১.
রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন এক উজ্জ্বল দিকপাল যাঁকে বা যাঁর কাজের গবেষণা করে বিখ্যাত হওয়া যায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকেননি, হয়ে উঠেছেন একটি দর্শনে, একটি প্রতিষ্ঠানে। রবীন্দ্র আলোচনার এটি যেমন একটি মৌলিক দিক, ঠিক একই করণে এটি একটি সমস্যাও বটে। সমস্যা এখানেই যে, রক্ত-মাংসের রবীন্দ্রনাথ অধিকাংশ আলোচনায় বা গবেষণায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। আলোচনার ভিত্তি থাকে দর্শন, সৃষ্টিকর্ম বা সাহিত্য। ফলে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যান অনুপস্থিত। এছাড়াও হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন- ‘…আমাদের শেখানো হয়েছিলো মহাপুরুষদের প্রশ্ন করতে নেই, বিব্রত করতে নেই, তাঁদের ভক্তি করাটাই জ্ঞান চর্চা’।

অভিজিৎ এই প্রচলিত ‘জ্ঞান চর্চা’য় আবদ্ধ থাকেননি কোন কালেই। বরাবরই ছিলেন প্রথাবিরোধীর ভূমিকায়। ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটি প্রথা বিরোধী বই নয় কোনভাবেই, কিন্তু ভিন্নধর্মী বইতো বটেই। ভিন্নতা এখানেই যে, লেখক এখানে রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন করেছেন দ্বন্দ্বের যায়গায় দাঁড়িয়ে। এই ধরনের আলোচনা সাধারণত পুরোপুরি মৌলিক হয়না। মৌলিক হয়না কারণ রক্তমাংসের কিংবদন্তিকে তুলে আনতে প্রচণ্ড বিচক্ষণতার সাথে লেখককে পূর্বে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যের ভিতর দিয়ে যেতে হয়; ভিত্তি ধরতে হয়। মুনশিয়ানা দেখাতে হয় তথ্যের বিশ্লেষণে এবং গ্রহণযোগ্যতা বিচারে। অভিজিৎ কেবল প্রাপ্ত গতানুগতিক তথ্যের উপর নির্ভর করেননি, ওলট-পালট করেছেন ভিলা ওকাম্পোর সংগ্রহশালা। সাগর সেঁচে তুলে এনেছেন মুক্তা। ফলে বইটিতে এমন অনেক তথ্যের সন্ধান মেলে যা সুদীর্ঘ কাল থেকেই অপ্রকাশিত। এখানেই বইটির মৌলিকত্ব। বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত তথ্যের পুণরোল্লেখ হলেও তথ্যের সমন্বয় গুণ এবং অপ্রকাশিত তথ্যের অনুসন্ধিৎসু বিশ্লেষণ বইটিকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটির কন্টেন্ট বাছাই এবং সেগ্রিগেশানেও অভিজিৎ রেখেছেন বুদ্ধিমত্তার ছাপ। অধ্যায়গুলোর নামকরণেও আছে অভিনবত্ব। যা নতুন করে পুরোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে ঘটনার সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করবে পাঠককে।

২.
ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের নৈকট্যের সূচনাটা ‘বিজয়ার করকমলে’ অধ্যায়টিতে পাওয়া যাবে। কোন্‌ বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ বুয়েন্স আইরেসে ‘অবসর’ যাপন করেছিলেন সেটির ব্যাখ্যা যেমন আছে অধ্যায়টিতে, তেমনি কিছু প্রথাগত ভুল তথ্যের সংশোধনীও আছে। অধিকাংশ রবীন্দ্র পাঠকের ধারণা ‘আমি চিনি গো চিনি, ওগো বিদেশিনী’ গানটি/কবিতাটি ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা। অভিজিৎ রচনাকালকে ভিত্তি ধরে সেই ভুল শুধরে দিয়েছেন। সাথে সেই ভুলের উৎসটাকেও চিহ্নিত করেছেন সচেতন ভাবে। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোর আথিতেয়তা গ্রহণের কয়েকদিনের মাথায় মূল কবিতাটির একটি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন কল্পনাকে বাস্তবরূপে দেখে। ‘বিদেশিনী’ আবিষ্কারে এখানেই হয়তো ভুলের সূচনা। অনুবাদকে মূল কবিতা ভেবে কিংবা কল্পনাকে ছাপিয়ে ‘বাস্তব’ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো অকাতরে। রবীন্দ্রনাথ ‘ভিলা ওকাম্পো’তে অবস্থান করেছিলেন বলে একটি প্রচলিত ধারণা আছে। প্রকৃতার্থে উনি ছিলেন মিরালনিও নামের ভাড়া বাড়িতে। তথ্যের সংশোধনী এবং সংযোজনী ছাড়াও বিজয়ার করকমলে অধ্যায়টিতে কিছু প্রচলিত পরস্পর বিরোধী তথ্যের আলোচনা আছে ফুটনোট অংশে, যা বইয়ের অপ্রয়োজনীয় কলেবর বৃদ্ধি কমিয়েছে নিঃসন্দেহে, সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিভ্রান্তিগুলোও পাঠককে জানানো গিয়েছে। ৮ নং ফুটনোটে ১২ নভেম্বর তারিখটি ভুল বসত ১২ অক্টোবর উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি পরবর্তী সংস্করণে ঠিক হবে আশা করি।

পূরবী কাব্যগ্রন্থটি যে রবীন্দ্রনাথের অনন্যসাধারণ প্রেমের কবিতার সঙ্কলন এই বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকবার কথা নয়। কিন্তু ভিন্নমত আছে কাব্য চরিত্র নিয়ে। যেহেতু এটি আর্জেন্টিনা ভ্রমণ শেষে প্রকাশিত হওয়া প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং যেহেতু এটি ‘বিজয়া’কে উৎসর্গীকৃত তাই স্বভাবতই অনুমেয় হয় যে, অমর কবিতাগুলোর রক্তমাংসের চরিত্র বোধহয় ওকাম্পো-ই। যেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে ‘অতিথি’, ‘আশঙ্কা’, ‘অন্তর্হিতা’, ‘বৈতরণী’ ‘বিদেশিফুল’, ‘শেষ বসন্ত’র মতো আবেগময় কবিতা। কিন্তু কাব্যগ্রন্থের ৭৮ টি কবিতার মধ্যে ২৯ টি কবিতায় আর্জেন্টিনীয় প্রভাব আছে বলে আমরা অভিজিতের আলোচনায় জানতে পারি। যা আমাদের পূর্ববর্তী গড্ডালিকা ভাবনায় সতর্ক হতে সাহায্য করে। অশ্রুত-গুঞ্জন অধ্যায়েও রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথের ‘প্রেমিক মনের’ ছোঁয়া আছে। পূরবী কাব্যগ্রন্থকে ভিত্তি ধরে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সপ্তদশী রাণু অধিকারী কিংবা এলমা হার্স্টকেও উপস্থিত করেছেন অভিজিৎ, যা সময়টাকে চারপাশ থেকে দেখতে বা পরিস্থিতিটা বুঝতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে।

৩.
কবি, ছোটগল্পকার, প্রবন্ধকার বা রাজনীতি ও সমাজ সচেতন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতোটা আলোচনা হয় চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ততোটা নয় সাধারণ মহলে। বিচ্ছিন্ন ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘childlike, but not childish’ চিত্রকলা সাধারণ পাঠক দেখলেও তাঁর চিত্রকর্মের উৎপত্তি বা অবয়বের পেছনের অবয়ব অজানাই থেকে যায়; কিংবা রঙ সমন্বয়ের জটিল বিষয়েও খুব বেশি জানাশোনা নেই সাধারণ পাঠকের। শিল্পকলার তীর্থ ভূমি প্যারিসে প্রথম রবীন্দ্র প্রদর্শনী তাই নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ কাজ’ হিসেবেই প্রতিভাত হয় সর্বসাধারণে। কিন্তু এই সর্বসাধারণের জন্য অভিজিৎ তুলে এনেছেন অনুপ্রেরণাদাতা ওকাম্পো’কে। যিনি তাঁর পরিচিত বলয়কে ব্যবহার করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন পিগ্যাল গ্যালারিতে। এই অধ্যায়ে সাধারণ পাঠকের জন্য নতুন তথ্য হতে পারে রবীন্দ্রনাথ বর্ণান্ধ ছিলেন। অভিজিতের বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি শুধু তথ্য উল্লেখ করেই শেষ করে দেননি আলোচনা। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় নিয়ে এসেছেন সমসাময়িক বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রটানোপিয়ার সমস্যার একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ অধ্যায়টিতে।

