১. শান্তির ধর্ম

শান্তির ধর্ম নামে পরিচিত ইসলাম। কিন্তু, ইসলাম শান্তির ধর্ম নয়, এই সহজ সত্যটাকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেই আয়ান হারসি আলি তাঁর সাম্প্রতিক বই হেরেটিকে ইসলাম ধর্মের জন্য সংস্কার প্রস্তাব এনেছেন। এক সময় প্রটেস্ট্যান্টরা যেমন সংস্কার প্রস্তাব এনেছিলো ক্যাথলিক খৃস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে, এটা অনেকটা সেরকমই।

আয়ান হারসি আলি উল্লেখ করেছেন যে, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে খুব সহজ একটা সত্যকে আমি বলার চেষ্টা করছি। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সবসময় বলার চেষ্টা করেন যে, উগ্র মৌলবাদী মুসলমানদের কর্মকাণ্ড যে ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা তারা অনুপ্রাণিত তার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। তার বদলে আমি বলবো যে, আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তারা এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত যা ইসলামের মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে, যা রয়েছে পবিত্র কোরানের মধ্যে, যা রয়েছে নবী মুহাম্মদের জীবন ও শিক্ষা বলে খ্যাত হাদিসের মধ্যে। ইসলামিক সন্ত্রাস সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা, বা ধর্মতাত্ত্বিক ভ্রান্তির মধ্যে নিহিত নয়, বরং এর শিকড় রয়ে গিয়েছে কোরানের আদি এবং অকৃত্রিম আয়াতসমুহের মধ্যে।“

আয়ান হারসি আলি যে খুব একটা ভুল বলেন নি, সেটা সাম্প্রতিককালের ঘটনা প্রবাহ যাচাই-বাছাই করলেই টের পাওয়া যায়। বিশ্বের যেখানে যতো সন্ত্রাস ঘটছে, তার সাথে কোনো না কোনভাবে শান্তির ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করা মুসলমানরা জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব মিডিয়াতে বার বার উঠে আসছে ইসলামের নাম। তবে, এই উঠে আসাটা শান্তির ধর্ম হিসাবে নয়, বরং এর বিপরীত সহিংস এক ধর্ম হিসাবেই আসছে।

গত বছরের এপ্রিলের চৌদ্দ তারিখে নাইজেরিয়াতে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী দল বোকো হারাম দুইশো ছিয়াত্তর জন স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মে মাসের পনেরো তারিখে সুদানে মরিয়ম ইব্রাহিম নামের একজন মহিলাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ ছিলো তিনি স্বধর্ম অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। জুনের ঊনত্রিশ তারিখে ইরাক এবং সিরিয়াতে আইএস তার খিলাফত ঘোষণা করে। অগাস্টের ঊনিশ তারিখে আমেরিকান সাংবাদিক জেমস ফলির শিরোচ্ছেদ করা হয়। এই শিরোচ্ছেদের ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখে আরেক আমেরিকান সাংবাদিক স্টিফেন সটলফকেও একই পরিণতি বহন করতে হয়। এদের দুজনেরই শিরোচ্ছেদ যে করেছে, সে বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন। শুধু এরা দুজনেই নয়, এরকম প্রায় তিন থেকে চার হাজার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নাগরিকেরা ইরাক এবং সিরিয়াতে জিহাদে অংশ নিয়েছে। সেপ্টেম্বরের ছাব্বিশ তারিখে এলটন নোলেন নামের এক নব্য মুসলমান, ওকলাহোমার এক ফুড প্রসেসিং প্লান্টে তার সহকর্মী কলিন হাফর্ডের কল্লা নামিয়ে দেয়। অক্টোবরের বাইশ তারিখে আরেক নব্য মুসলমান মাইকেল জিহাফ-বিবো অটোয়ার ক্যাপিটল বিল্ডিং এ হামলা চালায়। এই আক্রমণে করপোরাল ন্যাথান সিরিলো গুরুতরভাবে আহত হন। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখে ম্যান হারন মরিস সিডনির এক ক্যাফেতে আঠারো জন মানুষকে জিম্মি করে ফেলে। গোলাগুলিতে দুইজন মারা যায়। জানুয়ারি মাসের সাত তারিখে ঘটে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ। সাইদ এবং শেরিফ কুয়াচি নামের দুই ভাই মুখোশ পরে একে-৪৭ এসল্ট রাইফেল নিয়ে ঢুকে পড়ে ফরাসি স্যাটায়ার ম্যাগাজিন শার্লি হেবদোর অফিসে। পত্রিকার সম্পাদকসহ এগারো জনকে হত্যা করে তারা। সেই সাথে আহত করে আরো এগারো জনকে। বের হবার সময় বিল্ডিং এর বাইরে তারা গুলি করে হত্যা করে একজন পুলিশ অফিসারকেও। কুয়াচি ভাইয়েরা নিজেদের ইসলামি সন্ত্রাসী গ্রুপ আল কায়েদার ইয়েমেনি শাখা বলে পরিচয় দেয়। আল কায়দার ইয়েমেনি শাখা এই হামলার দায়-দায়িত্বও স্বীকার করে নেয়। একই দিনে এর সাথে সম্পৃক্ত আরো কিছু হামলা ঘটে শহরের নানা জায়গায়। এতে আরো পাঁচ জন নিহত হয়, আহত হয় এগারো জন।

আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। বরং এর চরমরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি এখন ভয়ানক বেদনার সাথে। মাত্র দুই বছর আগে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে থাবা বাবা ওরফে স্থপতি রাজীব হায়দারকে। এই হত্যাকাণ্ডের আসামী হিসাবে পাঁচজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরা সবাই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গ্রেফতারকৃত আসামীরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাজ কক্ষে নামাজ পড়তে গিয়ে একে অপরের সাথে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হয়। সেই সূত্রে তারা ইসলামিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং ইন্টারনেট হতে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করত। তারা জানায়, তাদের গ্রুপের এক বন্ধু একসময় বাংলাদেশ ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল।

থাবা বাবার স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে না আসতেই, এ বছরের শুরুতে চাপাতির আঘাতে নিহত হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক এবং যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বন্যা নিজেও একজন বিশিষ্ট লেখিকা, মুক্তমনা আন্দোলনের সামনের সারির মানুষ। তিনি এই হামলায় গুরুতরভাবে আহত হন। এক হাতের বুড়ো আঙুলও হারিয়েছেন চাপাতির আঘাতে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় আনসার বাংলা সেভেন নামের একটা গোপন ইসলামিক দল অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিয়ে টুইট করে। অনলাইনে অভিজিৎ-কে মৃত্যু হুমকি দেওয়া ফারাবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ফারবী নিজে একজন ইসলামিস্ট। অনলাইনে ব্লগারদের হুমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে এর অবস্থান শীর্ষে।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাত্র এক মাসের মাথায় নিহত হয় ওয়াশিকুর রহমান বাবু নামে একজন ব্লগার। বাবুর হত্যাকারীদের মধ্যে দুজনকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মানুষ। তাঁরা এদেরকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেন। দেখা যায় যে, এই খুনিদের দুইজনই মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র। তারা তাদের ইমানি দায়িত্ব পালন করার জন্য বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।

মাত্র কয়েকদিন আগে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মুক্তমনার লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে। খুনের অংশ নেয় চারজন ঘাতক। প্রত্যেকেই কালো মুখোশ দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলো। অভিজিৎ রায়ের মতোই অনন্ত বিজয় দাশের ক্ষেত্রেও আনসার বাংলা সেভেন থেকে টুইট করা হয়।

এ মাসের শুরুর দিকে অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করে নেয় ভারতীয় উপমহাদেশে তৎপর আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গ্রুপ আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)। বিশ্বব্যাপী চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসআইটিই’র (সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিজ) উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।

