(কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি দি গড ডিল্যুশন অনুবাদ প্রকাশ করা যখন সম্ভব হলো, সেই খবরটা নিজ উদ্যোগে ডঃ অভিজিৎ রায় তার টাইম লাইনে শেয়ার করেছিলেন শুভকামনা দিয়ে। তাঁর এই উদারতার কারণে আমার খুব ছোট জগতের বাইরে অনেকেই জানতে পেরেছিলেন বইটির কথা। ভীষন উৎসাহিত বোধ করেছিলাম। আজ এই খবরটা পেলে সবচেয়ে খুশী হতেন তিনি, তার মুক্তমনায় আজ সেই কথাটি জানাতে এসেছি। আমরা তাঁর কাজ অব্যাহত রাখবো, জীবনের বড় অংশটা পার হয়ে আসা আমি আরো আশা করবো, তরুণরা কেউ কেউ আরো নতুন উদ্যোগ নেবেন সারা পৃথিবীর মুক্তচিন্তার মিথস্ক্রিয়ায় নিজেদের যুক্ত করে বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য। এই লেখাটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসাবে প্রকাশ করার পর কেউ কেউ হয়তো পড়েছেন। পুনরাবৃত্তি করার দায়ভার আমার একার। অনেক ধন্যবাদ।) (শিরোনামটি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কবিতা হারানো অাঙ্গুলের একটি পংক্তি)

1262929_877097809031020_938670787795249489_o
(রিচার্ড ডকিন্স এর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ডের প্রচ্ছদ, প্রকাশিতব্য)

২৭ জুলাই অফিসে এসেই ইনবক্সে একটি ইমেইল পাই – রিচার্ড ডকিন্সের ইমেইল .. মাত্র বিশ মিনিট আগে ইনবক্সে এসে বসে আছে সেটি, জি মেইলে রিচার্ড কে সেটা ভাবতেই ভাবতেই ক্লিক করি। বিস্মিত আমার চোখের সামনে তখন তার সাথে আমার যোগাযোগের প্রথম স্মারকটি। আর সেই ইমেইলটি পড়ে আমার প্রথম অনুভূতিটি হচ্ছে কৃতজ্ঞতা। দ্রুত একটি উত্তর লেখার পর পরই একাধিক ইমেইলে তিনি নিশ্চিৎ করেন, তাঁর অসাধারণ বড় আর সুন্দর মনটি আমার পরিশ্রমের উদ্দেশ্যটি বুঝতে পেরেছে।আমার পক্ষে খুবই কঠিন এই অনুভূতির স্তরগুলো ব্যাখ্যা করা কারণ তার এই ইমেইল আমার জন্য আসলেই অর্জন বলে কোন গর্ব করার কোন অবকাশ নেই। আমি হয়তো সেই অনূভূতিটাকে খানিকটা ব্যাখ্যা করতে পারবো ‘বিস্ময়কর অনূপ্রেরণায় ঋণগ্রস্ত’ হিসাবে। তাঁর পরোক্ষ অনুমতিতে এ বছর বইমেলায় দি গড ডিল্যুশন অবশেষে প্রকাশ হলেও তাঁর কাছ থেকে সরাসরি কোন যোগাযোগ আমি প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি বহু প্রচেষ্ঠায়। কিছুদিন আগে বইটির একটি ভালো কপি হাতে পাবার পর তার ব্যাক্তিগত সহকারীর কাছে বইটি পাঠিয়েছিলাম। এই ইমেইলটি তারই প্রত্যুত্তর। আসমা সুলতানা মিতার করা প্রচ্ছদের কাজটিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি।

আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করে আছেন রিচার্ড ডকিন্স, আর সেটি সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হবে কেবল আমার জীবনের শেষ দিনটিতে, কারণ তখনই কেবল মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে আমি আমার অনুভূতিটাকে কি মর্যাদা দিতে পারলাম। কোন বিখ্যাত ব্যাক্তির পাশে দাড়িয়ে ছবি তোলা, তাঁর অটোগ্রাফ নেয়া সবকিছু ব্যক্তিগত আত্মতৃপ্তির কারণ হতে পারে ঠিকই – কিন্তু আমি মনে করি যদি তাঁর কাজকে নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে আরো বহু মানুষের কাছে পৌছে দেয়া যদি সম্ভব হয়, তাহলেই কেবল প্রকৃত অর্থেই সেই বিখ্যাত মানুষটি সন্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে। সেকারণে তাঁর লেখা প্রতিটি বইয়ের অক্ষর আমি বাংলায় করে যাবো এমন একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে জীবনের প্রায় তিন দশক কাটিয়ে দিয়েছি। এই মুহুর্তে তাই সামান্যতম আত্মতৃপ্তিরও সুযোগ নেই, কারণ কেবল মাত্র তিনটি বই অনুবাদ করতে পেরেছি।

২০০৭ এ টরোন্টো আসার পর স্থানীয় লাইব্রেরী থেকেই দি গড ডিল্যুশন বইটি পড়ার সুযোগ হয়। এটাই তাঁর প্রথম কোন বই যা আমি কিনে পড়িনি। যারা তার আগের বইগুলো পড়েছেন, তারা দি সেলফিশ জিন থেকে তাঁর লেখার বিবর্তনটি অনুভব করতে পারবেন। ষাটের দশকে জীববিজ্ঞানে বিল হ্যামিলটন, পরে রবার্ট ট্রিভার্স এর অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিকে তিনি সবার জন্য বোধগম্য একটি ভাষায় আর ডারউইনীয় বিবর্তনের মূলসারটিকে বিদ্যমান সব অস্পষ্টতাকে সরিয়ে শক্ত একটি ভিত্তিতে দাড় করিয়েছিলেন দি সেলফিশ জিন বইটিকে। তাঁর নিজের প্রিয় বই দি এক্সটেন্টেড ফেনোটাইপ ছিল সেলফিশ জিনের বিরুদ্ধ সমালোচনার প্রতি আসাধারণ একটি জবাব। জীবজ্ঞিানীদের জীববিজ্ঞানী ডকিন্স এই দুটি বই তাই বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।

