লেখক: সোজাকথা

চারশো বছর আগের বাইবেল আর আজকের কোরানের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। সেকালে বাইবেল যা বলেছে তাই ধ্রুব সত্য, তার উপরে কেউ কথা বলতে পারবে না – এটাই ছিলো বিধান। সেকালে বাইবেল সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিন করিয়েছে এবং রাষ্ট্র সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিন করার যাবতীয় নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছে। যদি কেউ ভুলেও সূর্যের চারদিকে পৃথিবীকে ঘোরার মত বাস্তব কথা বলতে গেছে কিংবা ইশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস করেছে তার পরমায়ু বেশীদিন এগোয়নি। নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুড়িয়ে মারা হয়েছে ব্রুনোকে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে বয়সের ভারে ন্যূজ্ব বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে। সবই সরকারী বদান্যতায়। মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ইউরোপের এই নৃশংসতম অধ্যায় মনে করলে সংবেদনশীল মনন শিউরে ওঠে। কিন্তু মজার কথা হল আজ কোরাণের দৌলতে চারশো বছর আগের ইতিহাস আবার বাস্তব রুপ পেয়েছে। যদিও ১৪০০ বছর ধরে এ হত্যাকান্ড চলে আসছে কিন্তু বর্তমানে সেটা অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন যখন ২০০১ সালে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জোড়া বিমান হানা হেনে কয়েক হাজার নিরপরাধ মার্কিন নাগরিককে হত্যা করেছিলো তখন বিশ্বের অবশিষ্ট সাচ্চা মৌলবাদী মুসলিমরা হো হো করে উঠেছিলো। কোলাকুলি করে মিষ্টি খেয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলো এই বুঝি সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। আল কায়দা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে সেদিন ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো। আজও আত্মঘাতী জঙ্গি দিয়ে তারা সশস্ত্র জেহাদিপনা চালিয়ে যাচ্ছে।

আল কায়দা ছাড়াও আরও বড়, মাঝারী ,সেঁজো বহু জঙ্গিগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। তাদের সবারই উদ্দ্যেশ্য জেহাদিপনা। কিন্তু বর্তমানে ঘুম কেড়েছে বাংলাদেশে আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম এবং সমগ্র বিশ্বে আই এস(ইসলামিক ষ্টেট) এর মতো নরমাংস পিপাসু জঙ্গিরা। আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষিত ব্লগারদের খতম করার কর্মসূচি নিয়েছে। একের পর এক ব্লগার হত্যা করে এরা উল্লসিত হয়ে উঠছে। অন্যদিকে আই এস জঙ্গিরা সারা বিশ্বের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়িয়েছে। আই এস জঙ্গিদের লক্ষ্য খলিফাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে খলিফাতন্ত্রের যুগটি এক অন্ধকারতম যুগ। এই যুগে কোন বাকস্বাধীনতার অধিকার ছিলো না। নারীরা ঘরের বাইরে বেরুতে পারত না। বোরখা পরে সারা জীবন গৃহেই কাটাতে হত। পূরুষতন্ত্রই অত্যন্ত কঠোরভাবে বহাল ছিলো এই যুগে। কোরাণ নির্দেশিত পথই এই যুগের প্রধান শর্ত।

is

এই লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আই এস জঙ্গিরা ভয়ংকর হত্যালীলা চালাচ্ছে। সারা বিশ্বজুড়ে খলিফারাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যেশ্যে চলছে হত্যালীলা। বাদ যাচ্ছে না নারী, শিশু। নারীদের যৌনদাসী বানানো হচ্ছে। এই যৌনদাসীরা নাবালিকা থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ মহিলা। জেহাদিদের সাথে যৌন সংসর্গ করাই যৌনদাসীদের কাজ। এককথায় যৌনদাসীরা জেহাদিদের যৌনখাদ্য। যেসব মহিলারা এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যৌনসংসর্গ করতে অস্বীকার করছে তাদের মুন্ডু কেটে হত্যা করা হচ্ছে। জেহাদি বীরপূঙ্গবেরা একাধিক নারীসঙ্গম করেই, ধর্মমন্ত্র মাথায় নিয়ে পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এইসব যৌনদাসীদের নিয়ে দর হাঁকা হচ্ছে। বয়স অনুপাতে দাম নির্ধারিত হচ্ছে। যার বয়স যত কম সে তত বেশী দামী। ৪৫-৫০ বছরের মহিলার দাম সবচেয়ে কম।

