প্রিয় বাঙালি মুসলমান,

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর আজ এক মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু খুনীদের ধরার ধারেকাছেও পুলিশ পৌঁছাতে পারেনি। আইনরক্ষকরা তাদের কাজ ঠিকমতো করতে না পারলেও, ‘ধর্মরক্ষকরা’ তাদের কাজ সবসময়ই খুব সুন্দরভাবে করে যান। হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা প্রসঙ্গে এক সমকাল সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আপনাদের হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।” আর অভিজিৎ রায় হত্যার ৯ দিন পর আপনাদের ফরহাদ মজহার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে লিখলেন, “বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়; কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।” আমি নিজেকে কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠিত মতবাদের রক্ষক মনে করি না, কিন্তু হাফিজ (১৩২৬–১৩৯০) যখন বলেন,

Let your
Intelligence begin to rule
Whenever you sit with others
Using this sane idea:
Leave all your cocked guns in a field
Far from us,
One of those damn things
Might go
Off. ((Ḥāfiẓ; The Gift; translated by Daniel Ladinsky.))

তখন এই sane idea টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা না করে থাকতে পারি না। আমার এই খোলাচিঠির উদ্দেশ্য আপনাদেরকে সেই sane পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো। লিখতে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে আপনাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানব, কিন্তু তার জন্য আমি দুঃখিত নই, কারণ যে পরিবেশে যেকারো যেকোনো অনুভূতিকে যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আহত করা যায় সে পরিবেশকেই আমি sane বলছি। তাই যখন আমার মুখ থেকে আপনাদের ধর্মের নামে খারাপ কথা শুনবেন, তখন মনে করবেন আমি হাফিজ হয়ে আপনাদেরকে আড্ডায় ডাকছি, নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি একে অপরের বা নিজের অনুভূতিগুলোকে আহত করার মেলায়। হাফিজের উক্ত সরল Ordet যাদেরকে স্পর্শ করেছে তাদের সবাই সে আড্ডায় নিমন্ত্রিত।

আমি আপনাদের কেউ নই, কিন্তু আপনাদের মাঝেই আমার জন্ম হয়েছিল, আপনাদের অন্তরের সব প্রাকৃতিক অন্ধকার আর প্রাকৃতিক আলো নিয়েই আমি এক বিজলিবাতিহীন গ্রামে জন্মেছিলাম, আমার অন্তর প্রথম আপনাদের শহরের কয়েকজনই বিজলি-আলোকে বিকশিত করেছিল। আজ আমি বহুদূরে থাকি, আপনাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ, আগন্তুক। কিন্তু এক বুড়ো দাদুর কাছে শুনেছিলাম, “আমাদের দেশে অতীতে যে সামাজিক প্রথা প্রচলিত ছিল, তাহাতে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যাক্তিও গৃহস্থের আতিথেয়তা হইতে বঞ্চিত হইত না।” সেই পৌরাণিক অধিকারেই আজ আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু লিখতে বসেছি।

আপনারা জানেন যে, পৃথিবীতে অনেক ধর্ম আছে। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না যে, ধর্মের সমালোচনা করার মতো মানুষও পৃথিবীতে অনেক আছে, এবং এই সংশয়বাদের ইতিহাস ধর্মের সমানই প্রাচীন। হয়ত আরো বেশি জানেন না যে, যে যুগগুলোতে ধর্মালোচক আর ধর্ম-সমালোচক এক টেবিলে বসে ডালভাত খেতে পারতেন সেই যুগগুলোই মানুষের সবচেয়ে ঐশ্বর্যের যুগ। যে যুগগুলোতে ধর্মহীনের তীব্র কটাক্ষ ধার্মিকের হাতে বা অন্তরে চাপাতি তুলে দিত না, তেমনই এক যুগের কথা দিয়ে আমার বিলাপগাঁথা শুরু করব।

যিশু’র জন্মের শ’ তিনেক বছর আগে পৌত্তলিক গ্রিকদের দেশে এপিকুরোস (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১–২৭০) নামে এক প্রকৃতিবাদী দার্শনিক বাস করতেন। ধর্মজীবীদের আতঙ্কগাঁথা শুনে থরথর-কম্পিত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি পরমাণুবাদী দর্শন প্রচার শুরু করেন। তিনি বলতেন, মানুষের দেহ কিছু পরমাণুর সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই না, বিদেহী আত্মা বলতে কিছু নেই, মৃত্যুর পর পরম শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই, ঈশ্বর বলে কিছু থাকলেও তিনি ধর্মগ্রন্থের বর্ণনার মতো নন এবং মর্ত্যের কোনো কাজে কক্ষনো হস্তক্ষেপ করেন না। এপিকুরোসের দর্শন রোমানদের মধ্যে প্রচারের জন্য কবি লুক্রেতিউস (খ্রিস্টপূর্ব ৯৯–৫৫) যিশু’র জন্মের পঞ্চাশ বছরের মতো আগে একটা মহাকাব্য লিখেছিলেন যা আসলে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাকৃতিক দর্শন বা বিজ্ঞান নিয়ে লেখা একমাত্র মহাকাব্য। এই কাব্যের শুরুতে তিনি যেভাবে ধর্মকে লাঞ্ছিত করেছিলেন আপনাদের মধ্যে খুব কমই তা শুনে দ্বেষহীন থাকতে পারবেন। কিন্তু বলে রাখি, তার কোনো বিচার হয়নি, তিনি চাপাতির কোপে মারা যাননি, বরং লাতিন ভাষার অন্যতম সেরা কবি, দ্বিতীয় আদিকবি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন, হয়েছেন ভার্জিলের মতো কবি’র পথপ্রদর্শক। প্রিয় পাঠক, নিজের অন্তরটাকে দ্বেষহীন, অহংকারমুক্ত করার পরীক্ষা হিসেবেই নাহয় নিচের চরণগুলো পড়ুন।

