গ্রিসের বর্তমান আর্থিক সংকট গোটা দুনিয়ায় প্রভাব ফেলেছে | পরিণামস্বরূপ গ্রিস ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পরিত্যাগ করেছে | কিন্তু গোটা সংকটটা ধীরে ধীরে অনেক সময় ধরে ঘটেছে | একদিনে দুম করে হয়নি | সেই সংকটটা কিভাবে হলো, কেন হলো এবং এটা থেকে আমরা কি শিখলাম : সেটাই এই লেখায় আমরা দেখব |

কিভাবে শুরু হলো

১৯৯৯ সালে ইউরো মুদ্রা আসার ফলে ট্রেড কস্ট কমতে শুরু করলো আর ট্রেড ভলুম বাড়তে শুরু করলো | ইউরোজোন থেকে পাওয়া অর্থ গ্রিস বিনিয়োগ করতে শুরু করলো শিল্পে, মূলত ভারী শিল্পে এবং পরিষেবায় | কিন্তু গ্রিসে মজুরি বাড়তে শুরু করলো ইউরোজোনের কেন্দ্রে থাকা দেশগুলি যেমন জার্মানির তুলনায় | এতে গ্রীসের রপ্তানি প্রতিযোগিতার তুলনায় পিছিয়ে পড়তে লাগলো | এর ফলে গ্রিসে কারেন্ট একাউন্ট এ ঘাটতি বাড়তে শুরু করলো |
এখন বানিজ্যে ঘাটতি মানে হলো একটা দেশ যত উত্পাদন করছে তার চেয়ে বেশি ভোগ করছে | এর ফলে সেই দেশটিকে ঋণ নিতে হয় | গ্রীসের বানিজ্যিক ঘাটতি ১৯৯৯ এর শেষের দিকে ছিল ৫% এর কম | ২০০৮-০৯ এর কাছাকাছি তা ১৫% হয়ে দাড়ালো | ঋণ পেতে গ্রিস সরকারী আর্থিক রিপোর্ট-এ কারচুপি শুরু করলো | ফলে ঋণদাতা গ্রিসের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারল না |
গ্রীসের ঋণ ছাড়া আরেকটা বিনিয়োগের উত্স ছিল ইউরোজোনের দেশগুলি | কিন্তু গ্রীসের ক্রমাগত ঋণ নেয়া আর ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি গ্রিসকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল বিনিয়োগকারীদের কাছে |
এর সাথে গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে যুক্ত হলো আমেরিকার মন্দা যা কিনা ২০০৭-০৯ সালের মধ্যে ইউরোপে ছড়িয়ে পরেছিল | এর ফলে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রের দেশগুলি যেমন জার্মানি থেকে বিনিয়োগ আসা বন্ধ হয়ে গেছিল | এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ২০০৯ সালের আর্থিক অব্যাবস্থার রিপোর্ট | এর ফলে গ্রিস নিজের বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য আর অর্থ পাচ্ছিল না |
এখন একটা দেশের সমস্ত অর্থ পাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তার কাছে একটাই পথ খোলা থাকে | নিজের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে বিনিয়োগ টানা অর্থাত মুদ্রাস্ফীতি | গ্রীসের কাছে সেই পথটাও বন্ধ যতদিন না সে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে আসে | কারণ ইউরো মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ আর গ্রীসের হাতে নেই | গ্রীসের মজুরি প্রায় ২০% কমে গেছিল ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মাঝখানে | এর ফলে আয় এবং জিডিপি কমে গিয়েছিল | এর অনিবার্য ফলস্বরূপ মন্দা শুরু হয় | বেকারী ২৫% বাড়ে | তবে সরকারী ব্যয়্সংকচের ফলে প্রাথমিক বাজেট উদ্বৃত্ত দেখা গেছিল |

এই সংকটের প্রভাব:

এই আর্থিক সংকটের প্রভাবকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: অর্থনৈতিক এবং সামাজিক | প্রভাব গুলিকে নিচে বর্ণনা করা হলো:

ক] অর্থনৈতিক প্রভাব:

