আমাদের আইকনিক অভিজিত, এরপর ওয়াশিকুর রহমান বাবু যার জীবন শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল। ‘নাস্তিকরা’ ধর্ম নিয়ে কেন লিখতে যায়? নিজে বিশ্বাস কর না ভাল কথা, অপরের ধর্মানুভূতিতে কেন খামোখা আঘাত হানো? ধর্ম নিয়ে খোঁচাখুচি করলে এমন হবেই… কোমলপ্রান নিরীহ ধার্মিকও খেপে উঠবে, বিদেশে এসাইলামের লোভে নাস্তিকরা এসব লেখে…। এ জাতীয় যুক্তি শোনা গেছে এমনকি হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা প্রসংগে মরহুম হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকেও।

যেটা ওনারা পরিষ্কার বলেন না (বললে আসলে খুবই ভাল হয়) তা হল ইসলাম যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম তাই এই ধর্ম সমালোচনার ঊর্ধ্বে; এই ধর্ম ব্যাবহার করে ভাবে গদ গদ হয়ে এর ফলোয়াররা যত খুশী বানোয়াট, আজগুবি, তত্ত্ব ছড়াবেন; সরাসরি সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবেন কিন্তু তার প্রতিবাদে রা কাড়া যাবে না। কারন প্রতিবাদ করতে গেলেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মানুভূতি আহত হবে। আপনি খুন হয়ে গেলেও এই উছিলায় সমাজের প্রগতিশীল অংশও আপনারই দোষ ধরবে। নিজের পিঠের চামড়া বাঁচানো বড় কথা, নাস্তিক মুরতাদরা তো আর চাপাতি নিয়ে গলায় কোপ দেবে না, দিলে দিবে নিজ ধর্মের ভাইরাই।

এরপর অবধারিতভাবে আরেকটি প্রশ্ন আসে, কেন শুধু ইসলাম? কই; হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্ট ধর্ম নিয়ে তো তেমন কিছু এরা লেখে না। কিছু বিদগ্ধ জ্ঞানী ভাই এর কাছে রীতিমত পরিসংখ্যানের বার গ্রাফ পওয়া যায় যাতে মুক্তমনায় অন্য ধর্মের তূলনায় ইসলাম কত বেশী সমালোচনা করা হয়েছে তার নিখুত হিসেব পাওয়া যায়।

ধরা যাক একটি কল্পিত চিত্র। আপনি জন্ম থেকে উঠতে বসতে শুনছেন হিন্দু ধর্মই একমাত্র পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা। এই ধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্মই বাতিল, আপনি চান আর না চান এই ধর্মের নির্দেশ অনুসারে রাষ্ট্র সমাজ সব চালাতে হবে, সাথে রামকৃষ্ম কিংবা বিবেকানন্দ এই জাতীয় কেউ হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ যার জীবন আদর্শ হল অবশ্য পালনীয় যার সাথে আপোষ নাই। আপনি নিজে সামান্য ঘাঁটাঘাটি করে জানতে পারলেন যে এসব দাবীতে বিরাট ফাঁক আছে। ঘাঁটাঘাটিও আসলে তেমন লাগে না, ৩ হাজার বছর আগের লিখিত বিধিবিধান এই যুগে অচল হবে সেটাই স্বাভাবিক। এখন আপনার কি উচিত হবে? হিন্দু ধর্মাবলম্বী যারা এসব দাবী দাওয়া অষ্ট প্রহর করে তাদের ধর্মানুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে নীরব থাকা? নাকি নিজে যা সত্য বলে জানছেন তা প্রকাশ করা? পরেরটা করে থাকলে আপনাকে ‘উগ্র হিন্দু বিদ্বেষী’ গাল দিলে আপনার নিজ অনুভূতি কেমন হবে? অথেন্টিক সোর্সে রামকৃষ্ম বা বিবেকানন্দের জীবনীতে আপত্তিকর বা অন্তত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ দাবীর সাথে অসামঞ্জ্যপূর্ন কিছু পেলে আপনি কি অপরের ধর্মানুভূতির সম্মানে চেপে যাবেন? ‘হিন্দু ধর্ম মানো না ভাল কথা, তাই বলে হিন্দু অনুভূতিতে আঘাত কর কেন’ জাতীয় মহান বানী শুনলে আপনার অনুভূতি ঠিক কেমন হবে? উদাহরনটা সম্পূর্ন তত্ত্বীয় হলেও এমন পরিস্থিতিতে ধর্মানুভূতি সচেতন শতকরা কতজন মোমিন মুসলমান অপরের ধর্মানুভূতিকে সম্মান জানিয়ে নীরব থাকতে পারবেন তা কি আত্মবিশ্বাসের সাথে কেউ বলতে পারবেন? বাংলাদেশের মিডিয়ায় কেন ইসলাম সম্পর্কিত এত আলোচনা হয় তা কি জলের মত পরিষ্কার নয়?

বাস্তব হল অন্তত মুসলমান প্রধান দেশগুলিতে ইসলাম ধর্মকে অবসেশনের কারনে যে অবাস্থব অবস্থানে রাখা হয়েছে; “একমাত্র পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা যার অন্যথা হতে পারে না” এমন দর্শন বহুযুগ থেকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢোকনো আছে তাতে কোন না কোন পর্যায়ে ধর্ম সমালোচনা বা ‘বিদ্বেষ’ প্রদর্শন ছাড়া কোন উপায় থাকে না। কেন ধর্ম সমালোচনামূলক লেখা, কেন শুধু ইসলাম তার সব জবাব এ যায়গাতেই আছে। কেন শুধু ইসলাম বলে যারা জেরবার হন তারা অভিনয় করেন কিনা ঠিক বুঝি না। যারা ধর্মানুভূতি সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান রাখেন তারাও কোন না কোন পর্যায়ে ঠিকই সেই ধর্মানুভূতিতে হয়ত আঘাত ঠিকই দেবেন। খুব অবাক লাগছে? আসলে তেমন অবাক হবার কিছু নেই।

শুরুতেই এ কারনে নাস্তিক শব্দটা বন্ধনির মাঝে রেখেছিলাম। এর কারন হল ইসলাম ধর্ম সমালোচনা আসলে কেবল নাস্তিক বা বিধর্মীরাই করে না। ওপরে উল্লেখ করা মূল কারনের জন্য করেন বা করতে বাধ্য হন খোদ মুসলমান দাবীদার অনেক ব্যাক্তিদেরও, পাঁড় নাস্তিকের সাথে পার্থক্য হয়তবা কেবল মাত্রাগত বা ভাষাগত; অবস্থানগত না। যেমন বাংলা ব্লগে কিছু শান্তিপ্রিয় মুসলমান আছেন যারা হুমায়ুন আহমেদ সম তত্ত্বে ঘোর বিশ্বাসী। তারা অত্যন্ত উদার, তাদের নিজ ইসলাম ধর্ম, এমনকি অন্য কোন ধর্মেও আপত্তিকর কিছু আছে বা থাকতেও পারে সেই সম্ভাবনাও তারা মনে ঠাঁই দেন না। ধর্ম সমালোচনকারীদের তারা ছাগু শ্রেনীর মতই ঘৃনা করে তা সগর্বে ঘোষনা দেন। মজার ব্যাপার হল হেফাজতি উত্থানের সময় নাস্তিককূলের সাথে সাথে তাদেরও বেশ ক’জনের নামে আরো বড় ধর্ম রক্ষক শ্রেনীর তরফ থেকে ‘নাস্তিক’ হিসেবেই জেল ফাঁসীর দাবী এসেছে।

এবার একটু আন্তর্জাতিক পরিসরে যাই, তাহলে সমস্যাটার ব্যাপকতা হয়ত বোঝা যাবে। ধর্মের ভূমিকা আছে কি নেই এই অদ্ভূত আর্গুমেন্ট এখানে বাদ দিয়েও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যে সমস্ত মুসলমান প্রধান দেশে অন্তত কিছু মাত্রায় বাক স্বাধীনতা আছে সে সব দেশেই ধর্মনিরপেক্ষ ধারা (যাদের সাধারন ভাবে সেক্যুলার বলা যায়) এবং যারা ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত এই দুই ধারা মুখোমুখি অবস্থানে আছে। সমীকরনটা বেশ জটিল হতে পারে এ কারনে যে সেক্যুলার মানেই ধর্মহীন বা নাস্তিক নয়, অন্তত বাংলাদেশে এই ধারায় যারা আছেন তারাও সকলে এক বড় অংশ নিজেদের মুসলমানই দাবী করেন, নানান ধর্মীয় রিচ্যূয়ালও পালন করেন। কিন্তু তারা ইসলাম ধর্মকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মত ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের গন্ডিতে রাখার পক্ষপাতি, পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে দেখতে চান না। ব্যাক্তি বিশেষে কিছুটা ওভারল্যাপ মাঝে মাঝে হলেও দুই গ্রুপের মাঝে মূল্যবোধগত মোটা দাগে পার্থক্য এখানেই আছে। উগ্র নাস্তিক বলে গাল দেওয়া ব্লগের মডারেটগন কিংবা বাস্তব জীবনের জাফর ইকবাল স্যার, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির এই শ্রেনীর আরো বহু বুদ্ধিজীবিগন এই কারনেই (ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাবস্থার সমর্থক) ইসলাপ্রেমিক পরের গ্রুপের কাছে গালি খান, সময় সময় নাস্তিক বনে যান, হত্যার হুমকিও পান। অত্যন্ত সরল ব্যাপার; ধর্ম ব্যাবসা…আসল ইসলাম জানা না জানা, জামাতি ষড়যন্ত্র এসব মূল ব্যাপার না।

এসব উদাহরন কয়েকটা কারনে দিলাম। এক, অন্তত মুসলমান প্রধান দেশগুলিতে ধর্ম সমালোচনা নিতান্ত ঐচ্ছিক কোন বিষয় নয়। ধর্মকে এসব সমাজে টেনে আনা হয় যত্রতত্র। জাতির পিতা শেখ মুজিব নয় জাতির পিতা ইব্রাহীম বা কিছু আলেম মোল্লার নারী অবমাননাকর বক্তব্য জাতীয় উটকো প্যাঁচাল বাদই দিলাম। আজকের খবরে দেখা যাচ্ছে সরকারী আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন দাবী করে ওলামা লীগ ব্যানারে কিছু আলেম মোল্লা কিসিমের ব্যাক্তি বাল্যবিলাহ বিরোধী আইন বাতিল করার দাবী জানাচ্ছে। আপনি বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠানে বা ২১শে ফেব্রুয়ারীতে প্রভাত ফেরীতে যাচ্ছেন আর তখন কেউ যদি বলে এসব বিদাতী হিন্দুয়ানী অনুষ্ঠানে গেলে গুনাহ হবে তবে ধর্ম এড়িয়ে কতক্ষন বিতর্ক করা সম্ভব? বিশিষ্ট আলেমগন যখন ৭১ সালে যা করেছি ইসলামের নামে করেছি বা কিছু লোকে গাদ্দারি করে পাকিস্তান ভেঙ্গেছে গোছের কথাবার্তা বলে তখন আমার উচিত কি? বছর দুয়েক আগে মুক্তমনায় ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা নামে একটি সিরিজ শুরু করেছিলাম, সেখানে দেখিয়েছিলাম কিভাবে আমাদের দেশসন নানান দেশে ইসলাম ধর্ম শিক্ষার নামে পরিষ্কার সাম্প্রদায়িকতার বিষ কোমলমতি শিশুদের মনে রোপন করা হচ্ছে। সরকারী সিলেবাসের সেসব বই এ সাম্প্রদায়িকতার সেসব পাঠ হাদীস কোরান কোট করে করা। ধর্ম বাদ দিয়ে এ সম্পর্কিত আলোচনা ঠিক কিভাবে সম্ভব সুশীল ভাইরা কেউ বোঝাবেন? নাকি ধর্মানুভূতি অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা বিনা বাধায় চলুক আমাদের মেনে নিতে হবে? যারা এসব সহি ইসলাম নয়, ধর্মব্যাবসায়ী, জামাত শিবিরের চক্রান্ত এসব বলে থাকেন তারা কিভাবে বছরের পর নিজের ছেলেমেয়েকে এসব পাঠ দেওয়া মেনে নেন সে প্রশ্ন এখানে বাদই দিলাম। কেউ কি বোঝাতে পারবেন ইসলাম বাদ দিয়ে এসব আলোচনায় কিভাবে অন্য ধর্ম আসবে? এসব কি হিন্দু ধর্ম বা খৃষ্ট ধর্মের নামে হচ্ছে? ধর্ম সম্পর্কিত অপ্রীতিকর প্রসংগ চলে আসলে সে দায় আসলে কার ওপর পড়ে?