মানবতা যখন সবার চোখের সামনে, ভূলুণ্ঠিত
হয়ে, পিষ্ট হচ্ছিল ‘ধর্মের’ নিচে চাপা পড়ে,
যে স্বর্গধাম হতে প্রদর্শন করে তার
ভীষণদর্শন মুখ, নশ্বরদের উপর চেপে বসে ছিল,
প্রথম এক গ্রিক-ই তখন নশ্বর নরচক্ষু তুলে তার দিকে
তাকিয়েছিল, প্রথম তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখিয়েছিল;
কারণ দেবদেবীর গল্পগাঁথা বা বজ্রপাত বা ভয়ংকর
হুংকার তোলা স্বর্গ কিছুই তাকে দমাতে পারেনি, উল্টো আরো বেশি
তার প্রাণশক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছে, যার ফলে সে-ই
প্রথম ভাঙতে পেরেছে প্রকৃতির রুদ্ধদ্বারের লৌহগরাদ।
সুতরাং তার আত্মার সঞ্জীবনী শক্তিরই জয় হয়েছে এবং ধেয়েছে
সে সম্মুখপানে, ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের অগ্নিপ্রাচীর
চিন্তা ও কল্পনায় বিচরণ করেছে অমেয় ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র, জয় শেষে
ফিরে এসে আমাদের জানিয়েছে—কিসের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব,
কিসের অসম্ভব, কিভাবে নির্ধারিত হয় কোনোকিছুর পরিসর,
চিহ্নিত হয় কোনোকিছুর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সীমারেখা।
ফলশ্রুতিতে এখন উল্টো ‘ধর্মই’ লুণ্ঠিত আমাদের পদতলে
আর আমরা তার বিজয়মাল্য পরে উঠে গেছি স্বর্গের সমতলে। ((Lucretius; De rerum natura; line. 62–79.))

এপিকুরোসের বিজয়মাল্য পরে লুক্রেতিউস যেভাবে স্বর্গারোহণ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই অভিজিতের বিজয়মাল্য পরে আমি স্বর্গলোকে গিয়েছিলাম। সেখানে অনিন্দ্য সুন্দর সব গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ, গ্যালাক্সিপুঞ্জ, আলোকমেলা দেখেছি; কোনো আল্লাহ, ফেরেশতা, জ্বিন, পরী দেখিনি। আপনাদের মধ্যে যারা পরকালে স্বর্গে যেতে চান, তারা আমাদের ইহকালে স্বর্গপ্রাপ্তির সাধটুকু পূরণের সুযোগ দিতে এত কুণ্ঠিত কেন? পরকালে মহাশূন্যের মহা অনর্থের মাঝে হারিয়ে যাওয়া আমাদের করুণা করে আমাদেরকে এই জীবনে একটু স্বর্গসাধনা করতে দিন না! ‘ধর্মের’ সমালোচনাই যে আমাদের স্বর্গসাধনা।

লুক্রেতিউস সকল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি দে রেরুম নাতুরা তে ধার্মিকতাকে শুভ, আর ‘ধর্ম’ কে অশুভ বলেছেন। এর কারণ এপিকুরোসবাদীরা ধর্ম বলতে আপামর জনসাধারণের শৈশবসূত্রে পাওয়া নৈতিকতা বোধ কে বুঝাত, তাই ধার্মিকতা তাদের কাছে অশুভ কিছু ছিল না। কিন্তু, religion (দুইপাশে উদ্ধৃতিচিহ্ন ওয়ালা ‘ধর্ম’) বলতে বুঝাত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে, যে ধর্ম বেচে ধর্মজীবীরা খেয়ে থাকে। আপনাদের অধিকাংশের ধর্ম অবশ্য আজ আর বাল্যসূত্রে পাওয়া সহজ-সরল নৈতিকতায় আবদ্ধ নেই, আপনাদের মধ্যে প্রায় সকল পেশার মানুষেরাই আজ ধর্মকে একটা দ্বিতীয় পেশা হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন। তারপরও আপনাদের মধ্যে দ্বেষহীন, অহংকারহীন মানবধর্ম বলতে যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুর উপর ভরসা রাখতে ইচ্ছা করে। হাজার হোক আমার মা আপনাদেরই একজন, আমার বাবা আপনাদেরই একজন ছিলেন। বাবা’র কাছ থেকেই ছেলেবেলায় ‘শহীদ’ শব্দটি শিখেছিলাম। এই সুন্দর শব্দটিকে আমি আপনাদেরই দান বলে গ্রহণ করেছি। এই শব্দের সৌন্দর্য্য আমি খুঁজে পাই সালাম বরকতের নামের আগে, এবং ত্রিশ লক্ষ শহীদ এ।

কিন্তু সেই ‘শহীদ’ শব্দেরই আবার কেমন ভয়ংকর ব্যবহার আপনাদের মধ্যে অনেকে করে থাকেন সেটা ভাবলে গা শিউরে উঠে। আপনাদের ইতিহাসটাই যেন প্রচুর বেদনাময় বৈপরীত্যে ভরা। শুনেছি, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ইতিহাসকে আপনারা নিজেদের ইতিহাসের অংশ বলেই ভাবেন। সেই মধ্যপ্রাচ্যে আপনাদের পূর্বজরা নবম–একাদশ শতকে বিপুল উদ্যমে আলোর সন্ধান শুরু করেছিলেন। তারা এরিস্টটলকে ‘প্রথম শিক্ষক’ ডাকতেন, প্লেটো-এরিস্টটল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা মুসলিম দার্শনিক আল-ফারাবি (৮৭২–৯৫০) কে ডাকতেন ‘দ্বিতীয় শিক্ষক’, আল-রাজি (৮৫৪–৯২৫) এবং আল-কিন্দি (৮০১–৮৭৩) দের অনুসরণ করতেন অনেকে। এরিস্টটলের গোটা দর্শনকে ইসলামের সাথে সমন্বিত করার নায়ক ইবনে সিনা (৯৮০–১০৩৭) ছিলেন কারো কারো নয়নের মণি। রাজি-কিন্দি-ফারাবি-সিনা দের দিয়ে তৈরি তাপসমালায় পরবর্তী পুঁতিটি গাঁথতে একসময় আপনাদের ধর্মাকাশে এমন এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে যিনি নিজের অজ্ঞাতেই ইসলামের ইতিহাস জীবনের তরে পাল্টে দেন।

