ফ্যাসিবাদ মূলত মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মুল্যবোধ গুলোকে পুঁজিবাদের মোড়কে নতুন ভাবে পরিবেশন করবার একটি আধুনিক ধারনা, যা পুঁজিবাদের একটি অবশ্যম্ভাবি পরিণাম।
খুব সংক্ষেপে, ফ্যাসিবাদ হল সমাজে ক্ষমতাসীন ধনী এবং ক্ষমতার সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে গরিব আর মেহনতি মানুষদের উপর অক্ষুণ্ণ রাজত্ব করার এক ব্যবস্থা, যেখানে সংসদীয়, আইনি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে অকার্যকর করে তোলা হয়, যেন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের দাবি গুলো ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে ওঠে এবং অপ্রধান দাবী গুলো প্রধান হয়ে ওঠে।
রোমা রঁল্যা বলতেন, ফ্যাসিজমের মুখোশ একটি নয়।
যে কোন রূপই সে ধারণ করতে পারে; অঙ্গে কখনও সামরিক বেশ, কখনও বা ধর্মযাজকের পোশাক। রূপে কখনও ধনতন্ত্রী, কখনও বা সমাজতন্ত্রী। তরল সংস্কৃতির সব ধরনের মিশ্রনের মাঝেই সে ছড়াতে পারে তার জীবানু; তবে এর যে মুখোশটি সার্বজনীন, সর্বত্রই তা এক – “জাতীয়তাবাদী”।
সবকিছুকেই সে জাতি ও জাতির সাথে একাত্মকৃত একনায়ক রাষ্ট্রের প্রাধান্য স্বীকারে বাধ্য করে, যেন সব কিছুকেই সে শৃঙ্খলিত করতে পারে।
জাঁ পল সার্ত্রে আরও স্পষ্টভাবে এর মৌলিক নির্ণায়ক স্থির করে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদের চরিত্রকে তার শিকারের সংখ্যা দিয়ে বর্ণনা করা যায়না, সেটা যায় কোন পদ্ধতিতে সে শিকার করছে তার পদ্ধতিটি দেখে।
প্রাথমিক ভাবে ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগীদের প্রতিনিধিত্বকারী দল বা সরকার প্রধান তাঁর আপাত জনপ্রিয়তার ছায়াতলে খুব সুচারু ভাবে এই নাগরিক অধিকার গুলো কে হরণ করেন, যেন একটি জনপ্রিয় মুখ্য দাবীকে কেন্দ্র করে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং অন্য সকল দাবিগুলোকে গৌণ করে তোলে।
জাতীয়তাবাদ, বা অমীমাংসিত জাতীয় দাবী, বা বর্ণবাদ, বা লিঙ্গ বৈষম্য, বা ধর্মীয় প্রণোদনা সাধারণত অধিকার হরণের আড়াল হিসেবে কাজ করে।
এই পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের কিছু আচরণ প্রবল জনসমর্থনও আদায় করে নেয়, কারন তা বিশেষ কিছু লোকের কর্মসংস্থান করে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলো চিরকালই নিজ নিজ স্বার্থে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে এসেছে সবসময়, কারন এই সময়টাতেই তাদের সর্বোচ্চ বিকাশ সম্ভব । তথাকথিত উন্নত বিশ্বে ফ্যাসিবাদ রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের, আর উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে ফ্যাসিবাদ আবির্ভূত হয়েছে সামরিক উর্দিতে বা গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে, আরও ক্রূর ভাবে।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হল সুশীল সমাজ ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর সক্রিয় বিরোধিতা, বিভিন্ন প্রোপাগান্ডায় তাদের হাস্যকর করে তোলার অপচেষ্টা; একই সাথে রাজনৈতিক ভাবে সাধারণত ফ্যাসিস্টদের প্রথম টার্গেট হল কমিউনিস্টরা (এবং সম্ভবত কিছু নৈরাজ্যবাদীরা)।
পুঁজিবাদ আর ফ্যাসিবাদ অবিচ্ছেদ্য; এ যেন বিজ্ঞাপনী ভাষায় — দু’জনে দু’জনার এক অনাবিল অনুষঙ্গ। এমনকি ফ্যাসিবাদ যখন সুপ্ত, তখনও এর লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট, যা লিঙ্গ বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, চটুল জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢাকা থাকে। পুঁজিবাদি সরকার গুলোর ফ্যাসিবাদি হয়ে ওঠার জন্য কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন হয়না, কারন ফ্যাসিবাদি ধারনা এবং ফ্যাসিবাদি অস্ত্রগুলো (পুলিশ, সহযোগী অঙ্গ সংগঠন, কালা কানুন, ইত্যাদি) পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্রে তৈরিই থাকে।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের গতানুগতিক ধারাগুলো সীমিত হয়ে আসলে, বা অর্থনৈতিক মন্দা কালীন অবস্থায় যখন মুনাফার পথগুলো সঙ্কুচিত হয়ে আসে, ফ্যাসিবাদই হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের প্রধান অবলম্বন, যার পরবর্তী ধাপ হল যুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন অবস্থা।
সাম্প্রদায়িক সংহতির নামে ভীতি ও সন্ত্রাস কে প্রশ্রয় দিয়েই বেড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ। কুসংস্কার, যুক্তিহীনতা, লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মান্ধত্ব, বিজ্ঞান এবং সামাজিক উৎপাদনে অনীহা, গন মানসে আশাহীনতা ইত্যাদি অনুষঙ্গগুলো ফ্যাসিবাদের বেড়ে ওঠার উপাদান, এবং এই উপাদানগুলো একই সাথে তার মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনিও।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আজ কোন মৌলিক আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ক্ষমতায় আসেনা। একদল, অন্য দলের অপকর্মের কারণে পাল্টা-পাল্টি করে নির্বাচন নামের এক ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকর উপস্থিতির অভাব এবং বিদেশি স্বার্থগোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থন আজও এখানে মুল প্রভাবক।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকর উপস্থিতির অভাবের কারনেই জনতার সামনে পছন্দমতো বিকল্প বেছে নেবার অভাবটিও প্রকট। ফলে প্রচলিত ভেঙে পড়া ম্যালোভ্যালেণ্ট ডেমোক্রেসি (Malevolent Democracies) -এর বিকল্প সন্ধানে সকলেই নিরাসক্ত। ফলে সেক্যুলার উদারনৈতিক শক্তিটি প্রতিনিয়ত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রশ্রয়ে শক্তিশালী হচ্ছে ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি।
বেনোভ্যালেণ্ট অটোক্রেসি (Benevolent Autocracies)-এর ইউটোপিয়ান স্বপ্নও কেউ কেউ দেখেন বটে; কিন্তু ফ্যাসিবাদী শক্তি কবেই বা কার জন্যে, কখন, কোথায়, কিভাবে কল্যান বয়ে এনেছে?
প্রয়োজন নির্দলীয় গণউদ্যোগ; প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার উদারনৈতিক শক্তির ঐক্য।
অরন্যে রোদন
আমি একজন ভারতীয় হিন্দু হিসাবে মনে করি, পৃথিবীর সমস্ত দেশই ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিৎ । যদি পৃথিবীর ধর্মীও রাষ্ট্র ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গুলির দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো , ধর্মীয় রাষ্ট্র গূলী থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গূলী অনেক বেশী উন্নতি করেছে । ধর্মীয় রাষ্ট্র গুলিতে এক শ্রেণির ধর্ম বাবশায়ী দের হাতে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে থাকে । তাঁরা ধর্মকে অপ ব্যাখ্যা দিয়ে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা ঠেলে সরিয়ে দেয় , তাঁরা প্রচার করে বিজ্ঞান আল্লা বা ঈশ্বর বিরোধী । আসলে তা নয় , তাঁরা একে অপরের পরিপূরক , সহযোগী । ধর্ম মানুষের মানসিক ও সামাজিক শ্রী বৃদ্ধি করে ও বিজ্ঞান আর্থিক , স্বাস্থ্য এছাড়া ধর্মীয় ক্ষেত্র গূলীকে আরও দৃঢ় করে । ধর্মীয় রাষ্ট্র গূলী নিজ ধর্মের মানুষ ছাড়া অন্য কাহাকেও আশ্রয় দিতে চায় ণা । তাঁরা নিজের মত ছাড়া অন্নের মত গ্রহণ করতে চায় ণা । সেই সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য আবার নিজেদের মধ্যেও মিল হয় না , ফলে দেশে গোলযোগ লেগেই থাকে । তাতে দেশের সার্বিক অগ্র গতি রোধ হয় । ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গুলিতে এই ধরণের সমস্যা খুবই কম থাকে , তাতে উন্নতির গতি বেশি । ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয় । ভারত হয় ধর্ম নিরপেক্ষ ও পাকিস্তান হয় ধর্মীয় রাষ্ট্র । বর্তমানে ভারত পৃথিবীর ষষ্ট শক্তিধর ও পাকিস্তান এখনও আমেরিকা ও চীনের সাহায্য প্রাপ্ত রাষ্ট্র । কট্টর মুসলিম দের ভাষায় আমেরিকা এক নম্বরের ইসলাম বীরুধই ও চীন চরম কাফের (আল্লা বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ) । পাকিস্তান অমুসলিম শূন্য হয়ে চলেছে , চলে যাচ্ছে মৌলবাদীদের দখলে । মুসলিম মুসলিমকে হত্যা করছে , অরাজকতায় পিছিয়ে যাচ্ছে আরও । ভারত যেখানে এ , পি, যে আব্দুল কালাম, মোহাম্মদ আজাহাড় উদ্দিন , মোহাম্মদ রফি , শানিয়া মীর্জা , দিলীপ কুমার , রতন টাটা , এছাড়া আরও অগণিত কৃতীদের পেয়েছে এবং আরও পাবে । একদিন পৃথিবীর কৃতী রাষ্ট্রে পরিণত হবেই । তবে আমাদের দেশেও কিছু সমস্যা আছে , মিটেও যাবে ।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের জন্য ‘গণতন্ত্রের চেয়ে একনায়কতন্ত্রই ভাল’ এমন একটা ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। এর পেছনে অজুহাত হিসাবে দেখানো হচ্ছে বিএনপি-জামাতের উগ্র ,পশ্চাতমুখী, আর স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সুরের বিপরীতধর্মী শাসনের প্রতিরোধ। এই অজুহাতের কিছুটা যৌক্তিক ভিত্তি থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর আসল উদ্দেশ্য একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করে পরিবার-তান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রকে সুসংহত করা। একথা পুরোপুরি ঠিক যে বিএনপি-জামাতের শাসন বাংলাদেশকে একটি জনমুখী, উদার আর আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে অপারগ, কিন্তু একদলীয় পরিবারতন্ত্র কখনই দেশ শাসনের দীর্ঘস্থায়ী বিকল্প হতে পারে না। ক্ষমতাসীনদের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যের কারণেই আমরা দেখছি বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ভিন্নমত দমন, আইনের অসম প্রয়োগ আর ধর্মীয় উগ্রতাকে মেনে নেয়ার প্রবণতা। দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে দেশের দুর্বল গণতন্ত্র-পন্থি আর সেক্যুলার শক্তির বাহ্যত কোন কর্মকাণ্ড নেই। ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিবাদী মনোভাব আর সেইসাথে ধর্মীয় উগ্রতার ক্রমবৃদ্ধির সমান্তরালে প্রগতিশীল দুর্বল ধারাটি আদৌ সংগঠিত হতে পারে নাকি দীর্ঘদিনের জন্য বিলীন হয়ে যায় তাই এখন দেখার বিষয়।
প্রগতিশীল ধারাটি দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে বলেই শঙ্কার যুক্তিসঙ্গত কারন রয়েছে।
আমাদের দেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তির উত্থান আসন্ন প্রায়। তার অশনিসংকেত আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ কালবেলায় উদার গণতান্ত্রিক, সেকুলার শক্তির নেতৃত্বে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।