ধর্মকে জীবন যাত্রার সাথে জড়িয়ে, নবী মোহাম্মদকে নিয়ে এমন অবসেশনের জগত মুসলমান প্রধান দেশগুলিতে গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে নিজ প্রয়োযনেই কোন না কোন সময় খোদ মুসলমানদেরই ধর্মবিদ্বেষী, নবী বিদ্বেষী বনে যেতে হয়। নাস্তিকের সাথে পার্থক্য কেবল ভাষাগত। এ সমস্যা শুরু বাংলাদেশেরই ইউনিক নয়, মোটামুটি আন্তর্জাতিকই বলা যায়।

মিশরের দিকে তাকাই। বেশ কিছু নামকরা ইসলামি স্কলার জন্মদানকারী এবং প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী এ দেশটি এক সময় দীর্ঘদিন আমাদের মতই সেক্যুলার এবং ইসলামপন্থী দুই গ্রুপের টানাপোড়েনের মাঝে আছে। আনোয়ার সাদাতের সময় দেশটির অবস্থা কিছুটা আমাদের ৭১-৭৫ সময়ের মত ছিল, ধর্মনিরপক্ষ ব্যাবস্থা মোটামুটি চলেছে, যদিও ধর্মীয় অনুভূতি যাদের প্রবল তারা স্বাভাবিকভাবেই মন থেকে সে ব্যাবস্থা মেনে নেয়নি। আনোয়ার সাদাত হত্যার পর পূনরায় ইসলামিষ্টদের পূনরুত্থান ঘটে, আমাদের ৭৫ পরবর্তি অবস্থার মতই ফলত যা হবার তাইই হতে থাকে। ধর্মীয় ব্যাবস্থা কায়েম কর আবহ তৈরী হতে থাকে, সেক্যুলার বুদ্ধিজীবিরাও বিরোধীতা করেন এবং আমাদের মতই সেখানকার সেক্যুলার বুদ্ধিজীবিগনদের নিরন্তর হত্যার হুমকি মাথায় রাখতে হয়, যদিও নিঃসন্দেহে তারাও বেশীরভাগই মুসলমান। সে দেশে ’৮২ সাল থেকে ৯৩ সালের মাঝে ২০২ জন মানুষকে ইসলামিষ্ট জংগীরা হত্যা করে। অফিশিয়ালী লেখা হয় “politically motivated assaults” যা শুনলে মডারেটগন অত্যন্ত স্বস্থি বোধ করেন, যাক ধর্ম তো রেহাই পেল, আরে ভাই সবই রাজনীতির দোষ। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাবহার করা হয়েছে।

ধরা যাক ফারাজ ফাওদার কথা। কৃষি বিষয়ের অধ্যাপক এই ভদ্রলোককে ‘৯২ সালে এক জিহাদী গ্রুপ প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে, মারাত্মক আহত হয় তার ছেলে এবং আরো কিছু পথচারী। কোন গোপন উগ্র সন্ত্রাসী গ্রুপ খুন করে গেলে বলার তেমন কিছু ছিল না, সন্ত্রাসীদের হাতে কত লোকেই তো খুন হয়। সেই খুনের পথ যখন আল আজহারের মত ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেম ওলামাগন ফতোয়ার মাধ্যমে করে দেন তখন চিন্তিত হতেই হয়, নিছক চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসী হামলার বাইরেও অনেক কিছু চিন্তা করার বিষয় আসে। ফারাজ ফাওদা নাস্তিক ছিলেন না। ব্যাক্তিগত জীবনে মুসলমানই ছিলেন, ইসলামের নামে প্রচলিত নানান বিধিবিধানের সমালোচনা করতেন, কোনদিন নবী রসূল গালিগালাজ করেননি; যাকে বলে সংস্কারপন্থী মুসলমান ছিলেন। সর্বোপরি ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ব্যাবস্থা থেকে পৃথক রাখার পক্ষে লেখালেখি করতেন, শরিয়া আইনের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার পক্ষে লিখতেন, সেটাই হয়েছিল কাল। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালের আলেমগন সে কারনেই তাকে ইসলামের শত্রু আখ্যায়িত করে। ফোদার খুনীরা সেই ফতোয়াই রেফার করে বিবেক বর্জিত হয়ে বীরের মত ঠান্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে। সেই বিজ্ঞ আলেমগন তাদের ধর্মীয় ফতোয়ার ব্যাপারে এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আদালতে দাঁড়িয়েও তাদের একজন প্রকাশ্য দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় ঘটা হত্যাকান্ডকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে স্বাক্ষ্য দেন। আর কয়টি সভ্য সমাজের আদালতে এমন স্বাক্ষ্য সম্ভব এ মুহুর্তে বলতে পারি না।

The group explicitly referred to the Al-Azhar fatwā when claiming responsibility. An Al-Azhar scholar, Mohammed al-Ghazali, later asserted as a witness before the court that it was not wrong to kill an apostate. Al-Ghazali said: “The killing of Farag Foda was in fact the implementation of the punishment against an apostate which the imam (the Islamic leader in Egypt) has failed to implement.” Eight of the thirteen Islamists brought to trial for the murder were subsequently acquitted.