এই নবনক্ষত্র, ইমাম আল-গাজ্জালি (১০৫৮–১১১১), আপনাদের আজকালকার সাংঘাতিক-বদ্ধ-হৃদয়ওয়ালা আলেম-ওলামাদের মতো ছিলেন না; অন্তত একদিক দিয়ে তো নয়ই: তিনি জ্ঞান কত প্রকার ও কী কী সেটা জানতেন এবং সেই সবগুলোকে আত্তীকরণের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সব জোড়া লাগাতে গিয়ে তিনি এক মহাভজঘটের জন্ম দেন, যে কারণে স্পেনদেশে জন্ম নেয়া আপনাদের আরেক দার্শনিক ইবনে রুশদ (১১২৬–১১৯৮) বলেছিলেন যে, গাজ্জালি “আশারীয়দের সাথে আশারীয়, দার্শনিকদের সাথে দার্শনিক, আর সূফিদের সাথে সূফি”। আজকে আপনাদের কারো কারো মধ্যেও যে বহুরূপীতা দেখতে পাই তা গাজ্জালিরই ছায়া কি-না কে জানে। গাজ্জালিকে কিন্তু আমি শুরুতে আমাদের লোকই ভেবে নিয়েছিলাম, তার তাহাফুত আল-ফালাসিফাহ বইয়ে পড়েছিলাম,

এই ব্যাপারগুলো [চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ] জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের মাধ্যমে সুপ্রমাণিত এবং এগুলোতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যে ব্যক্তি এসব নিয়ে গবেষণা করেছে, এ সম্পর্কিত সব উপাত্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে, এবং তার কারণে কখন সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে, সেটা আংশিক হবে না পূর্ণ হবে এবং কতক্ষণ বজায় থাকবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করার অধিকার অর্জন করেছে, তাকে গিয়ে যদি বলো যে এগুলো ধর্মের পরপন্থী, তাহলে তার বরং ধর্মবিশ্বাস টলে যাবে, কিন্তু তার গবেষণায় বিশ্বাস এতটুকু টলবে না। ((Al-Ghazali’s Tahafut al-Falasifah; translated by Sabih Ahmad Kamali; Pakistan Philosophical Congress, 1963; p. 6.))

গালিলেওকে যেখানে সপ্তদশ শতকেও প্রাকৃতিক বিষয়গুলোতে ধর্ম আগে না কি বিজ্ঞান আগে সে নিয়ে চার্চের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে, আপনাদের অন্যতম ধর্মবেত্তা গাজ্জালি সেখানে একাদশ শতকেই বিজ্ঞানের পক্ষে রায় দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বই যখন আরো কিছুদূর পড়লাম, আর ফ্র্যাংক গ্রিফেল ((Griffel, Frank; Al-Ghazali’s Philosophical Theology; Oxford University Press, 2009.)) এসে যখন আমার মনের অন্ধকার আরো কিছুটা দূর করলেন, ((Frank Griffel on al-Ghazālī; an interview taken by Peter Adamson, 13 October 2013.)) তখন দেখলাম গাজ্জালি’র রায়টা নিরঙ্কুশ ছিল না। অষ্টাদশ শতকে ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪–১৮০৪) বা ডেভিড হিউম (১৭১১–১৭৭৬) রা প্রাচীন দার্শনিকদের যে সমালোচনা করেছিলেন, গাজ্জালি সেটা তারো সাতশ’ বছর আগে করে গেছেন, এ নিয়ে আমাদের কারো সন্দেহ নেই। কিন্তু, হিউম-কান্ট যেখানে পুরনো দর্শন উপড়ে ফেলে আরো আলোকময় নতুন দর্শন সৃষ্টির পথ তৈরি করেছেন, গাজ্জালি সেখানে গোটা দর্শনচর্চাকেই ‘বাচ্চাদের’ থেকে দূরে রাখার আদেশ দিয়ে গেলেন, এবং ‘বড়দেরকেও’ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলে খুনের হুমকি দিয়ে গেলেন। আপনাদের সবচেয়ে বড় দার্শনিক, সবচেয়ে বড় সাধক, সবচেয়ে বড় সূফিদের একজনের কাছ থেকে আমি এটা একেবারেই আশা করিনি।

গাজ্জালি’র আগেও আপনাদের মধ্যপ্রাচ্যীয় পূর্বজরা ধর্মত্যাগের জন্য মাঝেমাঝে মানুষ হত্যা করত। আপনাদের অধিকাংশ ধর্মীয় আইনেই মুরতাদ তথা ধর্মত্যাগীদের হত্যার বিধান রয়েছে। কিন্তু গাজ্জালি’র আগে কেবল তাকেই হত্যা করা যেত যে নিজে ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিত। গাজ্জালি এসে বললেন, ঘোষণা-ফোষণার কোনো দরকার নেই, তিনটা নির্দিষ্ট দার্শনিক সিদ্ধান্ত ((গাজ্জালি মনে করতেন ৩টা জিনিস কোনো মুসলিম মানলে সে আর মুসলিম থাকে না: ১) জগৎ অনন্তকাল ধরে বিরাজমান; ২) সৃষ্টিকর্তা কেবল ‘সাধারণ’ অর্থে জগৎকে জানে, জগতের কোনো ‘বিশেষ’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট জিনিস সম্পর্কে জানে না, (দর্শনে এটা universals/particulars সমস্যা নামে পরিচিত) ৩) মানুষ একবার মরে গেলে তার দৈহিক পুনরুত্থান অসম্ভব, পরকালে তার কেবল আত্মিক পুনরুত্থান হতে পারে। সূত্র ৩ এর পৃষ্ঠা ২৪৯ দ্রষ্টব্য।)) যদি কেউ সর্বসমক্ষে বিশ্বাস করে ও প্রচার করে, তাহলে সকল মুসলমান তাকে ইসলামত্যাগী ধরে নিতে পারে, এখন সে নিজেকে মুসলমান মনে করুক আর নাই করুক। তিনি এমন মুসলমানদের নাম দিলেন ‘যান্দাক্বা’ ((Bello, M. I. F.; Accusations of Zandaqa in Al-Andalus; Quaderni di Studi Arabi, Vol. 5/6, Gli Arabi nella Storia: Tanti Popoli una Sola Civiltà (1987-1988), pp. 251-258.)) (زندقة) বা গুপ্ত ধর্মত্যাগী। আর কাকে যান্দাক্বা বলে সাব্যস্ত করা হবে তা নির্ধারণের অধিকার গাজ্জালি নিজের পাশাপাশি সকল মুমিন মুসলমানের মধ্যেও উদারহস্তে বিতরণ করলেন। আরো বললেন, যদি রাষ্ট্র এমন ধর্মত্যাগীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে, তাহলে যেকোনো মুসলমান আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারবে। উক্ত তিনটি সিদ্ধান্তই এরিস্টটলে পাওয়া যায়, এবং যথারীতি ইবনে সিনাতেও পাওয়া যায়; তাহাফুত বইটি লেখাই হয়েছিল মূলত ইবনে সিনা’র দর্শনের বিরুদ্ধে। আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় দার্শনিকের গবেষণার ফলাফল তাই দাঁড়াল, চিকিৎসাশাস্ত্রের জনকদের একজন বলে কথিত ইবনে সিনা কে দেখামাত্রই যেকোনো মুমিন মুসলমান তাকে হত্যা করতে যে শুধু পারে তাই নয়, করাটা তার ধর্মীয় দায়িত্ব। আল-রাজি হয়ে ইবনে সিনা পর্যন্ত যে উদার জ্ঞানচর্চার মালা গাঁথা হয়েছিল তাতে আরেকটা পুঁতি যোগ করার বদলে গাজ্জালি মালাটা ধরে জুতার তলায় পিষে ফেললেন।

তারপরও মধ্যপ্রাচ্যে বিজ্ঞানের, দর্শনের ধারা থেমে থাকেনি। গাজ্জালি’র দর্শনচর্চার কারণে বরং ইসলামী ধর্মতত্ত্বেও এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অধিকাংশই সেসব স্বীকার করেন না। আপনাদের গোষ্ঠীর অনেকের সাথেই আমার কথা হয়েছে। সবার কথায় দেখেছি দাম্ভীকতা, মহাস্ফীতি, অহংকার, অকৃতজ্ঞতা, কৃতঘ্নতা। আপনাদের দর্শনে ও ধর্মতত্ত্বে কোনো অমুসলিমের প্রভাব আপনারা স্বীকার করেন না। আপনাদের গবেষণার মূল বিষয় যেন একটিই: কিভাবে দেখানো সম্ভব আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের চেয়ে ভালো কেউ নেই, আমরা মানবজাতির ত্রাণকর্তা। আনাড়ি সাঁতারু হঠাৎ পায়ের নিচে মাটি পাওয়া যাচ্ছে না বোঝার পর যেমন হাঁসফাঁস শুরু করে আপনাদের অনেকের অবস্থা ঠিক সেরকমই। আপনাদের এই অবস্থার কথা আমার চেয়ে আপনাদেরই একজন, কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪–১৯৭০), অনেক ভালোভাবে বলে গিয়েছেন,

জীবনের অর্থই যেন আধুনিক মুসলমান বোঝে না। বুদ্ধি, বিচার, আত্মা, আনন্দ, এ সমস্তের গভীরতার যে আস্বাদ তা থেকে তাকে বঞ্চিত ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না। জগতের পানে সে তাকায় শুধু সন্দিগ্ধ আর অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে– এর কোলে যেন সে সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, একে যেন সে চেনে না। কেমন এক অস্বস্তিকর অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সারা জীবন সে ভীত ত্রস্ত হয়ে চলেছে। ((কাজী আবদুল ওদুদ; বই: শাশ্বত বঙ্গ, প্রবন্ধ: সম্মোহিত মুসলমান।))

কিসের ভয় আপনাদের? প্রবল বিশ্বাসী হওয়ার দাবী করা সত্ত্বেও কেন আপনারা জগতের সবাইকে এত অবিশ্বাসের চোখে দেখেন? মানুষেই যদি বিশ্বাস করতে না পারলেন তবে কী লাভ আপনাদের এত শত অদৃশ্যে বিশ্বাস দিয়ে? হয়ত এই ভয়, এই অবিশ্বাসের মূলে আছে আপনাদের অজ্ঞানতাপ্রসূত অহংকার। যারা বেহুদা অহংকারে ফুলে ফেঁপে স্ফীত হয় তাদেরকে সর্বক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়, কারণ তারা জানে “স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে”, যেকোনো মুহূর্তে তাদের স্ফীতি দারুণ আঘাতে বিদীর্ণ বিকীর্ণ হয়ে চূর্ণ হতে পারে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, নিজেদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য আপনাদের মধ্যেই অনেকে এগিয়ে এসেছেন। আপনাদেরই সজ্জন ইরানী কবি হাফিজ বলে গেছেন, “খোদাতালা প্রস্ফূটিত হয় সেই হাতির কাঁধ থেকে, যে পিঁপড়ার সামনে বিনয়ে বিগলিত হয়।” আপনাদের আরো কাছের বন্ধু ওদুদ লিখেছেন, “ইসলামের ইতিহাস বহুল পরিমাণে এক ব্যর্থতার ইতিহাস।” আহমদ ছফা (১৯৪৩–২০০১) লিখেছেন, “মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাই তার জাগতিক অগ্রগতির উৎস। বাঙালি মুসলমান চিন্তাই করতে শেখেনি।” আরো দেখেছি, ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে আপনাদের নবাব আবদুল লতিফেরা (১৮২৮–১৮৯৩) উর্দু ভাষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষা দেয়ার প্রস্তাব করলেও আপনারা সেটা মেনে নেননি। ব্যতিক্রমী মধ্যযুগীয় কবি আবদুল হাকিমের (১৬২০–) “সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি” স্মরণ করে আপনারা বাংলাতেই অটুট থেকেছেন; আপনাদের মধ্যকার অভিজাত অংশটির আরব-পারস্য গৌরবকে পরাজিত করে এদেশের চাষাদের ভাষাকেই ধারণ করেছেন।