আল কায়দা এবং আনসার বাংলার সংশ্লিষ্টতা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, এই সমস্ত ইসলামিক সশস্ত্র জঙ্গী বাহিনীগুলিই তালিকা তৈরি করে, একের পর এক মুক্তবুদ্ধির লোকদের হত্যা করে চলেছে। ঠিক যেমনটি করেছিলো এদেরই পুর্বসূরী পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার এবং আল বদর বাহিনী। তাদের ধর্মানুভূতি এতোই তীব্র যে সামান্যতম সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই।

উপরেরগুলো খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগেও এরকম বহু হামলা করা হয়েছে দেশে দেশে। আর, এই হামলাগুলোর প্রতিটাই হয়েছে ইসলামের নামে। ইসলামি সৈনিকেরা ইসলামের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে কিংবা প্রতিশোধ নিতে এই সব হামলা চালিয়েছে। ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ এখন আর শুধু মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ নেই, এর বিস্তার ঘটেছে পশ্চিম ইউরোপে, আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে উত্তর আমেরিকাতেও।

আয়ান আক্ষেপ করে বলেছেন যে, এতো কিছুর পরেও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারা এই সত্যটা বুঝতে অক্ষম হচ্ছেন যে, ইসলামের নামে এই চরমপন্থা বিপথগামী কিছু লোকের কাণ্ডকারখানা নয়, বরং এই চরমপন্থার কারণ গভীরভাবে প্রথিত রয়েছে এই ধর্মের অভ্যন্তরেই। শুধুমাত্র আল কায়েদা এবং আইএস এর মতো চরমপন্থী দলগুলোই তাদের সন্ত্রাসী চেহারা দেখাচ্ছে তা না, যেখানে যেখানে ইসলাম প্রচলিত রয়েছে সেখানে সেখানেই এই একই দশা বিদ্যমান। পাকিস্তানে মুহাম্মদকে সমালোচনা করলে, সেটিকে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং এর শাস্তি হচ্ছে মৃত্যদণ্ড। সৌদি আরবে চার্চ বা বিধর্মীদের প্রার্থনাঘর বে-আইনি। বড়সড় অপরাধের জন্য শিরোচ্ছেদ বৈধ। ইরানে পাথর মেরে হত্যা করার বিধান আছে। সমকামিতার শাস্তি সেখানে মৃত্যুদণ্ড। এই আইন ব্রুনাইতেও রয়েছে। পশ্চিমা উদারপন্থীরা ইসলামি সন্ত্রাসের চেয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার বিষয়ে বেশি ভীত। ফলে, নাইন ইলেভেনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদেরকে মুসলমান সন্ত্রাসী না বলে বলা হচ্ছে শুধুমাত্র সন্ত্রাসী। এর মাধ্যমে গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এরা আসলে মুসলিম সন্ত্রাসী, ইসলামের নামেই এই ভয়ংকর পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে। এই পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হচ্ছে মডারেট মুসলমানেরা। এই মডারেটরা অন্ধের মতো যপমন্ত্র আউড়ে যাচ্ছে শুধু এই বলে যে, ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম, ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। যাঁরা ইসলাম ধর্মত্যাগী, যাঁরা ইসলামের সংস্কারের পক্ষে, তাঁদেরকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখছে এই সকল উদারপন্থী ধার্মিকেরা।

আয়ান পরিষ্কারভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে, আল-কায়েদা এবং আইএস- এর সাথে ইসলামের সংযোগ অত্যন্ত নিবিড়। তাঁর এরকম সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন তিনি বহুবার। এর সাথে সাথে তুলনামূলকভাবে কম ভায়োলেন্ট সমস্যাও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সিএআইআর এর মতো ইসলামিক সংগঠনগুলো বিভিন্নভাবে তাঁকে বক্তব্য দিতে বাধা দিয়েছে। তারা বলার চেষ্টা করেছে যে, আয়ান ইসলাম ধর্মে বিশেষজ্ঞ না, এমনকি এই ধর্মের অনুসারীও নয়। কাজেই, এই বিষয়ের উপর কথা বলার যোগ্যতা তাঁর নেই। ওয়েস্টার্ন লিবারেলরাও কম যায় নি। তাঁরা তাঁকে ইসলাম বিদ্বেষীর ট্যাগ দিয়ে ফেলেছে।