১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করে ঢাকা ফিরেন সেদিনই। প্রাথমিকভাবে কথা ছিল দিল্লী থেকে ঢাকা আসার পথে কলকাতায় আরেকবার যাত্রা বিরতি করে পশ্চিমবংগের মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাবেন বংগবন্ধু। কলকাতার দমদম বিমান বন্দরসহ অন্যান্য প্রটোকলও প্রস্তত রাখাই ছিল। কিন্তু বংগবন্ধু আকাশপথ থেকেই বার্তা দিলেন, তিনি ঢাকাতেই ফিরবেন। ফলে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ পশ্চিমবংগে আর নামা হয়নি তাঁর।

কিন্তু দেশে ফিরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্টীয়ভার গ্রহন করার পর বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর করেন ভারতের পশ্চিমবংগে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি ৬ তারিখ থেকে শুরু করা ৩ দিনের সফরে বংগবন্ধু ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। লোক সমাগমের দিক থেকে সে জনসমুদ্রের আয়তনের রেকর্ড আজ পর্যন্ত অক্ষুন্ন আছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গরদের শাড়ি পড়ে তাঁর ভাষণের অনেকখানিই বাংলায় করেছিলেন সেদিন।

images

আকাশবাণী ও দূরদর্শণ থেকে বংগবন্ধু–ইন্দিরার জনসভার ধারাবিবরণীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মহালয়া- পাঠখ্যাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পঙ্কজ সাহা এই তিন জনকে। কবি, ধারাভাষ্যকার ও গনমাধ্যমব্যক্তিত্ব পঙ্কজ সাহা এক সাক্ষাৎকারের সেদিনের সে জনসভার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে,

“শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা উদ্ধৃতি দিলেন। তারপর জনতার সে বিশাল স্রোতের মধ্যে থেকে একটু পরপর আরো কবিতা পড়ার অনুরোধ করা হচ্ছিল শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব জনতার সে অনুরোধে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে কিছু কিছু অংশ পাঠ করে শোনাতে লাগলেন। আমরা সবাই আশ্চর্য হয়ে শেখ মুজিবের রবীন্দ্র কবিতাপ্রীতি দেখে বিস্মিত হচ্ছিলাম। কলকাতা ব্রিগেড প্যারাড গ্রাউন্ডের সে ঐতিহাসিক জনসভা নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রভক্ত শেখ মুজিবের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি”।

জনসভা চলাকালীন সময়েই পঙ্কজ সাহাকে দূরদর্শন থেকে জরুরী তলব করা হয় অফিসে ফিরে আসতে। দিল্লী থেকে নির্দেশ দেয়া হয় তিন ঘন্টা পরেই একটি আলোচনা অনুষ্টান করার যা দূরদর্শন ও ঢাকা টেলিভিশন থেকে এক যোগে প্রচার করা হবে। আলোচকদের নামও ব’লে দেয়া হয়। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সাহিত্যিক ও উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র প্রমুখ।

পঙ্কজ সাহা সে অনুষ্টান নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন,

“অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচার হচ্ছিল। আলোচনার প্রসংগক্রমে হঠাৎ করে ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার এবং সাহিত্যিক ও উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন একটু বিপত্তি করে ফেললেন কিছু আশঙ্কার কথা বলে। উনারা দু’জনেই পূর্ববংগের মানুষ। ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন অনেক বছর। সত্যেন সেনও পূর্ববংগের প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন বহু বছর। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছিলেন যে, তাঁরা এ অঞ্চলের মানুষের অনুভূতি, আবেগ ও পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছে থেকে। তাই যদি তাঁদের ভুল না হয় তবে ব’লা যায় শেখ মুজিবের এ জনপ্রিয়তা বেশীদিন স্থায়ী হবে না; শেখ মুজিবুর রহমান বিপদের সন্মুখীন হবেন। অনুষ্ঠানটি যেহেতু সরাসরি প্রচারিত হচ্ছিল, তাই কোন কথা সেন্সর বা বাদ দেয়া যাচ্ছিল না। অথচ শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা কলকাতা অতিথি ভবন থেকে এবং দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ অনুষ্ঠানটি দেখছিলেন। তাই অনুষ্ঠান সঞ্চালক হিসেবে বারবার বলছিলাম, আপনাদের এ আশঙ্কা ভুল প্রমানিত হোক আমরা এ কামনা করি। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘজীবি হউন”।

বিস্ময়করভাবে জ্ঞানী গুনী এ দু’মনীষীর কথা একটুও ভুল প্রমানিত হয়নি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যা করাই হয়নি, তাঁর হত্যার বিচারের সব পথও সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। কে জানতো বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যারা বেঁচে যাবেন এবং ক্ষমতায় আসবেন দু’দশক পরে? কে জানতো বংগবন্ধু হত্যার বিচার হবে বাংলাদেশেই?

সেদিন পঙ্কজ সাহার সাক্ষাৎকার শুনছিলাম আর আজকের বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে আসা বাংলাদেশের কথা ভাবছিলাম। ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার কিংবা সাহিত্যিক ও উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের সেদিনের সে আশঙ্কার কথা এখনও কীরকম অকাট্য? আসলেই বাংলাদেশ নামক এ গাংগেয় বদ্বীপের মানুষ কি এ রকমই হুজুগে? লালন-হাসন কিংবা অসংখ্য সূফীসাধকের পথ কত সহজেই গ্রহন করে তেমন কোন বাদবিসম্বাদ ব্যতিরিকেই। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুঝুক বা না- বুঝুক, সে চেতনার জন্য অস্ত্র হাতে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্থপতি বংগবন্ধুকে হত্যার পরও কী নির্বিকার থাকে। আর আজকের বাংলাদেশের উগ্র-ধর্মান্ধতাকেও কেমন গা-সহাভাবে সহে নেয়।

বেশ ক’বছর থেকে বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে গা শিউরে ওঠে। দৈব কিছু না ঘটলে সমগ্র দেশের ওপর আচ্ছন্ন ধর্মান্ধতার এ অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের সহসা কোন লক্ষণ নেই। কেন দেশের অধিকাংশ (?) মানুষ ধর্ম-নির্ভরতার এ পথে চলে গেল, তা নিয়ে হাজারটা কারণ ও হাজার ঘন্টা বিতর্ক করা যাবে। কিন্তু এ বাস্তবতা মানতেই হবে যে, ধর্মান্ধ মৌলবাদের থাবায় আজ বাংলাদেশ ক্ষত-বিক্ষত।

এ কঠিন সত্যকে স্বীকার এবং মোকাবেলা না করে শুধু উদার কিংবা মডারেট-মডারেট করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলে অচিরেই তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। আর এর পরিণতিতে একদিন বাংলাদেশ হবে আজকের আফগানিস্তান-পাকিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মতোই। আজকে আইসিস কে প্রতিহত করতে ওসব দেশে যা হচ্ছে, ধর্মীয় মৌলবাদী জংগীদের প্রতিহত করতে একদিন বাংলাদেশেও একইরকম হামলা-মামলা হবে, এটা নিশ্চিত। কারণ, নিজেদের পন্য-বাজা্রের স্বার্থ এবং বিশ্বসভ্যতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে আমেরিকা-ভারত-চিন কিংবা রাশিয়া ধর্মীয় মৌলবাদী জংগীদের নির্মূল করবেই। তাই ড্রোন কিংবা মরনাস্ত্র হামলায় আমার স্বপ্নের এ জন্মভুমিকে বিধ্বস্ত দেখার আগেই আসুন জংগী ধর্মান্ধদের প্রতিহত করি এবং মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনাকে ফিরিয়ে আনতে আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করি।