বসন্তে আমি মনোযোগ দিয়ে ধনিয়া পাতা চাষ করার চেষ্টা করি । মনোযোগ দিয়ে ধনিয়া পাতা চাষ করলে দশ বারোটা ধর্মগ্রন্থের চাইতে বেশি জীবন ও জগত নিয়ে জানা যায় । এই যেমন ধরেন, আমি ধনিয়া পাতার বীজ লাগানো শুরু করি গড়পড়তা মার্চের শেষের দিকে । মোটামুটি ৩ মাসে এক ব্যাচ শেষ হয় । দ্বিতীয় ব্যাচ পর্যন্ত ঠিকভাবেই ফলন হয় । তৃতীয় ব্যাচ যখন অক্টোবরে বীজ লাগাই, সেগুলোর চারা একটু শক্ত হতে হতে কোন কোন বছর শুরু হয়ে যায় শীতের প্রকোপ । ধনিয়া পাতা শীত এবং আলোর স্বপ্লতা সহ্য করতে পারে না । কিন্তু তাই বলে শীতের শত্রুতায় কি সে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে মারা যায় ? না । সে পাল্টা যুদ্ধ করে । প্রথম, দ্বিতীয় ব্যাচের ধনিয়া পাতা যেখানে তিনমাসে প্রায় ১২-১৫ ইঞ্চির মত লম্বা হয়ে পরিপুষ্ট হয়ে তারপরও রেখে দিলে ফুল ছড়ায়, সেখানে আগাম শীতের প্রকোপে পড়া এই ব্যাচ কোনরকমে ৪-৫ ইঞ্চি হওয়ার পরেই শিরদাঁড়া শক্ত করে ফুল ছড়িয়ে দেয় । আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখে , নিজে মরে যায় যাক, তবু জীবনের সিলসিলা যেন তার চলমান থাকে ।

আমি ঘৃণার্হ্য প্রাণী মানুষ, তার এই যুদ্ধের স্পিরিটকে সম্মান না জানিয়ে একটু শক্ত হলে তুলে কেটেকুটে ফ্রিজে রেখে দিই । প্রজাতি হিসাবে তাই মানুষের চাইতে আমার ধনিয়া পাতার উপর বরং শ্রদ্ধা বেশি ।

বিভিন্ন রকমের সূচকের রঙে রাঙ্গিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে গভীর তাকিয়ে থাকলে মানুষের প্রজননেও এমন একটি চিত্র ভেসে উঠবে । যেমন ধরা যাক, পৃথিবীর কোন অংশগুলোতে মানুষের জীবনের উপর ঝুঁকি সবচে বেশি ? কোন অংশগুলোতে জীবনের নিরাপত্তা নাই । ঠিক সেই অংশগুলোতে গড় উর্বরতার হারও সবচে বেশি । এই যে প্রতিকূল পরিবেশে নিজের জীবনের নিশ্চয়তা নাই তখন, তড়িঘড়ি করে পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়ার চেষ্টা , সরব বা নীরব, কোমল বা ডেয়ারিং , জীবন-গাছের সমস্ত প্রজাতিতেই অল্পবিস্তর দেখা যায় । যে প্রজাতি প্রজনন করে যৌন উপায়ে , তার মধ্যে এই প্রক্রিয়ার সেকেন্ডারি লক্ষণ হবে জীবনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশে যৌনতা নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যাবার মতো আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভট একটি অবস্থা ।

এই প্রক্রিয়ার বিবর্তনী ব্যাখ্যা যেদিন আমি বুঝতে পারি তার পর থেকে জীবনকে দেখার দৃষ্টি অমোচননীয়ভাবে পাল্টে গেছে আমার । এই সত্যিকারের এপিফিনি আসে সম্ভবত রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন পড়তে পড়তে অথবা ম্যাট রিডলির দ্য রেড কুইন । ঘটনা হচ্ছে গত শতাব্দীর ৭০ দশকের শুরু থেকে নতুন-ডারুইনিস্টরা যখন বিভিন্ন গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে প্রথমবারের মত বুঝা শুরু করেন যে বিবর্তনের একক , ইন্ডিভিজুয়াল, গ্রুপ, প্রজাতি এগুলোর কিছুই না, বরং একেকটা জিন ; তখন থেকে জীববিজ্ঞান নিজেই বিশাল-আকারে পাল্টে যেতে থাকে । পদার্থবিদ্যায় এর তুলনা হতে পারে নিউটনিয় গতিবিদ্যা থেকে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যায় উত্তরণের প্রক্রিয়া । এর চাইতে কম কিছু না ।

