মানবী

মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কাহিনী এসে জড়ো হয়। কোনোটা প্রবল ঘোর লাগায়, কোনোটা আচ্ছন্নের মতো টানে। এটাও সেরকম- ঘর আর পথ, পথ আর ঘর, গল্প শোনা আর অনুভব। বহুদিন আগে : গাছ আর ঘাসে ভরা ছোট্ট এক পথ। সামনে শীতল্ক্ষ্যা আর তীরিবিনি খালের সংযোগ স্থল। এখানে আনমনে হেটে বেড়াতো এক কিশোর। কখনো প্রান্তে এসে দাড়াতো, সন্ধান করতো খোলা পৃথিবীর। তারপর হঠাৎ একদিন ছোট্ট নৌকা নিয়ে চলে যায় সে ধলেশ্বরীর বাঁকে। হাটতে থাকে তীর ধরে, পিয়াজ আর টমেটোর ক্ষেত, কি উজ্জল এক রোদেলা দুপুর! দেখতে পায় রোমের পথে ছুটেচলা বাণিজ্য জাহাজগুলোর ক্ষীণও রেখা। উয়ারি বটেশ্বর থেকে আনা শুভ্র পাথরের গুটিকা নিয়ে ছুটছিল সেইসব বহর। এরপর সেই কিশোর সময় নদীর তীর ধরে এগোতে থাকে। ঢুকে পড়ে রোমের য়িষ্ণু পটভূমিতে।

প্রবেশ করে প্রথম শতাব্দীর শেষার্ধে। মুখোমুখি হয় আমরণযুদ্ধরত মানুষের- ধনীদের আনন্দ দেওয়ার খেলার গুটি। শারীরিকভাবে শক্তিশালী দাসরাই তা ছিল। মৃত্যুই এ খেলার সমাপ্তি। রোমের স্টেডিয়ামে বসে অভিজাতরা এই খেলা উপভোগ করত। এই ঘটনা বুঝিয়েছিল মানুষ দিয়ে মানুষকে হত্যার দৃশ্যও অদ্ভুত আনন্দের – শিকার কৌশল থেকে অর্জিত এক উপজাত! এই দাসরাই হলো ইতিহাসের গ্লাডিয়েটর।

পাঁচ-ছয়তলা ভবন দিয়ে গড়ে উঠতো তাদের নগর, আবার ভিতের কারণে, কখনো আগুন লেগে প্রায়শ ভেঙেও পড়ত। এইভাবে সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত, ভূমিধ্বস আর বিপর্যয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে পুরো রোম। অনেকটা বহমান তুরাগ, বুড়িগঙ্গা আর বালুনদী দিয়ে ঘেরা এই শহরের মতো, রক্তনালীর মতো ঘিরে থাকা এই নদীগুলোর মতো, ক্ষমতার লোভ আর অজ্ঞতায়, পঁচে গিয়েছিল রোমের প্রথম শতাব্দী। ভোগ আর বিপন্নতায় ভরা সব জীবন। অস্থির হয়ে ওঠে কিশোর, ছুটতে শুরু করে। বিরামহীন পথ চলা তার, পরিণত হয় ক্লান্তিহীন এক পথিকে।

মানবী, গত কয়েকদিন ধরেই ছুটে চলেছি। সুন্দরবনের মধ্যেদিয়ে অবিরাম এই ছুটে চলা। নদী আর খাল। খাল আর নদী। ঢুকে পড়ি শিবসা নদী হয়ে সরু এক খালে। গাছ আর লতাপাতায় ভরা দুপাশ। জাহাজের এসে পড়া গোলপাতার ডালগুলো দিয়ে কেমন ছায়াচিত্র তৈরি হচ্ছে। প্রতিবাকেই অন্ধকার আর রোদের বুনট জালে স্বপ্নগুলো যেন খেলা করছে। জাহাজও ছুটছে খালের আকাবাকা পথে। কিন্তু শেষ বিকেলের আলো আমাকে বারবার নিয়ে যাচ্ছিল গ্লাডিয়েটর আর স্পার্টাকাসের কাছে।
তা পৌছে দিয়েছিল রোমের আপ্পিয়ান পথে। শুনতে পাচ্ছিলাম ক্রুশে ঝুলে থাকা ছয় হাজার মৃত্যুর প্রতীায় থাকা দাসের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদই যেন রূপ নিয়েছিল স্পার্টাকাসের মানবিক মুক্তির পদযাত্রায়। দেড় হাজার বছর পরে তা যেন থমকে দাড়ায় একই জায়গায়: আগুনে পোড়ারত জিওর্দানো ব্রুনো বলছিল: অন্ধ বিশ্বাস আর চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির কথা; সূর্যের চারিদিকে আবর্তন করা মানুষ হলো মহাজাগতিক পথের পথিক। মানবী আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম পৃথিবীর পথে হাটারত বহুযুগের এইসব পথিকের মানবিক স্রোতে। পায়ে হেঁটে, ক্ষুদ্র ডিঙ্গি নিয়ে বিশাল নদী, এমন কি সমুদ্র পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে মানুষেরা – সেই মহাঅভিপ্রয়ানের সময় থেকে কৃষি উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত কতশত অর্জন আর অশ্রু নদীর জল।