সফটওয়্যার মোগল চার্লস সিমোনী যখন তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন ক্রমশ বাড়তে থাকা ধর্মীয় অযৌক্তিকতা, সৃষ্টিবাদের অর্থপূষ্ট শক্তিশালী প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য, তিনি বিজ্ঞানের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন অভূতপূর্ব দক্ষতায়। প্রকৃতি আর বাস্তবতার কবিতা যে বিজ্ঞান সেই মঞ্চে তখন বিজ্ঞানকে গ্রাস করতে উদ্যত ধর্মীয় কুসংস্কার। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি লেখেন দি গড ডিল্যুশন; কোন বিজ্ঞানী এর আগে এমন কোন বই লেখেননি। শুধু একটি বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে অসংখ্য বই। ঈশ্বর সহ কোন পৃথিবী ঈশ্বরহীন কোন পৃথিবী থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন হবে, আর ঈশ্বর সে কারণেই একটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প হতে পারে, যার অস্তিত্বের বিতর্কে তাই বিজ্ঞানের কৌশল ব্যবহার করা সম্ভব – ঈশ্বরের বিবর্তন এবং সত্য অনুসন্ধানের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়িয়ে থাকা ঐশী প্রত্যাদেশগুলো বিশ্বাসের খাতিরে বিশ্বাস করা শুধু বিভ্রান্তি নয়, ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর এক বিভ্রান্তি। আর বিভ্রান্তির বিনাশের চেয়েও বরং এই বিভ্রান্তিকে তার প্রকৃতার্থে চিহ্নিত করার করাই তিনি বলেছেন, যেন আমরা এর ক্ষতিকর দিক থেকে সভ্যতার অগ্রগতিকে সুরক্ষা করতে পারি।

আর বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে এই যুক্তিগুলো অনুধাবন করা খুব প্রয়োজন – আর সেকারণে দি গড ডিল্যুশনকে আমি প্রথম অনুবাদের জন্য বেঁছে নিয়েছিলাম। বইটির শিরোনাম নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আমি শুধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রিচার্ড ডকিন্সের প্রতিটি বই তার দেয়া শিরোনামেই প্রকাশ হবে, একারণেই বইটির নাম অপরিবর্তিত। আমি মুক্ত মনের মানুষ কিনা জানিনা, দাবীও করিনা। শুধু বিচিত্র বিষয়ে আমার জানার খুব আগ্রহ আছে । সেই আগ্রহটি সত্য অনুসন্ধানের সাথে সংশ্লিষ্ট। যারা রিচার্ড ডকিন্স এর বই পড়েছেন তাদের কাছে এই সত্য অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটা অচেনা মনে হবে না। আর আমার কাছে মুক্ত চিন্তার সংজ্ঞা হচ্ছে সেটি।

অনেকের মতই নানা বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করলেও যখনই নানা বিষয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম অনুভব করেছি বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমানে অনুবাদের প্রয়োজন – বিজ্ঞানতো বটেই – সব বিষয়ে। নবম দশকে আল কিন্দী বাগদাদে যেমন বায়াত আল হিকমাহতে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদের অবিশ্বাস্য বিশাল যজ্ঞ শুরু করেছিলেন, আমাদের ঠিক তেমন কিছু দরকার । লেখক প্রচুর সমস্যা শুধু পৃষ্ঠপোষকতার। আগের মত সেই নেস্টরীয় খ্রিস্টীয় যাজকরা নেই যারা গ্রীক পান্ডুলিপিগুলো সংরক্ষন করেছিলেন। অবিশ্বাস্য মাত্রায় সন্মান ছিল অনুবাদকদের সেই জগতে। তাদের পারিশ্রমিক, সামাজিক মর্যাদা তার স্বাক্ষ্য দেয়। এবং এই অনুবাদই সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছিল।

রিচার্ড ডকিন্স তাঁর পুরোটা জীবন নিবেদন করেছেন সত্য অনুসন্ধানে – অপবিজ্ঞান আর কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে লড়তে।সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে মৌলিক কিছু পরিবর্তনের জন্য লড়ছে এখন তার ফাউন্ডেশন।আর তার এই কাজের ক্ষেত্র সারা পৃথিবী। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন বাংলাভাষায় তাঁর সব বইই অনুবাদ করার জন্য, তিনি কোন সন্মানী নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, নিজের এজেন্টের মতামতের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে তিনি বাংলাভাষীদের কাছে তার লেখা পৌছে দেবার অনুমতি দিয়েছেন বিনামূল্যে। এটি তাঁর বিশাল মনের পরিচয়। যে বিশ্বাসটুকু তিনি আমাকে করেছেন সেটা শুধু কৃতজ্ঞতা দিয়ে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। আর তাই আমার অসমাপ্ত কাজের তালিকা আরো দীর্ঘতর হলো। আমি কাজ দিয়ে তার এই উদারতার প্রতিদান দিতে চাই।

তিনি তাঁর বিশ্বব্যাপী মুক্ত চিন্তা প্রসারের আন্দোলনে বাংলাদেশকে যুক্ত করে নিলেন।

mail.google.com

mail.google.com2

mail.google.com3 - Copy