জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

কোনো প্রজাতিই স্থির নয়। অভিযোজনের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল প্রাণই কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ সবকিছুই ঘটেছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভিত্তিতে।

-চার্লস রবার্ট ডারউইন

হ্যাঁ, মাত্র বাইশ বছর বয়সী অনুসন্ধানী তরুণটির সমুদ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের জগতে যে প্রলয়তুল্য আবিস্কারটির আবির্ভাব ঘটলো সেটি আর কিছুই নয়- বিবর্তনবাদ। চার্লস রবার্ট ডারউইন নামের অসাধারণ চিন্তা চেতনার অধিকারী তরুণটির সমুদ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের যে নতুন অগ্রযাত্রা সূচিত হয়ে এবং ক্রমেই বিকশিত হয়ে আজ আমরা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ থেকে ডিএনএ প্রতিটির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গঠন বর্ণনা করতে পারি, তার সূচনা ঘটেছিল সেই বিখ্যাত সমুদ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে। পাঁচ বছরব্যাপী দীর্ঘ সেই সমুদ্রযাত্রা শেষ করে তিনি লিখতে শুরু করলেন জীববিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় বিবর্তনবাদ নিয়ে। বিবর্তনবাদের শুরুর ইতিহাস অত্যন্ত মজার এবং আকর্ষণীয়। চলুন পাঠক আমরা সেই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি। জেনে নিই একজন ধর্মযাজক হবার অভিলাষ থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীটি।

d1

তিনি তখন সদ্য লন্ডনের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে বাংলাদেশের হিসেবে বিএ পাস করে বেরিয়েছেন। বাবা চেয়েছিলেন তার পুত্রটি ডাক্তার বা উকিল হোক। সেসময় সমাজ থেকে আজ অব্দি বাবামায়েদের চিন্তার খুব একটা পরিব্যপ্তি বাড়েনি বলেই বুঝি প্রতীয়মান। বাবা মায়েরা এখনো আশা করেন তাদের সন্তান ডাক্তার, উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার হবে! সে যাই হোক, ছেলেকে ডাক্তার বা উকিল বানানোর কর্মযজ্ঞ থেকে ক্ষান্ত দিয়ে বাবা রবার্ট ডারউইন ঠিক করলেন ছেলেকে ধর্মযাজক বানাবেন। সে লক্ষ্যেই ১৮৩১ সালে হঠাৎ করেই ডারউইন বিগল জাহাজে করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকাসহ প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো পাঁচ বছরের জন্য ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান। ধর্মগুরু হবার জন্য এতো সাধনা যার, তিনিই শেষ পর্যন্ত আঘাত হেনেছিলেন সনাতন ধর্মের উপর তাঁর বিবর্তনতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
তাহলে গল্পটা শুরুই করা যাক!

১৮৩১ সালে জাহাজে ওঠার আগে ডারউইনকে তাঁর শিক্ষক এবং একইসাথে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনেস্লো অপর এক প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক চার্লস লায়েলের লেখা Principle of Geology বইটি উপহার দেন। গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হেনেস্লো কড়াভাবে ডারউইনকে বলে দেন যেন ভুলেও লায়েলের লেখাগুলোকে ডারউইন বিশ্বাস না করেন! কিন্তু ডারউইন জাহাজে যেতে যেতে প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা দেখতে দেখতে গুরুর উপদেশ ভুলে গভীর সন্দেহে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন একের পর এক। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে এবার দেখা যাক, কি ছিল লায়েলের সেই বইয়ে! লায়েল তাঁর বইয়ে বলেছিলেন, “নূহের আমলের এক কথিত মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূ-ভাগ রূপান্তরিত হয়নি। ভূভাগ বিবর্তনের অন্যতম কারণ হল বাতাস, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের মতন অসংখ্য ছোটবড় প্রাকৃতিক শক্তি। এগুলোই অতীত থেকে বর্তমান সময়ে ভূভাগের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং আসছে।” গুরুর কথা ভুলে ডারউইন তাই মনোনিবেশ করলেন আশেপাশের ভূপ্রকৃতির উপর এবং আস্তে আস্তে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন লায়েলের সেই যুক্তিপূর্ণ রূপান্তরের মতবাদে। তাঁর চিন্তা ভাবনাকে উসকে দিতেই যেন একদিন চিলির উপকূলে নোঙর করা অবস্থায় তাঁদের জাহাজ কেঁপে উঠলো প্রবলভাবে।-ভূমিকম্প! দুইমিনিটের সেই ভূমিকম্প শেষে ডারউইন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মহাবিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন উপকূলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় আট ফুট! তাহলে কি লায়েলের Principle of Geology’র কথাই ঠিক? সব পরিবর্তনই কি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা করা শক্তিগুলোর ফলাফল?

