অশুভ সংকেত

ফোনটা আসে ঠিক দুপুরের দিকে, ভয়ংকর এক অশুভ সংকেত হয়ে। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার দেখেই টের পাই যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ভেসে আসে আমার একমাত্র শ্যালক রানার পরিচিত কণ্ঠ। “মিলটন ভাই, আপনার জন্য একটা খারাপ খবর আছে। আপনার বন্ধু অভিজিৎ রায় খুন হয়েছে। তাঁর ওয়াইফও আহত।“ ওর সঙ্গে আমার আর কী কী কথা হয়েছে কিছুই মনে নেই এখন। ফোনটা রেখেই তড়িৎ গতিতে প্রথম আলো খুলি। মন বলছে, এ সবের কিছুই সত্যি নয়। কিন্তু, খুলে দেখি সত্যি সত্যিই ঘটেছে এটি। অভি নিহত, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। বন্যাও গুরুতরভাবে আহত। সে বাঁচবে কি না, কেউ জানে না।

স্তব্দ হয়ে বসে থাকি আমি। গত দশ বছরের কতো স্মৃতি, কতো হাস্য রসিকতা, কতো স্বপ্ন, কতো পরিকল্পনা, কতো কিছু দুজনে এক সাথে। দুজনে বললেও ভুল হবে, আমার আসলে বলা উচিত তিনজনে মিলে। বন্যাও জড়িত থাকতো প্রায় সবকিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে। দশ বছরে আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু, প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে আমাদের, প্রতিদিনই হয়েছে চিন্তার আদান প্রদান। আমাকে যে পরিমাণ ইমেইল অভি করেছে, আমার মনে হয় না যে, এতো বিপুল পরিমান ইমেইল ও আর কাউকে করেছে। আমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার ইমেইল করেছি অভিকেই। সেই অভি আর নেই। ঘাতকের চাপাতির কয়েকটা আঘাতে এই সময়ের অন্যতম সেরা এক প্রতিভা ঝরে গেলো অকালে। শুধুমাত্র মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ছিলো না সে, বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো অনলাইনে তার পুরোধা ছিলো সে। যুগে যুগে তাকে স্মরণ করা হবে তার এই ভূমিকার জন্য। বিজ্ঞান লেখক হিসাবেও সে অনন্য। সে শুধু তার সময়েরই সেরা নয়, বাংলা ভাষায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক সে। তার মতো করে এমন সাহিত্যসমৃদ্ধ সুললিত ভাষায় বিজ্ঞানের একেবারে সর্বশেষ এবং প্রান্তিক বিষয়গুলো নিয়ে এমন সুখপাঠ্য বই আর কেউ লেখে নি কখনো। জনপ্রিয়তা সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, কিন্তু অভির ক্ষেত্রে এই দুইয়ের সমন্বয় হয়েছিলো অসাধারণভাবে।

পরিচয়ের সূত্রপাত

চৌদ্দ বছর আগে দেশ ছেড়েছি আমি। সোনালি স্বপ্নের প্রত্যাশায় স্বদেশ ছেড়ে চিরতরে চলে আসি শ্বেত শুভ্র বরফের দেশ ক্যানাডায়। প্রথম প্রথম শিঁকড় উৎপাটনের সুতীব্র যন্ত্রণায় চরম দুঃসহ সময় কেটেছে আমার। অপরিচিত বৈরী পরিবেশ সেই যন্ত্রণাকে আরো কষ্টময় করে তুলেছে প্রায়শই। কখনো কখনো বিনিদ্র রজনী পার করেছি সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে ভেবে ভেবে। অতি প্রিয় জন্মভূমির পলিমাটির সোঁদা গন্ধ থেকে বঞ্চিত এই আমি তখন ক্ষ্যাপার মতো ঘোরাফেরা করি আর সব কিছুতেই খুঁজে বেড়াই স্বদেশের পরিচিত আদরমাখা সুশীতল পরশ। মাতৃভূমির নাড়ি নক্ষত্র জানার প্রত্যাশায় প্রতিদিন বেশ খানিকটা সময় ব্যয় হয়ে যেতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশের দৈনিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো ইন্টারনেটে পড়ার কারণে। এরকমই একদিন পত্র-পত্রিকা পড়তে গিয়ে ‘যায় যায় দিনে’ কুদ্দুস খানের একটা লেখা থেকে পেয়ে যাই ভিন্নমত নামের একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা। ঠিকানা অনুযায়ী ভিন্নমতে গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। দেখি অসাধারণ সব বিচিত্র বিষয় নিয়ে রংবেরং এর অসংখ্য প্রবন্ধ দিয়ে ভরপুর ভিন্নমত ওয়েবসাইট। সেই সমস্ত প্রবন্ধের আবার বিরাট একটা অংশ জুড়েই ছিলো পুরোপুরি প্রথাবিরুদ্ধ লেখা। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামর অভ্যন্তরে থেকে এ ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার মতো দুঃসাহস বা চিন্তার বৈচিত্রতা প্রদর্শন করা রীতিমতো অচিন্তনীয় ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু, ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত অবারিত জগতে সমাজ কাঠামোর সেই রক্তচক্ষু অতোখানি প্রবল পরাক্রান্ত হবার সুযোগ তখন ছিলো না বলেই লেখকেরাও তাঁদের মুক্ত স্বাধীন চিন্তাকে নিয়ে গেছেন আমাদের প্রচলিত দৃষ্টিকোন থেকে দেখা জগতের বেশ খানিকটা বাইরে।

সেই সময় অনেকেরই লেখার আমি খুব ভক্ত ছিলাম।তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখনো নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতল গর্ভে। তবে, আমার দৃষ্টি বিশেষভাবে কেড়েছিলো এক অকুতোভয় তরুণের লেখা। কুপমুণ্ডকতা আর অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো ক্ষ্যাপা একটা ষাঁড়ের মতো অসম সাহস নিয়ে প্রায় একক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো সেই তরুণ। খাপ খোলা তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ শাণিত যুক্তি, ঝরঝরে প্রাঞ্জল ভাষা, তত্ত্ব আর তথ্যের সুসংবদ্ধ উপস্থাপনা এবং বিতর্কের এক অত্যাধুনিক স্টাইলে একের পর এক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে যাচ্ছিলো সে। সেই তরুণের ক্ষুরধার বুদ্ধি, জ্ঞানের অতলস্পর্শী গভীরতা, চিন্তার আধুনিকতা এবং ভাষার সাবলিলতা দেখে আমি পুরোপুরি তার ভক্ত হয়ে যাই। অজানা, অচেনা এক তরুণ বেশ বড়সড় একটা জায়গা করে নেয় আমার মনের মণিকোঠায়। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম তার পরবর্তী লেখা পাওয়ার আশায়। এরই মধ্যে একদিন দেখলাম, সেই তরুণ নিজেই খুলে ফেলেছে দারুন ঝকঝকে, তকতকে, স্মার্ট এবং ব্যতিক্রমধর্মী একটা ওয়েবসাইট। আপনারা নিশ্চয় এতোক্ষনে বুঝে ফেলেছেন যে, আমি কার কথা বলছি? হ্যাঁ, সেই তরুণটি আর কেউ নয়, সে আমাদের সকলের প্রিয় অভিজিৎ রায় আর সেই ওয়েবসাইটটিও আমরা জানি কোনটি। আমাদের সবার প্রিয়, সবার ভালবাসায় সিক্ত মুক্তমনা সেটি।