৪.
রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনায় বেশ খানিকটা রক্ষণশীলতা ছিলো, ছিলো আড়ষ্টতা। সমসাময়িক বেগম রোকেয়াতো নয়ই, পূর্ববর্তী বিদ্যাসাগর-রামমোহনদেরও ধারে কাছে ছিলোনা রবীন্দ্রনাথের নারী চিন্তার গতি। হুমায়ূন আজাদ যেটিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আজীবন প্রগতি বিরোধীতা’ বলে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও এই রক্ষণশীলতার সমন্বিত মূল্যায়ন পাওয়া যায় অভিজিতের ‘রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনা ও ওকাম্পো প্রভাব’ অধ্যায়টিতে। অভিজিৎ এখানে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো বা বিভিন্ন লেখার ইঙ্গিতপূর্ণ অংশগুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, যা এই মহামানবের সীমাবদ্ধতাকে পাঠকের সামনে আনবে। জীবনের শেষ ক’টি বছর ছাড়া সারা জীবনই রবীন্দ্রনাথ নারীবাদকে ‘কোলাহল’ বা নারীবাদের আন্দোলনকে ‘নাকি সুরে ক্রন্দন’ হিসেবেই মূল্যায়ন করে গিয়েছেন।

নারী চিন্তা বিষয়ক রবীন্দ্র সীমাবদ্ধতা আলোচনা করতে গিয়ে অভিজিৎ বিভিন্ন বইয়ের বা প্রবন্ধের আলোচনা এনেছেন প্রাসঙ্গিক ভাবে। শুধুমাত্র এই অধ্যায়েই অভিজিত ৫৯টি রেফারেন্স দিয়েছেন। যা তাঁর গবেষণানুদ্ধিৎসু মনকে আরো একবার পাঠকের কাছে দৃশ্যমান করবে।
অভিজিৎ শুধু রবীন্দ্র আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখেননি অধ্যায়টিকে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সেই সময়ের নারীবাদী আইডল বেগম রোকায়ার নারী ভাবনাকেও নিয়ে এসেছেন। যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মহীয়সী নারীর সীমাবদ্ধতাও তুলে এনেছেন। সাথে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র নারী ভাবনাকে জুড়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ–ওকাম্পোর ভাবনা জগতের ফারাক ধরিয়ে দিতে।

রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন-

“নানা দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসারের কল্যাণ অব্যাহত রেখে স্ত্রীলোক কখনো পুরুষের আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে না। প্রকৃতি এই স্ত্রীলোকের অধীনতা কেবল তাদের ধর্মবুদ্ধির উপরে রেখে দিয়েছেন তা নয়, নানা উপায়ে এমনই আটঘাট বেঁধে দিয়েছেন যে, সহজে তার থেকে নিষ্কৃতি নেই”।

ওকাম্পোর অবস্থান তখন-

“আজকের বিশ্বে নারীদের যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবটি সংগঠিত হতে চলেছে তা অধিকাংশ বিপ্লবের মতো ‘তুমি সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দাও’ ধরনের দাবি জানাচ্ছে না। নারীরা পুরুষদের এলাকা দখল করে নেবে – এটা নিশ্চিতভাবেই এর উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্যটা ঠিক এর উলটো, পুরুষরাই তাদের দখলদারিত্ব বন্ধ করবে…অধিকাংশ পুরুষই বুঝতে পারে না যে, আমরা আদের স্থান দখল করে নিতে চাই না (এই ভ্রান্ত ধারণাটি আদের আচরণের প্রতি আমাদের চরম প্রতিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়েছে), বরং আমরা আমাদের স্বকীয় অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে চাই-যেটা এখনো হয়ে উঠেনি”।

পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের রূপান্তরও অভিজিতের আলোচনায় বাদ যায়নি। অভিজিৎ রবীন্দ্রনাথ থেকেই আবার কোট করেছেন-

‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা- ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। যে-সকল দেশ আপন আপন ভৌগলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একান্ত বদ্ধ ছিল তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না- তারা পরস্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। স্বতঃই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়েছে, দৃষ্টিসীমা চিরাভ্যস্ত দিগন্ত পেরিয়ে গেছে। বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নূতন নূতন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার-বিচারের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে’।

শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর একটা নিঃসন্দেহে। যেখানে লাবণ্য চরিত্রটি রাণু অধিকারী এবং ওকাম্পোর সংমিশ্রণ বলেই প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। কিন্তু এই তথ্যটি অজানা ছিলো যে ‘তোমারে যে দিয়েছিনু সে তোমারি দান, গ্রহণ করেছো যতো, ঋণী ততো করেছো আমায়……’ লাইন কটি ওকাম্পোর একটি চিঠির আলোকে সৃষ্টি হয়েছিলো , যা চমকপ্রদ তথ্য নিঃসন্দেহে। ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন-

‘All I received from you has made me so rich in love that the more I spend, the more I have to give. And all I give comes from yourself…So I fell I am giving nothing.’

