অসংখ্য মানুষের সামনে হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণে নেমেছিলো দুঃশাসন। দ্রৌপদীর এই সম্ভ্রমহানিতে দোষ ছিলো তার পঞ্চ স্বামীর একজন যুধিষ্ঠিরের। দুর্যোধনের সাথে পাশা খেলার জুয়াতে নেমে সর্বস্ব হারিয়েছিলো সে। শুধুমাত্র পার্থিব ধন-সম্পদই তার একান্ত সম্পদ নয়, রক্তমাংসের স্ত্রীও তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কাজেই, তাকেও বাজিতে হারতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নি তার। এই কাজে দ্রৌপদীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য তার কাছে ছিলো না।

দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করা শুরু করে, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছে যে, তার বীর স্বামীরা তার এই অপমান রহিত করতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু, অপার বিস্ময়ে দ্রৌপদী দেখে যে, তার পঞ্চ পাণ্ডব স্বামী নিশ্চুপ এবং নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে আছে সভাকক্ষে। হাজার কাকুতি মিনতিতেও তারা এগিয়ে আসে না তাকে চুড়ান্ত অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে। দ্রৌপদী বুঝতে পারে নি যে, পুরুষতন্ত্রে সে আরো অসংখ্য পার্থিব ধন-সম্পদের মতো একটা সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়। পাশা খেলার জুয়ার দানের প্রতিশ্রুতির মূল্য তার নিজের থেকেও অনেক বেশি। এই সভাতেই তার অবাক উপলব্ধি ঘটে যে, নারী শুধু প্রয়োজনের। তার পছন্দ-অপছন্দের, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কোনো গুরুত্ব নেই তার প্রাণপ্রিয় স্বামীদের কাছে।

উপায়ন্তর না  দেখে সম্ভ্রম বাঁচাতে দ্রৌপদী বিষ্ণু, কৃষ্ণ, নর প্রভৃতি দেবতার স্তব করতে শুরু করে। তার এই স্তব শুনে কৃষ্ণ ধর্মরূপে অবতীর্ণ হয়ে অদৃশ্য থেকে নিজে বস্ত্রখণ্ড হয়ে দ্রৌপদীকে আবৃত করতে আরম্ভ করে। দুঃশাসনের বস্ত্র হরণের প্রচেষ্টায় নানা রঙ-বেরঙের বস্ত্রই শুধু বের হতে লাগে, দ্রৌপদীকে নগ্ন করার বাসনা তার আর মিটে না।

মহাভারতের দুঃশাসনের কুটিল ইচ্ছা পূর্ণতা পায় নি। কৃষ্ণের অদৃশ্য হস্তক্ষেপের কারণে দ্রৌপদী বেঁচে গিয়েছিলো ভয়াবহ এক সম্ভ্রম হারানোর  নিদারুণ লজ্জা থেকে। দ্রৌপদীর এই অকিঞ্চিৎকর সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে অতি সম্প্রতি কিছু দুর্ভাগা নারী। প্রকাশ্য রাজপথে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মতো পবিত্র একটা অঙ্গনে, এক দল দু:শাসন  নববর্ষের দিনে দলবদ্ধ নেকড়ের মতো নেমে এসেছিলো ললনাদের বস্ত্রহরণের লোলুপ লালসা নিয়ে। মহাভারতের দ্রৌপদীকে লড়তে হয়েছিলো একা এক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, আর এই নারীদের লড়তে হয়েছে এক পাল হিংস্র হরমোনাক্রান্ত হাভাতে হায়েনার বিরুদ্ধে। দুঃশাসন এখানে একজন-দুজন নয়, অসংখ্যজন। এদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলো অল্প কিছু সংখ্যক কৃষ্ণ। সংখ্যায় অতি নগন্য হবার কারণে খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারে নি। কিন্তু, জানবাজি লড়াইটা ঠিকই চালিয়ে গিয়েছে। আহত এবং ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে অসম রণে।

