(এই লেখাটি অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরে লিখেছিলাম; ইতিমধ্যে ওয়াশিকুর বাবু আর অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার মধ্য দিয়ে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গেছে। কাজেই লেখাটির বিষয়বস্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে শেষোক্ত দু’জনের জন্যও প্রযোজ্য হয়।)

একটি শিশুর যখন জন্ম হয় তখন সে একটি জড় বস্তুর মতো যার কিছু অনুভূতি থাকে এবং সেই অনুভূতিগুলোর প্রতি সাড়াব্যঞ্জক কিছু প্রতিক্রিয়া থাকে।ধীরে ধীরে সে পরিবেশের সাথে, পরিবার ও সমাজের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে চেতনাপ্রাপ্ত হয়, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় এবং তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। এভাবেই শিশুটি শৈশব, অতঃপর কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পদার্পণ করে।শিশুর মানসিক বিকাশে এবং জ্ঞান আহরণে যেমন তার পারিপার্শ্বিক মানুষের অবদান থাকে তেমনি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেও সে জ্ঞান লাভ করে। এভাবেই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে একজন ব্যক্তির জ্ঞানের ভাণ্ডার বিকশিত হতে থাকে।তবে সবার তা সমানভাবে হয় না।কিছু কিছু মানুষের জ্ঞানার্জন হয় শুধুমাত্র প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিগত কারণে। আর কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা নিজের অনুসন্ধিৎসা, প্রজ্ঞা, শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে জ্ঞানের পথে ধাবিত হন।এই দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষদের ঐকান্তিক ও নিরলস শ্রমের অবদানে তৈরি হয়েছে আজকের সভ্য পৃথিবী।

তবে সভ্যতার বিকাশের কোনো প্রান্তিক বিন্দু নেই। সভ্যতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। জ্ঞানের অগ্রযাত্রা এবং তার পরিবর্তন ও পরিমার্জন সভ্যতার বিকাশে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং তার ফলে পূর্ববর্তী জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনকি নৈতিকতার সংজ্ঞাও আমূল পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তাই সভ্য সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরিবর্তনশীলতা। যে সময় যত সহজে পরিবর্তন মেনে নিতে পারে আমরা সেই সমাজকে ততোই সভ্য হিসেবে দেখতে পাই। কিন্তু মানুষ একটি বিবর্তনপ্রক্রিয়াজাত পণ্য। এই পণ্যটি কোনো সুদক্ষ হাতে নির্মিত নয় আর তাই এর রয়েছে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ খুব সহজে তার সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া মানুষের রয়েছে কিছু নেতিবাচক আবেগ। এসবের সম্মিলিত প্রভাবে মানুষ কূপমণ্ডুকের মতো আচরণ করে যে তার সীমাবদ্ধ, পরিবার ও সমাজপ্রসূত জ্ঞানের বাইরে নতুন কিছু গ্রহণ করতে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে অপারগতাজ্ঞাপন করে।এদের মধ্যে একটি শ্রেণি সভ্যতার অগ্রগামিতায় বাধাসৃষ্টি করে। তারা তাদের মূলভিত্তির মতবাদ আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চায় এবং অন্যদেরও তাদের মতবাদগুলো গ্রহণ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। এভাবেই মৌলবাদের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের আলোচনার প্রথম শ্রেণীর মানুষদের একাংশ এভাবে মৌলবাদী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আর সমাজের একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির মানুষ শৈশবকালীন নানা ঘটনা, পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনার মাধ্যমে বিকল্প চিন্তা করতে শেখে। তারা বিনা বাক্যে সবকিছু মেনে নেয় না বরং সবকিছু তলিয়ে দেখে সত্য উদ্ঘাটনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরা পরিবারের ও সমাজের চাপিয়ে দেওয়া মতবাদ উপেক্ষা করতে শেখে এবং এদের একটি অংশ তার বিরোধিতাও করে। মৌলবাদের সীমাবদ্ধতা এবং সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সেগুলোর প্রতিবন্ধকতাগুলো তারা যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে এবং সেগুলো নিয়ে অগ্রগামী হয়। তারা প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার অনুমিত দর্শনের ঊর্দ্ধে উঠে মূল কার্যকারণগুলো খুঁজে বের করে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং এভাবেই তৈরি হয় বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র। এভাবেই অতিপ্রাচীন কাল থেকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের প্রথাবিরোধিতার মাধ্যমেই সূচিত হয়েছে সভ্যতার অগ্রযাত্রা।