সম্পূর্ন ভাবে রিলিজিয়াস মোটিভেটেড এসব ঘটনার মাঝে কদর্য ভাষায় নবী রসূল গালিগালাজ, ধর্ম নিয়ে ‘বেহুদা’ খোঁচাখুচির ভূমিকা কই? ফাওদা এসাইলাম প্রত্যাশী ছিলেন মার্কিন নাগরিক ও ছয় ফিগার রোজগার করা অভিজিত যেমন ছিল? আস্তিক নাস্তিকই বা কই? সিম্পল ফ্যাক্ট হল ধর্মীয় জীবন ব্যাবস্থা কায়েমের নামে হাজার বছরের প্রাচীন মূল্যবোধ কায়েমের দাবী করলে এক পর্যায়ে মুসলমানদেরও নিজ স্বার্থেই তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, অবশ্য সকলে শান্তির দিশারী নিজ ধর্মের ভাইদের হাতে খুন হতে চান না সেটাও স্বাভাবিক। সরল সমীকরন হল যতই ইসলাম প্রীতি দেখান ফারাজ ফাওদার পরিনতি আপনারও হতে পারে, সেজন্য ওয়াশিক বাবু, অভিজিত রায় বা হুমায়ুন আজাদের মত ঘোর নাস্তিক হতে হবে না। শরিয়ার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নাই, কিংবা আসল শরিয়ায় এটা নাই, অমূক হাদীস জাল, অমুক আয়াতের অমূক ব্যাখ্যা ভুল এসব বায়বীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে পার পাবেন না। আপনার চাইতেও বড় ধর্মপ্রেমিক এসে মেরে যাবে এবং সেটা ধর্মীয় সূত্র যেসব আপনারা পরম শ্রদ্ধাভরে সর্বযুগের আদর্শ বলে মানেন রেফার করে হালাল করবেন আপনাদেরই লালিত পালিত ধর্মগুরুগন।

শুধু তাই নয়, কারাদন্ড শেষ করার পর খালাস প্রাপ্ত এক খুনী রেডিও ইন্টারভিউতে ২০১৩ সালে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে সে এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে মোটেও অনুতপ্ত নয়, উলটো সে ইন্টারভিউকারীর ঈমান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। Abdrabu defended Foda’s murder, stating that “The punishment for an apostate is death, even if he repents” and that “…[if] the ruler does not implement the shari’a, any of the citizens is entitled to carry out Allah’s punishment.” Abdrabu also stated that “Farag Foda is dead, and will receive his just desserts in the Hereafter.” When asked about the feelings of Foda’s children, Abdrabu accused the interviewer of using “venomous methods” against him, and then stated “let me ask you if you were not harmed by someone who cursed the Prophet and his wives? What gives you greater pain and sorrow? If you say that it is Farag Foda, then you should reexamine your faith.”

একই পরিনতি থেকে রেহাই পাননি সে দেশের প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী সাহিত্যক নাগিব মাহফুজের মত ব্যাক্তিত্বও। সে বেচারার অপরাধ ছিল উনি রুশদীর লেখা স্যাটানিক ভার্সেস বইটার সমালোচনা করলেও আয়াতূল্লাহ খোমেনী কর্তৃক সালমান রুশদীর হত্যার ফতোয়ার সমালোচনা করে খোমেনীকে সন্ত্রাসী বলেছিলেন, ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাগত জানিয়েছিলেন। পুলিশ পাহারায় থাকা অবস্থায় ৮২ বছরের এই বৃদ্ধকেও ঘাড়ে ছুরি মেরে মারাত্মকভাবে আহত করে বাকি জীবনের জন্য লেখার হাত শেষ করে দেওয়া হয়। এই ভদ্রলোকও নাস্তিক, বিধর্মী বা ছূপা নাস্তিক এমন কিছুই ছিলেন না, ছিলেন একজন সাধারন মুসলমান যিনি ধর্মীয় বদ্ধ চিন্তাচেতনার বাইরে নিজের মস্তিষ্ক খাটাতেন, সেটাই আসল অপরাধ। হুমায়ুন আহমেদকে জিজ্ঞাসা করা হলে হয়ত উনি সাফ বলে দিতেন শত কোটি মুসলমানের প্রানপ্রিয় শরিয়া আইনের সমালোচনা করলে কিংবা ঘৃনিত সালমান রুশদির হত্যা ফতোয়ার সমালোচনা করলে মৌলবাদীর দরকার নেই……কিংবা কেন ফাওদা শুধু শরিয়ার সমালোচনা করতেন, কেন বৈদিক সমাজের সমালোচনা করতেন না? কিংবা নাগিব মাহফুজ খালি ইরানের সমালোচনা করলেন, ভারতের সমালোচনা কেন করলেন না এভাবে বহু অর্থহীন কেন দাঁড় করানো যায়।

