picture9792

১.
আমজাদ সাহেবের সংসার ঠেলাগাড়ির মতো। ঠেলে-ধাক্কিয়ে চালাতে হয়। তাও যদি জীবন নামের রাস্তাটা একটু মসৃণ হতো! একমাত্র মেয়ে আর সহধর্মীণিকে নিয়ে সংসার ঠেলতেই তার নাভিশ্বাস ওঠছে। আরেকটা বাচ্চার মুখ দেখবেন এই সাহস তার হয়ে ওঠেনা। আর মুখ শুধু দেখলেইতো হবেনা, অন্ন মুখে তুলে দেবার ব্যবস্থাও করতে হবে। ইচ্ছাটা তাই দমিত হয়ে মনের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যায়। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া মেয়েটাই তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে থাকে। আজ সকালে অফিসে যাবার মুহূর্তে মেয়ে আবদার করেছিল, চার্জলাইট কিনে দিতে হবে। সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ে কারণে মেয়েটা পড়তে বসতে পারেনা। তাই অফিস থেকে বেরিয়েই তিনি বাসে করে গুলিস্তান চলে এলেন। ফুটপাতে শত শত বাহারি ছোটবড় চার্জলাইটের পসরা নিয়ে হকাররা বসে আছে। হাজার পয়সা খরচ করে লাইট কেনার সামর্থ্য আমজাদ সাহেবের নাই। চাইনিজ সস্তা লাইট কিনতেই তাই এখানে আসা। আশি টাকায় পেয়েও গেলেন একখানা, ঝকঝকে আলো দেয়!!! চায়না জাতিকে আমজাদ সাহেবের এজন্যেই খুব সম্মান করতে ইচ্ছে করে। গরীবের কথা এরা সত্যিই ভাবে! কতগুলো টাকা বেঁচে গেল, তা দিয়ে ভালোমন্দ বাজার করে আজ ঘরে ফিরতে পারবেন।