সংখ্যায় অতিসামান্য হলেও আপনাদের মধ্য থেকেই সময় সময় বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন হয়েছে। স্মরণ করছি ১৯৩০–৪০ এর দশকে আপনাদের এই আলোকোজ্জ্বল, রক্তোজ্জ্বল নগরীর কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭–১৯৮১), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩–১৯৫৬) দের কথা; শিখাগোষ্ঠীর কথা। প্লেটোর প্রেমের সংলাপ, সমকামের সংলাপ সিম্পোজিয়াম আপনাদের কাজী সাহেবই অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী দেশভাগের আগে যেসব কথা লিখে গিয়েছিলেন তা পড়ার সাহস কি বর্তমানে আপনাদের আছে? আপনাদের কুরআন যেমন বারবার অন্তরের কালিমা দূর করার কথা বলে, মোতাহের পড়ার পরও কি আপনারা সেরকম কালিমামুক্ত থাকতে পারেন? চেষ্টা করে দেখুন না। মোতাহের লিখে গেছেন,

“ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম্ম।”
“বাইরের ধর্ম্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়।”
“আল্লাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করার আগ্রহে— অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্ব্বত্রই একটা ইতর লোভ।” ((মোতাহের হোসেন চৌধুরী; বই: সংস্কৃতি কথা, প্রবন্ধ: সংস্কৃতি কথা। বইটি PDF ফাইল হিসেবে ডাউনলোড করুন।))

এই ইতর লোভের প্রলোভনে আপনাদের প্রায় সবাই নিমজ্জিত, কারো মধ্যে সেটা প্রচ্ছন্ন, আর কারো মধ্যে প্রকট। যাদের মধ্যে তা বিকৃতরকমের প্রকট তাদের কাছেই গহন তিমিরের মাঝে একমাত্র আলো বলে বোধ হয় চাপাতির ঝলকানিকে। আর যাদের মধ্যে তা প্রচ্ছন্ন, তারা সেই ঝলকানির আলোও দেখতে পান না, তাদের বুকে কেবলই অন্ধকার। তারা চাপাতির কোপে কোনো জ্ঞানসাধক নিহত হওয়ার পর হয় নিরব থাকেন, নয় নিহতের সমালোচনায় মেতে উঠেন। সদর্পে হননকারীর বিচারের দাবী জানাতে তাদের বুক কাঁপে। অভিজিৎ রায় সম্পর্কে যারা একেবারেই জানেন না তাদের কেউ কেউ ভুলে চাপাতিধারীদের বিচার চেয়ে বসেন, কিন্তু যখন কেউ আপনাদের সামনে অভিজিতের লেখার খবর বিকৃতভাবে উপস্থান করে, তখন সেই লেখার আলো আপনাদের বুকে আরো গভীর অন্ধকার হয়ে প্রবেশ করে। তখন দোজখের নরমাংসের-জ্বালানি-দিয়ে-তৈরি আগুনের ভয়ে আপনারা ক্বিরা কেটে, তওবা করে আপনাদের ধর্মের চাপাতির কোপে খুন হওয়া তপস্বীকে গালি দিয়ে অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। আপনাদের কুরআন কি এভাবেই অন্তরের কালিমা দূর করার কথা বলে? সে আপনারাই ভাল জানেন।

আপনাদের মন আমি বুঝি না। আপনারাই বুঝেন কি না কে জানে! আপনাদের ঘরে জন্ম নেয়া আমার মতো আরেক ধর্মত্যাগী নাস্তিক আহমদ শরীফ আপনাদের ইতিহাসকে নিজের ইতিহাস মনে করতেন। মধ্যযুগীয় লোকসাহিত্যের মাধ্যমে আপনাদের একান্ত নিজস্ব ইতিহাস উদ্‌ঘাটন তার মতো করে আর কেউ করেনি। তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ এর আগে বাঙালি কোনোদিন নিজের শাসনভার নিজের হাতে পায়নি, বাংলার প্রত্যেকটি শাসকই ছিল বিদেশী। আপনাদের আহমদ ছফা “বাঙালি মুসলমানের উল্লেখ করার মত কোন কীর্তি” না থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে সেই বিদেশী শাসন কে দায়ী করেছেন, আর বলেছেন ১৯৭১ এর পর এখনো স্বশাসনের সুফল ঘরে তোলার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি। এই কথার সাথে আমার দ্বিমত নেই। আমি জানি, রোম একদিনে তৈরি হয়নি। আর ওদুদ যেখানে বলে গেছেন, “একটা সত্যসাধনার পূর্ণ পরিস্ফূটনের জন্য তের শত বৎসর খুব দীর্ঘকাল নয়”, সেখানে ৪৪ বছরের স্বশাসনের ইতিহাসকে আমি আত্মগঠনের জন্য কিভাবে দীর্ঘ সময় বলি? আপনাদের সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনা, অনন্ত ভবিষ্যৎ।