বাংলাদেশেও দুই গ্রুপের সঙ্ঘাত এই রকম বিপদজনক দিকে মোড় নিতে খুব বেশী বাকি নেই। ২০১৩ সালে বিখ্যাত পিউ রিসার্চের এক জরীপে দেখা যায় যে দেশের ৮২ ভাগ মুসলমান শরিয়া ভিত্তিক আইন ব্যাবস্থা চায়। এতে তেমন অবাক হবার কিছু নেই। শরিয়া আইনে কি কি আছে সে সম্পর্কে ষ্পষ্ট ধারনা থাক বা না থাক এটা কোরান সূন্নাহর ভিত্তিতে গড়ে তোলা আইন ব্যাবস্থা এটাই মুসলমান মানসের জন্য যথেষ্ট। যদিও শরিয়া আইনের নামে অন্যান্য মুসলমান প্রধান দেশে কি কি আইন চলে তার উদাহরন দেওয়া শুরু করলে সেই একই কন্ঠ থেকেই শোনা যাবে এসব আসল ইসলাম নয়। ফাঁকতালে এই বিভ্রান্ত পাবলিক সেন্টিমেন্ট ব্যাবহার করে দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে মোল্লাচক্র। যারাই শরিয়া আইনের বিরোধীতা করবেন তারাই হয়ে যাবেন নাস্তিক মুরতাদ, তাদের হত্যা করার ফতোয়া আসবে সহি সূত্র থেকে। আল্লাহ রসূলের আইনের যারা বিরোধীতা করে তাদের হত্যা করে ইসলাম রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনে ব্রতী ঈমান্দার ভাই এর অভাব নিঃসন্দেহে দুনিয়ার বহু যায়গার মত এই বাংলায়ও হবে না। একদল দাবী জানাবে মধ্যযুগের আরব সমাজে প্রচলিত আইন কানুন দাবী জানাতে, আপনার তার প্রতিবাদ করার অধিকার থাকবে না কারন সেটা করতে গেলে ধর্মবিরোধী বক্তব্য দিতেই হবে। হুজুরের নির্দেশ আসবে হত্যা করার, কার্যকরও হয়ে যাবে।

সময়ের সাথে কামাল আতাতূর্কের সেক্যুলার তুরষ্কেও সমসমায়িক বাকি দেশগুলির মতই ইসলাম কায়েম কর রব উঠেছে, ফলাফল যেমন হবার তেমনই চলছে। দুই ধরনের মূল্যবোধের বিভাজন দিনে দিনে বাড়ছে, অনেক সময়ই নন-রিলিজিয়াস বিষয় নিয়েও তিক্ততা সঙ্ঘাত বেঁধে যাচ্ছে। ধর্ম অবামাননার দায়ে মোহাম্মদ বেড়াল মার্কা কারনে সে দেশের লোকজনও সময়ে সময়ে ফেঁসে যাচ্ছেন। মাত্র কিছুদিন আগে ফাজিল সে নামের একজন পিয়ানিষ্টকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে টুইটারে ওমর খৈয়ামের বেহেশতের হুরী বিষয়ক কবিতার চরন কোট করা এবং মূয়াজ্জিন ঘটিত এক হাল্কা রসিকতার কারনে। সে দেশের একজন শীর্ষ মানবতাবাদি লেখক, কৌতূক অভিনেতা (শুধু বই লিখে ওনার মত উপার্জন সে দেশে আর কেউ করতে পারেনি, সেসব বই এর কপিরাইট ওনার মানবতাবাদী সংগঠনকে দিয়ে যান) এবং বুদ্ধিজীবি আজিজ নেসিনের ওপর ক্ষিপ্ত হয় দেশের ধর্মপ্রান সরল জনতা (মূলত সুন্নী মুসলমানরা); ওনার অপরাধ উনি সালমান রুশদির বই এর কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন। সুযোগ একদিন মিলেও যায়। ‘৯৩ সালের ২রা জুলাই তুরষ্কের সিভাস শহরের এক হোটেলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবার সময় জুমার নামাজের পর শান্তিপ্রিয় সুন্নী মুসলমানরা (দয়া করে কেন সন্ত্রাসী না বলে ধর্ম পরিচয় টান দিচ্ছি এমন প্রশ্ন কেউ করবেন না) সামান্য উত্তেজিত হয়ে সেই হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আজিজ নেসিন বেঁচে গেলেও পুড়ে মারা যান ৩৫ জন মানুষ যাদের মাঝে ছিলেন সে সময়কার বেশ কিছু শীর্ষ আর্টিষ্ট, পার্ফরমিষ্ট। এই ঘটনা তুরষ্কের ইতিহাসে Sivas massacre নামে পরিচিত। আজিজ নেসিন অবশ্য নাস্তিক ছিলেন, আরো বামপনন্থী। আশা করি এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এই তো পাওয়া গেছে সেই উগ্র নাস্তিক ব্যাটাই দায়ী, তায় আবার চীনাবাদাম। কেন সে রুশদির বই অনুবাদ শুরু করতে গেল…… এই ঘটনা তুরষ্কের চলমান সেক্যুলার বনাম ইসলামিষ্ট ধারার বিভাজন স্বাভাবিকভাবেই আরো বাড়ায়। ততকালীন সরকার এই ঘটনার বিচারে কঠোর হলেও সেন্সরশীপ আরোপ করে। যদিও অনেকের মতে সেদিনকার হামলা শুধু আজিজ নেসিনকে টার্গেট করেই করা হয়নি। করা হয়েছিল সমগ্র সেক্যুলার ধারার বিরুদ্ধেই ক্ষোভের কারনেই। বিচারে ১২৪ জনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল “overthrowing the secular constitutional order.” চার্জ।

