কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন; ৭৫ এর ১৫ অগাস্ট ঘটনার পেছনে আওয়ামী লীগের যে ব্যর্থতা ছিল, আওয়ামী লীগের বিশাল একটা উচ্ছৃঙ্খল অংশ সেই ষড়যন্ত্র এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য কিছুটা হলেও পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা এই অপ্রিয় সত্য কথাটি পেছনে বললেও মিডিয়া কিংবা জনসমাবেশে বলার হিম্মত রাখেন না। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর কতোটা ক্ষেপা হলে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন গুজব মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। অতিষ্ঠ মানুষের মধ্যে যখন বিরোধিতা করার মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় তখন মানুষ যে কোন কথাই বিরোধিতা করার জন্য বিশ্বাস করবে। যেমন- প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতি! একটা পাগলেও তা বিশ্বাস করবে না কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই মিথ্যাটা কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়! আরও বলা হতো-বঙ্গবন্ধু নাকি বিপুল অর্থের মালিক। অথচ তিনি যখন নিহত হলেন তখন কিছুই পাওয়া যায় নি। ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে ৫০০ টাকার নোটের ১৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। পাঁচ’শ টাকা যখন বাতিল করা হয় তখন বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মোস্তাক এই টাকাটা পরিবর্তন করে নি। পরবর্তীতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী’কে শেখ মুজিব বিষয়টা বললেও অর্থমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন এই টাকা এখন গ্রহণ করা সম্ভব নয়। টাকাটা যেন পরিবর্তন করে দেওয়া হয় সেই জন্য বেগম মুজিবের হাতে মোস্তাক দিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর সাথে একমাত্র খন্দকার মোস্তাকের তুই-তুকারির সম্পর্ক ছিল। খন্দকার মোস্তাক বয়সে বড় কিন্তু রাজনৈতিক মাঠে শেখ মুজিব ছোট তাই সবসময় একটা ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকতে চেয়েছে। ৭১ সালে আমেরিকা-পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বিরতির জন্য কাজ করেছিল মোস্তাক। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কারণে তা সফল হয়নি। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের উপর শেখ মনির, খন্দকার মোস্তাক সবসময় ক্ষিপ্ত ছিল। তাজউদ্দীনকে বিপদে ফেলার জন্য এরা ছিল সবসময় তৎপর। তারা একাত্তরে যা করতে পারেনি তারা তা একাত্তর পরবর্তীতে করে দেখিয়েছে। এদের ষড়যন্ত্রে তাজউদ্দীন একসময় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সময়ের সাথে সাথে দলের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় এবং দল থেকে অবসর নেন। দল থেকে অবসর নিলেও প্রিয় মুজিব ভাইকে ত্যাগ করেননি। তাই ১৫ই অগাস্টের আগের দিনও মুজিব ভাই সাথে দেখা করে জানিয়ে যান-মুজিব ভাই, আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে!

রাজনৈতিক কারণেই হয়তো শেখ মুজিব হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানের নামটি বারে বারে আসে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন কোনও স্পষ্ট প্রমাণ নেই, তবে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ব্যাংককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৈয়দ ফারুক রহমান বলেন তিনি তার পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিলেন এবং জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে তার বাসার রক্ষীদের নির্দেশ দেন এই ব্যক্তি যেন কখনও তার সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ না পায়। হত্যাকাণ্ডের উদ্যোগ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সরাসরি অবগত ছিলেন কিংবা ষড়যন্ত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন বিষয়টা নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত না হলেও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে নিশ্চিত হয়ে যায় বিদ্যমান পরিস্থিতি জিয়াউর রহমানকে বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছিলো। শেখ মুজিবের নামে জিয়াউর রহমান বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জিয়াউর রহমান যতো খারাপ হোক না কেন তিনি যে ঘোষণা পত্র পড়েছিলেন এই সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না। যেমন-মোস্তাক যতো বেইমান হোক না কেন ৭১ সালে সরকারের প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তীতে খাদ্য-মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বেতার কেন্দ্রে শুধু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান, বেতার কর্মী আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, বেতার কর্মী আবদু্ল্লাহ আল ফারুক, সম্পাদক আব্দুস সালাম, প্রবাসী মাহমুদ হোসেনসহ আরও অনেকেই এই ঘোষণা পত্র পাঠ করেছিলেন। তাই জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার না করে বরং এই নামগুলো মানুষকে জানানোর প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের।

সশস্ত্র বাহিনীর ইজ্জত রক্ষার জন্য ৭৫ এর ঘটনা কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যের কথা বলা হলেও সেই উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। উল্টো ধানমন্ডিতে জাতির পিতার লাশ ফেলে রেখে ক্ষমতার টানাটানিতে তারা ব্যস্ত ছিল। ইতিহাস বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে! পনের’শ বছর আগেও কোন এক জাতীয়তাবাদী নেতার লাশ ফেলে রেখে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল তার আত্মীয়রা। সেনা বাহিনী এই খুনি চক্রের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা তো নেয়নি উল্টো তাদের সাথে আপোষের টেবিলে বসেছে। গোলা-বারুদ ছাড়া খালি ট্যাংক দিয়ে তৎকালীন সময়ে রক্ষীর সদর দপ্তরের দখল নেয় খুনি সেনারা। শেখ মুজিবের হত্যার জন্য গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে কোন সংস্থা কি এই খুনের দায় এড়াতে পারে?

