সৃষ্টিতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে বৌদ্ধিক যে কোন চিন্তাকে ধর্ম নিন্দা বা ঈশ্বর নিন্দা অপবাদে অপরাধ গন্য করে, উপমহাদেশের দেশগুলোতে সেই বৃটিশ ভারতকালীন সময় থেকেই প্রচলিত আছে ব্লাসফেমি নামের হাস্যকর এক মধ্যযুগীয় আইন। ধর্মের ছায়ায় স্বৈরশাসনকে বৈধ করে নেয়ার অনুপম এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি রাষ্ট্রের শাসকবর্গ; বরং নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে বর্বর কালো আইনটিকে আরও বর্ধিত করেছেন শস্তা জনপ্রিয়তার লোভ ও মুক্তচিন্তা-বাক স্বাধীনতার টুঁটিকে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরবার স্বার্থে। অতি অসভ্য, অতি বর্বর এই আইনটিতে ধর্মানুভুতি নামের নিষ্ফল এক আবেগ ও নির্বোধ মনোচাঞ্চল্যকে আমলে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের অহং সন্তুষ্টির জন্যে আইনের নামে জনতার সাথে একটি রাষ্ট্রীয় রগড় করা হয় এবং সেই রগড়কে আইন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

ব্লাসফেমি হল সেই হাস্যকর আইন, যে আইনে কথিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে কেউ কখনও দেখেনি, সে অস্তিত্বহীন, মৃত বা নিখোঁজ। উপরন্তু তার নিজের কোন অভিযোগ আছে কি নেই সেটা স্পষ্ট ভাবে জানা সম্ভব না হলেও তার কপট ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করা ভন্ড, সুবিধাভোগী ও আপাত শুভানুধ্যায়ীদের অস্বাভাবিক অনুভূতিকে আমলে নিয়ে মধ্যযুগীয় এক রগড়কে বিচারকার্যের নাম দেয়া হয়। একবিংশ শতকের কোন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সাথে ব্লাসফেমি নামের এই ঠুনকো ও ছেঁদো রসিকতা করছে মানেই সে রাষ্ট্র আধুনিক সমাজের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠছে, রাষ্ট্র তাঁর নিজ ব্যর্থতা ও দুষ্কর্ম গুলোকে ঢাকার জন্য শঠতার আশ্রয়ী হচ্ছে।

ধর্মের নামে জনতার উপর অত্যাচারের অনন্য এই হাতিয়ারটির ব্যবহার প্রথম শুরু করেছিল ইউরোপীয়রাই। সভ্যতার বিবর্তনের কালক্রমে বর্বর সে আচার থেকে তারা আজ সরে এলেও এই আইনটি আজ মৌলবাদের অতি প্রিয় এক শব্দে পরিণত হয়েছে এবং ধর্মাশ্রয়ী সমাজ ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে অভ্যস্ত দেশগুলোতে আবির্ভূত হয়েছে অযৌক্তিক ভাবে ভিন্নমত দমনের জন্য মোক্ষম এক ব্রহ্মাস্ত্রে।

সব সম্ভবের লীলাভূমি বাংলা নামের দেশটির অসভ্য মূর্খ সমাজে ক্ষমতাশীন থাকা সত্ত্বেও জামাত সহযোগী মোটামাথার বিএনপি এই অস্ত্রটির মর্মার্থ ও গুরুত্ব সঠিকভাবে বোঝেনি বলে সেটাকে নিজ ক্ষমতাকালে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করতে সমর্থ হয়নি; কিন্তু ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের ধূর্ত নেতৃবৃন্দ সে ভ্রমটি করেননি। ব্লাসফেমি আইনটিকে স্বনামে আবির্ভূত না করলেও তারা প্রবর্তন করেছেন ৫৭ ধারা, যা প্রকারন্তরে ব্লাসফেমী আইনটির অভাব পরিপূর্ণ করেছে। ৫৭ ধারার কল্যানে আজ আমরা নিজের দেশে এমনভাবে বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যেনো মুক্তচিন্তা করাটা, প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটাই একটা অপরাধ! কোন রকম অন্যায় করবার আগেই ধর্মমোহে আচ্ছন্নদের মূর্খদের কল্পনার অনুভুতিতে আঘাত করবার আশংকাতেই আমরা নিজ নিজ মনোজগতে দণ্ডিত হয়ে আছি। রাজনৈতিক কারনে ধর্মান্ধদের সাথে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের ক্রমিক আপোষের কারনে আজ আমরা দমবন্ধ করা দুঃসহ এক অবস্থায় পৌঁছে গেছি।

প্রিয় হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, রাষ্ট্র আমাদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার ব্যবস্থা তো করেই নি, এমন কি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে নি; বরং রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছে হিংস্র; আমাদের জন্য চব্বিশ ঘণ্টার আতঙ্ক। রাষ্ট্র দ্বারা আমাদের দেহ বিকল, মনও আক্রান্ত, মগজ বিনষ্ট। দেহ-মন-মগজে আক্রান্ত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাস করা মৃত্যুর থেকেও পীড়াদায়ক।

একবিংশ শতকের কোন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সাথে ব্লাসফেমি নামের এই ঠুনকো ও ছেঁদো রসিকতা করছে মানেই সে রাষ্ট্র আধুনিক সমাজের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠছে, রাষ্ট্র তাঁর নিজ ব্যর্থতা ও দুষ্কর্ম গুলোকে ঢাকার জন্য শঠতার আশ্রয়ী হচ্ছে।

এই রাষ্ট্র কি চায়? বাংলাদেশকে বাংলাস্তানে পরিনত করতে? ধর্মের নামে মৌলবাদের অসভ্যতা আর বর্বরতাকে টিকিয়ে রাখতে? চিন্তার অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে?

ধিক্কার জানাই এই নীতিনির্ধারকদের, প্রতারক ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের।