বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে কথিত “আসমানী” গ্রন্থসমূহের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে মানুষ। এখনকার ওয়াজসমূহে ওয়াজিয়ানরা জাকির নায়েক স্টাইলে কোনো একটা সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের সাথে কুরানের একটা আয়াতের তুলনা করে কুরানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালান। যদিও এসব ক্লাস ফাইভে পড়া বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্স পুঙ্খানুপুঙ্খ বোঝাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা!

এভাবে ভাবলে মনে হয় উন্নতি একেবারে মন্দ হয়নি! ধর্মের ষাঁড়েরা যেখানে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিলো সেখানে আজ বিজ্ঞানকে একটা ফিল্টার হিসেবে ধরা হচ্ছে; এটা নেহায়েত কম অগ্রগতি নয়। ইদানিং আবার দেখছি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হাদিসগুলো হজম করতে না পেরে মোল্লামহলে হাদিস জাল না সহি সে ব্যাপারে মতভেদ তৈরি হচ্ছে। এসব ভালো লক্ষণ! বিজ্ঞানের যে স্ফূৎলিঙ্গ অনেকের মধ্যে প্রবেশ করেছিলো সেসব অনল হয়ে বেরুচ্ছে, আর আঘাত করছে দীর্ঘদিনের লালিত কুসংস্কারের গোড়ায়!

অপরাপর ধর্মগুলোর কিছুটা জীর্ণ দশার কারণেই হোক বা সবচেয়ে তরুণ ধর্ম বলেই হোক, বর্তমানে ইসলামিস্টরা চোটপাট বেশি বেশি করছে- ফলে মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছে- সেই সাথে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেও থাকছে; সম্ভবত তারা ভুলে গেছে যত বড় করে জ্বলে উঠার চেষ্টা করবে তত দ্রুত তাদের জ্বালানী শেষ হয়ে আসবে। ইতিহাস বলে, সব ধর্মই যার যার যেৌবনে ভালো পসার করেছে। উপমহাদেশের কথাই ধরা যাক। সনাতন ধর্মের যখন যৌবন তখন হিন্দু ধর্মের নামে কত কী অনাচার, কুসংস্কার, অত্যাচারের প্রচলন ছিলো। অচ্ছুৎ প্রথা তথা শ্রেণিবিভাগ জাঁকিয়ে বসেছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যাদের মধ্যে এসব নির্দিষ্ট কোনো কিছুর থেকে গা বাঁচানো কিংবা খুঁতখুঁতে ভাব কাজ করতো তারাও দিব্যি “আধুনিক” যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ধুতি-লুঙ্গি ছেড়ে শার্ট-প্যান্ট পড়ে একেবারে ইংরেজ সাহেব সেজে গেছে! অবশ্য মুসলমানেরা প্রগতির উল্টোদিকে সবসময়ই ছিলো। মুহাম্মদ আরো কয়েক শতক পর জন্মালে হয়তো আরো স্মার্ট হতো! যাহোক, ইসলামের ক্ষেত্রেও যে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একে একে ছবি, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপারে কড়াকড়ি (অনেক আলেম হারাম বলে ফতোয়াও দিয়েছিলেন এবং অনেকে এখনও দিচ্ছেন) আরোপ করলেও প্রগতির গতির কারণেই হোক কিংবা সহজলভ্যতার কারণেই হোক ধীরে ধীরে বাঁধন হালকা করতে হয়েছে আলেম সমাজের। মেয়েদের বাইরে কাজ করার ব্যাপারে অনেকখানি নমনীয়তা চলে এসেছে। অনুমান করছি ধর্মগুলো এ শতাব্দীর শেষদিকে দেউলিয়া হয়ে যাবে! তবে মধ্যবর্তী সময় যে খুব ভালো যাবে সে নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। পৃথিবীজুড়ে রক্তগঙ্গা রচনা করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া তীক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন ধর্ম ইসলাম নিঃচিন্হ হওয়ার আগমুহূর্তে আবারো রক্তক্ষয় ঘটাবে এটা তো এখনই বোঝা যাচ্ছে।

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। “অন্যায়” শব্দটার অর্থ অনুচিত কাজ, ন্যায়বিরুদ্ধ কর্ম, অবিচার কিংবা জুলুম আর পাপ হলো কলুষ, দুষ্কৃতি, অন্যায়, অধর্ম কিংবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ। তাহলে এখান থেকে বলা যায়, সকল পাপই অন্যায় কিন্তু সকল অন্যায় পাপ নয়। আরেকভাবে বললে, পাপের জন্য পৃথিবীতে আলাদা করে কোনো শাস্তি নেই কিন্তু অন্যায়ের জন্য চেৌদ্দ শিক মোটামুটিভাবে নিশ্চিত।