কত দেশের উদাহরন আর দেব? সেই একই ট্রেন্ড, ধর্মকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয় জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে; আবহ তৈরী করা হয় এক অদ্ভূত অনুভূতির আবেশের; সেটার বিরুদ্ধে যেভাবে বা যেইই কথা বলুক সে হয়ে যায় ইসলাম বিদ্বেষী, কাফের, মুরতাদ এমন নানান কিছু। তাদের হত্যা করা করার ফতোয়া আসে দেশের ধর্মীয় নেতাদের তরফ থেকে। এরপর ড্যামেজ রিপেয়ারে এগিয়ে আসেন ‘ইহা আসল ইসলাম নহে’ বলে মডারেট মুসলমানগন। আসল ইসলাম কিনা এই প্রশ্ন যে নিতান্তই অবান্তর কে কাকে বোঝায়। আসল ইসলাম হলেই কি এসব উগ্রতা, নির্বিচার বর্বর হত্যাকান্ড তারা সমর্থন করতেন? হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এক সময় ধর্মের নামে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারতেন ইতিহাসে এটাই গুরুত্বপূর্ন অংশ হিসেবে রয়ে গেছে, সেটা সহি হিন্দু সমর্থিত কিনা সে প্রশ্নের গুরুত্ব কতটা বহন করে? এটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন বোঝা যে আসল ইসলাম না হলেও এই ধরনের উগ্রতা, ভয়াবহ অপরাধের মাল মশলা তাদের সমাজে বহু বছর ধরেই জিয়ে আছে, এবং তারা নিজেরাও তাতে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কন্ট্রিবিউট করে চলেছেন। যেসব লোকজন ধর্মের চাদর গায়ে এসব ফতোয়া দিয়ে বেড়ায় তারা কোন গোপন দলের সদস্য নন, সমাজের উচ্চাসনে বসে থাকা পরম শ্রদ্ধেয় আলেম মোল্লাগন। তারা নেহায়েত মন থেকে বানিয়ে ফতোয়া দেন এমনও নয়, সেসব সূত্র উল্লেখ করে ফতোয়া দেন সেসব সূত্র ‘আসল ইসলাম নহে’ গ্রুপের লোকেরাও পরম শ্রদ্ধা করেন। সম্ভবত সে কারনেই তারা মুখে আসল ইসলাম নহে বললেও ভুল ইসলাম সংশোধনের কোন উদ্যোগ নেন না। বাংলাদেশে আল্লামা শাফি সাহেবের আগেও এই জাতীয় ফতোয়া আরো আলেম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের লোকজনে দিয়ে এসেছে। আজ পর্যন্ত কেউ শুনেছেন এদের আসল ইসলাম জানা দাবীদাররা বর্জন করেছে? উলটো সমাজ ব্যাবস্থা এদেরই মাথায় করে রাখে। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ওনাদের তেলিয়ে চলেন।

আমার এখানে ধর্ম আলোচনার তেমন উদ্দেশ্য বা স্কোপ নেই, সরাসরি প্রাসংগিক হিসেবে শুধু মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারি) হত্যা বিষয়ক ফতোয়া একটু আলোচনা করতে চাই। নইলে সেই চিরন্তন অনেক আলেম আছে এই ফতোয়া মানে না, অনেক দেশে এমন আইন নেই জাতীয় কথা আসবে। এই ফতোয়ার কথা কোরান থেকে সরাসরি আসে না, আসে সহি হাদীস থেকে। তাই অনেকে একে সহি ইসলাম সমর্থিত নয় বলে থাকেন। তাদের মত যাইই হোক, বর্তমান বিশ্বের অন্তত ২০টিরও বেশী মুসলমান প্রধান দেশের আইনে ইসলাম ধর্মত্যাগকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, দেশভেদে অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড থেকে জেল জরিমানা নানান শাস্তি আছে। এছাড়াও আরো কিছু দেশে (যেমন পাকিস্তান) সরাসরি না থাকলেও ব্লাসফেমি আইনের ছাতায় সাজা দেওয়া হয়। শুধু গায়ের জোরেই আইন করা হয়নি, নানান পরিসংখ্যান দেখায় যে সেসব দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ধর্মত্যাগের (অবশ্যই ইসলাম, অন্য ধর্মত্যাগ করে ইসলাম গ্রহন অবশ্যই সাদরে আমন্ত্রিত এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত) শাস্তি মৃত্যুদন্ড এই ধারনা পোষন করেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া কমিটি ১৯৭৮ সালে মুরতাদ হত্যা করার পক্ষে ফতোয়া দেয়। আমাদের অঞ্চলে লিজেন্ডারি জনপ্রিয় ইসলামি স্কলার জাকির নায়েকও এই ধরনের মতামতই ব্যাক্ত করেন। মালদ্বীপে ২০১০ সালের ওনারই এক অনুষ্ঠান থেকে এক ব্যাক্তিকে সরাসরি ইসলামে অবিশ্বাস প্রকাশ করায় পাকড়াও করে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, উনি অবশ্য আইন অনুযায়ী তিন দিনের মাঝে ভুল বুঝতে পেরে তওবা তাবি করে ইসলামে সকল বিশ্বাস ফেরত পেয়ে প্রানে বেঁচে যান, ইসলামও সে যাত্রা বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রেহাই পায়। আল্লামা শাফির নাস্তিক কতল করার ফতোয়া এই সূত্র থেকেই আসে (……তোমরা মুরতাদ হয়ে গেছ…)। আমার সব সময়ই অবাক লাগে ইসলাম সম্পর্কে কোন এক অজানা কারন বশতঃ বড় বড় আলেম স্কলারগন ভুল বুঝে থাকেন, এবং আরো বিস্ময়করভাবে যারা সেই ভুল আবিষ্কার করেন তারা ইহা আসল ইসলাম নহে মুখে বলা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেন না। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানহীন আলেমগন দিব্ব্যী ভুল ইসলাম দেশে দেশে বিনা বাধায় প্রচার করে যেতে পারেন। এটা অলৌকিক মিরাকল ছাড়া সম্ভব নয়। হতেই পারে আল আজহারের মত প্রেষ্টিজিয়াস সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া কমিটি আসল ইসলাম জানেন না, তা আমার বিবেচ্য না।