আই এস এর অত্যাচারে ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস। মসুল, নিমরূদের মতো প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ শহর এখন ধ্বংসভূমি, নিঃশব্দ মৃত্যু উপত্যকা। এই অঞ্চলে আর কোন প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন অবশিষ্ট নেই। সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা। একের পর এক মুর্তি, ভাস্কর্য হাতুড়ির ঘায়ে গুঁড়ো করে দিয়ে ইন্টারনেটে আপলোড করে দিয়েছে জঙ্গিরা। এদের তান্ডবে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা। মৌলবাদী আই এস জঙ্গিদের কীর্তিকলাপে ক্রমাগত পৃথিবী অশান্ত হয়ে উঠছে। হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষকে পনবন্দি করা হচ্ছে। পরে তাদের অনেককেই মুন্ডু কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শুধু এদের অপরাধ এরা অমুসলমান, অন্য ধর্মালম্বী।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এইসব জঙ্গিরা কী কারনে এগুলো করছে? কী এদের আদর্শ? কার নির্দেশে এসব সংগঠিত হচ্ছে ? কোন লোভে এরা মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে না?

এসব প্রশ্নের এককথায় উত্তর কোরান। কোরানের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত নয় কোন সাচ্চা মৌলবাদী মুসলিম। কোরাণকে আদর্শ করে সারা বিশ্বজুড়ে এরা মুসলিম সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তার জন্য হিংসা হত্যা কোন কিছুই বাদ যাবে না। এ প্রসঙ্গে কোরানের কিছু নির্দেশিকা আমরা দেখে নিই –

হে নবী মুমিনদের সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ কর, তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্য্যশীল থাকলে তারা দু’শোজন কাফেরকে পরাজিত করতে পারবে। তোমাদের মধ্যে একশ জন থাকলে তারা এক হাজার কাফেরকে পরাজিত করতে পারবে কারন ওরা এমনি এক জাত যাদের কোন বোধশক্তি নেই। সুরা-৮, আয়াত-৬৫

অতএব যখন তোমরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধে মিলিত হও তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর, পরিশেষে যখন তোমরা তাদেরকে সম্পূর্নরূপে পরাভূত করবে তখন তাদেরকে কষে বেড়িতে বাঁধবে; অতপর তখন হয় অনুকম্পা নয় মুক্তিপন। (তোমরা জিহাদ চালাবে) যতক্ষন না যুদ্ধ তার অস্ত্রের বোঝা নামিয়ে ফেলে। এটাই বিধান। এটা এই জন্য যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে (নিজেই) শাস্তি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে পরস্পরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। যারা আল্লাহর পথে নিহত তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেবেন না। সুরা-৪৭, আয়াত-৪

হে মুমিনগন কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সংগে যুদ্ধ কর এবং তারা তোমাদের কঠোরতা দেখুক। আর জেনে রেখো আল্লাহ পরাহজোগারদের সাথে রয়েছে। সুরা-৯, আয়াত-১২৩

নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে, মূর্তিপুজারীদের যেখানে পাবে বধ করবে। তাদের বন্দি করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওৎ পেতে থাকবে কিন্তু ওরা যদি তওবা করে, নামায করে, যাকাত দেয় তবে ওদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চই আল্লাহ ক্ষমা পরায়ণ, দয়ালু। সুরা-৯, আয়াত-৫

তোমরা আল্লাহ ও তার রসুল এ বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম যদি তোমরা তা বোঝ। সুরা-৬১, আয়াত-১১

অমুসলমানদের যেখানেই পাবে, সেখানেই ধরা হবে এবং নির্মমভাবে হত্যা করবে। সুরা-৩৩, আয়াত-৬১