আপনাদেরই কেউ কেউ সেই ভবিষ্যৎ ঠিকভাবে কাজে লাগানোর উপায় নিয়ে ভেবেছেন। আপনাদের নবী—যাকে আপনারা অধিকাংশই একবিন্দু চিনেন না, কিন্তু মহানবী বলে কেবল গর্ব করে বেড়ান—ওদুদের খুব প্রিয় ছিল। তিনি মনে করতেন বাংলার রেনেসাঁর—যা বহুলাংশে হিন্দুদের রেনেসাঁ—রূপকার রামমোহন রায়ও মুহাম্মাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেদের নিয়ে আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে,

একটা বড় সম্প্রদায় হিসেবে এই-ই মুসলমানের চরম দুর্ভাগ্য যে, তার যে সমস্ত পরমাত্মীয় পূর্ণাঙ্গ মনুষ্য-প্রকৃতি নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও গভীর আত্মবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদের পানে চেয়েছেন তাঁদের শান্তজ্জোল দৃষ্টান্তের চাইতে, যাঁরা ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদের দীপ্তিতে অন্ধ হয়ে সম্মোহিত হয়ে আস্ফালন করেছেন তাঁদের প্রচণ্ডতা, তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশী, আর আজ পর্যন্ত সেই আকর্ষণই তার পক্ষে প্রবলতম। ((সূত্র ৮ দ্রষ্টব্য।))

আর এরপর আশা ব্যাক্ত করেছেন এই বলে যে,

বিপুল ভবিষ্যৎ তাঁদের সামনে। সেই ভবিষ্যতে ভীত সম্মোহিত মুসলমানের পরিবর্তে মুক্তদৃষ্টি ভুমার প্রেমিক মুসলমানকে জগৎ পাবে, তা করে’ বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের চিরসংগ্রামে এক দৃঢ় মেরুদণ্ড-সমন্বিত অকুতোভয় সৈনিক জগতের লাভ হবে, ইসলামও এক অপূর্ব সার্থকতার শ্রীতে মণ্ডিত হবে—এই আশায় ও বিশ্বাসে তাঁরা তাঁদের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত ব্যর্থতা ও লজ্জা বহন করতে পারেন। ((সূত্র ৮ দ্রষ্টব্য।))

ওদুদ এখানে প্রেমের সৈনিকের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আপনারা এযাবৎ যে ধরণের সৈনিক জন্ম দিয়েছেন সেই ধারাল অস্ত্রধারী রক্তভুক সৈনিকের স্বপ্ন নয়। যে মেরুদণ্ডহীন সৈনিক রাতের আঁধারে পিছন থেকে অকুতোভয় তপস্বীর জ্ঞানযন্ত্র মস্তিষ্কে আঘাত হানে, তার কিবোর্ড চাপা’র আঙুল কেটে নেয়, তার গান শোনার কান ক্ষতবিক্ষত করে তেমন সৈনিক আমাদের কারো কাম্য নয়, হয়ত আপনাদেরও কাম্য নয়।

আপনাদের আহমদ ছফা আপনাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে “দেশের ভেতরে সেক্যুলারিজম আবিষ্কার করতে অক্ষম” বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে তিনিও আশাবাদী হয়েছেন এই বলে যে,

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় সংস্কারে পীড়িত মুসলিম সমাজের দিকে অত্যন্ত সাহস নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে তাকাতে হবে। মধ্যযুগীয় সমাজকাঠামোর ভেতরে আধুনিক সমাজের বীজ রোপণ করে প্রাচীন সমাজকাঠামো ফাটিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটি যেদিন হবে বাঙালির এ জাতীয় রাষ্ট্রটি আপন শক্তি এবং শৌর্য নিয়ে পূর্ব-ভারতের এই অঞ্চলে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। ((আহমদ ছফা; ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইয়ের ভূমিকা।))

তবে পাশাপাশি আমার এ-ও মনে হয় যে, আপনারা যতদিন “বাইরে থেকে আমদানিকৃত সেক্যুলারিজম” এর ভয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে পড়বেন আর তাকে অন্ধভাবে গালাগাল করতে থাকবেন, ততদিন নিজেদের ভেতরে ছফা’র ঐ কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী তৈরি করতে পারবেন না, ততদিন আপনাদের আঁধারযানের চালক ধর্মজীবীরাই রয়ে যাবে, ততদিন আপনারা ধর্মজীবীদের আতঙ্কগাঁথায় পরাভূত হয়ে পাখা গুটিয়ে বসে থাকতেই বাধ্য হবেন। জ্ঞানের অবাধ চলাচল আর আদান-প্রদান না ঘটলে কক্ষনো আত্মবিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর জন্ম হতে পারে না। আত্মবিশ্বাসটা আসবে কোথা থেকে? আপনাদের ইতিহাস থেকে তো তা আসা সম্ভব নয়। আসতে হলে বাইরে থেকেই আসতে হবে। বাইরে থেকে আসতেই যদি না দেন, তাহলে সেটাকে সংশোধন করে নিজেদের করে নেয়ার সুযোগটাও তো পাবেন না।

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আপনাদেরকে এতগুলো গঞ্জনা শোনানোর জন্য। কিন্তু আমারও একটা এজেন্ডা আছে, সেটা আমি লুকিয়ে রাখতে চাই না, অন্তত এমন সময়ে তো নয়ই। আমি আপনাদের আশাহত করতে আসিনি। আমি এসেছি ওদুদের “বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের চিরসংগ্রাম” এর কথা শোনাতে। আমি ছফা’র মতো বাঙালি মুসলমান না হতে পারি, কিন্তু তিনি “নতুন বীজ রোপণ করে পুরনো সমাজকাঠামো ফাটিয়ে ফেলার” যে প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছেন তার থেকে আমার প্রত্যয়টা ভয়ংকর রকমের আলাদা কিছু নয়। আমি বিশ্বাস করি, অভিজিৎ রায়ের প্রত্যয়টাও এর থেকে খুব আলাদা কিছু ছিল না।