বাংলাদেশে এই রকম ঘটনা, এটাই কিন্তু প্রথম নয়। গাওছিয়া মার্কেটের প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া,  জনাকীর্ণ বাসের মধ্যে সুযোগ নেওয়া, বইমেলার গেটের সামনে কৃত্রিম জ্যাম তৈরি করে ক্ষণিকের লাম্পট্য মেটানো, এগুলো সবই আগে ঘটেছে। ১৯৯৯ সালে থার্টি ফার্স্টের রাতে টিএসসি এলাকায় বাঁধন নামে একজন তরুণীর শাড়ি খুলে নেয় একদল বখাটে ছেলে।

এবারের সাথে আগের ঘটনাগুলোর পার্থক্য মূলত গুণগত। আগের ঘটনাগুলো ছিলো বিচ্ছিন্ন এবং দ্রুত। একজন বা দুজন নারী আক্রান্ত হয়েছেন অল্পসংখ্যক বখে যাওয়া ছেলেদের হাতে। এবারে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা আক্রমণ করেছে, তাদের সংখ্যাও অবিশ্বাস্য রকমভাবে বেশি। পরিকল্পিতভাবে একত্রিত হয়ে দীর্ঘসময় ধরে ঘেরাও করে রেখেছে তারা নারীদের, তারপর একে একে পরনের কাপড় খুলেছে তাদের। নারীদের অসহায় আর্তচিৎকার যাতে কারো কানে না যায়, সেজন্য বিকটশব্দে ভুভুজেলা বাজিয়েছে তারা।

প্রায় প্রতিটি ঘটনার মতোই এবারও আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিতরা নিজেদের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পুরো ঘটনা তাদের চোখের সামনে ঘটলেও, তারা নিষ্ক্রিয় থেকেছে কোনো এক রহস্যময় কারণে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে গেটের সামনে এই ঘটনা ঘটেছে প্রায় এক ঘণ্টা সময় ধরে, দুই মাস আগে এখানেই হত্যা করা হয়েছিলো জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক এবং মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে। তখনও আমরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের কাছ থেকে একই ধরনের নিষ্ক্রিয় আচরণ লক্ষ্য করেছি। অথচ, তারা এই সমস্ত জাতীয় অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা দেবার  জন্য তিন স্তর, চারস্তর, কিংবা পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে, এই সমস্ত গালভারী কথা শুনতে অভ্যস্ত। বাস্তবে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না প্রয়োজনের সময়ে।