আমাদের আলোচনার অভিজিৎ রায় ছিলেন এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের অন্তর্গত। অভিজিৎ রায়ের পিতা অজয় রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। একই সাথে তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তচিন্তার প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ। সেই সূত্রে অভিজিৎ রায়ের বিজ্ঞানমনস্কতা ও মুক্তচিন্তার প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার থেকেই অর্জিত। পরিবারের শিক্ষা যথাযথ ভাবেই কাজে লাগিয়ে তিনি মুক্তমত প্রসারে কাজ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।বাংলা ব্লগিং-এর ইতিহাসে তিনি শুরু থেকেই জড়িত এবং সক্রিয়ভাবে মুক্তমত প্রকাশের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই বাংলা ব্লগগুলোতে শুরু থেকেই মুক্তবুদ্ধি চর্চা, মুক্তমত এবং যুক্তিবাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি মূলত বিজ্ঞানের মানুষ এবং একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে কেন যাবতীয় কুসংস্কারচ্ছন্নতা,ধর্মান্ধতা দূর করতে হবে,কেন সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে,কেন সবকিছু যুক্তির মাপকাঠিতে দেখতে হবে সেসব তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। তিনি ছিলেন সমসাময়িক সবচেয়ে শক্তিশালী বিজ্ঞান লেখক।বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর মোট আটটি বই তিনি প্রকাশ করেন। সেগুলোতে বিভিন্ন জনপ্রিয় ও সর্বাধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন বিবর্তন বা সমকামিতার মত আমাদের সমাজে অপ্রচলিত, ট্যাবু হয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

২০০৬ এর দিকে বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে বিস্ফোরণ ঘটে।সেই সময় প্রথম বাংলায় একটি উন্মুক্ত ব্লগসাইট সামহোয়্যারইন ব্লগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আদর্শগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ব্লগারেরা বিভাজিত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। অনলাইনে শুরু হয় মুক্তমত, যুক্তিবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারের আন্দোলন। এই আন্দোলনের পালে হাওয়া দিয়ে গড়ে ওঠে সচলায়তন, আমার ব্লগ, মুক্তমনা। ধর্মান্ধতা, কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে কলম চলতে থাকে অবিরত। এই সময় অভিজিৎ রায় মুক্তমনার গোছ-গাছ নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চালু হয়ে যায় মুক্তমনার বাংলা ব্লগ। অভিজিৎ রায় বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারের প্রগতিশীল লেখকদের সাথে যোগযোগ করে তাঁদের মুক্তমনামুখী করতে থাকেন। সেই সাথে নিজেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কলম চালিয়ে যেতে থাকেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল এমনকি সমমনাদের বাক্যবাণেও অপদস্থ হতে হয়েছে।

কিন্তু তিনি দমে যান নি। কখনো অন্য মুক্তমনাদের সাথে নিয়ে কিংবা কখনো একাকী এসব আক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ২০১২ এর শুরুর দিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চেকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি গোষ্ঠী যখন এর কর্মীদের নাস্তিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চক্রান্তে ব্যস্ত ছিলো যার ফলে চারজন প্রগতিশীল ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, রাসেল পারভেজ, মশিউর রহমান বিপ্লব এবং সুব্রত অধিকারী শুভকে গ্রেফতার করা হয় তখন তিনি যাবতীয় তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলকানা ব্লগারদের বিষোদ্গারের ও নীরবতার প্রতিকূলে একাকী তাঁদের পক্ষ হয়ে লড়াই করে গিয়েছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে, পত্র-পত্রিকায়, বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উজ্জীবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

এসবের পাশাপাশি দলবাজ আর প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখে ছাই দিয়ে একে একে জনপ্রিয় হতে থাকে তাঁর “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”, “সমকামিতা”, “অবিশ্বাসের দর্শন”, “বিশ্বাসের ভাইরাস”, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” এর মতো গবেষণাধর্মী বই। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও লেখালেখির ব্যাপ্তি ছড়িয়ে রয়েছে অনেক বিশাল এলাকা জুড়ে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস সবকিছুতে তিনি তাঁর সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দৃঢ়তার সাথে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি সবকিছুই। বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের বিতর্কিত অধ্যায়ের সমালোচনা করেছেন অসীম সাহসিকতায়। রবীন্দ্রনাথের সাথে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রায় বিস্মৃত ইতিহাস গবেষণা করে তিনি তুলে এনে রচনা করেছেন,“ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো:এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে”।

কোনো সমাজেই নৈতিকতার ভিত্তিগুলো খুব মসৃণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। প্রত্যেক সমাজে মৌলবাদী, ধর্মান্ধগোষ্ঠীগুলোর সাথে সমাজের প্রথাবিরোধী একটি ক্ষুদ্র অংশকে প্রাণান্তকর পরিশ্রম, অত্যাচার, নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েই আধুনিক প্রগতিশীল সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে মৌলবাদীদের অন্ধত্বের আর প্রতিক্রিয়াশীলতার বলি হয়েছেন সক্রেটিস, হাইপেসিয়াসহ আরো বিপুল পরিমাণ মুক্তচিন্তার মানুষ। মধ্যযুগে মৌলবাদের শিকার হয়েছিলেন গ্যালিলিও, গিওর্দানো ব্রুনোসহ আরো অনেকেই। বাংলাদেশে গত কয়েকযুগে মৌলবাদীদের হামলা ও প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন অনেক প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ যাদের সর্বশেষ সংযোজন অভিজিৎ রায়। অভিজিৎ রায়ের আগেও বিভিন্ন সময় অনেকেই ধর্মান্ধদের চাপাতির তলে জীবন বলি দিয়েছেন কিংবা হুমকির মুখে এবং রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। অভিজিৎ এই হুমকি উপেক্ষা করেই তাঁর লেখালেখি চালিয়ে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এবং তাঁর সমমনা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা তাঁদের জীবনেও এসব হুমকি-ধামকির কোনো প্রভাব পড়তে দেন নি। তিনি কখনোই মনে করতেন না বিনা যুদ্ধেই মুক্তমত ও মুক্তচিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই ব্যপারে তিনি নিজেই বলে গিয়েছিলেন, “যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোঁরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জেনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়ি নি।আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।” স্বাধীনভাবেই তিনি তাঁর জীবন যাপন করতে চেয়েছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হলেও বিভিন্ন সময় বইমেলায় হলেই তিনি ছুটে এসেছেন দেশের টানে। পাঠক-লেখকদের সাথে নিয়মিত আড্ডা দিয়েছেন নির্ভীক চিত্তে।