আমার আজকের এই নিয়মিত লেখালেখির পিছনেও অভিজিৎ রায়ের পরোক্ষ ভুমিকা রয়েছে। অভিজিৎ এর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”-র পর্বগুলো আমাকে ব্যাপকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। মুগ্ধ বিস্ময়ে অসংখ্যবার পড়েছি আমি সেই পর্বগুলো। সত্যিকার অর্থেই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো অভিজিৎ এর ছন্দময় কাব্যিক ভাষায় লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলো। আচ্ছন্নতা এমনভাবে গ্রাস করেছিলো আমাকে যে, আমার মতো বিজ্ঞান না জানা কোনো মানুষ, যার বিজ্ঞানের কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পটভুমিকা নেই, সেই আমিও সাহস করে লিখে ফেলেছিলাম “ওয়ার্ম হোল এবং সময় পরিভ্রমণ” নামে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব বিষয়ক একটা প্রবন্ধ। সেই লেখাটি ছাপা হয়েছিলো সাপ্তাহিক যায় যায় দিনে। যায় যায় দিনে ছাপা হয়েছে, এই ভরসায় একদিন লেখাটিকে পাঠিয়ে দেই মুক্তমনায়। আমাকে মোটামুটি অবাক করে দিয়ে মডারেটরের প্রশংসাসূচক একটা নোটসহ আমার কাঁচা হাতের অপরিপক্ক লেখাটি ছাপা হয়ে যায় মুক্তমনায়। যায় যায় দিনে লেখাটি ছাপা হওয়ায় যতটা না খুশি হয়েছিলাম আমি, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম আমি সেটি মুক্তমনায় পোস্ট হওয়াতে।

অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে আমার দ্বিতীয় লেখা “ঝিলিমিলি আলোর নাচন” মুক্তমনায় ছাপা হবার পর পরই এক স্বর্ণালী ভোরে আমি মেইল পাই আমার খুবই পছন্দের একজন লেখক বন্যা আহমেদের কাছ থেকে। তখনও আমি অভিজিৎ আর বন্যার সম্পর্কের বিষয়টা জানি না। সেই মেইলে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মুক্তমনার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির একটা প্রজেক্টে কাজ করার জন্য। সেইদিনই সন্ধ্যায় সুদুর আটলান্টা থেকে ভেসে আসে অত্যন্ত সুমধুর এক তরুণীর কণ্ঠস্বর। আমি তখন থাকি উইন্ডজরে। অপূর্ব সুন্দর বাচনভঙ্গি, প্রাঞ্জল ভাষা আর গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সেই তরুণী একে একে বলে যেতে থাকে মুক্তমনার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড আর স্বপ্নের মত আদিগন্ত বিস্তৃত সব পরিকল্পনার কথা। সেই সাথে মুক্তমনার এই চলমান বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিনয়ী আমন্ত্রণ। আমি আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান আর প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভার স্বল্পতার দোহাই দিয়েও মুক্তি পাই নি নাছোড়বান্দা আমার এই অতি প্রিয় লেখকের হাত থেকে।

সেই থেকে শুরু একই সাথে পথচলা, একই সাথে স্বপ্ন দেখা, একই সাথে সকল সাফল্যের আনন্দ আর ব্যর্থতার গ্লানিকে ভাগাভাগি করা। এক সময় ছিলো যারা দূর দ্বীপের বাসিন্দা, তাদের সাথে চিন্তা-চেতনা ভাগাভাগি করে নেওয়া। সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমাটবদ্ধ অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমাদের ক’জন সমমনা মানুষের অসম এক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। সেই যুদ্ধ আজ চুড়ান্ত পর্যায়ে। শত্রু তার মরণকামড় দিচ্ছে। সেই কামড়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত আমরা, সাময়িকভাবে হতভম্ব, হতবিহবল। কিন্তু, এটি সাময়িক। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি আমরা গভীর প্রত্যয় আর দৃপ্ত শপথ নিয়ে। সাথীদের খুনে ভেজা পথে হায়েনার আনাগোনা দেখে ভীত নই আমরা। বরং অসম সাহস নিয়ে হায়েনার মোকাবেলা করার জন্য সর্বান্তকরণে প্রস্তুত আমরা। চুড়ান্ত বিজয় আমাদেরই হবে।

মুক্তমনার ইতিকথা

মুক্তমনার জন্ম ২০০১ সালে। মূলতঃ অভিজিৎ রায় এককভাবেই এর প্রতিষ্ঠাতা। আরো কেউ কেউ যে ছিলেন না এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেটা বলছি না। আসলে একটি আলোচনাচক্রের মাধ্যমে এর জন্ম। কিন্তু, জন্ম সময় এবং জন্মের পরে এর বিকাশে তার একক অবদান অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, প্রাচুর্যময় এবং প্রধানতর। মানব মনের বৌদ্ধিক বিকাশে যুক্তি-বুদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার গুরুত্ব বৃদ্ধি করাই ছিলো এর মূল কাজ। সেই লক্ষ্য নিয়েই নিরলসভাবে কাজ করে গেছে মুক্তমনা। মুক্তমনার বিরুদ্ধে গুরুতর একটা অভিযোগ হচ্ছে যে, মুক্তমনা ধর্ম-বিরোধী, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম বিরোধী। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। মুক্তমনা অবশ্য ধর্ম-বিরোধী, এতে লুকোছাপার কিছু নেই। কিন্তু, সেই সাথে এটা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, মুক্তমনার কোনো ধর্মের প্রতিই কোনো ধরনের বিশেষ পক্ষপাত নেই। ইসলাম নিয়ে লেখা বেশি আসে মুক্তমনায় শুধুমাত্র এ কারণেই যে, এর বেশিরভাগ সদস্যই মুসলিম পরিবার থেকে এসেছেন, তাঁদের জন্য ইসলাম নিয়ে লেখাটা যতটা সহজতর, অন্য ধর্ম নিয়ে লেখাটা ততোটা সহজতর নয়। কিন্তু, পরিমানগতভাবে কম হলেও, অন্য ধর্মগুলোকেও তীব্রভাবে সমালোচনা করতে মুক্তমনা কখনোই দ্বিধাবোধ করে নি। এ বিষয়ে মুক্তমনার নিজস্ব ব্যাখাটা এরকম।

মুক্ত-মনারা ধর্ম-বিরোধী নয়, বলা যায় অনেক মুক্তমনাই ধর্মের কঠোর সমালোচক। কারণ তাঁরা মনে করেন ধর্ম জিনিসটা পুরোটাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। মুক্তমনারা সর্বদা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আস্থাশীল, আজন্ম লালিত কুসংস্কারে নয়। কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ আসলে নিজের সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। তবে মুক্তমনাদের ধর্ম-বিরোধী হওয়ার একটা বড় কারণ হল, ধর্মগুলোর মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতা। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত এবং শ্লোকে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে ঢালাওভাবে, কখনো দেয়া হয়েছে হত্যার নির্দেশ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্ম আসলে জ্বিহাদ, দাসত্ব, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, হোমোফোবিয়া, অ-সহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং সমঅধিকার হরণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিটি যুগেই ব্যবহৃত হয়েছে।

