১৭ই জুলাই, ১৯৫৯ সাল।

উত্তর ভারতের আকাশে ছুটে চলছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটা ডাকোটা প্লেন। খোলা দরজায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন চারজন প্যারাট্রুপার। এক হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দেবার জন্য প্রস্তুত সবাই। এঁদের মধ্যে প্রথম তিনজনই প্যারাট্রুপার প্রশিক্ষক। তাঁদের পিছনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন প্রশিক্ষণার্থী প্যারাট্রুপার। জীবনের প্রথম ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন আজ। কিন্তু, অন্যেরা নয়, সেই তিনিই সব কিছুর মধ্য মণি আজ। নিচে বিপুল লোকের সমাবেশ ঘটেছে শুধু তাঁর এই ঝাঁপ দেখার জন্য। জমবেই বা না কেনো? আজকে যে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন তিনি।

সংকেত পেয়ে একে একে তিন প্রশিক্ষকই ঝাঁপ দিলেন শূন্যে। তাঁদের পিছু পিছু প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ডাকোটার খোলা দরজায় এসে পা রাখলেন খর্ব-দেহী প্রশিক্ষণার্থী প্যারাট্রুপার। শ্যামল বর্ণের একজন বাঙালি তরুণী তিনি।নাম গীতা চন্দ। শক্ত হয়ে গীতা দাঁড়ালেন সবুজ সংকেত পাবার অপেক্ষায়। দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল, চোখে তীব্র একাগ্রতা, বুকের মাঝে রোমাঞ্চের কাঁপন তাঁর। সবুজ আলো জ্বলতেই ভয়ডরকে এক পাশে সরিয়ে রেখে উড়ন্ত প্লেন থেকে শূন্যে ঝাঁপ দিলেন তিনি। আর এই এক ঝাঁপেই তিনি ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপার হিসাবে। এটি কতখানি অসম্ভব একটা কাজ তা টের পাওয়া যায় এটা দিয়ে যে, আমেরিকান মেয়েরাও তখন বিমান থেকে ঝাঁপ দেয় নি। দিয়েছে আরও চৌদ্দ বছর পরে ঊনিশ শো তিয়াত্তর সালে।গীতা চন্দ বিমান থেকে ঝাঁপ দিতেই বিপুল হর্ষে গর্জে উঠে অপেক্ষমাণ জনতা।

প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে শূন্যে পড়তেই দুই চার সেকেন্ডের জন্য সব নিশ্চল হয়ে গেল গীতার কাছে। দেহমন এমনকি চিন্তা-শক্তিও যেন তাদের সত্ত্বা হারিয়ে ফেলল। প্যারাসুটের টানে জেগে উঠলেন তিনি। বোধশক্তি ফিরে পেলেন দ্রুত। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন বিশাল প্যারাসুটটা পূর্ণমাত্রায় স্ফীত হয়ে গেছে। ফলে পড়ার গতি কমে গতি কমে গিয়েছে। ঝাঁপ দেবার বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই নিচের জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। নিচ থেকে একজন প্যারাসুট জাম্পিং প্রশিক্ষক চিৎকার করে নির্দেশাবলী দিচ্ছেন। চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যেই খুব নিচে এসে ভূমিতে নামার প্রস্তুতি নিলেন তিনি। ল্যান্ডিংটা হলো নিরাপদ এবং মসৃণ। হাজারো মানুষের অভিনন্দন আর ভালবাসায় সিক্ত হলেন বাঙালি এই তরুণীটি।

ছোটবেলা থেকেই দারুণ ডানপিটে ছিলেন গীতা চন্দ। গাছে ওঠা, সাইকেল চালনা, খেলাধুলায় ছেলেরাও তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারতো না। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে ডাক্তার হিসাবে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। কমিশন পাবার পরে পশ্চিমবঙ্গে পোস্টিং হয় তাঁর। ১৯৫৯ সালে বিমানবাহিনীর ডাক্তারদের প্যারাট্রুপার হবার জন্য আহবান জানায় বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ। সেই ডাকে কোনো পুরুষ ডাক্তারই এগিয়ে আসেন নি। এসেছিলেন গীতা চন্দ। চলুন, তাঁর মুখ থেকেই শুনি সেই ঘটনা।

“১৯৫৯ সালের প্রথম দিকে বিমানবাহিনীর ডাক্তারদের প্যারাট্রুপার হবার আহবান জানিয়ে সার্কুলার পাঠান হয় সব স্টেশনে। সেই আহবান আমার এখানেও আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এবং স্বেচ্ছায় সে ডাকে সাড়া দিই। কিন্তু আমার অন্যান্য সহকর্মী ডাক্তারদের নামের পাশে নিজস্ব হস্তাক্ষরে অসম্মতি জানানোর পর যখন আমাকে ওই সার্কুলারটা পাঠানো হয় “Not appilacable” লেখবার জন্য তখন খুবই আশ্চর্য হই। খানিকটা অপমানিত বোধ করি। এটাতে অসম্মতি জানিয়ে আমি যখন প্যারাট্রুপিংএ যাবার বাসনা প্রকাশ করি তখন অনেকেই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। প্যারাট্রুপিং নাকি ষণ্ডামার্কা সিপাইদের পক্ষেই সম্ভব। তাই আমার অবশ্যম্ভাবী নিষ্ফল প্রত্যাবর্তন বা পশ্চাদপসরণের জল্পনা কল্পনার অন্ত ছিল না সেদিন।“

