ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে গেলে যে দৃশ্যটি সবার চোখে পড়বে তা হল; সবাই বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকাল আট টায় লাইব্রেরি খোলা হয়। লাইব্রেরিতে আসন সংকটের কারণে সকাল সাতটা থেকে লাইন ধরে শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশুনা বাদ দিয়ে কেন বিসিএস মুখী পড়াশুনা করছে তা নিয়েও অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে আমরা আলোচনায় না গিয়ে এক কথায় যেটা বলতে পারি তাহলো; দেশে বিভাগীয় সাবজেক্টে চাকরির সুযোগ-সুবিধা কম, শিক্ষকতায় অনীহা, এক বিসিএস প্রিপারেশানে সকল চাকরির পরীক্ষার পড়া হয়ে যায় তাই সবাই বিসিএস মুখী পড়াশুনা করছে। অনেকে ফাস্ট ইয়ার থেকে বিসিএস মুখী পড়াশুনা শুরু করে থাকে।

বিসিএস পড়াশুনা সবাই মোটামুটি গ্রুপ বেঁধে শুরু করে। বাংলাদেশে বিসিএস চাকরিতে ৫৬% কোটা নির্ভর নিয়োগ হয়। ফলে যারা কোন কোটাতেই আসে না তারা ৪৪% সিটের জন্য যুদ্ধ করে। ৫৬% কোটার মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% মহিলা কোটা, ১০% জেলা কোটা, ৫% উপজাতি কোটা, এবং বিভিন্ন পদে ১% প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করা হয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি নন কোটা-ধারী বিসিএস পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা-ধারীদের সাথে পড়াশুনা করে না। মানে এক গ্রুপে পড়াশুনা করে না। এর পেছনে ঈর্ষা অথবা কোটার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ আছে বলতে পারেন। কিছু শিক্ষার্থী নারী কোটার সমালোচনা করলেও নারীরা যেহেতু পিছিয়ে আছে তাই এক প্রকার দরদী হয়ে এই বিষয়ে চুপ থাকে, উপজাতিরা যেহেতু পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী তাই তাদের জন্য ৫% কোটা দেওয়াতে কেউ অখুশি না। আর প্রতিবন্ধীদের তো মানবিক কারণেই সাপোট করতে হয়। জেলা কোটা বিষয়টি দেশের সকল জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সৃষ্টি করা হয়। মানে যেই জেলা ছোট বা যে জেলার ছেলেরা বিসিএস খুব কম দেয় সেই জেলার কেউ ভাল রেজাল্ট করলে পছন্দের পদে সহজে নিয়োগ হয়। সকল শিক্ষার্থীরা এই জেলা কোটার সুবিধাটা পাবে।

বাংলাদেশের চাকরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের জন্য কোটা রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতিবছর এই কোটা গুলো পূরণ হতো না বিধায় বর্তমানে নাতি-নাতনি যোগ করা হয়েছে। ভার্সিটি জীবনের কাছের দুই বড় ভাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এএসপি ও ট্যাক্স অফিসার হয়েছেন। একজন দ্বিতীয় বারে এএসপি হওন অন্যজন ছয় বার পরীক্ষা দিয়ে ট্যাক্স অফিসার হোন। এরা কেউ কোটাধারী না। তাই কোন কোটা-ধারী চাকরি হয়েছে শুনলে প্রথমেই বলে; কোটাতে চাকরি হইছে এতো পাত্তা দেবার কিছু নেই। তোদের মেধা দিয়েই চাকরি নিতে হবে। কথাগুলো অভিমান এবং ক্ষোভের। ২০১২ সালের বিসিএস নিয়োগ পত্র দেখে ছিলাম। ১১০টি কোটাধারী এএসপি সিটের মধ্যে ১৯টি খালি ছিল (স্মৃতি থেকে বলছি দুই এক কম বেশি হতে পারে) তাতে কোন নিয়োগ হয়নি। অথচ বাংলাদেশে সরকারী স্কুলে ঝাড়ুদারের চাকরি নিতে মানুষ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দেয়, সেখানে কোটাধারীদের সিট খালি পড়ে থাকে।

৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়েছি রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার দাবীতে। পাকিস্তানীরা রাষ্ট্রভাষা উর্দু (উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র একটি অংশের ভাষা। উর্দু ভাষীরা সবচেয়ে বেশি বাস করে ভারতে) করল। রাষ্ট্রভাষা যদি উর্দু হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বাঙালি ও মাঠে কাজ করা বাঙালি এক শ্রেণিতে নেমে যাবে। কারণ দুইজনই উর্দু পারে না। যেখানে পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের চাকরি হতো খুবই কম সেখানে শিক্ষিত বাঙালি চাকরি পেতে আরও বেশি কঠিন হবে। ফলে শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই আন্দোলন। এই ইতিহাসটা এখানে বলার কারণ মধ্যবিত্ত স্বার্থের সাথে বিসিএস চাকরি জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মধ্যবিত্তরাই বিসিএস চাকরিতে বেশি প্রবেশ করতে চায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে এসে যখন দেখে কোটা পদ্ধতির নামে এমন রাষ্ট্রীয় বৈষম্য তখন কোটা প্রতি এক গুমোট ক্ষোভের জন্ম নেওয়া কি অস্বাভাবিক?

