মানুষ হত্যা করতে কী দরকার?

ভেবে দেখলাম আসলে কিছুই দরকার নেই, খালি হাতেই হত্যা করা যায়। অত্যন্ত নগণ্য ও সহজলভ্য অস্ত্র দিয়েও হত্যাকাণ্ড সামাধা করা সম্ভব। মানুষ হত্যার জন্য বড় কোন আয়োজনের প্রয়োজন নেই।

মানুষ প্রকৃতপক্ষে খুব দুর্বল একটি প্রাণী। যেখানে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হাঁটতে শিখে সেখানে মানুষকে অন্তত বছর খানেক অপেক্ষা করতে হয় হাঁটা শিখতে। বাঘের বাচ্চারা দুই বছর বয়সেই ভালভাবে শিকার ধরতে পারে। যেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা স্বাবলম্বী হয়ে যায়, নিজের খাদ্য নিজেই শিকার করতে শিখে যায় সেখানে মানুষ পরিপূর্ণ স্বাবলম্বী হতে ২০/২৫ বছর পর্যন্ত সময় নেয়। আমাদের এই দূর্বলতার কারণ হচ্ছে, আমরা একে অন্যের উপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল এবং আমরা একে আপরের উপর নির্ভর করতে পারি অনেক ভাবেই। আর পরস্পরের উপর নির্ভর করেই আমরা গড়ে তোলেছি সভ্যতা।

এক সময় মানুষ হানাহানির মধ্যে, নৃশংসতার মধ্যে ডুবে থাকত। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বর্তমানে আমরা যে ‘মানবিক সামাজ’ এর ধারণা পোষণ করি তার কল্পনাও কষ্টকর ছিল। একসময় আবার দাসপ্রথা ছিল এবং তা সমাজ ও ধর্মে স্বীকৃত ছিল। এক দেশ সুযোগ পেলেই আরেক দেশকে আক্রমণ করত, বিপুল পরিমাণ প্রাণসংহারেও কারো কিছু আসত-যেত না। এর মধ্যে আবার দুর্ভিক্ষ ছিল, মহামারী ছিল। বর্তমানে যেসব রোগকে আমরা পাত্তাই দেই না, সেসব রোগেও অনেক এলাকার মানুষ উজাড় হয়ে যেত। সংগত কারণেই মানুষের গড় আয়ু ছিল কম। Steven Pinker এর এই ভিডিও দেখেন-

এসব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে এসেছি বর্তমান অবস্থানে। বিজ্ঞান এগিয়েছে, তাই মানুষ এখন আর আগের মত মহামারীতে মরে যাচ্ছে না, জীবন যাত্রা হয়েছে সহজ, নারী-পুরুষ সবাই কম বেশি শিক্ষা লাভের অধিকার পেয়েছে। বর্তমানে একজন সাধারণ মানুষ যেসব সুবিধা পাচ্ছে তা মধ্যযুগের একজন প্রতাপশালী রাজাও পেতেন না। এই যে আমরা এগিয়ে গেলাম তা কখনো সহজ ছিল না। সব সময় সভ্যতার বিরুদ্ধে, মানবিকতার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছে তাদের হীন স্বার্থের জন্য।

যা বলছিলাম, মানুষ একটি দুর্বল প্রাণী। তাই একজন প্রকৃত মানুষ কোনোভাবেও আরেকজন মানুষকে আঘাত করার কথা ভাববে না। মানুষের সহযোগিতার দরকার, সহযোগিতা ছাড়াই সে যেখানে বাচবে না সেখানে আবার আঘাত করার চিন্তা আসবে কেন? বলতে গেলে কোনো সভ্য সমাজেই বড় অপরাধীকেও শারীরিক শাস্তি দেয়া হয় না।

সেই অবস্থায় কিছু বর্বর জঙ্গিরা মানুষকে হত্যা করার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছে তাদের সকল সাফল্য এবং সেইসব মানুষদের তারা হত্যা করতে চায় যারা সবসময় শান্তির পক্ষে, আলোচনায় বিশ্বাসী ও আগ্রহী এবং কোনদিন কাউকে আঘাত করার চিন্তাও তারা করেন নি।

বলি, কয়েক কোটি ঘাতক-জঙ্গির ঘিলু একত্র করলেও তা কি একজন অভিজিৎ, অনন্ত বিজয়ের সমান মেধা ধারণ করতে পারবে? এসব জঙ্গিদের অর্ধেক হয়ত ডায়রিয়ায় মারা যেত যদিনা বিজ্ঞান আজকের অবস্থায় পৌছত, বাকি অর্ধেক কারো দাস হয়ে থাকত, এবং এক অংশ কোথাও হানাহানি করে আগেই মারা যেত। এরা এখন প্রযুক্তিকেও ব্যবহার করছে মানুষ নিধনে। সেদিন দেখলাম তারা মানুষ হত্যা করার নানা উপায় নিয়ে একটি বই তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে রেখেছে। আরে নির্বোধ, মানুষ হত্যার জন্য কি এতো মাথা খাটাতে হয়? আরেকবার দেখলাম কিভাবে রান্নাঘরে বসে বোমা বানাতে হয় তার ফর্মুলা দিচ্ছে! জেএমবি ৬৩ টি জেলায় বোমা হামলা করে, নিরীহ মানুষদের হত্যা করে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। এসব বোমা না মেরে, বোমা বানানোর ফর্মূলার পেছনে না ঘুরে, মানুষ হত্যার উপায় বের না করে, কিভাবে মানুষকে বাচানো যায়, সাহায্য করা যায় তা নিয়ে কি ভাবা যেত না? কারো মতাদর্শ পছন্দ না হলে তাকে আঘাত না করে আলোচনা করা যেত না যেখানে তিনি নিজেই আলোচনায় বিশ্বাসী, প্রস্তুত এবং এক্ষেত্রে সহজলভ্য। কেউ যদি কোনো কিছুর সমালোচনা-নিন্দা একবার করে তবে কি এর বিপরীতে হাজার বার প্রশংসা-স্তুতি করা যেত না, কেউ বিপক্ষে একবার লেখলে হাজার বার পক্ষে লেখা যেত না? না, তারা এসবের দ্বারে-কাছেই যায় নি। সোজা মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়েছে, এটাই তাদের কাজ কারণ তারা অন্ধকারের প্রাণী, অন্ধকারকে ছড়িয়ে দিতে তারা বদ্ধ পরিকর।

কিন্তু আমাদেরকে ভাবতে হয় মানুষকে কিভাবে বাচানো যায় তা নিয়ে। এজন্য আমরা ছুটে যাই কারো রক্তের প্রয়োজন হলে। আমরা মরণোত্তর দেহদান-চক্ষুদান করে যাই যাতে তা মানুষের কাজে লাগে। বসে বসে আয়েশি জীবন যাপন না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অন্ধকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাই যাতে মানুষের জীবন আরেকটু সুন্দর হয়। আমাদের লড়াই চলবে অত্যাচারিতের পক্ষে, দূর্বলের পক্ষে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে এবং আমরা আরো এগিয়ে যাব মানবিকতার পথ ধরেই। এ লড়াই শুরু থেকেই চলে আসছে এবং চলবে; মানবিক বোধশক্তি সম্পন্ন সকল মানুষ আমাদের সাথে একদিন না একদিন দাঁড়াবেই।

ধর্মান্ধতা থাকবে না, জঙ্গিরা থাকবে না
মানুষ থাকবে, মানবিকতা থাকবেই।