অনন্ত এই মহাবিশ্ব কোনো মহা শক্তিমান ঈশ্বরের হাতের স্পর্শে তৈরি হয় নি। নিতান্ত প্রাকৃতিক এক কারণে, পদার্থবিজ্ঞানের সকল সুত্রাবলীকে মেনেই তৈরি হয়েছে। যাঁরা এই অনন্ত মহাবিশ্বের অপার রহস্য দেখে গভীরভাবে আপ্লুত হয়ে ঈশ্বরের মতো অলীক সত্ত্বার কাছে আত্ম-সমর্পন করেন, ভাবেন যে পরম শক্তিমান ঈশ্বর ছাড়া এই অসম্ভব জটিল মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারতো না, তাঁদের প্রতি আমাদের বক্তব্য এরকম।

এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে কোন পরম পুরুষের হাতের ছোঁয়ায় নয়, বরং নিতান্তই প্রাকৃতিক নিয়মে। সব কিছুর পেছনে সৃষ্টিকর্তা থাকতে হবে, কিংবা সব ঘটনার পেছনেই কারণ থাকতে হবে, এটি স্বতঃসিদ্ধ বলে ভাবে নেওয়ার আসলেই কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আকাশে যখন ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’ খেলা করে, কিংবা একপশলা বৃষ্টির পর পশ্চিম আকাশে উদয় হয় রংধনুর, আমরা সত্যই মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই। কিন্তু আমরা এও জানি এগুলো তৈরি হয়েছে স্রষ্টা ছাড়াই পদার্থবিজ্ঞানের কিছু সূত্রাবলী অনুসরণ করে। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা সকলেই জানেন, রেডিও অ্যাকটিভ ডিকের মাধ্যমে আলফা বিটা, গামা কণিকার উদ্ভব হয় প্রকৃতিতে কোন কারণ ছাড়াই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এছাড়াও ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’ এর ঘটনাও একটি কারণবিহীন ঘটনা বলে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অনেক আগে থেকেই স্বীকৃত। বহু পদার্থবিজ্ঞানীই বহু গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে শূন্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্বজগৎ তৈরি হওয়া কোন অসম্ভব বা অলৌকিক ব্যাপার নয়, এবং এভাবে বিশ্বজগৎ তৈরি হলে তা পদার্থবিজ্ঞানের কোন সূত্রকেই আসলে অস্বীকার করা হয় না।

কিন্তু, শুধুমাত্র ধর্মের সমালোচনা করার মতো সংকীর্ণ একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকার জন্য মুক্তমনার জন্ম হয় নি। এটিকে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছি আমরা। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, শোষণ, বঞ্চনা সবকিছুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনেই মুক্তমনার আগ্রহ। আলাপ-আলোচনা আর তর্ক বিতর্কের মাধ্যমেই এগুলো সম্ভব। মানুষ যখন এগুলো সম্পর্কে সচেতন হবে, তখন আপনাআপনি এই সব ভ্রান্ত বিশ্বাসের কবল থেকে বের হয়ে আসাটা তাদের পক্ষে সহজতর হবে।

মুক্তমনার মাধ্যমে আমরা – একদল উদ্যমী স্বাপ্নিক- দীর্ঘদিনের একটি অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পরিচালনা করছি, যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠছে ‘চেতনামুক্তির’ লড়াই – যার মাধ্যমে জনচেতনাকে পার্থিব সমাজমুখী করে তোলা, প্রতিটি শোষণ ও বঞ্চনার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভব। মুক্তমনার পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত তৈরীতে ব্যাপক জোর দেয়া হয়েছে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা গঠনের উপর। মুক্তমনা মনে করে বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে যুক্তির পথ ধরে, নিরন্তর এবং ব্যাপক বিচার-বিতর্কের মাধ্যমে। আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ফোরামগুলোতে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, মুক্তমনারা মনে করে তা প্রাচীনকালের ব্রাক্ষ্মণ-চার্বাকদের লড়াইয়ের মত বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্বেরই একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ। এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেন বাঙালীর এক নবজাগরণ।

গত কয়েক বছরে স্বচ্ছ চিন্তাচেতনা সম্পন্ন মুক্তমনা যুক্তিবাদীদের বিশাল উত্থান ঘটেছে বিভিন্ন ফোরাম এবং আলোচনাচক্রে, যা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে সম্ভব ছিল না মোটেই। জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং বিভিন্ন মতামতের দ্বন্দ্ব প্রয়োজনীয়, উপকারী এবং অনিবার্য। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বচ্ছ এবং সুস্থ বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টি হলে জনগণের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবোধের উপর আকর্ষণ বাড়বে এবং মিথ্যা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে তারা ক্রমান্বয়ে যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। যুক্তিনিষ্ঠ মন-মানসিকতাই অবশেষে জনগণকে পরিচালিত করবে আধ্যাত্মবাদ পরিত্যাগ করে মানবমুখী সমাজ বিনির্মাণে, সামিল করবে বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে। মুক্তমনার সদস্যরা তাদের ‘শখের তর্ক-বিতর্ক’কে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করে জনচেতনাকে একটি সঠিক পথ দেখাতে সর্বদা উন্মুখ।

মুক্তমনার জন্মই হয়েছিলো বিশেষ একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সেই উদ্দেশ্যকে বলা যেতে পারে চেতনা মুক্তি এবং বৌদ্ধিক বিকাশের লড়াই। একজন মানব শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই আমাদের এই সমাজ মহা উৎসাহে তার মধ্যে রোপন করে দিতে থাকে সমাজের যাবতীয় সব কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের চারা। সেই চারা গাছই অনুকুল পরিস্থিতিতে আলো বাতাস পেয়ে তরতর করে একদিন পরিণত হয়ে যায় বিরাট বিষবৃক্ষে। বিনা প্রমাণেই অপ্রমাণিত, অলীক এবং আজগুবি বিষয়সমুহকে অবলীলায় মেনে নেয় তারা। রক্তের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের চোরাবালি নিয়ে বড় হওয়া বেশিরভাগ লোকজনের পক্ষেই এই চোরাস্রোত থেকে মুক্ত হওয়ার আর কোনো সুযোগই থাকে না। বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ বা যুক্তি-তর্ক কোনো কিছুই আর কাজ করে না তাদের ক্ষেত্রে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যে যে, বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ ও আবিষ্কারকে নিজেদের সুবিধামত বিকৃত করে তারা তাদের অন্ধবিশ্বাসএই সঠিক বলে দাবি করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার বছর ধরে সমাজের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এই সব ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তনের বিরুদ্ধেই ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে মুক্তমনা। কোনো কিছুকেই বিনা প্রমাণে মেনে নিতে রাজি নন মুক্তমনারা। যুক্তি ও বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই বাছাই হয়ে আসতে হবে সব কিছুকে। বিশ্বাসের এই দূর্গ যতোই অভেদ্য দেখাক না কেনো, কোথাও না কোথাও ঠিকই রয়ে গিয়েছে বেহুলার বাসর ঘরের মতো ক্ষুদ্র কিন্তু মারণঘাতী এক ছিদ্র। আজ সময় এসেছে এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এই বিষবৃক্ষকে সমুলে উৎপাটিত করার।

মুক্তমনা যে শুধুমাত্র রণরঙ্গিনী বেশে অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। নিরন্তর এই লড়াইয়ের পাশাপাশি মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষেও কাজ করে যাচ্ছে মুক্তমনা। যেখানেই মানবতা লংঘিত হচ্ছে, অন্যায়-অবিচার হচ্ছে, সেখানেই মুক্তমনা তার সামর্থের শেষ বিন্দু দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হোক না তা বাংলাদেশে, ভারতে, ফিলিস্তিনে বা ইরাকে। মৌলবাদ অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও মুক্তমনা সোচ্চার কণ্ঠ। মুক্তমনার এই কর্মকাণ্ড চোখ এড়ায় নি সচেতন মানুষদের। এরই কারণে ২০০৭ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মুক্তমনাকে জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক ২০০৭ প্রদান করেছিলো। সেই পদক প্রাপ্তির সম্মাননায় লেখা হয়েছিলো নিচের কথাগুলো।

বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখেছে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইট। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে ও বিদেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সেক্যুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনষ্ক করবার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের তরুণ মানবাধিকার কর্মীরা এই ওয়েব সাইটকে তাদের লেখা ও তথ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করছেন। ২০০১ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ‘মুক্তমনা’ তখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনের পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশেষ অবদানের জন্য ‘মুক্তমনা’ ওয়েব সাইটকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক ২০০৭’ প্রদান করা হলো।

রক্তে ভেজা ফুটপাত

রক্তে ভেজা ফুটপাতে পড়ে আছে অভিজিৎ এর চশমা। একপাশে তার অনন্যসাধারন মগজের এক টুকরো রক্তে খাবি খাচ্ছে অবহেলায়। তারই পাশে ঝরে পড়ে আছে বন্যার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল, অসহায়, বোবা কান্নায় মুখর। এরই পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে লাল পাঞ্জাবি পরা অভিজিৎ এর রক্তাক্ত নিথর দীর্ঘ দেহখানা। রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া অসহায় বন্যা দুই হাত বাড়িয়ে সাহায্যের আকুল জানাচ্ছে মানুষের কাছে, নিজের জন্য নয়, তার প্রিয় অভিজিৎ এর জন্য। দুই হাত দিয়ে তুলে ধরেছে অভিজিৎ এর মাথা, আকুল হয়ে বলছে, “অভি ওঠো, অভি ওঠো।“

হলিউডের হরর মুভির চেয়েও অনেক বেশি হিংস্রতা দেখেছে ঢাকার মানুষ সেদিন। এ যেনো এক ভয়াবহ আতংক নগরী, দুঃস্বপ্নের মাঝে ঘটে যাচ্ছে সবকিছু। ছায়াছায়াভাবে নড়ছে সবাই, দৃশ্যপটে থেকেও যেনো কেউ নেই সেখানে।

বইমেলায় গিয়েছিলো বন্যা আর অভিজিৎ সেদিন। বইমেলাকে সবাই বলে প্রাণের মেলা। অভিজিৎ এর মতো অতিমাত্রায় পড়ুয়া একজন মানুষের জন্য এটা প্রাণের মেলার চেয়েও বেশি কিছু। বই-ই ছিলো তার স্বপ্ন আর ভালবাসা। সেই ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রেমে পড়েছে সে। সেই থেকে গোগ্রাসে গিলে চলেছে বই। এর কোনো ক্ষান্তি নেই যেনো। আমি ওকে মাঝে মাঝে বলতাম যে, তুমি কোন কোন বই পড়েছো, সেটা বলার চেয়ে কোন কোন বই পড়ো নাই, সেটা বলাই বরং ভালো। এবার অবশ্য বই পড়ার চেয়েও অন্য তাগিদ ছিলো বেশি। অভিজিৎ এর দু’দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে এই বইমেলায়। ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ আর ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’। দুটোই অসাধারণ মানের বই। মেলার প্রথম দিন থেকেই বিক্রি হচ্ছে দুরন্ত গতিতে।

বইমেলা থেকে ফিরে আসার পথে টিএসসির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকের ফুটপাতে আক্রান্ত হয় তারা। প্রেমিকার প্রেমিকার মতো উচ্ছ্বলতা নিয়ে বইমেলা থেকে বের হয়ে এসেছিলো দুজনে। আচমকাই ঘাতক এসে হামলে পড়ে তাদের উপরে। দুটো ছেলে চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিজিৎ এর উপরে। মাথার পিছনে পেশাদার খুনির দক্ষতায় নিখুঁতভাবে তিনবার আঘাত করে তারা। অভিজিৎ -কে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়া বন্যাও আক্রান্ত হয় নিষ্ঠুরভাবে। মাথা এবং ঘাড়ে কোপ খায় সে। আঙুলগুলো তার ঝাঁঝরা হয়ে যায় চাপাতির ধারালো আঘাতে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল হাত থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ে যায় ফুটপাতে।

মাত্র দুই মিনিটের প্রবল আক্রমণ শেষ করে দুই ঘাতক নিশ্চিন্তে চলে যায় দুই দিকে। নিথর দেখে অভিজিৎ পড়ে থাকে ফুটপাতের উপর। আর, বন্যা, বনপোড়া এক হরিণীর মতো আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে তাকে বাঁচানোর জন্য।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে ভাবা হতো বাংলাদেশের সবচেয়ে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন এলাকা। মাত্র বিশ বছরের ব্যাবধানে সেই ক্যাম্পাস এখন পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তদের পদচারণায় মুখর। একজন স্বনামধন্য লেখককে প্রকাশ্য রাজপথে এখানে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে, ভয়হীন চিত্তে চলে যেতে পারে ঘাতকেরা। এই দুঃসাহস কোথা থেকে পায় এরা? এই ধরণের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বইমেলা থেকে ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছিলো আরেক সাহসী লেখক হুমায়ূন আজাদকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, যাকে মনে করা হয় মুক্তবুদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা, সেখানেই যদি মুক্তমত প্রকাশ করতে গিয়ে একের পর এক নিহত হন অমিত প্রতিভারা, তাহলে আর আশার জায়গাটা, ভরসার স্থলটা কোথায় থাকে আমাদের?

হুমকি, ধামকি এবং মৃত্যু পরোয়ানা

মুক্তমনা শুরুর দিক থেকেই আমরা নানা ধরনের হুমকি ধামকি পেতাম। পেতাম অশ্লীল খিস্তিখেউড়। আমি পেতাম কম, অভিজিৎ পেতো অনেক বেশি। এসব হুমকির বেশিরভাগই আসতো ইমেইলে। নানান ধরনের গালিগালাজসমৃদ্ধ ছিলো সেই সব হুমকিগুলো। আমরা এগুলোকে পাত্তাও দিতাম না। বরং নানা সময়ে হাসি-ঠাট্টা রসিকতাই করেছি সেই সব হুমকি-ধামকি নিয়ে। এই হুমকিগুলোকে সিরিয়াসলি না নেবার পিছনে অবশ্য তখন যুক্তিও ছিলো আমাদের। আমরা সেই সময় মুলত ব্লগেই লিখতাম। ব্লগে আমাদের ছবি ছিলো না, কোনো পরিচয় ছিলো না। কোথা থেকে লিখছি সেটা নিজে না বলে দিলে কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিলো না। আমাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিলো ইমেইল। এরকমটা হবার কারণে, আমরা মূলত অদৃশ্য এবং অপরিচিতই ছিলাম বেশিরভাগ মানুষের কাছে। আমাদের নামটা ছাড়া আর কিছুই তারা জানতো না। কিন্তু, ফেসবুকে আমরা সক্রিয় হবার পরেই এই পরিস্থিতি রাতারাতি পালটে গেলো। এখন অনেকেই আমাদেরকে চেহারায় চেনে। অভিজিৎ এর জন্য কাল হলো আরো বেশি করে। সে ফেসবুকে অনেক বেশি সক্রিয়, অনেক বেশি বন্ধু তার। অনেক অচেনা লোকও তার ফেসবুক পেইজ দেখতে পায়। সহজ কথায় পুরোপুরি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে সে। এই সময় থেকেই আসলে হুমকিগুলো সিরিয়াস দিকে টার্ন নেয়। নানাজনে তাকে হুমকি দিতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বহুল প্রচারিত হুমকিটি ছিলো ফারাবির।

