ক্রিকেট খেলা আসলেই হ্যাপী নামটি সবার আগে হাজির হয়। ট্রল থেকে গালি সবকিছুতে হ্যাপী জড়িয়ে থাকে। রুবেল-হ্যাপীর মামলা মোকদ্দমা কিংবা এটা প্রণয় নাকি প্রতারণা কোনটাই আমার আগ্রহের বিষয় নয়। কিন্তু কাহিনি শুরু হওয়ার পর একটা বিষয় বরাবরের ন্যায় সামনে এসে হাজির হলো, মিডিয়ায় কাজ করা মেয়ে মানে খারাপ। পত্রিকা, ফেসবুক ইত্যাদির কমেন্ট অপশানে দেখা যায়- রুবেল খারাপ না ভাল তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও হ্যাপী যে খারাপ মেয়ে তাতে বেশিভাগ মানুষ নিশ্চিত। এর মূল কারণ হ্যাপী মিডিয়াতে কাজ করে। মিডিয়ার অভিনেত্রীরা কম বেশি সবাই খারাপ এমন ধারণা আমাদের রক্ষণশীল সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অভিনেত্রীরা কেন খারাপ অথবা কেন এই খারাপ ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হল তার জন্য আমাদের একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক।

নিম্নবিত্তদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল যাত্রা আর তথাকথিত শিক্ষিত ও আধুনিক মানুষদের বিনোদনের আধুনিক মাধ্যম হিসেবে আর্বিভূত হয় নাটক। বর্তমান মিডিয়ার পূর্ববর্তী সময়ে মঞ্চ নাটকই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। নাটক প্রদর্শীর প্রথম পর্যায়ে নারী চরিত্রগুলোয় পুরুষেরাই নারী সেজে অভিনয় করত। সামাজিক বাস্তবতায় নারীদের অভিনয় করা সম্ভব ছিল না। নারী অধিকার ও নারী সম্মান নিয়ে শ্রী চৈতন্যদেব কথা বললেও সামাজিক বাস্তবতায় অথবা ভীতির কারণে তিনিও নারীদের মঞ্চে ডাকেন নি। বরং চৈতন্যদেব নিজেও নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। চৈতন্যদেবের তিন শতাব্দী’র পর নারীরা নাটকে প্রথম অভিনয় করে। ‘কাল্পনিক সংবদল’ নামে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৫ সালে। তবে সেই নাটকে সমাজের তথাকথিত ভদ্র নারীরা ছিল না। ইংরেজ শাসনের ফলে কলকাতায় থিয়েটার চালু হয়। ইংরেজি থিয়েটারের সাথে বাংলা থিয়েটারও চালু হয়। তবে প্রথম পর্যায়ে নারী অভিনেত্রী ছিল না। আর পুরুষদের দিয়ে অভিনয় করাও খুব সহজ ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই নাটকগুলোতে নারী চরিত্র কম রাখা হতো। আর ওভাবেই নাটক লেখা হতো। তবে ১৮৩৫ সালে নবীবচন্দ্র বসু নামে একজন ধনীর উদ্যোগে একটি নাটকে একাধিক নারী অভিনয় করেন। তবে তারাও তথাকথিত ভদ্র নারী ছিল না। প্রথম পর্যায়ে নারী যৌনকর্মীদের দিয়ে অভিনয় করানো হতো।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দুই ভাগে দেখা হয়; ঘরের নারী ও বাইরের নারী। পুরুষের চোখে ঘরের নারী হতো নম্রভদ্র, শান্ত! যে কখনো কামার্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাবে না, স্বামীর পিটুনির প্রতিবাদ করবে না। বরং নীরবে শুয়ে থেকে যৌনতা উপভোগ করে স্বামীর সেবা করবে। সে শুধু স্বামীর ইচ্ছায়- অনিচ্ছায় স্বামীর কাছে অথবা দূরে থাকবে। আর শীৎকার শব্দটি শুধু বাইরের মেয়ে অথবা তথাকথিত ‘বাজারী মেয়েদের’ (স্যরি, শব্দটির জন্য) জন্য ছিল। নারীকে ঘরের নারী ও বাজারী নারীতে ভাগ করলেও পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটা ছিল না। উল্টো স্বামীর ফুর্তির জন্য স্ত্রীরা বাইজী পাড়ায় স্বামীকে দিয়ে আসত। অনেকে আবার লক্ষ টাকা খরচ করে রক্ষিতাও রাখতো। এগুলো করেও পুরুষ থাকে শুদ্ধ আর নাটকে অভিনয় করে নারী হয় বেশ্যা! যৌনতার নিয়ে পুরুষের এমন ভণ্ডামো আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নাটকে যারা প্রথম দিকে অভিনয় করত তারা অনেকে বারাঙ্গনার কন্যা ছিলেন, আবার অনেকে আসেন অভাব থেকে। সবাই যে ভাল অভিনয় করত তা বলা যাবে না। তবে অনেকে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যদিও পত্রিকায় এদেরকে ‘বেশ্যা’ বলে তকমা লাগিয়ে দিত। বেঙ্গল থিয়েটার নাটকে নারী অভিনেত্রীদের জন্য নতুন এক দিগন্তের সূচনা করে। যদিও তখনও নাটকে তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র মেয়েরা অংশগ্রহণ করত না। যারা অভিনয় করত তাদের কেবল নাচ ও গানের যোগ্যতা থাকত। নাটকের প্রতি ভালোবাসার কারণে কোন কোন পরিচালক নিজের স্ত্রীকে অভিনয় করার জন্য উৎসাহিত করতেন। যদিও তা সংখ্যায় নগণ্য ছিল। ১৮৮০ সালে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। প্রথমদিকে তা দেখার সুযোগ শুধু পরিবারের মানুষ ও ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।। রবীন্দ্রনাথ্ও তখন তাদের সাথে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্য তা সম্ভব হয়। যদিও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেও অনেক নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তারপরও নাটকে ঘরের মেয়েদের অংশগ্রহণের জন্য ঠাকুরবাড়ির অনেক বড় অবদান ছিল। তারা সেই সময়কার অচলায়তন অনেকখানিই ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এবার আসা যাক বর্তমানের কথায়। সেই মধ্যযুগ থেকে খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির। বিশেষত ধর্মীয় কারণে নারী যেহেতু হীন ও শয়তানের সহকারী হিসেবে চিহ্নিত এবং অভিনয় যেহেতু ধর্মীয় মতে নিষেধ সেহেতু এখানে যারা অভিনয় করেন তারা সবাই পাপী ও ছিনাল প্রকৃতির। তাই অনেক সময় দেখা যায় অনেক নারী অভিনেত্রী শেষ বয়সে অতিমাত্রায় ধার্মিক হয়ে ওঠেন। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে পুরুষ হলো পরমহংস। যারা শত কাদামাটিতে হাঁটলেও তাদেরকে নোংরা স্পর্শ করতে পারে না। আমাদের দৃষ্টিতে মিডিয়ার নারীরা খারাপ হলেও পুরুষেরা শুদ্ধ মানব। মিডিয়ার নারীদের ঘরের বৌ করতে নারাজ হলেও, বিছানার সঙ্গী করতে সবাই কম বেশি চিংড়ির মতন উৎসাহী।

