লেখক: সোজাকথা

দুই বন্ধু গাড়িতে বোমা লাগাতে গিয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির তলায় দুজন ঢুকেছে। দুজন পাশাপাশি চিৎ হয়ে শুয়ে গাড়িতে বোমা লাগানোর তোড়জোড় করছে। প্রথম বন্ধু বোমাটি বের করে আশঙ্কা প্রকাশ করে দ্বিতীয় বন্ধুকে বলল- গাড়িতে বোমা লাগাতে গিয়ে যদি বোমাটি ফেটে যায়?
দ্বিতীয় বন্ধু বলল- কোনও ভয় নেই আমার কাছে আরও একটি বোমা আছে।

গল্পটির মূল সারাংশ এই, দুজনেরই নিজেদের সর্বনাশ সম্বন্ধে কারও কোনও কান্ডজ্ঞান নেই।

বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খতম করে, ইসলামিক দেশগুলির লেখকদের দেশছাড়া করে, প্রয়োজনে তাদের খতম করে আপনার কী বার্তা দিতে চাইছেন? বন্ধ করে দিতে চাইছেন এদের মুক্ত চিন্তায় লেখার ক্ষমতাকে? স্তব্দ করে দিতে চাইছেন এদের কর্মকান্ডকে? এদের কর্মকান্ড স্তব্দ হওয়ার বদলে আপনাদের কর্মকান্ড কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, একবার ভেবে দেখেছেন কী?

আপনারা তসলিমাকে দেশছাড়া করলেন। সলমন রুশদিকে দেশছাড়া করলেন। ভাবলেন সব ল্যাঠা চুকে গেল। একটা বিরাট বড় কাজ করেছি। দেশের যুব সমাজকে রক্ষে করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

তসলিমাকে দেশছাড়া করার আগে বাংলাদেশে কতজন নাস্তিক ছিলো? কতজন নাস্তিকতার পক্ষ নিত? যতদুর জানি, আজকে যেভাবে যুব সমাজ এগিয়ে এসে নাস্তিকতার পক্ষ নিচ্ছে এত ব্যাপক সংখ্যায় তো দুর অস্ত, মুষ্টিমেয় কিছু আসত কিনা তা নিয়েও সন্দহ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে নাস্তিকদের এত সাফল্যের পিছনে কারা রয়েছে? নাস্তিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ানোর মুলে কারা আছে? তখনও তো আমেরিকা ছিলো ইউরোপ ছিলো। তাই এদের কথা বাদ দেওয়াই ভালো। বাংলাদেশে নাস্তিকতার প্রসারে তসলিমা হুমায়ুন আজাদদের ভুমিকা যতটা না আছে তার থেকে বেশী আছে মুসলিম মৌলবাদের হাত। অর্থাৎ আপনার বাড়িয়েছেন নাস্তিকদের। কীভাবে বাড়িয়েছেন তবে দেখুন –

অনেক সাহিত্যিক, সমালোচক, গবেষকরা তসলিমা নাসরিনকে সাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ প্রাধান্য দিতে চান না। তার কবিতা প্রবন্ধ জীবনীকে তারা সাহিত্য বলে মনে করেন না। তাদের যুক্তি- “যিনি সাল তারিখ উল্লেখ করে ধর্ষনের খবর বইয়ে লেখেন, পত্র পত্রিকার খন্ডাংশ নিজের বইয়ে সাল তারিখ উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করেন তিনি সম্ভবত রিপোর্টার, সাহিত্যিক নন’’। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এসব সনাতনপন্থী সাহিত্যিকের বচন। সাহিত্যের যুগে যুগে কালে কালে বদল ঘটে। কালের চাহিদা অনুসারে তার চলন। সমাজের ছায়া দর্পনে কীভাবে পড়বে তা সনাতন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম তসলিমা সাহিত্যিক নন, একজন জোলো লেখিকা, যিনি রিপোর্টার, যার লেখনীর কোন সাহিত্য মূল্য নেই, তার কলম থেকে সমাজ সংস্কারমূলক লেখা বেরোয় না অর্থাৎ তার লেখনিতে ধার নেই, যিনি প্রচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে লেখেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

দেখুন বড় বড় সমালোচক যখন তসলিমাকে এই সার্টিফিকেট দিয়েছে তবে তো তার লেখনী খুব জোরালো বলা যায় না। আপনাদের তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো ছিলো। কিন্তু আপনারা “নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর” বলে মিছিল করে তার বাড়ির সামনে ধর্না দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। হাজার হাজার লোক জড় করে রাজপথে তার ফাঁসির দাবিতে মিছিল করেছেন। তাকে দেশ থেকে শেষপর্যন্ত উৎখাত করেছেন। কলকাতাতেও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় মিডিয়ার সামনে আপনারা লুঙ্গি উঁচু করে পুরুষাঙ্গ দেখিয়েছেন। তাকে বাংলা ছাড়া করেছেন।