হাজার হাজার বছর মানুষ হেটেছে যাযাবরের মতো। কখনও তৃণভূমির অঞ্চলে, কখনও খোলা প্রান্তরে, সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ি গিরীখাতে, কখনও গভীর জঙ্গলে। পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছিল, শুধু খাবারের সন্ধানে, টিকে থাকার জন্য, মানবী। কৃষি উদ্ভাবনই তাকে স্থিরতা দিয়েছিল। প্রতিদিন খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়ার নিয়তি থেকে সে মুক্তি পায়। অনুভব করে নতুন কিছু, তৈরি করে ঘর। ঘর স্থিতিশীলতা দেয়। নারীরাই তা এনে দিয়েছিল। মাঝেমধ্যে মনে হয়, স্থিতি এমন এক ব্যাপার, যা মানুষকে আত্মমগ্ন করে, বিশ্ব চরাচরে নিজের অবস্থানকে অনুধাবন করায়: কোথা থেকে আমরা এসেছি, কোথায় বা যাব? শিকড়ের অনুসন্ধান আর ওই মহাকাশে নক্ষত্রের রহস্য উম্মোচনকি একই ব্যাপার?

মানুষ ঘর বেঁধেছিল বহু প্রজন্মের স্বপ্ন নিয়েই। তা জন্ম দিয়েছিল আরও বড় অনুভবের। সেই প্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছিল পথে প্রান্তরে। পৃথিবী পরিণত হয়েছিল মানবজাতির বসত গৃহে। মাঝে মাঝে মনে হয় হাজার প্রজন্মের অনুভব দিয়ে ঘিরে রাখা এই পৃথিবী যেন মানবী তোমার হৃদয় – এক মানবিক প্রান্তর।
মানবী, তুমি না বলেছিলে, ঘর হলো স্থিতিশীলতা, ঘর হলো অনুভব, একীভূত হওয়া। নিবির বনভূমির মধ্যেদিয়ে হাটা। বৃক্ষ, ঝরনা, উন্মুক্ত আকাশের প্রান্তর- একটা নির্ভাবনার আশ্রয়। মানবিকতার পথে এক ধাপ। ঘর হলো সাময়িক বিরতী – আরও দূর যাত্রার প্রস্তুতি। কৃষিকাজ উদ্ভাবনের ১৬ হাজার বছর পরে সে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। এবার তাকে নক্ষত্রের পথে যেতে হবে।

মনে আছে, কোনো এক সন্ধ্যায়। অন্ধকার ভেদ করে ছুটেছিলাম, হীম শীতল অন্ধকার। ছুটে চলেছিলাম ক্ষয়িষ্ণু নগরীর পথ ছেড়ে। এক অনির্দিষ্টের পথে। যন্ত্রাযানের একটানা শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল বাতাসের ঝাপটায়। ফেলে আসা অতীত আর অনাগত ভবিষ্যত কেমন ডেকে চলেছিল। মৃদু উষ্ণতা আমাদের ঘিরে রেখেছিল। ছুতে চেয়েছিলাম তোমাকে, মানবী তোমাকে। কিন্তু আমি ছিলাম ঘর আর পথের মাঝে ভাসমান প্রবাহে। ফিরে গিয়েছিলাম শীতলক্ষা নদীর তীরে এক অপরূপ কৈশরে। যেখানে সময় থমকে দাড়িয়ে আছে। এখনও কিশোরেরা সেই খাল আর নদীর মোহনায় খোলা পৃথিবীর সন্ধান করে। যেখানে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে আমি দেখতাম আপন মগ্নতায়। যেমন দেখেছিলাম তুরাগের প্রান্তরে, যমুনার তীরে, মেঘনার অববাহিকায় অথবা ছুটেচলা যন্ত্রযানে ওই চোখের গভীরে লক্ষতারার ভীড়ে। তাই না মানবী।

আগস্ট ২০১৩