আক্রমণে এবার যেমন অভিনবত্ব ছিলো, প্রতিবাদেও পার্থক্য ছিলো সেরকম সুস্পষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই এই অস্বাভাবিক, অনভিপ্রেত এবং অকাঙ্ক্ষিত ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্য থেকে। বাঁধনের সময় জয়নাল হাজারী পুরো ঘটনার জন্য বাঁধনকে দায়ী করে ‘বাঁধনের বিচার চাই’ নামে বই লিখেছেন। এবার আমরা ওই রকম অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে অন্তত দেখা যায় নি। এটা শুভ লক্ষণ। কিন্তু, এখান থেকে খুব বেশি আশারও কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বা সরকারী দল এই ঘটনায় মোটামুটি নিশ্চুপই থেকেছে। এ বিষয়ে তারা কী ভাবছে, সেটা জানতে ব্যর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষেরা। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে অনিশ্চয়তা এবং অনিরাপত্তাবোধের ভয়াল আবহ।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে নারীদের সম্ভ্রমের উপর এই ধরনের আক্রমণ কেনো হয়? শুধুই কী নিরাপত্তাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে, কিংবা বিচারের সম্মুখীন না হবার কারণে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, সে কারণে? এগুলোতো অবশ্যই কারণ। অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে দেখেও যখন নিরাপত্তা বাহিনী অগ্রসর হয় না, বা আগে থেকে পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয় না, কিংবা অপরাধ করার পরেও যখন গ্রেফতার হতে হয় না বা আদালতে সাজা হয় না, তখন অপরাধমনষ্ক ব্যক্তিরা দুঃসাহসী হয়ে ওঠে, অপরাধ করার জন্য উৎসাহ পায়। কিন্তু, এটিই মূল কারণ নয়। নারীর সম্ভ্রমহানি করার এই প্রবনতার শিকড় আসলে রয়ে গিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিতরে। পিতৃতন্ত্রে নারীকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। নারী হচ্ছে পুরুষের কাছে বিলাসের সামগ্রী, ভোগের বস্তু কিংবা সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্র এবং ঘর সংসার সামলে রাখার  জন্য দাসি মাত্র। এরকম একজনকে সম্মানপ্রদর্শন করার জন্য পুরুষ প্রস্তুত থাকে না। পিতৃতন্ত্র তাকে শেখায় নারীকে অবমাননা করতে, তাকে পদদলিত করে রাখতে, তাকে তার ভোগের সামগ্রী হিসাবে বিবেচনা করতে। পিতৃতন্ত্রের পুরুষ নিজের ঘরের নারীর সম্মানের জন্য  বিচলিত থাকে, কিন্তু সেটি সেই নারীদের জন্য নয়। ওই নারীদের সাথে তার সম্মান জড়িত বলেই সে তাদের সম্মান নিয়ে বিচলিত থাকে, সেটিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু, ঘরের বাইরের নারীদের প্রতি তার আচরণ হয় ঘৃণা আর অবজ্ঞার। এদের প্রতি এক ধরনের বিচিত্র আক্রোশ অনুভব করে সে, অসম্মানিত করে, লাঞ্ছিত করে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। নারী তার কাছে যৌনলালসার বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন সে  একা থাকে, তখন প্রতিটি নারীরই কাপড় খোলে সে মনে মনে।  যখন সে দলবদ্ধ হয় তার মতো আরো অনেকের সাথে, তখন সে সত্যি সত্যিই কাপড় খোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে অসহায় নারীদের উপর।

হাজার বছর ধরে চলে আসা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে যাবে বা বদলে যাবে, এটা আশা করা যায় না। তবে, এটাও ঠিক এর পতন শুরু হয়ে গিয়েছে। যতদিন পিতৃতন্ত্র পুরোপুরি উচ্ছেদ না হয়, ততোদিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকেই এক সাথে কাজ করতে হবে। তবে, সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে নারীদেরই। প্রতিদিন, প্রতি মাসে, প্রতি বছরে আক্রান্ত হচ্ছে তারাই। পিতৃতন্ত্র যে লজ্জাশীলা নারী, যে কোমল এবং মমতাময়ী নারীর আদর্শ চিত্ররূপ তাকে দেখায়, সেই চিত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে তাদের। কাপড় খুলে নিলে, কিংবা যে কোনো ভাবে অসম্মান করার চেষ্টা করলে, বিব্রত এবং লজ্জিত হয়ে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে পড়ার কিছু নেই, বরং বিপুল বিক্রমে বেতের ডাল হয়ে পালটা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে হবে আক্রমণকারীদের। সংঘবদ্ধদের সাথে হয়তো পারা যাবে না এটা করে। কিন্তু, প্রতিটা ছোটখাটো আক্রমণেই যদি এরকম করে পালটা আঘাত হানা যায়, প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, এই সমস্ত আক্রমণকারীরা আর সংঘবদ্ধ হবার সাহস দেখাবে না। মনে রাখবেন, এদের শক্তি আমাদের প্রতিরোধহীনতা আর ওদের সংঘবদ্ধতার থেকেই উদ্ভুত।

আজকের নারীদের, আজকের দ্রৌপদীদের, এখন আর আক্রান্ত হবার পরে কোনো কৃষ্ণ অবতারকে ডাকার প্রয়োজন নেই। তার বদলে নমনীয়তা কাটিয়ে দ্রঢ়িষ্ঠ হোক তারা,  দুরন্ত-দুর্বার হোক, দণ্ডে দণ্ডে দুঁদেমি দেখাক, দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটাক দিকবিদিক,  দ্বিজিহ্বের মতো মারাত্মক বিষধর হোক, দুঃসাহসী দর্পে দ্রোহের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিক সব দুঃশাসন আর দুর্যোধনদের।