প্রতিটি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার রদবদল হয়। তার মানে প্রতি আসলে অসংখ্য নাম ছাটাই হওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য নামও যুক্ত হচ্ছে! দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হলিডে ফাইটার নামে একটা ব্যঙ্গাত্মক কথা প্রচলন ছিল। এর মানে বিজয় দিবসের দিন যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হতো। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে যখন দেখে এলাকার রাজাকারটিও তার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তখন ক্ষোভে সার্টিফিকেটটিও নিলেন না। এমন ইতিহাসও আছে। যাই হোক, কোটার জন্য কোন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কাউকে অসম্মান করতে দেখিনি। তবে তাদের সন্তানের রাষ্ট্র কর্তৃক এমন বাড়তি সুযোগ-সুবিধার জন্য অনেকেই সমালোচনা করে। কোটা প্রসঙ্গে আসলে যে কথাটি বলা হয় তাহলো; মুক্তিযোদ্ধারা কোটার জন্য যুদ্ধ করেনি কিন্তু রাষ্ট্র তাদের সম্মান অথবা আহত বা দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা যেন কিছুটা সুযোগ সুবিধা পায় তার জন্য এই ব্যবস্থা। সন্তান সুবিধা পাবে এতে কারো আপত্তি ছিল না কিন্তু বছর তিনেক আগে নাতি-নাতনিদের এই কোটা পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত করা হয়। এই পদ্ধতির বিরোধিতা অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও করে। নাতি-নাতনিদের সুবিধা দিলে অসুবিধা কোথায় তা বলার আগে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আর্মিদের বাড়তি সুযোগ সুবিধার কথাটা বলা প্রয়োজন বোধ করি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন বীরের পদে ভূষিত করার পাশাপাশি আরেকটি অদূরদর্শী সুবিধা প্রদান করে। তা হল; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দুই বছরের সিনিয়ারিটি লাভ করবে। এরকম বাড়তি সুবিধা সেনা বাহিনীর কোন নিয়মের মধ্যে পড়ে না। ফলে যাই হবার তাই হল; পাকিস্তান ফেরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সদস্যদের মধ্যে দ্বন্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধে অনেক সেনা সদস্য অংশ নিয়েছে যেমন সত্য তেমনি অনেকে বন্দি থাকা অবস্থায় অংশ নিতে পারেন নি। শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বেশির ভাগ নভেম্বর মাসে মুক্তিযু্দ্ধে অংশে নেয়। অর্থাৎ যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এমন একটা পরিস্থিতি ধারণা করা যাচ্ছে ঠিক সেই সময় এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। আবার অনেক সদস্য বাংলাদেশে থেকেই পাকিস্তানীদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান থেকে অনেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এই প্রমোশনের বদলে অন্যভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের সম্মান দেওয়া যেত। তাহলে সেনা বাহিনীর মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব শুরু হতো না। কারণ এই সিনিয়রিটির কারণে অনেক জুনিয়র পূর্বের সিনিয়রের সমমর্যাদায় অনেক ক্ষেত্রে আবার জুনিয়র সিনিয়র হয়ে গেছেন। ফলে এটা স্বাভাবিক ভাবে কারো পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় নি। এই বাড়তি সুবিধার কারণে সেনা বাহিনীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া যোদ্ধারাই। তাই স্বাভাবিকভাবে এই নাতি-নাতনি