না, হাসবেন না। আমরা একেবারে কল্পনাশ্রয়ী আদর্শবাদী নই, আমাদের বাড়ি মেঘের উপরে নয়। আমরা জানি, আমরা যা বলি তা গ্রহণ করার মতো মানসিকতা বাঙালি মুসলমানের নেই। সেই উদার আদান-প্রদানের যুগ আসতে বহু দেরি, কত দেরি তা আমরা কেউ জানি না। অভিজিৎ রায় বিশ্বাস করতেন, লেখালেখি দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ পাল্টানো সম্ভব। আমি সেটা মনে করি না। সাহিত্য বা শিল্পকলা সমাজ-বিপ্লবের সহকারী হতে পারে, চালিকাশক্তি হতে পারে না, এই আমার মত। কিন্তু আমি মনে করি, লেখালেখি অন্তত কিছু মানুষ পাল্টাতে পারে। সেই মানুষের সংখ্যাটা খুব কম, গোটা সমাজের তুলনায় তো নগণ্য, কিন্তু শূন্য নয়। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ আমি নিজে। আমাকে পাল্টিয়েছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী, অভিজিৎ রায়। আমার এই লেখনি সমাজের ০.০০০০০০১ শতাংশ মানুষের উপরও ছাপ ফেলতে পারবে না, হয়ত কারো উপরই ছাপ ফেলতে পারবে না। আজ পারবে না, কে জানে হয়ত ১০০ বছর পরে পারবে! ১০০ বছরও পরিবর্তনের পক্ষে বড্ড কম সময় মনে হচ্ছে? আচ্ছা, সে-ই সই। না হয় ১০০০ বছর পরই পারলো। হাসির পাত্র না হওয়ার জন্য আপনাদের সামনে দুটো উদাহরণ হাজির করব।

তখন আমার বয়স ১৭। আমি বাল্যসূত্রে পাওয়া হাজারো অন্ধবিশ্বাসের নিগড়ে আবদ্ধ। একদিন একটা ছোট্ট, জীর্ণ-শীর্ণ পাঠাগারের ধূলিমলিন তাকগুলোতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছিলাম। হাতে উঠে আসল সংস্কৃতি কথা নামে একটা বই, লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী। লেখকের নামটা পরিচিত, বাংলা পাঠ্যবইয়ের লেখক-পরিচিতি থেকে মুখস্ত করা কিছু তথ্য অবচেতন থেকে চেতন মনের দিকে বারবার উঁকি দিচ্ছিল। একটা কালো রঙের টেবিলের উপর বইটা রেখে মলাট উল্টে পড়া শুরু করলাম। প্রথম বাক্যেই বিশাল ধাক্কা খেলাম, “ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম্ম।” প্রথম প্রবন্ধটা এক নিশ্বাসে পড়া শেষ করলাম। বুঝলাম এই বই আমার সংগ্রহে থাকা চাই। তক্ষুনি পাঠাগার থেকে বেরিয়ে বইয়ের দোকানের দিকে দৌড় দিলাম। সেদিন কেনা সেই বই এখনো আমার হাতে আছে। সেই বইয়ের মর্মার্থ বুঝতে আমার সংগ্রাম করতে হয়েছে, ৪ বছর লাগিয়ে হলেও আমি সেই অর্থ পুরোপুরি অনুধাবন করে ছেড়েছি। এই মুহূর্তেও ল্যাপটপের আড়ালে বইটার প্রচ্ছদ দেখতে পাচ্ছি। এই প্রচ্ছদই আমার কিবোর্ডযুদ্ধে শক্তি জুগিয়ে চলেছে। আমি জানি, বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এই বইয়ের মূল্য নেই, কিন্তু আমার কাছে যে তার মূল্য অনেক।

তখন আমার বয়স ২১। ইন্টারনেটে লেখালেখি বাংলাদেশে সবে আসন পাততে শুরু করেছে। বন্ধু-বান্ধবের দেখাদেখি আমার মধ্যেও লেখক হবার বাসনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেই সূত্রে পরিচয় হলো একটা নতুন সমাজের সাথে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, সেই সমাজটা বাংলাদেশের সাধারণ সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, কিন্তু যতদিন না একটা সেতু রচিত হচ্ছে ততদিন আমরা দুই পাড়ে না থেকে কী করব বলুন? তবে ওপাড়ে যেতে পারার মধ্যেই কিন্তু আমি জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাইনি। তখনো আমি অক্ষমই রয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে সক্ষম করেছিলেন অভিজিৎ রায় এবং রাফিদা আহমেদ বন্যা, বিজ্ঞানসাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করার মাধ্যমে। শুরু করেছিলেন অভিজিৎ রায়, ২০০৪ সালের কোনো এক সময়। তিনি কার্ল সেগানের The Demon-Haunted World বই হাতে নিয়ে দেখেন সে বইয়ের শুরুতে লেখা, “Science as a Candle in the Dark”। অভিজিৎ তার কাব্যিক বিজ্ঞানগ্রন্থের জন্য কোনো কাব্যিক নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এই ইংরেজি বাক্যটির একটা বাংলা অনুবাদ করা গেলে হতো। তিনি একটি ব্লগে লিখেছেন,

স্যাগানের বইটি বুকের উপরে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম, মনের অজান্তেই তন্দ্রার মধ্যে শুনলাম ক্যাসেটে বেজে চলেছে প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতটি:
‘তুমি কি কেবলি ছবি, শুধু পটে লিখা?
ওই যে সুদূর নিহারীকা—
যারা করে আছে ভিড়,
আকাশের নীড়
ওই যারা দিন-রাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী,
গ্রহ তারা রবি…’
আর এখানে এসেই আমি থমকে গেলাম। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’—এই শব্দক’টি মনের গহীনে কোথায় যেন একটি অনুরণন তুলল। ভাবলাম এর চাইতে কাব্যিক আর মনোহর শিরোনাম আর কি হতে পারে? ((অভিজিৎ রায়; রবীন্দ্রে বিজ্ঞান; সচলায়তন, ৯ মে, ২০০৮।))