কী প্রয়োজন ছিলো এসবগুলো করার? আপনাদের এসব বাড়বাড়ন্তির আগে তসলিমাকে কতজন চিনত? দেশে কিংবা বিদেশে, কে এই তসলিমা অতসব খবর কি কেঊ রাখত? কিন্ত এখন রাখে অর্থাৎ আপনাদের বাড়বাড়ন্তির পর রাখে। একবাক্যে সবাই চেনে তসলিমা নাসরিনকে। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নাস্তিক, আস্তিক সবাই তসলিমাকে না পড়েই চেনে। তার লেখনীতে সাহিত্যমূল্য থাকুক আর না থাকুক সারাবিশ্বে তাকে সাহিত্যিক হিসেবে আপনারাই প্রচার পাইয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী, আলোচিত বাঙালি, তসলিমা নাসরিন। যাকে এক ডাকে সবাই চেনে। সারা বিশ্ব চেনে। তিনি সারা বিশ্বের বিভিন্ন সম্মানজনক পুরস্কারে ভুষিত। এত তাড়াতাড়ি একটা লেখিকাকে কারা এই ভিত প্রস্তূত করে দিলো একবার ভেবে দেখেছেন কী??

সলমন রুশদির ক্ষেত্রেও আপনারা একই পদক্ষেপ নিলেন। “দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস” লেখার দরুন তার মাথার দাম ধার্য করে ফতোয়া দিলেন। এক্ষেত্রেও একজন লেখককে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাইয়ে দিলেন। তার যতটা প্রচার পাওয়ার কথা ছিলো তার চেয়ে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুললেন আপনারই।

হুমায়ুন আজাদকে নৃশংসভাবে খুন করলেন। সমস্ত মানুষ জেনে গেল একজন নাস্তিক লেখক খুন হয়েছে। কী এই নাস্তিকতা? এর পক্ষে মানুষ কেমন ভাবে যুক্তি সাজায়? মসজিদে গিয়ে নামায পড়া, মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করা, চার্চে গিয়ে বাতি জ্বালানোর বাইরেও কী কিছু হয়? মানুষের মধ্যে আপনারাই কৌতুহল বাড়িয়ে দিলেন।

বর্তমান বিশ্বে ব্লগ শব্দটা নতুন। খুব বেশী মানুষ ব্লগ সম্মন্ধে জানে না। ব্লগ খায় না মাথায় দেয় এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধারনা নেই। আপনারা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক, লেখক অভিজিৎ রায়কে দুম করে অত্যন্ত বর্বরভাবে খুন করে ফেললেন। সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী বন্যা আহমেদকে মারাত্মকভাবে জখম করলেন। তার স্ত্রীকেও খুনের পরিকল্পনা ঘটনাক্রমে ব্যর্থ হয়েছিলো সেদিন। আপনারা তার জন্য অলক্ষ্যে হাত কামড়েছেন। কী সুযোগ মিস করলেন এই ভেবে। এক্ষেত্রেও অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদকে আপনার সারা বিশ্বে চিনিয়ে দিলেন। হয়ত অল্প অল্প করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল ব্লগটি। হয়ত অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদের লেখনীতে ধার ছিলো। কিন্তু এই দম্পতির উপর আক্রমনের আগে তাদেরকে এবং ব্লগটিকে কতজন চিনত? কিন্তু আপনাদের নৃশংসতার পরে এখন অভিজিৎ রায় এবং তার প্রতিষ্ঠিত ব্লগকে বহু মানুষ চেনেন। তার স্ত্রী বন্যা আহমেদকে চেনেন। যারা চেনেননি তারা দলে দলে চিনতে চায়। দলে দলে মানুষ নাস্তিকতা সম্মন্ধে জানতে চায়। অনেকেই সরাসরি নাস্তিক হতে চায়। এইসব কাহাদের দান??? একবার ভেবেছেন কী?

শুধু অভিজিৎ রায় নয় তারপরও আপনার একের পর এক ব্লগার খুন করে চলেছেন। লেখক বুদ্ধিজীবী তাড়িয়ে অথবা খুন করে চলেছেন। এদের বই নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে ছুটেছেন। ব্লগগুলো নিষিদ্ধ করার করার দাবি তুলেছেন। ব্লগারদের মৃত্যুদন্ডের জন্য মিছিল করেছেন। সমস্ত রকমভাবে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা হল নিষিদ্ধ সংস্কৃতির একটি বৃহৎ সমস্যা আছে। সমস্যাটি হল- পৃথিবীতে যা কিছু নিষিদ্ধ এবং যা কিছু গোপন তা জানার সুপ্ত কৌতুহল মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়। সেজন্য কোন কিছু নিষিদ্ধ করাটাও একটি প্রচার। বিশেষ করে যুব সমাজ এর প্রতি আকৃষ্ট হবেই। কী এমন জিনিস যা নিষিদ্ধ হল? এই সুপ্ত কৌতুহলে। বারংবার এই কৌতুহল শুধুই যুব সমাজ নয়, আপামর জনসাধারনের মধ্যে আপনারাই সৃষ্টি করেছেন এবং দিনের পর দিন তার পরিধি বাড়াচ্ছেন। এই বাড়বাড়ন্তি আপনারা যতই করছেন ততই পায়ের তলায় জমি হারাচ্ছেন, ততই মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। আপনাদের হাতে আক্রান্ত সমস্ত নাস্তিক লেখকের বই দিনের পর দিন বেস্টসেলারের তালিকায়। নাস্তিক ব্লগগুলিতেও দিনের পর দিন মানুষের উঁকি বাড়ছে। নাস্তিকদের মতাদর্শ জানার জন্য মানুষের ঢল নামছে ব্লগগুলিতে। একটা নাস্তিক আক্রান্ত হলে হাজার নাস্তিকের জন্ম হচ্ছে। এখন আপনাদের কর্মকান্ড দেখে দূরদর্শীরা অলক্ষ্যে হাসছেন। আপনারা দিনের পর দিন নিজেদের পায়ের তলার জমি হারিয়ে হায়েনার মতো হয়ে উঠছেন। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে আপনাদের। শান্ত হয়ে ভাবতে না বসলে আপনাদের মতবাদ কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। সেটা ভাববার প্রয়োজনবোধ করেছেন কী??

আপনাদের গোঁড়ামির চাপে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলো লেখক, লেখিকা, শিল্পীদের জন্য বিশেষ ধরনের আইন প্রনয়নে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছেন। এই আইনের বলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন রকমভাবে লেখক, লেখিকা, শিল্পীদের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড থেকে শুরু করে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত শাস্তির বিধান রেখেছেন। শুধু ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করলেই এ ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হবে। যা সম্পুর্ন মানবতা বিরোধী। যা আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটা শোরগোল সৃষ্টি করার মতই একটা বৃহত্তর ইস্যু।

এখানে একটা বিষয় পরিস্কার হওয়া ভালো- যেসব লেখক, লেখিকা, শিল্পী, ব্লগারদের কথা বললাম তাদের যে বাইরের বিশ্বে পরিচিত হওয়ার যোগ্যতা নেই কিংবা তাদের ব্যক্তিত্বের বলে তারা যে প্রচার পাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। অবশ্যই তারা প্রচার পাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব। এই প্রচারটা যতটা পাওয়ার তার কয়েকগুন বেশী পাইয়ে দেওয়ার অনুঘটক হিসেবে আপনারা কাজ করছেন এবং এটা করছেন তাদের জীবদ্দশায়। আমাদের দেশের লেখকদের নিয়ে একটা প্রবাদ আছে যে- লেখকরা জীবদ্দশায় খুব বেশী করে প্রচার পায় না যত প্রচার তার মৃত্যুর পরে। এটা আমাদের দেশের লেখকদেরই একটা বড় আক্ষেপ।

আপনারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলবেন এটা কী শুধু আমরা করি? হিন্দু মৌলবাদীরাও কী করে না? ওরাও তো শিল্পী মকবুল ফিদা হোসেনকে নগ্ন সরস্বতী আঁকার দায়ে দেশছাড়া করেছিলো। এ প্রসঙ্গে সবপক্ষের মৌলবাদীদের বলছি- নিজেদের মতবাদকে যদি আরও কিছুদিন দীর্ঘায়ু করতে চান তবে এখনই সতর্ক হোন। নইলে যতই আপনারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়বেন ততই মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। এবার ভেবে দেখুন নিজের ভালো নিজেরা বুঝবেন কিনা? একটা কথা চিরদিনই মনে রাখবেন- “আপন ভালো পাগলেও বোঝে”।