ফারাবি একটা ফাতরা ধরনের ছেলে। ফেসবুকে মেয়েদের ত্যাক্ত-বিরক্ত করা আর লোকজনের কাছ থেকে টাকা চাওয়ার মতো ছোটলোকি কাজ-কারবার করে বেড়ানোই ছিলো তার কাজ। অভিজিৎ এর কাছেও একবার দশ হাজার টাকা চেয়েছিলো সে স্মার্টফোন কেনার জন্য। একে কেউ-ই কখনো গুরুত্বের সাথে নেয় নি। এর মানসিক সুস্থতা নিয়েই অনেকে সন্দিহান ছিলো। রাজীব হায়দারের হত্যাকান্ডের পর তার জানাযা পড়ানো ইমামকে হত্যার হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে লাইমলাইটে আসে সে। সেই হুমকিটা নিচে দেওয়া হলো।

এর পরপরই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কথিত আছে যে, পুলিশের জেরার সময়ে এ নাকি ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার কারনেই হোক, কিংবা তার অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণেই হোক, পুলিশ তাকে বেশিদিন আটকে রাখে নি। কিন্তু, এই পুলিশের কাছে আটক হওয়াটাই ফারাবিকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যায়। আগেকার দিনে যেমন জেলখাটা রাজনীতিবিদদের কদর বেশি ছিলো, ঠিক সেরকম করেই ফারাবি জেল খেটে এসে পরিনত হয় পাক্কা একজন ডিজিটাল ফতোয়াবাজে। অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারি জুটে যায় তার। আর এর প্রভাবেই একে ওকে তাকে অহর্নিশ মৃত্যুর হুমকি দিতে থাকে সে।

অভিজিৎ এর সাথে তার প্রথম ঝামেলা শুরু হয় অভিজিৎ এর একটা লেখাকে কেন্দ্র করে। অভিজিৎ এর সেই লেখার শিরোনাম হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন সংযোজন ‘ধর্ম ও নৈতিকতা’ নিয়ে কিছু কথা’। এই লেখাতে অভিজিৎ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নতুন প্রস্তাবিত ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইগুলোর কিছু সমালোচনা করেছিলো। লেখাটির মূল বক্তব্য ছিল এই ছিলো যে, নৈতিকতাকে ধর্মের সাথে জুড়ে দিতে উন্মুখ দেশের হর্তাকর্তারা ধর্মগ্রন্থগুলোকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে সেখানেই অসংখ্য অনৈতিকতার আলামত পেয়ে যাবেন। এই লেখাতে অভিজিৎ বানিয়ে বানিয়ে কিছু লেখে নি। রেফারেন্স দিয়েই ধর্মের অনৈতিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলো। কিন্তু, তাতে লাভ হয় নি। এই লেখা দেখে গভীরভাবে গোস্বা করে ফারাবি। অভিজিত-কে হত্যা করার ফতোয়া জারি করে সে। শুধু অভিজিৎ একা নয়, মুক্তমনার সকল নাস্তিক ব্লগারদের পাথর ছুড়ে হত্যা করার হুমকি দেয় সে।

এক স্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য স্ত্রীদের সাথে সহবাস করবেন, এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কি- যে দিন এক স্ত্রীর পালা আসতো, সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি অন্য কোন স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতও করতেন না? অবশ্যই করতেন, এবং প্রত্যেকে স্ত্রীর সাথেই তিনি সাক্ষাত করতেন। কিন্তু অন্য কোন স্ত্রীর সাথে ঐ দিনে/রাতে সহবাস করতেন না। তাই অভিজিৎ রায় উনার এই ব্লগে যেই কথাটা বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই রাতে উনার ৯ জন স্ত্রীর সাথে সহবাস করতেন এটা একটা চরম মিথ্যাকথা। সম্মানিত ৩ জন উম্মুল মুমেনীন হযরত রায়হানা, হযরত সাফিয়া ও হযরত জুহায়রিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা কে বেশ্যা বা রক্ষিতা বলার অপরাধে ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২০/২২ জন স্ত্রী ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে এই চরম মিথ্যা কথা বলার জন্য অভিজিৎ রায় কে হত্যা করা বংলার মুসলমানদের জন্য ফরয হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিজিৎ রায় দিনের পর দিন উনার মুক্তমনা ওয়েবসাইটে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে চরম মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। হাজার হাজার information Gap রেখে এই মুক্তমনা ওয়েবসাইটে আল্লাহর রাসূল কে নিয়ে প্রতিদিন চরম ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। তাই মুক্তমনা ওয়েবসাইটের প্রতিটি নাস্তিক ব্লগারকে পাথর মেরে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আগে যে সমস্ত হুমকি ছিলো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ, সেই হুমকিগুলোই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে ২০১৩ সালে ব্লগার থাবা বাবা ওরফে রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। রাজীব হায়দারকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে বাসার পাশেই এক নির্জন জায়গায় গলা কেটে হত্যা করা হয়। গত বছর নিজ বাড়িতে গলা কেটে হত্যা করা হয় মাওলানা ফারুকীকে। তিনি উদারপন্থী মাওলানা বলে পরিচিত ছিলেন। জঙ্গীরা কী করতে পারে সে সম্পর্কে জ্ঞাত থাকার পরেও নানা ধরনের হত্যার হুমকিকে কেউ-ই আসলে সেভাবে আমলে নেয় নি। কিন্তু থাবা বাবার এবং মাওলানা ফারুকীর হত্যাকাণ্ড সব হিসাব নিকাশকে পালটে দেয়। বোঝা যায় যে, অন্তর্জালে যুক্তিবাদ এবং নাস্তিকতার যে চর্চা চলছে, তাকে সশস্ত্রভাবে আক্রমণ করার মাধ্যমেই নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। এর মধ্যে ফারাবি গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অভিজিৎ-কে হত্যা করার পরিকল্পনা ঘোষণা দেয়। সেটি এখানে তুলে দিলাম।

এই সমস্ত হুমকিতে অভিজিৎ ভয় পায় নি, কিন্তু সতর্ক যে ছিলো না, সেটা বলা যাবে না। দেশে গেলে সমস্যা হতে পারে, সেই আশংকাও ছিলো তার মনে। ফেব্রুয়ারির তিন তারিখে সে তার ঘনিষ্ঠ জনদের জানিয়েছে এভাবে।

ফেব্রুয়ারির মাখামাঝি সময় দেশে আসার চান্স আছে একটা আমার আর বন্যার। দেখা যাক। তবে এটা নিয়ে হাউকাউ করার দরকার নাই। লো লেভেলে রাখতে চাইছি সব কিছু।

কিন্তু, সেই অভিজিৎ-ই দেশে যাবার পরে বইমেলার টানে এটাকে আর লো লেভেলে রাখতে পারে নি। রাখতে পারার কথাও নয়। তার নিজস্ব অসংখ্য গুণে সে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো সেলিব্রিটিতে। বইয়ের মোড়ক উদ্বোধন করেছে সে, নিজের বইয়ের অটোগ্রাফ দিয়েছে, পাঠকদের সাথে ছবি তুলেছে, সমমনা লেখক, পাঠক, গুণগ্রাহীদের সাথে আড্ডা দিয়েছে, আড্ডা দিয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ সংগঠনের মানুষজনদের সাথেও। আর এর মাধ্যমে নিজেকে পরিণত করেছে মৌলবাদীদের সহজতর শিকারে।

রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হয় না

প্রতিটা যুগেই, মুক্তচিন্তা যাঁরা করেছেন, সমাজকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সামনের দিকে, গাঢ় অন্ধকারকে দূর করতে চেয়েছেন প্রদীপ জ্বেলে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থপর গোষ্ঠী তাঁদের সহ্য করতে পারে নি। নৃশংসভাবে হামলে পড়েছে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তকচিন্তাকে রুদ্ধ করতে, ভয়ানক আক্রোশে ঝাঁপিয়েছে আলোর মশালকে নিভিয়ে দিতে। আলোর চেয়ে অন্ধকার এদের বেশি পছন্দ, মুক্ত বাতাসের চেয়ে দমবন্ধকরা গুমোট পরিবেশই এদের বেশি কাম্য। তাঁদের এই আক্রোশে, নৃশংস হামলায় রক্ত ঝরেছে মুক্তচিন্তকদের। তাঁদের শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়েছে রুক্ষ মাটিতে। বন্ধ্যা মাটি সেই রক্তে হয়ে উঠেছে উর্বর। মুক্তচিন্তকদের রক্তবীজ থেকে বের হয়ে এসেছে আরো অসংখ্য মুক্ত চিন্তার মানুষ।

প্রহসনের এক বিচারের মাধ্যমে সক্রেটিসকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে প্রাচীন গ্রীসে, হাইপেশিয়াকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে, ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, গ্যালিলিওকে বন্দি করা হয়েছে অন্ধকার কারাকক্ষে, অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে, বন্যা আহমেদ মারাত্মক আঘাত নিয়ে পর্যুদস্ত। কিন্তু, তারপরেও মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল আন্দোলনকে থামানো যায় নি কখনো, যাবেও না।

সমাজের নিয়মই হচ্ছে যে, এটি সামনের দিকেই এগোবে। পিছন থেকে একে যতই টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেনো এর সম্মুখ গতি সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও একেবারে কখনোই থেমে যাবে না। প্রতিক্রিয়াশীলরা এটা জানে। তাই, সবসময়ই তারা থাকে মরিয়া। যতোখানি সম্ভব অঙ্গহানি ঘটিয়ে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে সমাজের চাকাকে। প্রতিক্রিয়াশীল আর প্রগতিশীলের এই দ্বন্দ্ব তাই সবসময়ই রক্তক্ষয়ী। তবে, এই রক্ত ঝরে শুধু প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো খুন, জখম, মারামারি-কাটাকাটি করার মতো মানসিকতা তাঁদের নেই। অস্ত্রের চেয়ে কলমের শক্তিতেই বেশি বিশ্বাস তাঁদের। প্রতিটা আন্দোলনে তাই রক্ত দিতে হয় ভূমিকে। রক্ত দেয়া ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। তাই তো অভিজিৎ লিখেছিলো,

যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি। জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়িনি। আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।

অদ্ভুত এক আঁধার

অদ্ভুত এক আঁধার নেমেছে আজ বাংলাদেশে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা এখন আর কোনোভাবে নিরাপদ নয় বাংলাদেশে। অসহিষ্ণুতা এমনই সর্বব্যাপী যে, বিপরীত কোনো চিন্তা, বিশেষ করে ধর্ম সমালোচনা বিষয়ক কোনো জিনিসকে সহ্য করতে পারছে না কেউ। একদল ধর্মান্ধ মোল্লা ছড়ি ঘোরাচ্ছে সবার মাথার উপর দিয়ে। সমাজটাও হয়ে উঠেছে ধর্মাচ্ছন্ন। পত্রিকায় নির্দোষ একটা মোহাম্মদ বিড়াল নামের কৌতুকের জন্যও তরুণ কার্টুনিস্টকে জীবন নিয়ে পালাতে হয় দেশ ছেড়ে। দিকে দিকে শুধু ধর্মানুভুতি আহত হবার জিগির। মানুষের আর কোনো অনুভুতি আঘাতপ্রাপ্ত হয় না, কিন্তু এই অনুভুতি এমনই প্রবল যে, তা আঘাত হানে সহসা। এই আঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তখন মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় রক্তের নেশায়। হুমায়ূন আজাদ এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেনঃ

একটি কথা প্রায়ই শোনা যায় আজকাল, কথাটি হচ্ছে, ‘ধর্মানুভুতি’! কথাটি সাধারণত একলা উচ্চারিত হয় না, সাথে জড়িয়ে থাকে ‘আহত’ ও ‘আঘাত’ কথা দুটি; শোনা যায় ‘ধর্মানুভুতি আহত’ হওয়ায় বা ‘ধর্মানুভুতিতে আঘাত’ লাগার কথা। আজকাল নিরন্তর আহত আর আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মানুষের একটি অসাধারণ অনুভুতি, যার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ খুবই কোমল স্পর্শকাতর জীব, তার রয়েছে ফুলের পাপড়ির মতো অজস্র অনুভূতি; স্বর্গাচ্যুত মানুষেরা বাস ক্রছে নরকের থেকেও নির্মম পৃথিবীতে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অপবিত্রতা সীমাহীন; তাই তার বিচিত্র ধরনের কোমল অনুভুতি যে প্রতি মুহুর্তে আহত রক্তাক্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন সুদিন আসবে, সে আবার স্বর্গে ফিরে যাবে, তখন ওই বিশুদ্ধ জগতে সে পাবে বিশুদ্ধ শান্তি; সেখানে তার কোনো অনুভুতি আহত হবে না, ফুলের টোকাটিও লাগবে না তার কোনো শুদ্ধ অনুভুতির গায়ে। অনন্ত শান্তির মধ্যে সেখানে সে বিলাস করতে থাকবে। কিন্তু, পৃথিবী অশুদ্ধ এলাকা, এখানে আহত হচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে তার নানা অনুভূতি – এটা খুবই বেদনার কথা এবং সবচেয়ে আহত হচ্ছে একটি অনুভূতি, যেটি পুরোপুরি পৌরানিক উপকথার মতো, তার নাম ধর্মানুভূতি। মানুষ বিশ্বকে অনুভব করে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে; ইন্দ্রিয়গুলো মানুষকে দেয় রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শ্রুতির অনুভুতি; কিন্তু মানুষ একমাত্র প্রতিভাবান প্রাণী মহাবিশ্বে, শুধু এ পাঁচটি ইন্দ্রিয়েই সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে অজস্র ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয়। তার আছে একটি ইন্দ্রিয়, যার নাম দিতে পারি সৌন্দর্যেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে সৌন্দর্য; আছে একটি ইন্দ্রিয়, নাম দিতে পারি শিল্পেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে উপভোগ করে শিল্পকলা; এমন অনেক ইন্দ্রিয় রয়েছে তার, সেগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রখর প্রবল প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে তার ধর্মেন্দ্রিয়, যা দিয়ে সে অনুভব করে ধর্ম, তার ভেতরে বিকশিত হয় ধর্মানুভূতি, এবং আজকের অধার্মিক বিশ্বে তার স্পর্শকাতর ধর্মানুভুতি আহত হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয় ভোরবেলা থেকে ভোরবেলা। অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে পরাভূত করে এখন এটি হয়ে উঠেছে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়; ধর্মেন্দ্রিয় সারাক্ষণ জেগে থাকে, তার চোখে ঘুম নেই; জেগে জেগে সে পাহারা দেয় ধর্মানুভূতিকে, মাঝে মাঝেই আহত হয়ে চিৎকার করে ওঠে এবং বোধ করে প্রচণ্ড উত্তেজনা। এটা শিল্পানুভুতির মতো দুর্বল অনুভুতি নয় যে আহত হওয়ার যন্ত্রণা একলাই সহ্য করবে। এটা আহত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ধর্মানুভুতির উত্তেজনা ও ক্ষিপ্ততায় এখন বিশ্ব কাঁপছে।