সেই বই তিনি ২০০৫ সালে প্রকাশ করলেন, আর ২০০৮ এ আমি পড়লাম। কয়েকদিন পর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম এই অভিজিৎ রায় সচলায়তনে লিখছেন। আর তারো কয়েকদিন পর আমাকে আরো বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে অভিজিৎ দা আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি আমার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা পছন্দ করেছেন। ছোটো ছোটো ব্লগের যুগে তিনি যেরকম ঢাউস আকারের বিস্তৃত বিজ্ঞানপ্রবন্ধ লিখতেন সেটা না দেখলে আমি কোনোদিন বিজ্ঞানসাহিত্যের ব্যাপারে সিরিয়াস হতাম না। আজ আমার যেকোনো লেখা কেউ পড়লেই বুঝতে পারবেন, আর কিছুতে না পারলেও অন্তত লেখার দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে আমি অভিজিৎ রায়কে হার মানাতে বদ্ধ পরিকর। আমাকে এবং আমাদেরকে আরো উৎসাহ দিতে ২০০৯ সালে ডারউইনের ২০০তম জন্মবার্ষিকী এবং তার অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস (যে নাম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার মাস্টার থিসিসের নাম দিতে চেয়েছিলাম On the Origin of Cold Fronts) প্রকাশের ১৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তিনি একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেটিই ছিল প্রথম এবং একমাত্র সময় যখন আমি বঙ্গীয় বিজ্ঞানকর্মী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারতাম।

এবং সে যেন তেন বিজ্ঞানকর্ম নয়, নিজের যতটুকু সামর্থ ছিল সবই তখন খাটাতে চেয়েছিলাম। যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, ছোটোমামা’র উচ্চ-মাধ্যমিকের প্রাণিবিজ্ঞান বইয়ে বিবর্তন নিয়ে বিশদ বর্ণনা দেখেছিলাম। তখন কিছু বুঝিনি। মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে, বড় হয়ে বুঝব। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা শেষে যখন নিজের উচ্চ-মাধ্যমিক প্রাণিবিজ্ঞান বই হাতে পেলাম, তখন ‘খাঁটি’ মুসলমানের মতো বিবর্তন খণ্ডানোর জন্য বইয়ের পাতা উল্টাতে শুরু করলাম, বই শেষ হয়ে গেল, বিবর্তন আর এলো না। ২০০৯ সালে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ, বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ এবং মুক্তমনা’র যৌথ উদ্যোগে ঢাকার শাহবাগে ডারউইন দিবস শোভাযাত্রার অন্যতম শ্লোগান ছিল “পাঠ্যপুস্তক থেকে জৈববির্তনবাদ বাদ দেয়ার চক্রান্ত রুখো”। শোভাযাত্রা এবং অনুষ্ঠানের অনেকগুলো ছবি তুলে অভিজিৎ দা কে পাঠিয়েছিলাম যা তিনি বাংলাদেশে ডারউইন দিবস উদযাপন নিয়ে লেখাটিতে সংযুক্ত করেছিলেন। পাশাপাশি ডারউইন দিবস উপলক্ষে দ্রুতলয়ে বেশ কয়েকটা লেখা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে ফেললাম, এবং প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়ে নিজেই চমকে গেলাম। অভিজিৎ দা, বন্যা আপা দেশে এলেন; পুরস্কারস্বরূপ পেলাম ডারউইনের অন দি অরিজিন এর একটা অসাধারণ সংস্করণ, ডকিন্সের দি অ্যানসেস্টরস টেইল, আর সেই আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী। সেসব স্মৃতি আজ মনে হলে মনে কোনো দ্বিধা থাকে না যে, আমার মনে যদি গতি দিয়ে থাকেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী, তবে কলমধরা-হাতে গতি দিয়েছেন অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ। মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে বা বিবর্তনের পথ ধরে আপনাদের বৃহত্তর সমাজে কোনো আঁচড় কাটতে পারেনি তো কী হয়েছে? আপনাদের নবী যদি একজন মানুষকে মুসলমান করার জন্যও যুগযুগ ধরে সাধনা করতে পারেন, তাহলে আমরা কেবল একজন মানুষকে ধর্মহীন জীবনের সম্ভাব্যতা বুঝাতে পারলেও খুশি থাকব না কেন?

২০০৯ সালের যেই মাসে, বাংলাদেশের যেই পথ ধরে ডারউইন দিবসের শোভাযাত্রা হয়েছিল সেই মাসে, সেই পথের উপর দিয়ে এই ২০১৫ সালে যে প্রলয়ংকরী ঝড় বয়ে গেল তা আপনাদেরকে ইস্রাফিলের শিঙ্গা যতটা কাঁপিয়ে দেয় আমাকে ঠিক ততটাই কাঁপিয়ে দিয়েছিল! আপনারা হয়ত ভাববেন, সেই ঝড়ে আপনাদের কোনো ক্ষতি হয়নি, আপনাদের কোনো ঘরের চালা উড়ে যায়নি, আপনাদের লাগানো কোনো গাছ মূলোৎপাটিত হয়নি। কিন্তু, যদি আপনাদের মধ্যে আজও এমন কেউ থেকে থাকেন যিনি আহমদ ছফা’র ঐ কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অপেক্ষায় বসে আছেন, তাহলে আমার ধারণা তিনি ক্ষতিটা বুঝতে পারবেন, বা হয়ত পারবেন না, বা হয়ত আসলেই কোনো ক্ষতি হয়নি আপনাদের। এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত টানতে আমি একেবারেই অক্ষম। আপনাদের সিদ্ধান্ত আপনারাই নিন।

ইতি,
…..