কোটার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এক প্রকার অশ্রদ্ধা আসে তাহলে এই দায় নিতে হবে সিস্টেমকে এবং যারা প্রণয়ন করেছে তাদেরকে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও যদি মেধার মূল্যায়নে চাকরি না হয়ে বরং দাদুর কর্মে চাকরি হয় তাহলে ক্ষোভ কার না আসবে বলুন? রাষ্ট্রীয় চাকরিতে ৫৬% কোটায় চাকরি হচ্ছে তাহলে বোঝাই যাচ্ছে রাষ্ট্র মেধাবী নয় বরং কোটা-ধারী আমলাতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম যারা কোটার মাধ্যমে চাকরি পাচ্ছেন তাদের এই বাড়তি সুবিধার কথা কর্মক্ষেত্রে কিংবা গ্রেজেটে প্রকাশ করা হয় না। মানে অন্য কাউকে জানতে দেওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গে কর্মকর্তাদের যুক্তি কাজের পরিবেশ বজায় রাখতেই এমন নিয়ম করেছে সরকার। মূল কথাটি হল; মানুষের হক নষ্ট করে চাকরি নেওয়া কর্মকর্তাদের অন্যরা সহ্য করতে পারে না। যারা কোটায় চাকরি নেয় তারা নিজেও এটি জানে যে, অন্য হক নষ্ট করে নিজেরা বিশেষ সুবিধায় চাকরি পেয়েছে। তাদের থেকে বেশি মেধা নিয়ে অন্যরা চাকরি পায়নি।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ভুয়া সনদে ধরে খেয়েছেন। এরকম হাজারো ভুয়া সনদ-ধারী আমলা বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীতে চাকুরী করছেন। ২০১২ সালে মুহসীন হলের এক বড় ভাই পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে পিতার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়েছেন। সবার নাকের উপর দিয়ে আমলাও হয়েছেন। আশা করি এই এক সার্টিফিকেট দিয়ে তার সন্তানরাও চাকরি পেয়ে যাবেন। যাই হোক। এমন হাজারো মানুষ ভুয়া সনদ নিয়েছেন কেউ ধরা খায় কেউ খায় না। যদি ধরি প্রতিটি নিয়োগে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বাদে বাদ বাকি শিক্ষার্থীদের জন্য আসন থাকে ৮০০ (কম বেশি সবসময় হয়) এর মধ্যে ৫৬% কোটায় গেলে আসন থাকে ৩৫২টি! বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ শিক্ষার্থী! ফলে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভের প্রবণতা বাড়ছে। উপরে যে বড় ভাইয়ের কথা বললাম; যিনি ছয় বার দিয়ে ট্যাক্স বিভাগে চাকুরী পেয়েছেন তিনি প্রতিবারই লাস্ট স্টেপ মৌখিক পরীক্ষার পর্যন্ত যেতেন এবং কোন বারই চাকরি হয়নি। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কম হওয়ায় লিখিত পরীক্ষায় পাশের পর মৌখিক পরীক্ষায় ৮০ (২০০ মধ্যে পাশ নম্বর ৮০) পেলেই চাকরি হয়ে যায়। মেধায় নয় কোটার ভিত্তিতে চাকরি হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ জন্মে। ভবিষ্যতে যদি এই ক্ষোভ আরও তীব্র হয় তাহলে দায়টা কার? মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও দেশ ভালের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। তাই দাদার দোহাই দিয়ে নাতি-নাতনীদের জন্য এতো বৃহৎ কোটা সিস্টেম বৈধতা দেবার কোন যৌক্তিকতা নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের ছিদ্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা তাদের নৌকায় বাতাস পায়, রাষ্ট্রে মেধার অবমূল্যায়ন হয়, শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ জন্ম নেয়। যা ভবিষ্যতে কোন সুফল আনবে না তা হলফ করে বলা যায়। এছাড়া একটি উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে গেলে মেধার অগ্রঅধিকার দিতে হয়, কোটায় নয়।