এসব ভাবতে ভাবতেই যাত্রাপথে আবার জাহাজে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু একটি দ্বীপে। সেখানে দেখা গেল পাহাড়ের গায়ে এক রহস্যময় সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পরীক্ষা করে জানা গেল রহস্যের তেমন কিছুই নেই, শামুক ঝিনুকের খোলের চুনাপাথরের ক্ষয়ই এই লম্বা দাগের সূচনা করেছে। কিন্তু শামুক ঝিনুক এতো উঁচুতে এক পাহাড়ের গায়ে আসবে কিভাবে? তাহলে কি একসময় সেই পাহাড় লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের গ্যালন গ্যালন পানির নিচে?

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি দেখা গেল গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে নামার পর। এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে দেখতে তরুণ প্রকৃতিবিজ্ঞানীটি দেখতে পেলেন বিভিন্ন প্রজাতির একগাদা ফিঞ্চ পাখি, যেগুলোকে আমরা ফিঙে নামে ডাকি। ডারউইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন সবগুলোই ফিঞ্চ পাখি হলেও সমস্যা হল এদের খাবারের প্রকৃতি অনুযায়ী বদলে গেছে এদের গঠন। যেমন যেগুলো গাছে থাকে তারা খায় একরকম খাবার, যেগুলো মাটিতে থাকে তারা খায় আরেকরকমের খাবার। খাবারের ধরন অনুযায়ী সেই পাখিগুলোর আকৃতিও আলাদা! তিনি এই বৈচিত্র্য দেখতে দেখতেই এদের ১৩টি প্রজাতির বর্ণনা দেন, দেখান প্রজাতির বৈচিত্র্য। এই ১৩টির পর বর্তমানে আর একটিসহ মোট ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই। এই পাখিদের দেখার পরেই তিনি প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেন যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই জীবের মাঝে একেকরকম বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ক্রমেই অভিযোজিত হয়ে তৈরি করে এক বা একাধিক নতুন প্রজাতি! সুতরাং প্রজাতি হল এমন কিছু জীবের সমষ্টি যারা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম। যেমন- আধুনিক মানুষ Homo sapiens প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন প্রজাতির সঙ্গে তারা কেউ প্রজনন ঘটাতে পারবেনা!

ডারউইন আদতে এই তথ্যটি প্রকাশ করতে যথেষ্ট দ্বিধাবোধ করেছেন। কেননা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন তাঁর দেয়া মতবাদ কতটা বৈপ্লবিক। আরেক বিজ্ঞানী হুকারের কাছে লেখা চিঠিতে তাই তিনি লিখেছিলেন- নিজেকে তাঁর বড় একজন অপরাধী মনে হচ্ছে, তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন! তাই তত্ত্বের সত্যতা জেনেও কেবলমাত্র সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হতে তিনি আরও ২০ বছর ধরে গবেষণা করে লিখলেন জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বই- Origin and Species by the means of Natural selection।
ডারউইনের তত্ত্ব যে ভুল নয় তার প্রমান আমরা দেখতে পাই অন্যপ্রাণীদের মতন মানুষেরও অসংখ্য প্রজাতি আবিষ্কৃত হওয়ায়। এগুলোর মধ্যে হোমিনিড গণের অন্তর্ভুক্ত হোমোস্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেক্টাস-সহ অসংখ্য প্রজাতির ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মতন আরও অন্য এক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের ফসিল। অনেক গবেষণার পর দেখা গেছে একপ্রজাতির বনমানুষ বা এপদের সঙ্গে মিলে গেছে আমাদের ডিএনের প্রায় ৯৮.৬%! ডারউইনের সময় কার্বন ডেটিং-সহ অনেক পরীক্ষার সুব্যবস্থা না থাকলেও এটা এখন পরীক্ষিত গবেষণাধর্মী সত্য যে, ৪০-৮০ লক্ষ বছর আগে একধরণের বানর প্রজাতি দুইপায়ে ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তাদের থেকে বর্তমান আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র দেড় থেকে দুইলক্ষ বছর আগে। এপর্যন্ত একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি যেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদকে সমর্থন করেনা। এমনকি মজার কথা হল ডারউইন পূর্ববর্তী সময়েও জর্জ বুফো, হাওয়ার, ওয়ালেস, উইঙ্গারসহ বেশকিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি স্থির নয়, চলমান বিবর্তনের ফসল। কিন্তু এরা বিবর্তনকে মেনে নিলেও সেটি কিভাবে ঘটে তা কেউই ডারউইনের আগে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের বহুল পঠিত Ancestor’s Tale বা আশির দশকে ড. টিএম বেড়ার লেখা Evolution and Myth of Creationism কোনোটিই ডারউইনের বিবর্তনবাদ অতিক্রম করেনি, বরং সমর্থন যুগিয়েছে বহুগুনে। ডকিন্স তাঁর প্রতিটি লেখায় তুলে এনেছেন বিবর্তনবাদের মৌলিকত্বকে। তিনি বারবার বলেছেন- এখন পর্যন্ত একটি ফসিলও ভুল জায়গায় আবিষ্কৃত হয়নি যেটি বিবর্তনবাদকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে!

d5

প্রজাতির স্থবিরতায় বিশ্বাসী মানুষদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি শোনা যায় তা হল- বনমানুষ থেকে বিবর্তিত হয়েই যদি মানুষের বিবর্তন ঘটে থাকে তাহলে সেটি এখন আর হচ্ছেনা কেন?

তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়ঃ তাৎক্ষনিক মিউটেশন বা জেনেটিক রিকম্বিনেশান দুটোই জীবের পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে ঘটে থাকে। ৪০ লক্ষ বছর আগের জলবায়ু তারতম্য যে মিউটেশান ঘটতে সাহায্য করেছে বর্তমান জলবায়ু যে হুবহু সেটিই করবে এবং একই প্রক্রিয়ায় করবে এটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। প্রকৃতির একটি খামখেয়ালিপনা যেমন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প এগুলো যদি এক বা দুইমিনিট পরে ঘটে তাহলেও সেগুলোর ফলাফল দুইমিনিট আগে ঘটা ফলাফলের সঙ্গে মিলবেনা! বিজ্ঞানী গুল্ড এসম্পর্কে বলেছিলেন, “বিবর্তনের ধারাটিকে যদি আমরা আবার বর্তমান থেকে পেছনের জুরাসিক কিংবা সারকিয়ান যুগের দিকে নিয়ে যাই তবে প্রাপ্ত ফলাফলও হুবহু মিলবে না সেকালের পাওয়া সবগুলো ফসিলের সঙ্গে। কেননা, তাৎক্ষণিক মিউটেশন নিজেই জানেনা সেটি কিভাবে ঘটবে!” একটি প্রজাতি থেকে বিভিন্ন প্রজাতি তৈরির নজির যেমন প্রকৃতিতে দেখা যায়, ঠিক তেমনিই দেখা যায় দুইটি জীবের একটি বৈশিষ্ট্যগত মিল পাওয়া গেলেও তাদের দুজনের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ দাঁ-কুমড়ো সম্পর্কের! যেমন মানুষের পায়ের অস্থির সাথে তিমি মাছের বিলুপ্তপ্রায় পায়ের অস্থির গঠনে মিল থাকলেও তারা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বিবর্তিত। তাই বলা যায়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি বা ততোধিক প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব যদি অন্যভাবে বা অন্যসময়ে ঘটত তাহলে বিবর্তনগুলোও হতো অন্যভাবে। সেক্ষেত্রে হয়ত মানব সম্প্রদায় উৎপত্তির প্রক্রিয়া শুরুই হতোনা!

আর সবচে অজ্ঞতার বিষয় হল চিড়িয়াখানায় ঝুলে থাকা বানর আর শিম্পাঞ্জী দেখে অনেকের করা প্রশ্নঃ যদি বানর থেকেই মানুষের উৎপত্তি ঘটে থাকে তাহলে এই বানরগুলো এখানে কি করছে? এক্ষেত্রে বলা যায়- অন্যান্য প্রজাতিগুলোর মতই মানব সম্প্রদায়ের বিকাশও একটা গাছের ডালের মতন, যার অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা। এই বিশাল গাছের পাতাগুলোর মতই একএকটি প্রজাতি হিসেবে সেগুলোরই আলাদা আলাদা ধারা তৈরি করেছে। অর্থাৎ একসময় শিম্পাঞ্জী, গরিলা, মানুষ এদের একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। সেই সাধারণ পূর্বপুরুষদের বিবর্তিত হয়ে একসময় ওরাংওটাংদের প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়। তখন বাকিরা প্রজননগতভাবে আলাদা হয়ে যায় পূর্ববর্তী প্রজাতির থেকে। এভাবেই ধারা উপধারা তৈরি করে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে এই সাধারণ পূর্বপুরুষটি থেকেই মানুষ এবং শিম্পাঞ্জীর প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। তারপর এরাও প্রজননগতভাবে আলাদা হয়ে পড়ে। কেননা, প্রজাতি হবার শর্তই হল অন্য প্রজাতির সঙ্গে প্রজননে অক্ষম হওয়া।
বিবর্তনের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হল এইডসের জীবাণু। এটি এক সেকেন্ডের মাঝে এত বহুবার বিবর্তন ঘটায় যে বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা এখনো এর কোন প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেননি। এইডসের জীবাণুর মতন অসংখ্য পরিবর্তন আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে যেগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছেনা।

মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং বৈচিত্র্যে ভরা। বিবর্তনের ইতিহাস হল একরকমের বৈজ্ঞানিক পিরিয়ডিক টেবিল যেখানে আদি এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে জটিল বহুকোষী প্রাণী এবং এদের মাঝামাঝি অবস্থান করা ব্যাক্টেরিয়া, সায়ানোব্যাক্টেরিয়াসহ সবগুলো গণ ও প্রজাতিকে এক সুতোয় গাঁথা যায়। চমকপ্রদ এই ইতিহাসের শুরু হয়েছে ডারউইনের মতন কৌতূহলী বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনায়, যার প্রতিটি কথাই লিখতে হয়েছে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। অন্যদিকে ধর্মের সঙ্গে বিবর্তনের সংঘর্ষ তখনই তৈরি হয়েছে যখন ধর্মগ্রন্থগুলোর কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক স্থবিরতার তত্ত্বকে মেনে নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে আবার অন্যদিকে ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে রক্তবিন্দু থেকে’- এমন কথাও বলা হয়েছে। কেননা রক্তবিন্দু থেকে বেড়ে উঠতে হলেও যে ধাপগুলো পেরিয়ে ভ্রূণ থেকে মানুষ হয়ে উঠতে হয় সেগুলোর সমষ্টিও আদতে বিবর্তন!

ডারউইনকে উদ্দেশ্য করে যখন খ্রিষ্টান ধর্মগুরু বিশপ স্যামুয়েল ঈশ্বরবিরোধী আখ্যা দেন এবং এর সমর্থনে থাকা আরেক বিজ্ঞানী হাক্সলিকে যিনি প্রশ্ন করেন তাঁর দাদা এবং দাদীর মধ্যে কে বানর ছিলেন, তখন বিখ্যাত বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলি’র করা মন্তব্যটিঃ যারা এতসব প্রমান, গবেষণা, যুক্তির পরেও বিবর্তন নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায়-

“যে ব্যক্তি তার মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কুসংস্কার ও মিথ্যার পদতলে বলি দেয়, তার উত্তরসূরি না হয়ে বরং আমি ওইসব নিরীহ প্রাণীদের উত্তরসূরি হতে চাইবো যারা গাছে বাস করে ও লাফিয়ে বেড়ায়!”

আধুনিক মানুষ জানে বিজ্ঞান কোনো তত্ত্বকে পবিত্র বা অপবিত্র ভাবেনা। বিজ্ঞান গতিশীলঃ যে গতিশীলতা প্রজাতিগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। হাজার বছরের বিশ্বাসকে লালন করার নাম বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসকে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তার সত্যতা বা মিথ্যাচারকে সত্যের আলোকে উন্মোচন করাই বিজ্ঞানের কাজ। বিবর্তন এতটাই প্রমাণিত যে সেটি ঘটেছে কি ঘটেনি তা নিয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। তাই কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কি বিবর্তনে বিশ্বাস করি? আমি প্রশ্নকর্তার কাছে তখন জানতে চাইব- আপনি কি বিশ্বাস করেন সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে? সে যদি তখন বিস্ময় নিয়ে বলে- এতে বিশ্বাসের কি আছে? সূর্য তো পূর্ব দিকেই উঠবে! আমি তখন আরেকটা বড় হাসি দিয়ে বলব- বিবর্তনেও বিশ্বাস অবিশ্বাসের বালাই নেই, আপনি বিশ্বাস না করলেও সেটা ঘটবে না করলেও সেটা ঘটবে!

তথ্যসূত্রঃ
১। The Ancestor’s Tale: Richard Dawkins
২। Wonderful life: Sir J. Gould
৩। Evolution as Fact and theory: SJ Gould
৪। Has Science Found God? : Stringer
৫। Evolution and Myth of Creationism: Dr. TM Berra
৬। Origin and Species by the means of Natural selection: Charles Robert Darwin
৭। Principle of Geology- Charles Lyell
৮। ডারউইন থেকে ডিএনএ এবং চারশ কোটি বছর- নারায়ণ সেন
৯। What is Evolution- Ernest Myer
১০। An overview on Human Genome Project- published by National Human Genome Research Institute, 2006.
১১। The compelete world of Human Evolution- Stringer and Andrews
১২। Unweaving The Rainbow- Richard Dawkins
১৩। Book of Genesis- The most important part of Bible
১৪। Was Darwin Wrong? – The National Geographic Magazine, Issue of November 2004
১৫। জীব বিবর্তন সাধারণ পাঠ- মূলঃ ফ্রান্সিসকো জে আয়ালা, ভাষান্তরঃ অনন্ত বিজয় দাশ, সিদ্ধার্থ কর।
১৬। BBC Documentary:The Incredible Human Journey- Part 1,2,3,4,5(find in youtube.com )।