আরও এ রকম বহু নির্দেশিকা কোরানে আছে (স্থানাভাবে দেওয়া গেল না), যা মানুষকে হিংসাশ্রয়ী করে তোলে, হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে, সারা পৃথিবীতে ধর্মান্ধ হয়ে সন্ত্রাস চালাতে সাহায্য করে। যারা ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি অথবা ইসলাম শান্তির ধর্ম বলে গলাবাজি করেন তারা অনুগ্রহ করা শান্ত হোন। তারা আপাতত এই সুরা আয়াতগুলি কোরাণে ভালো করে দেখে নেবেন। না বুঝতে পারলে মৌলভির কাছে ছুটুন। তারা একটু চোখ খুলে বিশ্ব পরিস্থিতি লক্ষ্য করুন, কোরাণের নির্দেশিত পথ কতদূর এগোল। ইরান, ইরাক, আফগানিস্থান, পাকিস্থান মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও জঙ্গি হামলার শিকার। প্রায় প্রত্যেকদিন আত্মঘাতী জঙ্গি হানায় বহু নিরীহ মানুষ প্রান দিচ্ছে। নারী শিশুও বাদ নেই। ইসলামিক মৌলবাদের রোষানল থেকে বাদ যাচ্ছে না বিশ্বের কোনও দেশ। কোরানের বিরোধিতা করলেই আত্মঘাতী জঙ্গি গায়ের উপর লাফিয়ে পড়ছে। যারা ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে থাকেন তারা একটা জ্বলন্ত সত্যিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই ধরনের মানুষগুলো মুসলিম মৌলবাদীদের বিশৃঙ্খলতাকে অত্যন্ত ভয় পেয়ে এই ধরনের কথা বলে ক্ষত মেরামত করেন। সমাজকে আপাত শান্ত রাখার চেষ্টা, ধরি মাছ না ছুঁই পানি। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতকে আপাত মেরামত করার অপচেষ্টা। কিন্তু এইসব মানুষগুলো কখনোই আল কায়দা, আই এস, হরকত-উল-মুজাহিদিন, লস্কর-ই-তৈবা, আনসার আল ইসলাম এর মতো সংগঠনের কার্যকলাপকে কখনোই নিন্দা করেন না। মিডিয়ার সামনে মুসলমান ধর্ম কত সাধুত্বের ধর্ম তাই প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাপৃত থাকেন। এরা নিজেকে তথাকথিত মুসলিম সমাজের কর্নধার ভেবে মিডিয়ার সামনে আসেন। কিন্তু এরা মানুষকে বুঝতে দিতে চান না মুসলিম মৌলবাদ আর সমস্ত ধর্মীয় মৌলবাদকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ভয়ংকর ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মুসলিম মৌলবাদের বিষ। ক্রমাগত ইসলাম মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, সন্ত্রাসের ধর্ম রূপে পরিগনিত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যা হচ্ছে। শিক্ষিত রুচিশীল তরুন তরতাজা যুবকরা ধর্মান্ধদের হাতে, কোরাণের নির্দেশিকা অনুসারে খুন হচ্ছে। মুক্তবুদ্ধির আলোয় উদ্বুদ্ধ এই শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের কোন নিরাপত্তা নেই। মুর্খ, ধর্মান্ধ, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এই ঘাতকদের হাতে মননশীল, সমাজ সচেতন, মানবতাবাদী যুবকরা নিহত হচ্ছেন। যা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। অথচ রাষ্ট্র চুপচাপ, যেন কিচ্ছুটি তার করার নেই। এমন শান্ত শিষ্ট নিরীহ, অসহায় রাষ্ট্র দেখে মায়া হয়।

banner

লেখার আদিতে চারশো বছর আগের ইউরোপকে স্মরন করেছিলাম। চারশো বছর আগে ইউরোপে ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছিলো তারা আজ জয়ী। আজ ইউরোপ বাক স্বাধীনতার মস্ত স্বর্গরাজ্য। আজ বাইবেল অতটা নৃশংস নয়। ধার ভারহীন, নখ দন্তহীন একটি মানবসৃষ্ট গ্রন্থ। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ তাদের পূর্বপূরুষের মৌলবাদী কার্যকলাপকে ঘৃনা করেন। লজ্জাবোধ করেন তাদের এই প্রাচীন কর্মকান্ডের।
কোরানের নখ দন্ত ভাঙা শুরু হয়েছে। এটাই কোরানবাদীদের চিন্তায় ফেলেছে, এরা দিন দিন তাই নৃশংস হয়ে উঠছে। কলমের কাছে হেরে নাভিশ্বাস উঠছে ঘাতকদের। তাই মুক্তমনাদের পিছু হঠার কোন কারন নেই। পৃথিবীতে দিন দিন নাস্তিক মানবতাবাদীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সেজন্য আগামী পৃথিবী নাস্তিকদের, মানবতাবাদীদের, বাক স্বাধীনতাকামীদের। জয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখাটি ঊৎসর্গ – নীলয় নীল (নীলয় চক্রবর্তী) কে

candle

তুমি রবে,
নীরবে।

সবাইকে ধন্যবাদন্তে
– সোজাকথা