শেখ মুজিব যখন নিহত হলেন তখন পাকিস্তানপন্থীরা আবার সামনের সারিতে চলে আসল। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা, লুটপাটে জড়িত থাকার কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা রাস্তায় নামতে সাহস করেনি। হ্যাঁ! অনেকে ভয় পেয়ে রাস্তায় নামেনি তা যেমন সত্য তেমনি সত্য অনেকের নামার মতন আর রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। শেখ মুজিব হত্যার বিচার চাই প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়ন বের করে। ১৫ অগাস্টের পর আওয়ামীলীগের কিংবা মুজিব ভক্তদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ যেটুকু পরবর্তীতে হয়েছে তাতে দলের কোন বড় নেতার নেতৃত্ব ছিল না। জীবিত শেখ মুজিবের কর্মীর অভাব ছিল না, ভক্তের অভাব ছিল না কিন্তু মৃত শেখ মুজিব ছিলেন এক নিঃসঙ্গ এক মানুষ। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়- চাটুকাররা যতোই শেখ মুজিবকে ঘিরে ধরেছিল ততই শেখ মুজিব ছোট থেকে ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন। লুটপাটে শেখ পরিবার জড়িত ছিলেন না কিন্তু তার নেতাকর্মীরা জড়িত ছিল আর সেই দায় নিহত শেখ মুজিবকেই মাথা পেতে নিতে হয়েছিল।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্নি পুরুষ শেখ মুজিব নিহত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সংবিধানের স্তম্ভের ভীত দুর্বল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব দোষে গুণের মানুষ। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধ করেছে শেখ মুজিবের নামে। শেখ মুজিব ছিল তাদের মুক্তির প্রেরণা। শেখ মুজিব বরাবরই জননেতা হতে চেয়েছিলেন হয়েছিলেনও। কিন্তু সফল রাষ্ট্র নায়ক হতে পারেননি, হতে পারতেনও না। যিনি বিশ্বাস করতেন তাঁকে কোন বাঙালি মারতে পারে না সেই মানুষ আসলে রাষ্ট্র নায়ক হবেন কী করে? পাকিস্তান সেনা বাহিনী যা করতে পারেনি বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সদস্যরা তা করে দেখিয়েছে। ৭১ এ অক্টোবর শেষে নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন- শেখ মুজিবকে যদি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানকার জনগণই তাঁকে হত্যা করবে। শেখ মুজিব এই বাঙলার সন্তান হয়েও যা বুঝতে পারেননি ইয়াহিয়া কয়েক মাস চাটুকার বাঙালিকে দেখে ঠিকই চিনি ফেললেন! শেখ মুজিব নিহত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ উল্টো রাস্তায় হাটতে শুরু করে। নিহত মুজিবের রক্ত দেখে এই মাসেই মুসলিম রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে শেখ মুজিব মুখ থুবড়ে পড়েনি মুখ থুবড়ে পড়েছিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে জঘন্য ও নোংরা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হল ১৫ অগাস্টে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন। এই জন্মদিন পালনের মাধ্যমে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি জানান দেয়; নিহত শেখ মুজিবের খুনিদের সহায়তায় তারা আজ প্রতিষ্ঠিত। শেখ মুজিব আজ আওয়ামী লীগের হাতেও নিরাপদ নয়। কারণ ১৫ অগাস্ট আসলেই রাজনৈতিক চাঁদাবাজি শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবের নামে বিভিন্ন সংগঠন চাঁদাবাজি শুরু করে। চোখে সানগ্লাস, মুখে বিড়ি ফুকে বখাটে রাজনৈতিক কর্মীরা লোক দেখানো শোক পালন করে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যতোটা না শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা করে কিংবা ভালোবাসে তার থেকে বেশি নিহত শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে। শেখ মুজিব যতে পারত দল-মতের বাহিরে সকলের সর্বজনীন নেতা কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে দলগুলো শেখ মুজিবকে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। স্বার্থপর ব্যবসায়িক রাজনৈতিক নেতা-দল থেকে নিহত মুজিবের মুক্তি নেই।