গীতা চন্দ

সহকর্মীদের এই বিরূপ মনোভাব গীতার সংকল্পকে শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সামান্য যেটুকু ভয় বা দ্বিধা মনের মধ্যে লুকোনো ছিল, সব কোথায় উড়ে চলে গেল। তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নত হতে বাধ্য হলেন। গীতা চন্দের নাম পাঠানো হলো কোর্সের আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে। তারপরেও গীতার এই বাসনা হয়তো থেমে যেতো। কিন্তু থামে নি একজনের জন্য। তিনি এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জী। তিনি তখন বিমানবাহিনীর অধিনায়ক। গীতার দৃঢ় সংকল্পের যথাযথ মর্যাদা এবং সমাদর দিলেন তিনি। কোর্সের জন্য মনোনীত হয়ে গেলেন গীতা চন্দ। ১৯৫৯ সালের মে মাসে প্যারাট্রুপার স্কুলে যোগ দিলেন তিনি।

উত্তর ভারতের তীব্র গরমের সময়ে শুরু হলো ট্রেনিং। বর্ষার সময়ে প্যারাট্রুপার স্কুলের ট্রেনিং চালানো যায় না বলে সেই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকে প্রতি বছর। কিন্তু, এবার ব্যতিক্রম হলো। স্কুল খোলা থাকলো। একজন মাত্র শিক্ষার্থীকে নিয়ে স্কুল চালু থাকলো। আর সেই শিক্ষার্থী হচ্ছেন গীতা চন্দ।

প্যারাট্রুপিং কোনো সহজ কাজ নয়। এর জন্য শুধু মানসিক শক্তিই নয়, শারীরিক সবলতার এবং কঠোর পরিশ্রম করার সক্ষমতারও প্রয়োজন হয়।প্যারাট্রুপারদের প্রায়ই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। কাজেই দেহের জড়তা দূর করে তাকে সবল করাটা জরুরী। গীতা চন্দকেও সেই কাজ করতে হলো। দেড়-মাস ধরে পিটি, প্যারেড, দৌড়ানো এবং অন্যান্য শারীরিক কসরত করতে হলো নিয়মিত। প্রতিদিন সকালে পাঁচ মাইল দৌড়াতে হতো তাঁকে। এই কঠোর পরিশ্রম করতে গিয়ে শুরুর দিকে মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তেন তিনি। নিজের মনেই সন্দেহ জাগতো আদৌ তিনি পারবেন কি না টিকে থাকতে এই কোর্সে। প্রশিক্ষকদের উৎসাহ এবং নিজের মনের মধ্যে লালিত দৃঢ় সংকল্প দিয়ে সবকিছুকে অবশেষে জয় করে নেন তিনি।

দেড় মাস পরে শুরু হয় প্যারাট্রুপিং এর কলাকৌশল শেখার জন্য গ্রাউন্ড ট্রেনিং। প্যারাসুট নিয়ে নামার সময় একজন প্যারাট্রুপারকে যে সব কলাকৌশল করতে হয়, সেগুলো শেখানো শুরু হয়। আকাশপথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে বিশেষভাবে রেখে কীভাবে প্যারাসুটকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং কীভাবে নিরাপদে ভূমিতে অবতরণ করতে হয় তা শেখানো হয় তাঁকে।

সবকিছু শিখে নিয়েই ১৭ই জুলাই, ১৯৫৯ সালে উড়ন্ত ডাকোটা থেকে প্রথমবারের মতো ঝাঁপ দেন তিনি। এর মাত্র আটদিন পরেই দ্বিতীয় ঝাঁপ দেন তিনি। সেদিন জনগণের মাঝে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ মেননও উপস্থিত ছিলেন। তবে এদিনের ঝাঁপটা প্রথম দিনের মতো মসৃণ ছিল না। গীতা চন্দের মুখেই শুনি কী ঘটেছিল সেদিন।

“প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাজনিত বিপুল আত্মনির্ভরতাকে সম্বল করে বিনা দ্বিধায় জাম্প এর জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালাম। জাম্প হল কিন্তু এবার দেখা দিল এক সমস্যা। সাংঘাতিক ভাবে টুইস্টেড হয়ে প্যারাসুটটা নামছে। দড়িতে দড়িতে গেছে জট পাকিয়ে। তাই ক্ষিপ্রগতিতে নির্দেশানুযায়ী পদ্ধতিতে প্যারাসুটটাকে আয়ত্তে এনে ল্যাণ্ড করলাম।“

এরকম একে একে সাত বার ঝাঁপালেন তিনি চলন্ত বিমান থেকে। এর মধ্যে একটা ছিল রাতের বেলায়। কোর্স শেষ হলো অগাস্ট মাসে। প্যারাট্রুপারের ব্যাজ দেওয়া হলো গীতা চন্দকে। সেটা আবার পরিয়ে দিলেন এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জীই।

উপমহাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপার একজন বাঙালি, এটা অবশ্যই বিশাল গর্বের ব্যাপার আমাদের জন্য। সেই গর্ব এবং আনন্দ আরও খানিকটা বেড়ে যায়, যখন জানা যায় যে, তিনি আসলে আমাদের কুমিল্লারই মেয়ে। তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে রংপুরে। বাবা হরেন্দ্র চন্দ্র চন্দ ছিলেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক।

সুগভীর ভালবাসা রইলো গীতা চন্দের জন্য।