জ্ঞান ও বিশ্বাস-এ শব্দ দু’টো বেশ খটকা লাগে আজকাল। জ্ঞান দিয়ে বিশ্বাসে আস্থা? না,বিশ্বাসের গন্ডিতেই জ্ঞানের অনুশীলন? না,দু’টোই? এ রকম ভাবতে ভাবতেই সেদিন পড়লাম হাজার হাজার বছরের পুরানো “ব্ল্যাকফুট” আদিবাসীদের একটি লোকগাঁথা|

আদি মানুষের সৃষ্টি ও বিনাশ নিয়ে হাজারো রূপকথার গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে সারাবিশ্বের প্রাচীন লোকগাঁথাগুলোতে| সে রকমই একটা কাহিনী প্রচলিত আছে “ব্ল্যাকফুট” আদিবাসীদের মধ্যে| যদিও “ব্ল্যাকফুট” আদিবাসীরা কানাডা থেকে কয়েকশ বছর আগে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে আমেরিকার মন্টানা রাজ্যে বসতি গেড়েছে, তবুও তাদের পূর্বপুরুষ কানাডার নর্দান-ওন্টারিও ও ম্যানিটোবা প্রদেশের “ওজেবয়” আদিবাসী গোষ্ঠীই| তাই “ব্ল্যাকফুট” ফার্স্টনেসনসদের লোকগাঁথা কানাডার “ওজেবয়”-দের মতোই|

যা হোক, আসল কথায় আসি| আদি মানুষের সৃষ্টি ও মানুষের নশ্বরতা নিয়ে এক সুন্দর ও দার্শনিক তত্ত্ব লুকিয়ে আছে এই লোককাহিনীটিতে| পাশ্চাত্যে অবস্থান করেও একবারে প্রাচীন ভারতীয় দর্শণ কীভাবে এলো, সে নিয়ে পরে আলোচনা করার অবকাশ রেখে লোককাহিনীটি এখানে বলে নিই|

“ব্ল্যাকফুট”দের স্রষ্টাকে বলা হয় ওল্ড ম্যান। উত্তর আমেরিকার আদি অধিবাসী প্রায় হাজারো গোত্রের প্রায় প্রত্যেকেরই এরকম একজন করে স্রষ্টা আছেন| পৃথিবী সৃষ্টি করার পর “ব্ল্যাকফুট”দের স্রষ্টা ওল্ড ম্যান বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে কিছু একটার অভাব| সেই না-থাকা জিনিসটা কী? প্রথমেই ভাবলেন, নারী ও শিশুর কথা| কিন্তু নারী ও শিশুরা দেখতে কী রকম হবে এ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন তিনি কাদা মাটিতে বিভিন্ন বস্তু সৃষ্টি করে ঢেকে রেখে দিলেন|

প্রতিদিন দেখেন একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে কাদা মাটির বস্তুগুলোতে| প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয় দিন চলে গেল। চতুর্থ দিন দেখলেন,কাদা মাটি দিয়ে সৃষ্ট সবচেয়ে বড় বস্তুটা খুব সুন্দর আকারে ও আকৃতিতে গড়ে উঠেছে| দেখতেও একবারে কোমল ও রমনীয়| ওল্ড ম্যান ভাবলেন এটাই হোক পৃথিবীর প্রথম নারী| সে মতেই প্রাণও দিলেন এই প্রথম নারীকে|

পৃথিবীর এই প্রথম নারী জ’ন্মেই তার একাকীত্বের কথা জানালেন ওল্ড ম্যানকে| প্রথম রমণীর অনুরোধে মাটির তৈ্রী অন্য বস্তুগুলোতে প্রাণ দিয়ে বললেন, যাও এখন থেকে তোমরা হাঁটবে, চলবে, নিঃশ্বাস নেবে,খাবে এবং এই পৃথিবীর জন্য কাজ করবে|

পৃথিবীর প্রথম মানবী জিজ্ঞেস করলেন, এই যে আমরা এলাম;পৃথিবীতে থাকবো; এটাকে কী বলবো?

ওল্ড ম্যান বললেন, এটা একটা অধ্যায় থেকে অন্য আরেকটা অধ্যায়ে প্রত্যাবর্তন, এর নাম “জীবন”|

মানবী জিজ্ঞেস করলেন, আমরা যেখানে আগে ছিলাম তার নাম কী ছিল তাহ’লে?
ওল্ড ম্যান বললেন, তোমরা আদিপর্বে ছিলে জড়বস্তু, আর সে পর্বের নাম ছিল মরণ|

মানবী আবারও জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি আবারও আদি জড়বস্তু পর্বে অর্থ্যাৎ মৃত্যুর ভিতর ফিরে যেতে পারব?