২.
একরাতে খাবারপর্ব শেষ করে চার্জলাইটা নিয়ে আমজাদ সাহেব বসেছেন। কিনা কি ডিস্টাব দিচ্ছে। আশ্চর্য!! লাইটটা শতচেষ্টা করেও জ্বালাতে পারছেন না। এখনি নষ্ট হয়ে গেল!!! সস্তার হীন অবস্থা! আমজাদ সাহেবের চায়না জাতির প্রতি শ্রদ্ধা বেশিক্ষণ আর টিকলো না। গরীবের সাথে আসলে সবাই ঠাট্টা-তামাশা নেয়। রাগে-দুঃখে মেঝেতে সজোরে আছরে ফেললেন চার্জলাইটা।
কি কান্ড!! গুড়িয়ে যাওয়া চার্জলাইটা থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকলো, পুরো ঘর আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আবিভার্ব ঘটলো এক ভয়ানক দর্শন দৈতের!!!!!!!!!
-হুকুম করুন আমার মালিক!!!
আমজাদ সাহেব পরিস্থিতির আকস্মিকতায় পাথর হয়ে আছেন। ভয়ার্ত কন্ঠে জিঙ্গেস করলেন,
-তুমি কে!?
-আমি এ প্রদীপের দৈত্য!!
-ও আচ্ছা। আমজাদ সাহেবের মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। গরীবের সাথে সত্যিই আজকাল সবাই ঠাট্টা-তামাশা করতে শুরু করেছে!
-হুকুম করুন মালিক! হু…হু….হু..হ..হা….হা…..হা…..হা………
-এই!! খবরদার হাসবা না!!! এইটা সিনামা-আলিফলায়লা না।
হঠাৎ দৈত্য হাসি থামিয়ে ঢোঁক গিললো! তার মালিক দেখা যায় বড়ই বেরসিক! এমন নাটকীয় ঘটনার ক্লাইমেক্সটাও ওনার মাথায় ঢুকছে না।
-মালিক, আমি আলাদীনের সেই দৈত্য।
-তুমি সেই দৈত্য ভালো কথা, তাহলে চায়না চার্জলাইটের ভিতর কি করো!??? আমারে বলদ পাইছো? যা বুঝাবা তাই বুজবো?
-প্রভু, আমার প্রথম মালিক আলাদীন চীনদেশের বাসিন্দা ছিলেন। আমাকে নিয়ে রুপকথার সৃষ্টিও চীনে।
-আমিতো তোমাকে এতোকিছু জিঞ্জাসা করি নাই। এই চায়না চার্জলাইটের ভিতর তুমি আসলা কিভাবে সেইটা জিঞ্জাসা করছি।
-প্রভু, এখন আধুনিক যুগ। মাটির প্রদীপে থাকলে আর চলবে কেন? মানে….আরকি…বুজেনেই তো স্ট্যাটাস থাকে না! তাই চার্জলাইটে আশ্রয় নিলাম।
-স্ট্যাটাসের জন্যে রূপকথার আশ্রয় চেঞ্জ করে ফালাইলা!?
– না মানে…… ইয়ে.. ইদানীংকার ভেজাল কেরোসিনের গন্ধটাও আর সহ্য হয় না। তাই আশ্রয়বদল।
-ও আচ্ছা।
-প্রভু, তাছাড়া মাটির প্রদীপে বাস করে আমার যে উদ্দেশ্য সেটা আর পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ এই প্রদীপের ব্যবহার অনেক যুগ আগেই পরিত্যক্ত হইয়াছে।
– উদ্দেশ্যটা কি আবার!?
-যেই আমার মালিক হবেন, তার তিনটি ইচ্ছা পূরণ করা।
-বলো কি!?
-জ্বি মালিক! আপনি শুধু আদেশ করেই দেখুন।
আমজাদ সাহেবের ছানাবড়া চোখ চকচক করে ওঠে। বলে কি এই দৈত্য!! আমজাদ সাহেব নিজের হাতে চিমটি কাটলেন স্বপ্ন দেখছেন কিনা এই ভেবে। এতো দেখি সত্যিই ঘটছে!
-আমি যাই চাইবো তাই দিতে পারবা তো?
-আপনি শুধু বলেই দেখুন মালিক, দেখুন আমি কি করে দেখাতে পারি।
আমজাদ সাহেবের গলা দিয়ে আর শব্দ বেরুচ্ছে না। তার মতো ছাপোষা মানুষের উচ্চাকাক্ষা থাকতে নেই, তাই চিন্তার ঝাঁপি এতোদিন তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। আজ মনে ইচ্ছের বান ডেকেছে, এতো এতো ইচ্ছেরা ভীড় করেছে কোন তিনটি ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিবেন বুঝে ওঠতে পারছেন না।
-দেখো দৈত্য, আমার চাহিদা কিন্তু খুব বেশী না। এই শহরের সবচাইতে আলিশান বাড়ির মালিক আমাকে বানায়ে দাও।
-জুঁ হুকুম মালিক। এই শহরের সেরা আলিশান বাড়িটি আপনারেই হবে। এইবার আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছের কথা বলুন।
-দ্বিতীয়টাও এতো বড় কোন চাহিদা না, শুধু দেশের সবচাইতে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক আমাকে করে দাও। কি? পারবা না? নাকি বেশী বইলা ফালাইছি?
দৈত্য মুচকি হাসে। তার এই মালিকও পূর্বের আর সবার মতোই লোভী হয়ে উঠছে, পেছনের জীবনের যে অবদমিত চাহিদাগুলি চাপা দেয়া ছিল তারাই আজ অস্তিত্বকে আছন্ন করে ফেলছে ধীরে ধীরে।
-মালিক, আপনি যাই হুকুম করুন না কেন তাই শিরোধার্য। আপনি শুধু আপনার শেষ ইচ্ছেটা পেশ করুন।
-আমাকে এতো টাকা-প্রতিপত্তিশালী করে দাও “অভাব” কথাটা যেন বাকি জীবন শুনতে না হয়।
-তাই হবে মালিক, এতোটাই ঐশ্বর্যশালী হবেন যে “অভাব” শব্দটাই আপনি ডিকশেনারি থেকে মুছে দিবেন। হু…হু….হু..হ..হা….হা…..হা…..হা………
– থামো! তোমাকে না বললাম এইভাবে না হাসতে! এই যে এতোক্ষণ হবে হবে বইলা গেলা কিন্তু হবেটা কখন? এইজাতীয় ফাইজলামি করবা না, ফাইজলামি আমার পছন্দ না।
দৈত্য আবারো হাসি থামিয়ে ঢোঁক গিললো! মালিক মানুষটা আসলেই বদমেজাজী। ওনার কাছে আর বেশিক্ষণ থাকা উচিত হবেনা, ইচ্ছে পূরণের একটা দফা-রফা করেই ভাগতে হবে। দীর্ঘ হাজার বছরের জীবনে অনেক মালিকের সেবা করেছে তবে এমন আশ্চর্য হবার ক্ষমতাহীন মানুষ দেখে নাই।
-মালিক এই হচ্ছে আপনার বাড়ির চাবি। আগামীকাল থেকেই শুরু হচ্ছে আপনার নতুন জীবন।
প্রকান্ড আকারের দেহবায়ব আস্তে আস্তে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল।