হাজারো সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এই সমাজ। কোনো একটি সমস্যা সমাধান করতে গেলে আরো অনেক রকমের সমস্যায় আমাদের জড়িয়ে যেতে হয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, জনসংখ্যার চাপ, রাজনৈতিক অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা, দূর্নীতি, অসহিষ্ণুতা এসব কিছুর চাপে নাগরিকদের জীবন অতীষ্ঠ। সেই সাথে রয়েছে তীব্র আদর্শিকতার দ্বন্দ্ব। আমাদের সমাজের মত এতো মত, এতো পথ এতো আদর্শ আর এদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এত দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রাখা যায়। প্রতিক্রিয়াশীলতা, কুটিলতা আর ধর্মোন্মাদনা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এসব সংকট নিরসনে যাদের এগিয়ে আসার কথা সেই সুশীল সমাজ আর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় লেজুড়বৃত্তি আর উচ্ছিষ্টভোগিতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রগতিশীল গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বহুধাবিভক্তি এবং কাদাছোঁড়াছুঁড়ির সুযোগ নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী। তাই ক্যানিবালিজমেও এদের আগ্রহের ঘাটতি নেই। যার ফলে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারীরই মুখে কোনো রা নেই। নিজের পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমর্থন আর আনুকূল্য প্রত্যাশী এবং ঈর্ষান্বিত অনেকেই আবার পরোক্ষভাবে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিজিৎকেই দায়ী করার চেষ্টা করছেন। অথচ নগরে আগুন লাগলে দেবালয় যে রক্ষা পায় না সেই বিষয়টি তাঁরা বেমালুম ভুলে আছেন। ফলস্বরূপ, “বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না” জাতীয় বিষ্ঠাও প্রসূত হয় অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল আর একদা স্বঘোষিত নাস্তিকের কলম হতে। এসবের সুযোগেই ধর্মান্ধ কাপুরুষরা একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।

ফলে অভিজিৎ হত্যার দায় বিভ্রান্ত, বহুধাবিভক্ত বাম আর সুশীলদের উপরও কম আরোপিত হয় না। স্বাধীনতার পর হতেই নানা ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে এরাই আজকের এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রতিষ্ঠা করেছে। বিভিন্ন সময় এদের প্রশ্রয়ে এমনকি আশ্রয়ে এই গোষ্ঠী জেঁকে বসেছে সর্বত্র।এবং তার ফলেই আজ এদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে দেশের প্রগতিশীলতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার আন্দোলন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতকিছুর পরেও কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই নিজ নিজ আখের গোছানোর তাগিদে বিভেদের মন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছেন এবং একই সাথে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে পথ করে দিচ্ছেন। অপর দিকে প্রতিক্রিয়াশীলদের নানাবিধ কুকর্মে রাষ্ট্রীয় নীরবতা এসবের প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রবলভাবে। মৌলবাদী হামলার ঘটনার কোনো মামলারই এখন পর্যন্ত যথাযথ বিচার হয় নি; উল্টো রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় মুক্তচিন্তার কর্মীদের উপর নানাভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। এতে ভবিষ্যতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।

তবে এতসব নেতিবাচক তথ্যের ভিড়েও আশার বাণী হচ্ছে, দমন-পীড়ন, নির্যাতন আর হত্যার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার প্রসার বন্ধ করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রগতিশীল আন্দোলনকারীরা দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েই অনেক সমাজে পরিবর্তন এনেছিলেন। তাছাড়া এর জন্য কোনো সোজা-সাপটা রাস্তাও নেই। সভ্য প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পেছন থেকে ছুরি-চালানো কাপুরুষ কূপমণ্ডুকদের মোকাবেলা করেই তা করতে হবে। আইডিয়ার মৃত্যু নেই। একজন অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর চিন্তা-চেতনা হাজারো অভিজিতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অভিজিৎ রায়ও তা জানতেন। তাই তিনি মৌলবাদীদের হুমকি-ধামকিতেও তাঁর স্বাধীন চিন্তাভাবনা, স্বাধীন জীবন-যাপন বিসর্জন দেন নি। যাঁরা প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদেরও বিষয়টি মাথায় রেখেই চলতে হবে।