ওল্ড ম্যান বললেন, আমি সেটা এখনো ভাবি নি| তবে একটা পরীক্ষা করা যাক। একটি ক্ষুদ্র প্রাণীকে জলে ছুঁড়ে ফেলি| যদি ডুবে যায় তবে জানবে তোমাদেরও মৃত্যু অবধারিত আর যদি ভেসে ওঠে তবে জানবে, তোমরা অবিনশ্বর|

মানবী বললেন, এই প্রাণী জলে গ’লে যাবে| তার চেয়ে এই প্রস্তর খন্ডকে জলে ছুঁড়ে ফেলে পরীক্ষা করা যাক| সে মতেই পাথর টুকরো জলে নিক্ষেপ করা হলো। পাথরখন্ডটি ডুবে গেল জলের গভীরে|

ওল্ড ম্যান বললেন, ওহে মানবী, তুমি কিন্তু ইচ্ছে করেই পাথর খন্ডকে বেছে নিয়েছ। পাথরখন্ডটা জলে ডুবে গেল অর্থ্যাৎ তুমি মৃত্যুকে বরণ করে নিলে| আমার কিছুই করার নেই| এখন থেকে জীবনের অন্য অধ্যায় মরণ|

সে থেকেই নাকি “ব্ল্যাকফুট” আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, মানুষ মরণশীল; একমাত্র পাথর ও পাহাড়ই চিরকাল থাকবে| আদিবাসীদের খোঁদাই কিংবা বাধাঁইয়ে তাই লেখা থাকেঃ
‘ Only the rocks and mountains last forever, men must die”

কিন্তু এ লোককাহিনী আমাদের আরো কিছু ভারতীয় দর্শণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়| যার মধ্যে অন্যতমঃ এক, মানুষ নিজেই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে জন্মের সময়েই| দুই, প্রত্যেক প্রাণই মিশে যায় জলে কিংবা অন্তঃরীক্ষে| তিন এবং প্রধানতম, প্রত্যেক মানুষই পৃথিবীতে কিছু কাজ করার নিমিত্তে জন্মেছে|

প্রাচীন ভারতের বেদশাস্ত্রে একটি কথা আছে, “ঋণকারী পিতা পুত্রের শত্রু, কিন্তু পিতা ঋণদাতা হইলে শত্রু নয়|” অর্থ্যাৎ, পৃথিবীকে যদি পিতার সাথে তুলনা করি, তবে ঋণদাতা পৃথিবী মানুষের শত্রু নয়| কিন্তু এ কথাও সত্য যে, বিশ্বের কোন দানই শর্তবিহীন হওয়া উচিত নয়|

সেদিক বিবেচনা করলেও মানুষ জন্মের সময়ই পৃথিবীর কাছে কিছু ঋণ নিয়ে জন্মেছে| ধর্মশাস্ত্র-নীতিশাস্ত্র যাই বলি না কেনো সবখানেই এটাও উল্লেখ আছে যে, প্রত্যেক মানুষের উচিত তার শক্তি, সামর্থ্য ও সাধ্যমতো পৃথিবীর সে ঋণ পরিশোধ করা| কিন্তু প্রশ্ন, কীভাবে?

সেখানেই আসে জ্ঞান ও বিশ্বাসের প্রশ্ন| জ্ঞান এখানে “knowledge”-এর প্রতিশব্দ না হয়ে যর্থাথ হবে যদি “Intellect” অর্থে ব্যবহ্রত হয়| মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের উপর আস্থা স্থাপন করেই পৃথিবীর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে এবং করে আসছেও যুগ যুগ ধরেই| তাই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর ও বাসযোগ্য!

কিন্তু এখানে বিশ্বাসের স্থান কোথায়? পৃথিবীর প্রতি দায়িত্ববোধের সকল কাজই হতে হবে মানুষের শুভ, কল্যান ও উন্নতির জন্য। এ বিশ্বাসটুকুতে আস্থা আসবে অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই| তাহলে প্রশ্ন, মানুষের এই যে কর্তব্যকর্ম সেটাই আবার কী? কেননা, একথা তো সত্য যে, প্রত্যেক মানুষ যেমন নিজস্ব মানুষ, প্রত্যেক মানুষের ক্ষমতা-অক্ষমতাও তেমনি নিজস্ব ও স্বতন্ত্র; দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সবক্ষেত্রেই|

আরো সহজ করে বললে, কেউ সুন্দর গান করেন, কেউ সুন্দর ছবি আঁকেন, কেউ সুন্দর লিখতে পারেন কিংবা কারো অনন্য প্রতিভা অন্য কোথাও নিহিত| প্রতিভাবান মানুষের প্রতিভা যদি বিশিষ্ট শক্তি বা ক্ষমতা হয় এবং সে ক্ষমতা যদি কারো দান কিংবা অর্জণ -যেভাবেই হোক, তাকে অপচয় করা একধরণের অকৃতজ্ঞতাই বটে| প্রত্যেক মানুষের তাই উচিত তার নিজস্ব প্রতিভার আবিষ্কার ও তাকে চর্চা করা|

কেননা, আদিবাসী “ব্ল্যাকফুট” কিংবা “ওজেবয়” লোকগাঁথার মতো অনেক প্রাচীন ভারতীয় দর্শণশাস্ত্রেও বলা আছে, মানুষ জন্মেছে কিছু নির্ধারিত সত্য মেনে নিয়েই; যাদের অন্যতম অনিবার্য মৃত্যু এবং বেঁচে থাকা সময়ে যার যার ব্যক্তিশক্তি ও ব্যক্তিপ্রতিভা দিয়ে পৃথিবী ও তার মানুষের কল্যানের জন্য কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।