ফাইন, বুঝলাম যে বিবর্তন জিনকেন্দ্রিক । কিন্তু তাতে কি ? আসলে তাতেই বিশাল কিছু । দুনিয়া উল্টেপাল্টে যাবার মত কিছু । তাতে, এতএতদিন যে আমরা জেনে এসেছিলাম উপযুক্তরা টিকে থাকে, বুদ্ধিমানরা, সুন্দররা, ধূর্তরা, বলবানরা, দূরন্তরা, রোগহীন দীর্ঘায়ুরা ইত্যাতি ইত্যাদি তার সবই বুলশিট । যত সূন্দর, যত বলবান, যত ধূর্ত ধুরন্ধর আর শতায়ু হও প্রজননধারা বজায় রাখতে না পারলে বিবর্তনের দুনিয়ায় জীবনের ষোল আনাই মিছে । অর্থাৎ, অর্থাৎ, অর্থাৎ ইন্ডিভিজুয়াল জীবের দিক থেকে টিকে থাকার চাইতে প্রজনন গুরুত্বপূর্ণ । মানুষের ক্ষেত্রে, যেহেতু সে যৌনজননকারী প্রাণী,সেহেতু এর অর্থ দাঁড়ায় খাবারের চাইতে , শারিরীক নিরাপত্তার চাইতে, বৈষয়িক সফলতার চাইতে যৌনজীবনের সফলতার প্রতি মানুষের জৈবিক বিবর্তনীয় চাপ থাকবে বেশি ।

একারণে যৌনতার ইচ্ছা, যৌন ঈর্ষা, এবং যৌনতার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এ জিনিসগুলো আফ্রিকার জঙ্গল থেকে শুরু করে সিলিকল ভ্যালি পর্যন্ত সব স্তরের মানব সমাজের বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে, মানুষের চিন্তা-চেতনা জগতবীক্ষার মধ্যে অমোছনীয় ছাপ ফেলে আছে । প্রজননের দুর্দমনীয় ইচ্ছা আবার নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে গিয়ে গ্যামেটের কার্যপ্রক্রিয়ার পার্থ্যক্যের জন্য , সেকেন্ডারি আচরণে প্রকাশ পায় আলাদাভাবে । পুরুষের একক প্রজনন কোষের মূল্য যেহেতু শূণ্যের কাছাকাছি, তাই তার সফলতা নির্ভর করে কত বেশি সংখ্যায় ও কত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায় তার উপর । নারীর গ্যামেট যেহেতু মাসে একবারই অল্পসময়ের জন্য সক্রিয় থাকে আর একবার সফল ফার্টিলাইযেশনের পর গর্ভধারণ এবং অল্পবয়সের শিশুকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য গড়পড়তা তিন-চার বছর সময় চলে যায়, সেহেতু নারীর প্রজনন সফলতা নির্ভর করে ভালো ও নির্ভরযোগ্য সংগী বাছাইয়ের উপর ।

সোজা বাংলায় এর অনুবাদ দাঁড়ায়, পুরুষ চাইবে যত বেশি সংখ্যক নারীর সাথে যৌনমিলন করতে ; অন্যদিকে নারী চাইবে গুণগতমানে ভালো এবং নির্ভরযোগ্য কারো সাথে যৌনমিলন করতে । যেহেতু গুণগতমানে ভালো এবং একইসাথে নির্ভরযোগ্য পুরুষ পাওয়ার সম্ভাবণা কম –কারণ পুরুষেরর ইচ্ছা আবার বেশি সংখ্যক নারীর সাথে যৌনমিলন করা- সেহেতু নারীর জন্য উপায় হচ্ছে নির্ভরযোগ্যতা ও গুণগত মান এই দুই জিনিস দুই বা ততোধিক পুরুষের কাছ থেকে আদায় করা ।

