শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় তার “শেষ প্রশ্ন” বইটিতে “কমল” চরিত্রের যে বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্র উপস্থাপন করে গেছেন, বর্তমানে দাঁড়িয়েও সে চরিত্র এদেশের মেয়েদের জন্য কল্পনামাত্র!!

কমল চরিত্রের স্বপ্ন শরৎ দেখে গেছেন সেই কবে, আর আজ এতোকাল পরেও সে চরিত্র বহন করতে এদেশীয় মেয়েরা ভয় পায়। তারা বই পড়ে, স্বপ্ন দেখে কিছু করার, অতঃপর সামাজিক ও পারিপার্কশ্বিক বাধা-বিপত্তির কথা ভেবে সেই লালিত স্বপ্নটাকে ধামাচাপা দিয়ে বসে থাকে। তাদের জীবনটা চলতে থাকে চার্জ দেয়া খেলনা গাড়ির মতো, যেখানে জীবনভর চার্জারটা তার পরিবার অথবা পরিবারের বাইরে কোনো না কোনো ছেলের হাতে থাকে।

এক কমল নিজেই যেমন একশটা ছেলেকে দমিয়ে রাখার সামর্থ্য রাখার মতো প্রতিভা নিয়ে জন্ম নিয়েছে তেমনি হাজারো প্রতিভাধর কমলিকারা আছে এইদেশে যারা দেশটাকেই বা বিশ্বটাকেই পাল্টে ফেলার অথবা নতুন কোনো ধারা সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমাদের সমাজ এই প্রতিভা লালন করে না, এর মর্যাদা বোঝে না বা বুঝতে চায় না।

আমরা জাতি হিসেবে ভিতু ধরনের। ভয় আমাদের দমিয়ে রাখে। এখানে নিরাপত্তার অভাব, প্রতিভা লালনের অভাব। ছোট থেকে ওখানে মেয়েদের শেখানো হয় আস্তে কথা বলতে, রাস্তায় পা ফেলার আগেই বলে দেয়া হয় মাথা নীচু করে চলতে, তাদের প্রশ্ন করতে দেয়া হয় না, নিজের শরীর সম্পর্কে নানা ধরণের কুরুচিকর কথা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। নারী শুধুমাত্র কাম বা শরীর না, নয় প্রেম পূজারী বা শুধুমাত্র বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ। সে একক একটা মানব সত্তা। যে সত্তাটাকে মুরব্বি নামক বিশেষ গোষ্টি যেভাবে খুশি সেভাবে নাচাতে থাকে।

ভবিষ্যতে এই কমলিকারা নিজেদের দাসি বা দেবী নয়, স্বাধীন কোন সত্তাও নয় বরং পুরুষ নামক গাছের পরগাছা ভাবতে থাকে!

এদেশের মেয়েরা বড় হয় তাদের সমস্ত চিন্তাধারা বিসর্জন দিয়ে অথবা ছোটকালেই এমনভাবে তার উন্মুক্ত বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, মনকে বন্ধ করে দেয়া হয় যে মেয়েটি নিজেও নিজেকে বোঝা বা জড় খেলনা গাড়ির মতো বা পরগাছা ভাবতে শুরু করে।

কমল চরিত্রের কথা বাদ দিয়ে বর্তমান কমলীকা চরিত্রের দিকে তাকাই। আমরা আমাদের দেশ নিয়ে গর্ববোধ কর। এটা স্বাধীন বাংলাদেশ তাই? নাকি সোনার বাংলা তাই? কোনোটাই না। স্বাধীনতা সিলগালা মারা দেশটার মধ্যে আলাদা আলাদা ভাবে আমরা প্রত্যেকে পরাধীন। নিজ দেশে নিজের চিন্তাধারারর বুদ্ধিবিকাশ কেউ করতে পরে না।

সতীদাহ প্রথারর মতো বর্বর প্রথা বহুকাল আগে বিদায় নিলেও তার বেহুদা হাড্ডি পড়ে আছে এখনো। সেই হাড্ডির খচখচানিতে এখনো দাহ হতে হচ্ছে শত সহস্র নারীদের প্রতিনিয়ত। নারী পুরুষ নাকি একে অপরের পরিপূরক অথচ পরিপূরকের সংজ্ঞাটাই বোধহয় কেউ জানে ন। এর ভিত্তিতে নিদারুণ অথচ কঠিন সত্যি একটা কথা বলা যায় “ঘরে ঘরে তসলিমা নাসরিনের মতো মেয়ে জন্ম নিক”। আমাদের সমাজ পরিবর্তন এক তসলিমা করতে পারেনি, কিন্তু হাজারো তসলিমা জন্ম নিলে সব পরিবর্তন হতে বাধ্য থাকবে।

খাই খাই স্বভাবধরী লোকদের দিকে আঙ্গুল তুললেই নারীবিদ্বেষী অথবা খারাপ চরিত্র বলে সহজেই আখ্যা দিয়ে দিব। অথচ খাই খাই যে বা যারা করছে করে যাচ্ছে, তারা দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবে, সাথে শক্তি হিসেবে তো ধর্মের জ্ঞান আছেই। ধর্ম একটা দোহাই মাত্র সে যে কোন ধর্মই হোক, যেসব দোহাই দিয়ে পুং-লিঙ্গধারী ব্যক্তিবর্গ আদিকাল থেকে এইকাল পর্যন্ত নিজেদের এককভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেছে।

মেয়েরা পারে। পুরুষদের থেকে হাজার ধাপ বেশি এগিয়ে যাবে যদি সবকিছু একদিনের জন্যও মেয়েদের উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সেই একদিন সময় দেয়া হবে না কারণ পুরুষজাতি কখনোই চাইবে না মেয়েরা তাদের থেকে এগিয়ে যাক।

লেখাটাকে নারীবিদ্বেষী মনোভাব বলে নিজেদেরকেই লজ্জ্বা দিবেন না নিজেরা। বিশ্বাস করুন একটা মেয়ে চাইলে দুনিয়ার সব পুরুষদের স্বর রুদ্ধ করে দিতে পারে, সকল পুরুষের আনন্দ কান্না নিভিয়ে দিতে পারে জন্মের প্রথম দিনেই। কিন্তু, সে সেটা করে না কোনো দিন করবেও না। কারণ সে চায় ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। কিন্তু সেই আলোর মিছিলে মেয়েরাই অন্ধকারে পরে থাকে। এক পা এগিয়ে দিতে না পারলেও এক পা যদি পিছিয়ে দেয়ার জন্য লোকের অভাব হয় না।

বছরের একদিন নারী দিবস করে সারা বছর পুরুষ দিবসের গণ্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করে চলাটা এখানে কঠিন বটে তবে অসম্ভব না। একদিনের নারী দিবসের দরকার নাই। ৩৬৫ টা দিনই হয়ে উঠুক নারী পুরুষ সবার। আর নারী পুরুষ লিঙ্গ ভেদাভেদ না করে মনুষ্যরূপে সবার সামনে সবাই উপস্থিত হোক সকল প্রকার জড়তা সরিয়ে।

আজকের মেয়েশিশুটি যেন নিজেকে সেই খেলনা গাড়িটি না ভেবে মানুষ ভেবে সকল গুণাবলী নিয়ে বড় হতে পারে, ছেলে শিশুটিকে জ্ঞান দিন মেয়েটিকে স্বজাতীয় ভাবার, সমান ভাবার সে যেন তার শিশ্নটাকে তার শক্তি হীসেবে না ভাবে।

আর তাদের জন্য সুষ্ঠধারা আমাদেরই গড়ে দিতে হবে সবাই এক হয়ে।