সেই উত্তেজনা এবং ক্ষিপ্ততায় এখন বাংলাদেশও কাঁপছে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার লেখকদের এখন জান হাতে রেখে লেখালেখি করতে হয়। মত প্রকাশে সকলেই দ্বিধাগ্রস্ত এখন। অসীম সাহসী না হলে নিজের নামে আর লিখছে না কেউ। এরকম ভয় এবং আতংকের পরিবেশে থেকে সেটা সম্ভবও নয়। আমি নিজে সবসময় ছদ্মনাম, ছদ্ম পরিচয়ে লেখালেখির বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু, আজকে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো্তে যুক্তিবাদী মানুষদের চরম অনিরাপত্তা দেখে, নিজের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছি। সুস্থ স্বাভাবিক একটা পরিবেশে সুস্থতা আশা করা যায়, অসুস্থ এবং বিপদজনক পরিবেশে নিজের নিরাপত্তাই সবার আগে বিবেচ্য হওয়া উচিত। এই লেখাটা যখন প্রকাশ করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই আরেকটি মর্মান্তিক খবর এলো। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাসার কাছেই রাস্তার মধ্যে তিনজন চাপাতি নিয়ে ওয়াশিকুরের ওপর হামলা চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পেশাগত জীবনে তিনি এনজিওতে কাজ করতেন । এবং বিভিন্ন ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। তিনি ফেসবুকে অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদ করে আসছিলেন ।

ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার দুই হামলাকারীর মধ্যে জিকরুল্লাহ নামের একজন চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র। আর আরিফুল নামের অন্যজন পড়েন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসায়। তারা পুলিশকে বলেছেন, আবু তাহের নামে আরেকজন তাদের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।

উপ কমিশনার বিপ্লব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, “ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে লেখালেখির কারণে বিরোধ থেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার কথা গ্রেপ্তার দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা কোনো সংগঠন বা দলের কি-না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

ওয়াশিকুর বাবু একবার তাঁর লিখেছিলেন, ‘এক থাবা বাবার মৃত্যু হাজার থাবা বাবা জন্ম দিয়েছে, এক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু লাখো অভিজিত্রায়কে জন্ম দিবে।’ তাঁর ফেসবুকের কভার ছবি করেছিলেন ‘আই এম অভিজিৎ, ওয়ার্ড ক্যাননট বি কিলড’ লিখে। সেই তিনি আজ সত্যি সত্যিই অভিজিৎ হয়ে গেলেন।

দেশের বাইরে যাঁরা আছেন তাঁরাও যে নিরাপদ নয়, সেটা অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদকে দেখেই বোঝা গেছে। বিদেশে থাকি আর যেখানেই থাকি না কেনো, আমাদের সবার শিঁকড় তো পোতা রয়েছে ওই বাংলাদেশেই। কোনো না কোনো প্রয়োজনে ফিরতেই হয় সেখানে। অভিজিৎ নিজেও এটা নিয়ে সচেতন ছিলো। মুক্তবুদ্ধির লেখকদের এই অনিরাপত্তা বিষয়ে সে লিখেছেঃ

বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখকদের জীবন হাতে নিয়ে লেখালিখি করতে হয়। লেখালিখি তো অনেকেই করেন, এবং বহু বিষয়েই, কিন্তু আমরা দেখছি ক্রমাগতভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তারাই যারা ধর্মীয় কুসংস্কারকে ক্রিটিকালি দেখছেন, কিংবা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছেন। বাংলার কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্ববরকে ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি লেখার কারণে শাসক শ্রেণীর গ্রেফতারী মামলা ও মত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও কম নিগৃহ তাকে পোহাতে হয়নি। কবীর চৌধুরী, আলি আসগর, আহমদ শরীফ দের একসময় মুরতাদ আখ্যা পেতে হয়েছে, তসলিমাকে ফতোয়া দেয়া হয়েছে,তার মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে, এমনকি ফতোয়াবাজ আমিনী এও বলেছিলেন – তসলিমা নাসরিনের কোন লেখা আমি পড়িনি, তবে তার ফাঁসি চাই’। তসলিমাকে অতঃপর দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছে, আর আজ আসিফ মহিউদ্দীনদের হতে হচ্ছে ছুরিকাহত, আর রাজীবকে তো জবাই করেই মেরে ফেলা হল। অথচ ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকেল-১৯ এ পরিষ্কার বলা আছে –

“Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”

বাংলাদেশের সংবিধানেও (অনুচ্ছেদ ৩৯ দ্রঃ) কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রে নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত’ থাকার উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবেই। অথচ তারপরেও মুক্তচিন্তার লেখকেরা তাদের মতপ্রকাশের কারণে আক্রান্ত হন, নির্যাতিত হন, কিংবা বিপন্ন-বোধ করেন।

বিচারের বাণী কাঁদে নিভৃতে

অভিজিৎ এর হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই আনসার বাংলা ৭ নামের টুইটার একাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। অভিজিৎ এর হত্যাকাণ্ডে উল্লসিত হয়ে একগাদা টুইট করে আনসার বাংলা ৭। প্রথম টুইটেই লেখা হয়, আল্লাহু আকবর, এ গ্রেট সাক্সেস টুডে হেয়ার ইন বাংলাদেশ। টার্গেট ইজ ডাউন হেয়ার ইন ঢাকা।

আনুসার বাংলা ৭ এর কাউকেই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় না পুলিশ। তবে, অভিজিৎ কে নানা সময়ে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেওয়া ফারাবিকে কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে, এটুকুই। এর বেশি করার আর সামর্থ দেখায় নি পুলিশ। অভিজিৎ এবং বন্যা, দুজনেই আমেরিকার নাগরিক হবার কারণে, এই ঘটনায় আমেরিকান সরকারও জড়িত হয়ে পড়ে। ঘটনার তদন্তে চার সদস্যের এফবিআই টীম এসে হাজির হয় ঢাকায়। ডিবির সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করে দেয় তারা।

কিন্তু, আজকে অভিজিৎ হত্যার এক মাস হয়ে যাবার পরেও তদন্তে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। খুনি বা খুনিদের ধরাতো অনেক দুরের কথা, কে তাকে খুন করতে পারে, সেই সম্পর্কেই পুলিশের কোনো ধারণা নেই। সেই শুরুতে তারা যেখানে ছিলো, সেখানেই পড়ে আছে আজকেও।

গত রোববার ২২শে মার্চ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন যে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডটি ক্লু-লেস হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।“ জনসম্মুখে ঘটা একটি হত্যা কীভাবে ক্লু-লেস হয়’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, ঘটনাটি সবার সামনে ঘটেছে ঠিক আছে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। ঘটনার সময় কয়জন ছিল, তারা দেখতে কেমন- এ সব তথ্য কেউ দিতে পারেনি।“

উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে প্রবলভাবে শংকিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। প্রকাশ্য রাজপথে অসংখ্য মানুষের সামনে খুন হওয়া খুনের কোনো ক্লু যদি পুলিশ ঘটনার এক মাস পরেও বের না করতে পারে, তবে সেই খুনের তদন্তে কী ফলাফল বেরিয়ে আসবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। আরো একটি অমিমাংসিত খুনের ঘটনা হিসাবেই অভিজিৎ এর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ধামাচাপা পরে যাবে হয়তো চিরতরে। খুনিরা থেকে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এরকম ঘটনা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। এর আগে অভিজিৎ এর মতো একই কায়দায় একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে মৌলবাদী দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন হুমায়ূন আজাদ। সেই আক্রমণের হোতাদেরকেও পুলিশ ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো।

ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের অবশ্য পুলিশ ধরতে পেরেছে। হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্র – ফয়সাল বিন নাইম, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসানুর রেজা রোমান, নাঈম সিকদার ও নাফিস ইমতিয়াজকে আটক করা হয়েছিলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন যে, তারা পাঁচজনই এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। ঘটনা এ পর্যন্তই। এদের কবে বিচার হবে, কবে সাজা হবে, আদৌ হবে কিনা, তার আমরা কিছুই জানি না।

বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাই হত্যাকারীদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে অবিরাম। হত্যা করার পরে যেহেতু খুব সহজে আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে সটকে পড়া যায়, সে কারণে হত্যা, গুম কিংবা কিডন্যাপে অংশ নিতে ষণ্ডা-পাণ্ডাদের খুব একটা ভয়ের কিছু থাকে না। স্বাধীন একটা দেশে আপনাআপনিতেই অপরাধের তদন্ত হবে, বিচার হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, বাংলাদেশে যেনো ঘটছে উলটো ঘটনা। এখানে অপরাধ ঘটানো সুলভ, বিচার পাওয়াটা দুর্লভ। তাই তো অভিজিৎ এর হত্যার এক মাস পরে বন্যা আহমেদকে বিবৃতি দিতে হয় সুষ্ঠু তদন্ত আর ন্যায় বিচারের চেয়ে। তাকে বলতে হয়,

এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম একটা মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করার কথা ছিল সকল মানুষের বাকস্বাধীনতা। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা উপলদ্ধি করছি যে, আজকে সেই দেশেই ধর্মোন্মাদদের অরাজক কাজকর্মের বিচার চাইবার জন্য আমাদের কাকুতি-মিনতি করতে হচ্ছে।

বিচারের জন্য কেনো রাষ্ট্রের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হবে? কেনো ভিক্ষা চাইতে হবে চাইতে হবে? রাষ্ট্রের তো স্বাভাবিক দায়িত্ব অপরাধীদের ধরা, তাদের সাজা দেওয়া। এর মাধ্যমে তার নাগরিকদের নিরাপদ একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা। সেই স্বাভাবিক আচরণটা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, আর আমরা বারবার রাষ্ট্রের কাছে করজোড়ে ভিক্ষা চাইছি। যেনো এটাই আমাদের দায়িত্ব। খাদিজা বেগম নামের একজন ফেসবুকার তাঁর স্ট্যাটাসে এটাকে চরমভাবে বিদ্রুপ করে এই কথাগুলো লিখেছেনঃ

হুমায়ুন আজাদকে কোপানোর পরে আমরা বলেছি, বিচার চাই, বিচার চাই। আমরা এখনো বিচার চাই, বিচাই চাই। রাজীবকে কুপিয়ে হত্যা করার পরে আমরা বলেছি, বিচার চাই, বিচার চাই। আমরা এখনো বলছি, বিচার চাই, বিচার চাই। আভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করার পর আমরা বলে চলেছি, বিচার চাই, বিচার চাই, বিচার চাই। এভাবে আমরা ভিখিরির মত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিচার ভিক্ষে করে যাবো। বিচার যেন বাংলাদেশে ভিক্ষে, আর বিচার প্রার্থীরা যেন ভিখিরি। হত্যাকারীরা আর তাদের রক্ষাকারী ক্ষমতাসীনরা আল্লা ভগবান ঈশ্বর। তারা আমাদের বৃথা ভিক্ষে চাওয়া দেখে আসমানে বসে বিনোদন লাভ করেন, অট্ট হাসেন।

অসুর বধের কাব্য

অভিজিৎ-কে অকালে এবং অকস্মাৎভাবে হারানোটা মুক্তমনাদের জন্য বিশাল বড়ো একটা ধাক্কা। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটেছে যে, হতচকিত এবং হতবিহ্বল হওয়া ছাড়া কারো আর কোনো উপায় ছিলো না। বিপুলভাবে বিচলিত আমরা শুরুতে থমকে গিয়েছি, সংশয়ে পড়েছি, দ্বিধাগ্রস্ত আচরণও করেছি কেউ কেউ। এতে দোষের কিছু নেই, অভিজিৎ এককভাবে বিশাল এক ছাদ হয়ে সবাইকে ছায়া দিয়ে গিয়েছে এতোদিন। নির্বিঘ্ন এই ছায়ার কারণে সবার মধ্যেই একটা স্বস্তিভাব বিরাজমান ছিলো। মাথার উপর থেকে নিরাপত্তার সেই ছাদ হুট করে সরে গেলে যে কেউ-ই বিচলিত হবে, বিভ্রান্তিতে ভুগবে। কিন্তু, এটা ছিলো সাময়িক। শুরুর বিচলিত অবস্থাকে দ্রুত সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুক্তমনারা। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ তারা, অনেক বেশি সচেতন তারা, অনেক বেশি কর্মস্পৃহ, অনেক বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অভিজিৎ-কে হত্যার মাধ্যমে যে লড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তমনার উপরে, সেই লড়াই থেকে এক পাও পিছিয়ে আসছি না আমরা। তবে, হ্যাঁ, মৌলবাদীদের মতো চাপাতি, কিরিচ নিয়ে এই লড়াইয়ে নামছি না আমরা। আমরা নামছি কলম আর কি-বোর্ড নিয়ে। আমরা দেখতে চাই, কোনটা বেশি শক্তিশালী, চাপাতি-কিরিচ, আগ্নেয়াস্ত্র, নাকি কলম, কি-বোর্ড আর আত্মশুদ্ধিতার?

চৌদ্দ বছর আগে অসুর বধের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে অভিজিৎ রায় ‘মুক্তমনা’ নামের যে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় সে সন্তান এখন আর অভিজিৎ এর একার নয়। যৌথ পরিবারের আরো অনেক সদস্যের বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে। সবার সম্মিলিত প্রশিক্ষণে অসুর বধের কলাকৌশল সে শিখে নিচ্ছে দিনকে দিন। শত আঘাত, শত আক্রমণকে তুচ্ছ করে শাণিত হচ্ছে সে প্রতিদিন। অসুর বধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দ্রোহের আগুনে পুড়িয়ে দেবো ঘর দুয়ার সব।

আমাদের চারপাশে জমে থাকা সহস্র বছরের অন্তহীন আঁধারকে দূরে ঠেলে সরিয়ে জানি একদিন ভোর হবে। জমাট বাঁধা প্রগাঢ় অন্ধকার ভেদ করে দিগন্তের কাছে ক্ষীণ অস্পষ্ট যে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, তার আড়ালেই তো লুকিয়ে আছে অনাগত সূর্যের উজ্জ্বল হাসি।