সবকিছু মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনা সম্পর্কিত সফল এবং তথ্যবহুল একটি লেখা হিসেবে অভিজিতের এই লেখাটি স্বীকৃতি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যেখানে রক্ষণশীল রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ূন আজাদের ভাষায় পরিণত রবীন্দ্রনাথকে আমারা খুঁজে পাই।

৫.
রবীন্দ্রনাথের প্রেম বা ভালোবাসা সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও গবেষক অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের মূল্যায়ন ছিলো-

“৬৫ বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ (রবীন্দ্রনাথ) অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তাঁদের সবার বয়সই তাঁর চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তাঁদের সবার বয়সই তাঁর চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তাঁর যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।

কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তাঁর সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষা ভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে…”।

ডঃ মুরশিদের মতো অনেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রেমকে প্লেটোনিক প্রেম কিংবা নিষ্কাম প্রেম হিসেবে ব্যাখ্যা করেতে গিয়ে রক্ত মাংসের রবীন্দ্রনাথকে লুকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের আলোকে অভিজিৎ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন অন্য সবক্ষেত্রের মতোই রবীন্দ্র জীবনও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ক্লাসিক ট্রেন্ডের বাইরে নয়। প্রথম জীবনে কাদম্বরী দেবী, আনা তড়খড়, ফ্যানি ও লুসি এবং পরবর্তীতে মৈত্রয়ী দেবী, রাণু অধিকারী, ওকাম্পো সহ আরো অনেকের উপস্থিতি জৈব বিবর্তনের আলোচিত মেটিং পার্টনার নির্বাচনের পথেই হেঁটেছে স্বাভাবিক ভাবে। এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে বইটির পঞ্চম অধ্যায়- ‘রবীন্দ্র জীবনে নারী: একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান’ এ।

অধ্যায়টির অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- ওকাম্পো সম্পর্কে আমাদের জানার সীমিত পরিধিকে বিস্তৃত করবে এটি। ওকাম্পো আমাদের কাছে নেহাতই একজন রবীন্দ্রনাথের বান্ধবী কিংবা বড়জোর নারীবাদী লেখিকা হিসেবে পরিচিত। কিংবা ২০১২ সালের পর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সুহৃদ হিসেবে তিনি সাধারণ মহলে চিহ্নিত। কিন্তু ব্যক্তি জীবনের সংগ্রাম বা একইসঙ্গে ফ্যাসিস্ট, কমিউনিস্ট কিংবা নাৎসি ‘উপাধি’ নিয়ে কারা অন্তরীন থাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কিংবা হার্ভাড, বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সম্মাননা কিংবা আর্জেন্টাইন একাডেমী ও লেটার্সের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার মতো তথ্য অজানাই থেকে গিয়েছিলো। অভিজিৎ যেগুলোকে সাধারণ পাঠকের জন্য তুলে এনেছেন অপূর্ব দক্ষতায়।

৬.
পরিশিষ্ট ছাড়া ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে পড়লে মনে হতে পারে প্রতিভাময়ী এক নারী ওকাম্পোর পেছনে কেবল রবীন্দ্রনাথই ছুটে বেড়িয়েছেন। কিংবা ওকাম্পোর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীর খসড়ার খণ্ডিত একটি অনুবাদ, যেটি ‘রবীন্দ্র জীবনে নারী: একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান’ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে-সেটি পড়লে মনে হতে পারে ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা বুঝি একতরফাই ছিলো। ওকাম্পোর অনুভূতি সেখানে অনুপস্থিত। কিন্তু সেই অনুপস্থিত অনুভূতিকে তুলে ধরতে পরিশিষ্ট অংশের চিঠিপত্রের অনুবাদ একটি অনন্যসাধারণ সংযোজনী। যা রক্তমাংসের ওকাম্পোকেই হাজির করবে স্পষ্ট ভাবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, একজন বিজ্ঞান লেখকের এই রকম অসাধারণ সাহিত্যানুবাদ সত্যি বিরল। যেমন অভিজিৎ অনুবাদ করেছেন-

‘আমি খুব খুশি হব এই ভেবে যে, আমার মতো তৃষ্ণার্ত একজন মরু পথিকের জন্য জল খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা বহন করে নিয়ে যাবার উপায় বা শক্তি কোনটাই আমার ছিলোনা……’।

এটার ইংরেজি কী হতে পারে? কিংবা কোনো ইংরেজির ভাবানুবাদ হিসেবে এমন দুর্দান্ত উপস্থাপনা হয়তো কেবল অভিজিতের পক্ষেই সম্ভব!

৭ নম্বর চিঠিতে ওকাম্পোর সম্বোধনটা আপনি থেকে তুমিতে নিয়ে এসেছেন অভিজিৎ (যদিও ১১ নং চিঠিতে আপনি/তুমি বিভ্রাট দেখা গিয়েছে)। খুব সচেতন ভাবেই অভিজিৎ এটি করেছেন যাতে করে পাঠক সম্পর্কের ক্রমোন্নয়নটা ধরতে পারে এবং একাত্ম হতে পারে। এছাড়াও অভিজিৎ চিঠি অনুবাদের সময় পুরো বইটিকে মাথায় রেখেছেন, কিংবা বইটি লেখার সময় ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোকে মাথায় রেখেছেন যাতে কন্ট্রাডিকশন না হয়। কোন একটি সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে কিংবা নির্দিষ্ট অর্থে অনুবাদের ক্ষেত্রে ফুটনোট দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। যা তাঁর বস্তুবাদী এবং যুক্তিবাদী চিন্তাকেই প্রমাণ করে।

পুরো বইটি লিখতে অভিজিৎ যে পরিমান পরিশ্রম করেছেন এবং যে পরিমান রেফারেন্স বইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সেটা আমার কল্পনারও অতীত। অভিনন্দন অভিজিৎ রায়। হ্যাটস্‌ অফ্‌ টু ইউ!!

মূল আলোচনা এখানেই শেষ। এবারের অংশটি সবাই না পড়লেও চলবে। পাঠ প্রতিক্রিয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
——————————————————————————————————-
বইটি কিনে পড়া শুরু করেছিলাম ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহে। চতুর্থ অধ্যায় পড়ে ফেসবুকে একটি মন্তব্য করেছিলাম, যেখানে অভিজিৎ’দা মন্তব্য করে আমাকে একটি গুরু দ্বায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন, যেটির যোগ্য আমি নই কোনভাবেই। উনি একটি রিভিউ লেখার কথা বলেছিলেন। ২৬ তারিখের পর আমি বইটির দিকে তাকাতে পারছিলাম না। রিভিউতো দূরের কথা! বন্যা’দির লেখা পড়ে সাহস করে রিভিউটি তৈরি করার চেষ্টা করেছি। উনি যদি কলম ধরতে পারেন আমি কেন সামান্য রিভিউ করতে পারবোনা?
আরেকটি কথা লিখতে গিয়ে আমার ভিষণ ভিষণ কান্না পাচ্ছে- ২৩ তারিখ অভিজিৎ’দার সাথে আমার প্রথম এবং শেষ দেখা। ১৮ তারিখ থেকেই ফোনে কথা বলে ওনার সাথে মিট করার চেষ্টা করছিলাম। সওদাগরি অফিসের কেরাণীগিরি করে পেরে উঠছিলামনা। অবশেষে ২৩ তারিখ দেখা হয়। বন্যা’দি সহ আমরা প্রদীপ দেবের বই কিনি মীরা প্রকাশনী থেকে। আমি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে বইটি ব্যাগে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। দাদার শুভেচ্ছা নেবো বলে। অভিজিৎ’দা আমাকে যা দিয়েছেন তার কানা কড়ির যোগ্য আমি নই (সেটা প্রশ্রয় হোক, প্রশংসা হোক কিংবা উৎসাহ); আক্ষরিকভাবেই কথাটা বললাম। বিনয়ের জন্য নয়। দাদা, একদিন তোমার সঙ্গ পেয়ে আজ আমি ভিষণ রকমের নিসঙ্গতায় ভুগছি। যা হয়েছে তা কল্পনারও অতীত।