গ্রিক জিডিপি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো | এটি সবচেয়ে নিচে নেমে গেছিল ২০১১ সালে | তার বৃদ্ধি ওই বছর ছিল -৬.৯ % |ওই বছর এক লক্ষ এগারো হাজার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছিল | এই সংখ্যাটা ২০১০ সালের চেয়ে ২৭% বেশি ছিল | বেকার সংখ্যা ২২% থেকে বেড়ে দাড়িয়েছিল ৫৪.৯ % | গ্রিক অর্থমন্ত্রক ১৭ই অক্টোবর ২০১১ সালে ঘোষণা করে যে তারা একটা নতুন ফান্ড বানাবে যা থেকে এই আর্থিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্য দেয়া হবে | এই ফান্ডের টাকা আসবে ট্যাক্স ফাকি বন্ধ করে অর্থাত কালো টাকা উদ্ধার করে |

খ ] সামাজিক প্রভাব :

এই আর্থিক সংকটের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল গ্রিক সমাজব্যবস্থার ওপর | ফেব্রুয়ারী ২০১২ তে ২০ হাজারের বেশি গ্রিক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল | এথেন্স নগরীর ২০% এর বেশি দোকান খালি ছিল | ওই মাসেই পল থমসন নাম একজন ডেনিশ আই এম এফ অফিসার হুশিয়ারী দেন যে গ্রিক জনতা তাদের সহ্যশক্তির সীমার ওপর দাড়িয়ে আছে | তিনি এও পরামর্শ দেন যে সরকারী ব্যয়সংকোচ যেন তরিঘরি না করে ধীরে ধীরে করা হয় |
২০১৫ সাল নাগাদ বেকারী ২৫ % এ পৌছে গেছিল | ২০% গ্রিকের কাছে দৈনন্দিন খাওয়ার খরচা দেয়ার মত ক্ষমতাও নেই | বেশিরভাগ গ্রিকই তাদের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছিল এবং পরে যখন সেটাও আর সম্ভব হলো না তখন হোমলেস শেল্টারে নাম লেখাচ্ছিল | এই গৃহহীনতার সমস্যা তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল | সরকার কোনভাবেই তাদের আর্থিক সাহায্য দিতে পারছিল না |

সংকটের মূল কারণ :

প্রিয় পাঠক একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন সব সমস্যার সূচনা হয়েছিল মজুরির হার বৃদ্ধি পাবার জন্য | মজুরির হার অস্বাভাবিকরকম বৃদ্ধি পাবার ফলে গ্রীসের বানিজ্য ঘাটতি হচ্ছিল | সেই ঘাটতি ঠেকাতে ঋণ নেয়া শুরু হলো এবং গ্রিস ঋণের ফাদে পরে গেল |এতে ইউরোজোনের বিনিয়োগকারীরাও গ্রীসের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল | এরপর আমেরিকার মন্দা এলো | গ্রীসের ঋণ বা বিনিয়োগ কোনটাই পাওয়া সম্ভব হলো না | তখন সে মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু করলো আর তার ফলে এলো মুদ্রাস্ফীতি | সব মিলিয়ে মেলা ভজঘট অবস্থা |
কিন্তু প্রশ্ন হলো : মজুরি বৃদ্ধি পেল কেন? আসলে যখন গ্রিসে আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছিল অর্থাত ২০০০-২০০৭ সময়কালে, তখন মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয় | সেটাকে ঠেকাতে দেদার মজুরি বৃদ্ধি শুরু করে গ্রিক সরকার | ওদিকে গ্রিকরা দেদার ট্যাক্স ফাকি দিতে শুরু করে | ফলে বাজেটে ঘাটতি শুরু হয় | আর্থিক বৃদ্ধির চাদরে এই বাজেট ঘাটতি ঢাকা ছিল | অবশ্য সরকার ঘাটতি ঠেকাতে ঋণ নিতে শুরু করেছিল | এখন আমেরিকার মন্দায় যখন ওই আর্থিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেল তখন বাজেট ঘাটতি এবং নাক পর্যন্ত ঋণে ডুবে যাওয়া অর্থব্যবস্থার বেসামাল দিকটি প্রকট হয়ে উঠলো |

আরেকটা কারণ ছিল ট্যাক্স ফাকি | গ্রীসের মানুষজন অনেক বেশি করে ট্যাক্স ফাকি দিত যার ফলে সরকারের আয় কমে গেল | এটাও কারেন্ট একাউন্ট ঘাটতির আরেকটি মূল কারণ |transperency international এর করাপশন পার্সেপ্সান ইনডেক্স গ্রিসকে ১০০ তে ৩৬ দিয়েছিল যার অর্থ হলো গ্রিস সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ |

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো আর্থিক রিপোর্টে কারচুপি | আর এতে গ্রিসকে সাহায্য করেছে গোল্ডমান সাক্স-এর মত আর্থিক বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক | গ্রিসের সরকারী ঋণ ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রধান ক্রিস্তফরস সার্দেলিস জানিয়েছেন যে “গ্রিস জানত না যে সে কি কিনছে |”

কেমনভাবে রিপোর্টে কারচুপি করা হত ? ডার স্পিগেল জানাচ্ছে যে ঋণদাতা সংস্থাগুলি সরকারকে ঋণ দিত কিন্তু সেটাকে তারা ঋণ না বলে ফিনান্সিয়াল ডেরিভেটিভ বলত |এর ফলে সেগুলো নথিভুক্ত হত না কারণ ইউরোস্ট্যাট সেই সময় এইসব ফিনান্সিয়াল ডেরিভেটিভকে অগ্রাহ্য করত | ইতালিও একইভাবে নিজের প্রকৃত ঋণ অবস্থাকে জনৈক মার্কিন ব্যাঙ্কএর সাহায্যে লুকিয়েছিল | এরফলে ঋণদাতারা প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হত | এইভাবেই ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণ আমানতকারীর সর্বনাশ করে | আমার মনে হয় যে আমেরিকার মন্দার পিছনে এই ব্যবস্থাও কিছুটা দায়ী আছে |

শুধু যে ব্যাঙ্ক গুলি কারচুপি করত তাই নয় | সরকারী মদতেও কারচুপি হত | ২০১০ এর শুরুতে দেখা গেছে যে গ্রিক সরকার গোল্ডমান সাক্স ও অন্য ব্যাঙ্ক-কে লক্ষাধিক টাকার ফিস দিয়েছে শুধু প্রকৃত ঋণ অবস্থাকে ঢাকতে | সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রস কারেন্সী স্বপ (cross currency swap) যেখানে কোটি কোটি টাকার গ্রিক ঋণ ডলার অথবা ইএনে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে একটা ভূয় এক্সচেঞ্জ রেটে | কাজটি করছে গোল্ডমান সাক্স |

আমরা কি শিখলাম এই ঘটনা থেকে ?

দুমদাম মূল্যবৃদ্ধি হলেই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো যাবে না | মূল্যবৃদ্ধি কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে | গ্রিসের আর্থিক দুর্যোগের মূলে রয়েছে এই ভুল পদক্ষেপ | মজুরি বাড়ানোর আগে সব দিক খতিয়ে দেখে নিতে হবে | একটা ভুল পদক্ষেপ পর পর অনেকগুলি ভুল পদক্ষেপের জন্ম দিতে পারে |

দ্বিতীয়ত ঘাটতি মেটাবার জন্য ঋণ ব্যতিত অন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া উচিত | ঋণগ্রহণ হবে সবচেয়ে শেষ অপসন | ঋণ করতে আর্থিক রিপোর্টে কোনভাবেই কারচুপি করা চলবে না |গ্রিসে গোল্ডমান সাক্স যা করেছে তাকে গ্রিক সারদা বলা যেতে পারে |

তৃতীয়ত দেশের করব্যাবস্থাকে মজবুত করতে হবে | গ্রিসের লোকেরা মজুরি নিত চড়া হারে আর ট্যাক্স ফাকি দিত | এর ফলে সরকারের ব্যয় বাড়ল কিন্তু আয় বাড়ল না | পরিনাম ঘাটতি |

চতুর্থত : সবক্ষেত্রে সরকারী ব্যয়সংকোচ ঘাটতি কমানোর ব্রম্ভাস্ত্র নয় | সরকারের আয় বৃদ্ধিও একটি অস্ত্র যদিও তার ব্যবহার খুব কমই করা হয় | ট্যাক্স বাড়িয়ে সরকারের আয় বৃদ্ধি করেও ঘাটতি কমানো যায় |

সর্বোপরি যে কোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে হবে না বরং তা দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে | সবসময় খারাপ পরিস্থিতির কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে | রক্ষনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে | গ্রিস যদি মজুরি বারবার আগে ঘাটতির কথাটা ভাবত এবং ভবিষ্যতের মন্দার কথাটা ভাবত তাহলে তাকে এই সর্বনাশের দিন দেখতে হত না |

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১] উইকিপেডিয়া
২] ওয়াশিংটন পোস্ট
৩] নিউ ইয়র্ক টাইমস