৩.
পরদিন থেকে শুরু হলো আমজাদ সাহেবের রাজকীয় জীবন। গতদিনেরেই যাপিত জীবনখানা তার কাছে দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলো, ঘুম থেকে জেগেই তিনি যেন তার আলিশান দালানের বিছানায় নিজেকে দেখে স্বস্তিবোধ করার চেষ্টা করেন, “ওটা আসলেই দুঃস্বপ্ন ছিল।”
সময় বয়ে চলার সাথে সাথে আমজাদ সাহেবের পরিবর্তন হতে সময় লাগলো না। রোদ তাপ এখন তার একদম সহ্য হয়না, গ্রীষ্মের সময়টা বাইরের কোন শীতল দেশে কাটিয়ে আসেন। দমবন্ধ বাসে ঘর্মাক্ত মানুষের ঠাসাঠাসি দেখলে তার গা ঘিনঘিন করে। দেশ থেকে এই গরীবগুলারে খেদায় না কেন এটা তার মনে আজ বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। “বুঝলা রহিম, সিটি কর্পোরেশনের ময়লা পরিষ্কারের ট্রাকের মতো গরীব তোলার ট্রাক বিদেশ থাইকা আমদানী করা জরুরী হয়ে গেছে, সুন্দরমতো গরীব তুইলা দেশের বর্ডারে ঐপাশে ফালায়ে আসবো। সরকারী কেউ যদি এই উদ্যোগ নেয় আমাকে জানাবা, যতো ডোনেশন লাগে আমি দিবো।” যানজটে শীতাতপ গাড়িতে বসে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আমজাদ সাহেব কথাগুলো বলেন আর সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিগত সহকারী রহিম হাসিমুখে শোনে। স্যার যা বলেন সেই কথার উল্টো কোন চিন্তা রহিম করতে পারেনা। যে লোক নাকে দড়ি দিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের ওঠাবসা করান তার সাথে তর্কে জড়াবে এতো বোকা ও নয়। স্যারকে তুষ্ট রাখাতেই সে সদা ব্যস্ত। স্যারের যেকোন “চাহিদা” সে ম্যানেজ করে দেয়।এতো দামি চাকরীটা স্যারকে খোশমেজাজে রাখার জন্য বেজার করতে নয়।

আমজাদ সাহেবের ফোনটা বেজে ওঠলো। স্ত্রীর নাম্বারটা ভেসে আছে। আমজাদ সাহেব অবাক হলেন, স্ত্রী তাকে সচরাচর ফোন দেয়না। তিনিই যোগাযোগ রাখেন না। তার স্ত্রীর যদি কোন সাংসারিক এটা-ওটা প্রয়োজনও হয় রহিমকে বলা আছে সেই ব্যবস্থা করে দেয়। টাকার পাহাড় করে রাখা আছে শুধু চাহিদা মিটিয়ে যাও এই হচ্ছে তার কথা। দেশী-বিদেশী বিজনেস ডেলিগেটদের সাথে দেশ-বিদেশ ঘুরে আমজাদ সাহেব সংসার কি ভুলে গেছেন। ঝকঝকে-তকতকে নারীদের সমাগমে তার মধ্যবিত্ত চেহারার স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ছোট্ট মেয়েটিই প্রতিই শুধু ভালোবাসা একই আছে। আমজাদ সাহেব বিরক্ত নিয়ে ফোন ধরলেন। অবশ্য তার বিরক্তি বেশীক্ষণ থাকলো না, সহসা সংশয়ের মেঘ জমে ওঠলো মুখে। সংশয় তার মেয়েকে নিয়েই, বেশ কিছুদিন জ্বরে কাবু ছিলো। ডাক্তাররা প্রাথমিক অনুসন্ধান করে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছেন। তবুও কিছু সঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

মেয়ের কথা চিন্তা করেই তিনি শিউরে ওঠলেন।

৪.
আমজাদ সাহেব চেষ্টার ত্রুটি কিছু রাখেন নি। বিদেশের সেরা হসপিটালে নিয়ে গেলেন মেয়েকে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু অদৃষ্টে যা লিখার তা আগেই লিখা হয়ে গেছে, মেয়েটির ক্যান্সার ধরা পড়লো একবারে শেষ পর্যায়ে এসে। সত্যিকার অর্থে কিছুই করার ছিলো না শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া। আমজাদ সাহেব তবুও হাল ছাড়েন নি, আলৌকিক রূপকথার গল্পের মতোই পাওয়া তার অঢেল বিত্তের পাহাড় পুরোটাই ঢেলে দিতে প্রস্তুত হলেন। মেয়েটি মৃত্যুর আগেও বাবার হাত ধরে আবদার করলো, “ও বাবা, আমি বাঁচতে চাই।” মহা প্রাচুর্যবান আমজাদ সাহেব, তবুও এবার মেয়ের আবদার রাখার সামর্থ্য তার নাই?!

পরের ঘটনা খুবেই সংক্ষিপ্ত। কোমায় থাকা মেয়েটির আয়ু মাস থেকে কমে পক্ষকালে নেমে আসে। মৃত্যুর অপেক্ষাকাল ক্রমশই কমে আসতে থাকে। আমজাদ সাহেব এখন দিনে-দুপুরে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকেন। সারা ঘরে আছড়ে পড়া প্লাস্টিক-কাঁচের ভাঁঙ্গা ময়লা জমে ওঠে স্তুপ হয়। তিনি বসে বসে চার্জলাইট ভাঙ্গেন, রহিম গুলিস্তান থেকে বস্তায় বস্তায় নিয়ে আসে। চায়না এই চার্জলাইট গুলো এমনিতেই বেশীদিন ঠিকে না। আছড়ে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে রহিমের তাই কোন গরজ হয়না, স্যারের মনখোশ করা দিয়েই
তার কাজ।

আমজাদ সাহেব খুব মনযোগ দিয়ে ভেঙ্গে চলেন, এই ব্যাপারে তার কোন ক্লান্তি নাই। এইবার তার ইচ্ছাপূরণ নয়, চাই ভিক্ষা।