অভিনেত্রী হ্যাপীকে নিয়ে যতো কমেন্ট পড়লাম তাতে সবগুলোতেই বক্তাই বলতে চাচ্ছেন হ্যাপী একটা খারাপ মেয়ে। কারণ সে মিডিয়ার জগতের মানুষ। আমাদের একটা অদ্ভূত মানসিকতা রয়েছে। আমরা নাটক, সিনেমা উপভোগ করি আবার সেই সাথে তাদের ঘৃণা করি। তাদের জীবনসঙ্গী করতে নারাজ, কিন্তু একরাতের সঙ্গী হতে রাজি হই। অভিনয় জগতে কোন নারী যদি খারাপ কাজই করে থাকে তাহলে সেই খারাপ কাজ কোন না কোন পুরুষের সাথেই তো করে। অথচ ধর্ষণের ঘটনায় দোষী শুধু মেয়েটা। নারীর শরীরে পবিত্রতার বর্ম পড়ালেও পুরুষের শরীরের তার লেশমাত্র্ নেই। ফলে পুরুষ বিয়ের আগে গন্ডা খানিক প্রেম করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়না বরং এটা পুরুষের স্বাভাবিক চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

অনেকে হয়তো বলবে নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটাও অস্বীকার করার জো নেই! তবে এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে বর্তমান সময়ে শুধু নারী না পুরুষও ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। দোষটা সিস্টেম ও দৃষ্ঠিভঙ্গির! যারা অভিনয় না করে গান অথবা নাচ করে সেসব নারীকে যে খুব একটা সম্মান দেওয়া হয় তাও নয়। বরং টাকার বিনিময়ে যেহেতু গান-নাচ করে, সুতরাং এটাও ছিনাল চরিত্রের নারী। এর প্রধান কারণ আমাদের মগজে সর্বদা ঘরের নারী ও বাইরের নারীর তত্ত্ব খেলা করে। ধর্মীয় ও রক্ষণশীল সমাজে যেহেতু বাহিরের নারী মাত্রই নষ্টা ও চরিত্রহীন সুতরাং এরা সবাই খারাপ এমনটা ধারণা নিয়ে আমরা বেড়ে উঠতে থাকি। তাই অনেক তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষের কাছে মিডিয়ার অভিনেত্রীরা বাহিরের নারী হিসেবে বিবেচিত হলেও তাদের সাথে একরাত উপভোগ করা বা করার ইচ্ছাটাকে খুব একটা অপরাধ জ্ঞান করে না।

সহায়ক গ্রন্থ- নারী ধর্ম ইত্যাদি-গোলাম মুরশিদ