্য নয়।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
এমিল বার্নসের “what is Marxism” থেকে সাহায্য নেওয়া।