দুই বৈশিষ্ট্য দুই ধরণের পুরষের কাছ থেকে আদায় করার এই নারী প্রবণতা পুরুষের মধ্যে তৈরী করে অবিশ্বাস, যেটার গালভরা বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে cuckoldry paranoia. সহজ কথায়, পুরুষ চাচ্ছে তার দেয়া নির্ভরতা নিয়ে নারী যেনো অন্যকোন পুরুষের গ্যামেটের মাধ্যমে সন্তান ধারণ না করে । অর্থাৎ তার রিসোর্স ব্যাবহার করে অন্য পুরুষের সন্তান যেনো বড়ো না হয়, কারণ তা তার নিজের জিনের জন্য পুরোই বাঁশ খাওয়া । মানুষের কাজিন শিম্পাঞ্জি , গরিলা এবং মানুষের মধ্যেও এই কাকলর্ড্রি প্যারানয়ার প্রতিক্রিয়ায় পুরুষের মধ্যে তৈরী করে এক বর্বর আচরণ । অন্য পুরুষের বীজ থেকে জন্ম নেয়া বলে সন্দেহ হলে নিজের সংগীর শিশুকে হত্যা করার প্রবণতা । নারীর পক্ষে অনেক সময় ও যত্ন নিয়ে লালন করা সন্তান এভাবে বেঘোরে মারা যাওয়াটা তার জিনের জন্য , তার নিজের প্রজনন সফলতার জন্য বিশালবড় হুমকি ।

এই হুমকির মোকাবেলায় নারী যে সিস্টেম ব্যাবহার করে তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে infanticide prevention. অর্থাৎ কিভাবে সন্দেহপ্রবণ পুরুষের কাছ থেকে তার শিশুকে রক্ষা করা যায় । একেক এইপ প্রজাতি একেকভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করে । বনোবোদের মধ্যে দেখা যায় অবাধ যৌনতা । যার ফলে কোন পুরুষের পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না কোন শিশু আসলে তার নাকি অন্য কার ঔরসজাত । ফলে বাধাহীনভাবে শিশুহত্যা করতে গেলে নিজহাতে নিজের শিশু হত্যা হয়ে যাবে । সেজন্য বনোবো পুরুষ শিশুহত্যা থেকে বিরত থাকে । শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন নিউক্লিয়ার কাপল না হয়ে কিছু সংখ্যক পুরুষের একটা দল কিছুসংখ্যক নারীর একটা দলের সাথে নন-এক্সক্লুসিভ প্রজনন করে । ফলে শিশুদের রক্ষা করার দায়িত্ব পুরো দল মিলে নেয় । গরিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কঠিন বহুপত্নীক ব্যাবস্থা । আলফা মেইল কয়েকটি নারীর সাথে প্রজননের একচ্ছত্র অধিকার নেয় এবং মেইল ও ফিমেইল দুইপক্ষই এই সিস্টেম কড়াভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে । এক্ষেত্রে নারী তার সংগীর গুণগত মান ও নির্ভরযোগ্যতা এক পুরুষের কাছ থেকেই আদায় করে নেয় ।

মানুষের মেইটিং সিস্টেমে এসে এর সবকিছুই হযবরল লেগে গেছে । মানুষে সাধারণভাবে আলফা মেইলের ধারণা উঠে গেছে । আবার অবাধ যৌনতার সিস্টেমও নাই । তাই সমাজ ও সময়ের অবস্থা অনুযায়ী কাকলর্ড্রি প্যারানয়া আর ইনফ্যান্টিসাইড প্রিভেনশনের টানাপোড়েনে মানুষের মেইটিং সিস্টেম নানান ধরণের জটিল মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এখনো কোথাও থিতু হতে পারে নি । তার উপর সংস্কৃতি ও বিশাল আকারের সমাজ, রাস্ট্র এইসবের কারণে শিশুর নিরাপত্তা ও নির্ভরতার অন্য অনেকরকম উপায় বের হওয়াতে কোন একটা নির্দিষ্ট মেইটিং সিস্টেমের দিকে থিতু হওয়ার জন্য বিবর্তনীয় চাপও নেই ।

এই অস্থিরতাই মানুষের সমাজে যৌনতা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপণা, বালখিল্যতা, নিরীক্ষা, মুখরোচক গালগল্প ও প্রতারণা বিপরীত প্রতারণার উৎস । তাই এত শতাব্দী পেরিয়ে, এত ধরণের সভ্য সমাজ তৈরী হয়ে, গত শতকের ষাটের দশকের যৌনতা বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গিয়েও , এখনো সেক্সুয়াল স্ক্যান্ডালে আমাদের মনোযোগ চলে যায় অবশ্যাম্ভাবীভাবে ।

সম্ভবত এ কারণেই আসিফ নজরুল, আল-মাহমুদ আর হুমায়ুন আহমেদ আর প্রভাতে এখনো আমাদের আগ্রহ জাগে , কৌতুহল জাগে ।

শুরু করলাম ধনিয়া পাতার মত মহান প্রজাতি নিয়ে, শেষ করলাম হোমো ছাগলাইটিস var. Asif Nazrulaitis দিয়ে । ড্যামিট ।