মুরতাদ ঘটিত ক্যাঁচাল ইসলামের আদিযুগ থেকেই, নবীজির মৃত্যুর পর পর থেকেই মুসলমান সমাজে বিরাজমান আছে। ধর্ম কোন প্রমানিত সত্য নয়, এর নানান ইন্টারপ্রেটেশনে মতভেদ হবেই। বিশেষ করে একে পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে চিন্তা করা হলে এর আওতা যা নয় তাও আনতে হবে, ফলে হাজার রকমের মতভেদ অবশ্যই হবে। এক গ্রুপের কাছে আরেক দল তখন হয়ে যায় মুরতাদ, ইসলামের শত্রু। শিয়া সুন্নীর উদাহরন তো মোটামুটি সকলেই জানেন, নবীজির মৃত্যুর পর থেকে শুরু হওয়া এই বিশ্রী আভ্যন্তরীন কোন্দলে কত রক্ত আজ পর্যন্ত ঝরছে কে তার হিসেব রাখে, যদিও কারা আসল মুসলমান এই সমাধান এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ের আইসিসের মত ভয়াবহ সংগঠনের জন্মের পেছনেও এই কোন্দলের ব্যাপক ভূমিকা আছে যা সামনে আরেক সিরিজে আলোচনা করবো।

ধর্ম নিয়ে অবসেশনের জগত তৈরী করে সারাক্ষন ইসলামের শত্রু সন্ধান করতে থাকার ফল হিসেবে নিজেদেরই নিজেদের শত্রু বানানোর এই প্রক্রিয়ায় তৈরী হয়েছে এক চির অসহিষ্মুতার সংস্কৃতি; যার প্রকোপে ইসলামী ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকেই ফেঁসে গেছেন নিজেদেরও বেশ কিছু বড় বড় আলেম ওলামা। কেউ কেউ এই বিরোধীতার চেষ্টা করলেও তেমন লাভ হয়নি। সেই প্রক্রিয়া চলছে অব্যাহত গতিতেই, নিজেদের ভেতরেই একে তাকে কথায় কথায় নাস্তিক মুরতাদ গাল দেওয়া, এমনকি হত্যার ফতোয়া দেওয়া ডালভাত। এই রকম উন্মাদনা আর কোন কমিউনিটিতে আছে বলা শক্ত। এত জনপ্রিয় যে জাকির নায়েক তার নামেও দেখা যায় কাফির/ইসলামের শত্রু হওয়ার অভিযোগ আছে। ঢাকা শহরে মাওলানা ফারুকীকে হত্যা করেছিল কি নাস্তিক মুরতাদরা? এই সেদিন কলকাতায় মাদ্রাসা শিক্ষক আহত হয়েছেন ইসলাম অবমাননার অজুহাতে। এর আগে ঢাকা শহরেই একজন পীর দাবীদারকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে ৬ জন পারিবারিক সদস্য এবং খাদেম সহ। পীরের আরেক জীবিত পুত্র অভিযোগ করেছিলেন ধর্মীয় আদর্শগত কারনে তাদের ওপর অতীতে বেশ কবার হামলা হয়েছে। এসব এমন কিছু ব্যাপার না, ব্যাপার হল ব্লগের চিপায় কোন নাস্তিক উগ্র ভাষায় দুই লাইন কি লিখেছে তা। কারন তাদের লেখাতেই না মোমিন বান্দারা খেপে এসব ঘটাচ্ছে।

মাত্র গত সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগের ডীন শাকিল আউজ নিহত হয়েছেন ইসলাম সম্পর্কে লিবারেল দৃষ্টিভংগীর কারনে। এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে একই বিভাগের আরেক শিক্ষক মাওলানা মাসুদ বেগও নিহত হয়েছিলেন খুনীদের হাতে। শাকিল আউজ নিহত হবার আগে পুলিশের কাছে একই বিভাগের ৪ অধ্যাপকের নামে তাকে হুমকির অভিযোগ করেছিলেন, অভিযোগ তিনি ব্লাসফেমি অপরাধ করেছেন। যথারীতি করাচীরই এক ধর্মীয় সভা থেকে ব্লাসফেমি আইনে তাকে হত্যার ফতোয়া প্রদান করা হয়। সম্ভবত সেটাই পালিত হয়েছে। আমাদের দেশেও ব্লাসফেমি আইন কায়েমের স্বপ্নে ইসলামিষ্টরা তো বটেই, অনেক মডারেটরাও উতসাহিত, কারন এভাবে তারা প্রিয় ধর্মের ইজ্জত রক্ষা করবেন। নাস্তিক মুরতাদদের থোতা মুখ ভোতা হবে। আগুন নিয়ে খেলা করার ফল যে কি হতে পারে তা তাদের মস্তিষ্কে ঢোকানো শক্ত। আমরা ঘৃন্য ধর্মবিদ্বেষীরা কথায় কথায় পাকিস্তানী জুযুর ভয় দেখাই, শান্তির ধর্ম কায়েমে বাধা দেই। এখন আরো চমতকার আবহ তৈরী করা হচ্ছে যে ধর্ম সম্পর্কিত কোন কথাই বলা যাবে না। ব্লাসফেমি আইন কায়েমের দাবী জানানো হবে, আমরা কিছু বলতে পারবো না। সরকারী উদ্যোগে শিক্ষা ব্যাবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার পাঠ দেওয়া হবে, জিহাদী হবার শিক্ষা দেওয়া হবে কিন্তু প্রতিবাদ কলমেও করা যাবে না। প্রতিবাদ করলেই আমরা উগ্র নাস্তিক, জংগীবাদ উষ্কানোর জন্য দায়ী। ধর্মের নামে মধ্যযুগের আরবের আইন ব্যাবস্থা যা নিজেরাও কি নিশ্চিত জানেন না তা কায়েমের বিরুদ্ধেও কথা বলা যাবে না কারন সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। চুড়ান্ত সর্বনাশ ঘটার পর খালি শোনা যাবে ইহা আসল ইসলাম নহে…।