ধরে নিলাম প্রথম ধর্মের প্রচলন হয়েছিলো মহৎ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। আর সেটি হলো সামাজিক শৃঙ্খলা আনয়ন। আজকের এই একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে বলতেই হয় সে কাজে ধর্ম পুরোপুরি ব্যর্থ। যদি তেমনটাই ঘটতো তাহলে পৃথিবীতে সবচাইতে সুশৃঙ্খল জাতি হতো বাংলাদেশ, ভারত কিংবা সৌদি আরব। অথচ তালিকা করলে শৃঙ্খলার দিক দিয়ে এসব দেশের অবস্থান শেষদিকেই হবে। অর্থাৎ ধর্ম শৃঙ্খলা আনার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।
এখানে এসে মমিনরা বলা শুরু করে খেলাফতের কথা। কিন্তু খেলাফত যেসব দেশে কায়েম আছে সেসব দেশের দিকে তাকালে কতটুকু শৃঙ্খলা দেখতে পাওয়া যায়? এখন তারা বলবে কোনো দেশেই পরিপূর্ণ খেলাফত কায়েম নেই। সেক্ষেত্রে আমরা ইসলামের প্রধান দুটি গ্রন্থ কোরান ও হাদিস থেকে কয়েকটিমাত্র আয়াত পড়ে নিই। কারণ এগুলোই মুসলমানদের জন্য “পরিপূর্ণ” জীবন বিধান।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন –
“ তোমরা সৎকর্ম প্রকাশ্যে করলে অথবা গোপনে করলে অথবা দোষ ক্ষমা করলে আল্লাহও দোষ মোচনকারী, শক্তিমান”
(আন-নিসা : ১৪৯)।

একজন মুসলমানকে কোনো একটা দোষের কাজ করতে দেখে (হতে পারে তা চুরি, মিথ্যা বলা, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি) নিজের দোষত্রুটি ক্ষমা করানোর নিমিত্তে তার দোষ গোপন করা যেতেই পারে?

মহান আল্লাহ্‌ বলেন –
“মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ, কিন্তু যে মাফ করে দেয় এবং আপোষে নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকটই রয়েছে। তিনি যালিমদের পছন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হওয়ার পর যারা প্রতিবিধান করে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের উপর যুল্‌ম করে এবং পৃথিবীকে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করে বেড়ায়। এদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। অবশ্য যে ধৈর্য ধারণ করে এবং মাফ করে দেয়, এতো হবে দৃঢ়সংকল্পের কাজ। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন অভিভাবক নেই। যালিমরা (কিয়ামতের দিন) যখন শাস্তি দেখবে, তখন আপনি তাদের বলতে শুনবেন প্রত্যাবর্তনের কোন পথ আছে কি?”
(সূরা শূরা (৪২) : ৪০-৪৪)

একই ধরনের কথা আবারো বলা হলো। এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস দেখা যাক-

আবদুল্লাহ্‌ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন-
” মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুল্‌ম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।”
(হাদিস- বুখারী-২৪৪২)

সাফওয়ান ইবনু মুহরিব আল–মাযিনী (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, একদিন আমি ইবনু ‘উমর (রাঃ) –এর সাথে তাঁর হাত ধরে চলছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর মু’মিন বান্দার একান্তে কথাবার্তা সম্পর্কে আপনি রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে কি বলতে শুনেছেন? তখন তিনি বললেন, আমি রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন ব্যক্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন এবং তার উপর স্বীয় আবরণ দ্বারা তাকে ঢেকে নিবেন। তারপর বলবেন, অমুন পাপের কথা কি তুমি জান? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! এভাবে তিনি তার কাছ হতে তার পাপগুলো স্বীকার করিয়ে নিবেন। আর সে মনে করবে যে, তার ধ্বংস অনিবার্য। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, “আমি পৃথিবীতে তোমার পাপ গোপন রেখেছিলাম। আর আজ আমি তা মাফ করে দিব”। তারপর তার নেকের আমলনামা তাকে দেয়া হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে সাক্ষীরা বলবে, এরাই তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল। সাবধান, যালিমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।
(হাদিস -বুখারী)

অর্থাৎ ভুলভাল কিছু করলে সেটা থেকে নিষ্কৃতির জন্য একটা ছোট্ট ফাঁক আল্লাহ রেখে দিয়েছেন এবং এটা বিশেষ করে ইমানদারদের জন্য। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যখন এমন অফার দেন তখন সে সমাজে স্বজনপ্রীতি শিকড় গেড়ে বসবারই কথা!

তাছাড়া বিভিন্ন আমলের (প্রার্থনা) মাধ্যমে গুনাহ মাফের কথা আসার মানে হলো পরোক্ষে সেসব গুনাহ করার ইন্ধন দেয়া। এ সহজ ব্যাপারটা আল্লাহ বুঝলেন না?! এখানে কি ইসলামিক নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?

আমরা যদি “পাপ” টার্মটা সমাজ থেকে তুলে দিতে পারি, প্রত্যেক অন্যায়কে অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি আর একটা শক্ত সংবিধান তৈরি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। পরকালীন শাস্তির ভয় কিংবা শান্তির লোভ দেখিয়ে মানুষকে খারাপ কাজ থেকে নিবৃত্ত করার সিস্টেমটির কার্যকারিতা যৎসামান্য। (…চলবে)