ঊটপাখী নীতিতে হয়ত ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে কিন্তু তাতে কি শেষ রক্ষা হবে? সব কূল রক্ষা করে পার পাওয়া যাবে না। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক অশিক্ষা কুশিক্ষা, অবাস্তব ইউটোপিয়ান জগতের স্বপ্ন দেখানোর ফল কি তা কি আইসিসের মত খুনে বাহিনীর জিহাদী ভাইদের মনোরঞ্জনের জন্য কিশোরী মেয়েদের রাতের বেলা গৃহত্যাগ দেখেও মনে কিছুটা হলেও রেখাপাত করে না? সেটা অবশ্য আমেরিকার দোষ হবে।

আমাদের দেশের টপ আলেম আল্লামা শাফি সাহেবের নাস্তিকদের হত্যা করা ওয়াজিব জাতীয় ফতোয়া কি শুধু আমাদের দেশের ইসলামের সাথে ‘সম্পর্কহীন’ ‘অশিক্ষিত’ গ্রা্ম্য মোল্লাই দেয়? সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে কি বলা যেতে পারে, ইসলামের সাথে সম্পর্ক বিহীন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়? ওয়াশিক বাবুর হত্যাকারীদের স্বীকারোক্তির সাথে ফারাজ ফাওদার হত্যাকারীর স্বীকারোক্তি কি মিলে যায় না? যে কারনে ফারাজ ফাওদা খুন হয়েছিলেন সেই একই কারনেই বাংলাদেশসহ আরো বহু মুসলমান প্রধান দেশেই বহু প্রগতিশীল সেক্যুলার ধারার চিন্তাশীলরা হুমকির মুখে থাকেন, অনেকে খুন হয়েও যান। তারা ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে মুসলমান না কি তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। এই পরিষ্কার ট্রেন্ড অস্বীকার করে খালি অযথা ধর্ম খোঁচাখুচি, অশ্রাব্য ভাষায় নবী বিদ্বেষমূলক লেখাই মূল কারন সন্তাক্তকরন হল মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া। বাংলা ব্লগ চালুর বহু আগ থেকেই দেশের প্রগতিশীল ধারার বুদ্ধিজীবিরা নানান সময়ে হুমকি এবং শারীরিক আক্রমনের শিকার হয়েছেন। ফাওদা হত্যা, শাকিল আউজ হত্যা, বা নাগিব মাহফুজকে পংগু করে দেওয়া ঘটনার জন্য দুচারটি স্ক্রীন শট জুড়ে অভিজিত খাসী/মগাচিত এরাই দায়ী এসব বলে ফেসবুকে হয়ত ব্যাপক লাইক পাওয়া যাবে কিন্তু তাতে নিজেদের ক্ষতি করা ছাড়া ভাল কিছু হবে না।

সমস্যার মূল এড়িয়ে ঊটপাখি নীতি অবলম্বন সাময়িক স্বস্থি দিলেও স্থায়ী দূরে থাক কোন দীর্ঘমেয়াদী সমাধানও আনতে পারবে না। আজকের এই উন্মুক্ত তথ্য প্রযুক্তির দিনে একপেশে আইন আদালত বা চাপাতির কোপের ভয় দেখিয়ে যা শুনতে চাই না বা অস্বস্থি বোধ করি তা বেশিদিন চেপে রাখা যাবে না। কারো হাতেই যাদুমন্ত্র নেই যে এটা করতে পারে, এখানে আমি কি চাই না চাই তা অবান্তর। আপনি কম্যুনিজম কেন্দ্রিক জীবন ব্যাবস্থা চালুর দাবী জানাতে থাকবেন আর তার বিপরীত কথা শুনলেই খেপে উঠবেন এটা কি হয়? কার্ল মার্ক্সই শ্রেষ্ঠ মানব প্রচার করবেন এবং তার সমালোচনা শুনলে অনুভূতি আহত হয়েছে বলে চাপাতির কোপ দেবেন এমন কিভাবে সম্ভব? বাস্তব জীবনে আলোচনা করার, লেখালেখির অজস্র বিচিত্র বিষয় আছে; সে সব ছেড়ে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড সহি ইসলামী কিনা, বিবি পেটানো ধর্ম সম্মত কিনা বা বাল্যবিবাহ রোধ আইন ইসলাম সম্মত কিনা এসব আলোচনার জন্য সময় দেওয়া আমার কাছেও বড় অপচয় মনে হয়। কিন্তু যে সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা বহু শতক ধরে করা হয়েছে তাতে কোন উপায়ও নাই। ইসলাম ধর্ম পূর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা এই দর্শন যতদিন বজায় থাকবে ততদিনই ধর্ম আসবে জীবনের পদে পদে, পালটা যুক্তিও আসবে; আহত হবে অনুভূতি…ঘটবে অর্থীন হানাহানি রক্তপাত; এবং দায় অবশ্যই যারা এসব টেনে আনেন তাদের ওপর যাবে না, যাবে সহজ টার্গেট যারা তাদের ওপর।

[পরের পর্বে চেষ্টা করব সমাধানের দিক হাইলাইটের]