প্রথমেই অনুরোধ করবো ভিডিওটা দেখে নেয়ার জন্য ।

ফেসবুকের কল্যাণে অনেকেই হয়তো আগেই দেখে ফেলেছেন । তারপরেও বীভৎস ভিডিওটা শেয়ার করতে হলো আমাদের মন-মানসিকতার একটা সরল ব্যবচ্ছেদ করার স্বার্থে ।
সামান্যতম মনুষ্যত্ববোধ আছে এমন যে কাউকে ভিডিওটা দেখালে অন্তত একবার হলেও সমবেদনা প্রকাশ করার কথা, অথচ এখানে স্কুলপড়ুয়া কিশোরটাও মনের নিঃসীম আক্রোশ মেটাচ্ছে মৃতপ্রায় একটা দেহকে “সাপপেটা” করে ! কী এমন অপরাধের শাস্তি এতো কঠোর ? পর পুরুষের সাথে বিছানায় যাওয়া ? সেটা তো এদেশে অনেকেই যায়; (সম্ভবত পুরুষেরাই বেশি যায়; যদিও সমাজ বরাবরই পুরুষদের অমন দোষকে “পুরুষ মানুষের এসব এক-আধটু থাকে” বলে হালকা করে দেয়া হয়) তাই বলে এভাবে অমানুষের মতো পেটাতে হবে ? দেশের আইন-কানুন সব উঠে গেছে? নাকি মদিনা সনদের পর এখন শরীয়া পদ্ধতিতে দেশ চলছে ? ( মোল্লারা কিন্তু সেই কবে থেকে বলে আসছে সমস্ত কল্যাণ একমাত্র কুরানের শাসনে; শঙ্কার কথা হলো তারা যদি আবারো ঢাকা অবরোধ করে এবং দাবি করে নাসারাদের আইনে কাজ হচ্ছেনা, শরীয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই ! আর এদিকে যদি সাধারণ জনগণ মুসলিম বিশ্বের “শরীয়তি শাসন” থেকে সামান্যতম অভিজ্ঞতাও না নিয়ে বরাবরের মতোই মোল্লাদের সাথে গলা মেলায় তাহলে তো কেল্লা ফতে ! তেমনটা হলে অবশ্য আধুনিক আইয়্যামে জাহেলিয়াত দেখার দুর্ভাগ্যও হয়ে যাবে!)

যাহোক, বিষয়বস্তুতে ফিরি । ভিডিওটাতে সবচাইতে চমকে উঠা ব্যাপার হলো, সেখানে কিশোরদের অমানুষিক নৃশংসতা শিক্ষা দেয়ার প্রতি একপ্রকার উৎসাহই প্রদান করা হয়েছে । দর্শকমাত্রই দেখবেন অন্যদের চাইতে ঐ স্কুলড্রেস পরিহিত কিশোরদের উৎসাহ বেশি বৈ কম ছিলোনা । এরাই যদি পরে হুমায়ূন আযাদ, অভি, রাজীবদের রাস্তার পাশে কুপিয়ে ফেলে যায় তাহলে খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার থাকবে কি ?

এখন প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎ করেই কি আমাদের শিশু-কিশোরেরা এমন আক্রমনাত্নক হয়ে উঠেছে ? তাছাড়া এসব ব্যাপারে আমরা তাদের নাক গলাতেই বা দিচ্ছি কেনো ? যে দেশের টিনেজারদের যৌনশিক্ষার মানে “স্বামী-স্ত্রীর মিলনতত্ত্ব” নাহয় চটি বই সে দেশে এভাবে উন্মুক্ত বিচারই বা কতটুকু যৌক্তিক ?

প্রশ্নগুলোর উত্তরে বলা যায়- সেই নব্বইয়ের দশক থেকে পেট্রোডলারের সাথে সাথে যে “সহীহ ইসলাম” এদেশে প্রবেশ করেছে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে সেই যে সভ্যতার উল্টোরথে যাত্রা শুরু সেটা এখনো চলছে । উপরন্তু সেটার গতি ক্রমশঃ বাড়ছে ! নিত্য নতুন মাদ্রাসা খোলার সাথে সাথে বাহারি টাইলস-মোজাইক সংবলিত ঝকঝকে তকতকে মসজিদ এখন অজপাড়াগাঁয়েও দেখা যায় । অথচ সেখানকার সবচাইতে ধনী পরিবারটি আধা পাকা বাড়িতে থাকে আর গ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের দিন আনে দিন খায় টাইপের অবস্থা ! এসব মসজিদ দেখে অনেক মুমিন বান্দাকে আবার “কপট” চর্বিতচর্বণ করতে দেখি- “মহানবী (স) বলে গেছেন, এমন একটা সময় আসবে যখন জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ থাকবে কিন্তু নামাজ পড়ার কেউ থাকবেনা (অল্প থাকবে)” । “কপট” শব্দটি ব্যবহারের করা হলো মুমিন বান্দারা এই হাদিসকেই আবার নবীর মুজেজার (ভবিষ্যদ্বানী) প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে বলে! অবশ্য এমন কোনো হাদিসের ভিত্তি চোখে পড়েনি ।
যাহোক, তৎপরবর্তী প্রত্যেকটা সরকারই “সহীহ ইসলাম”কে একটু একটু করে পরিচর্যা করতে করতে আজকের মহীরূহে পরিণত করেছে । এখন অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, একে সমূলে উৎপাটন করা রীতিমতো অসম্ভব । তবে সামাজিকভাবে একে কম গুরুত্বপূর্ণ করে ফেলা গেলে সমস্যার বেশ কিছুটা সমাধান করা হয়তো সম্ভব । একটু ব্যাখ্যা করা যাক ।
আমার ধারণা মসজিদে যাওয়া লোকেদের একটা অংশ যায় ঠেকায় পড়ে কিংবা লোকচক্ষু থেকে বাঁচতে ! তা না’হলে পাঞ্জেগানা নামাজের তুলনায় জুম্মা কিংবা ঈদের নামাজে বেশি লোক হতো না । আসলে মানুষ এখন অনেক বেশি ব্যস্ত দৈনন্দিন কাজে । প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে তাদের কাজের পরিধিও অনেকাংশে বেড়েছে । যেমন: যখন টেলিভিশন, মোবাইল কিংবা কম্পিউটার ছিলো না তখন মানুষ এদিক সেদিক আড্ডাবাজি করে কিংবা নিজের অন্য কোনো কাজ করে সময় কাটিয়েছে । অথচ এখন এসব যন্ত্রপাতির জন্য বেশ কিছুটা সময় বরাদ্দ না করলেই নয় ।

আচ্ছা ! আসুন একটি সিনেমাটিক কাহিনি শোনাই । আমার নিজের এলাকাতে এক সুপরিচিত ডাকাত ছিলো । সঙ্গত কারণেই তার নাম বলছিনা । তার নাম ধরলাম ‘অমুক ডাকাত’ । তিনি ডাকাতি করে ঐ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকাতেও বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন । শোনা যায় তৎকালীন সময়ে মায়েরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতো ‘অমুক ডাকাতের’ ভয় দেখিয়ে ! মানুষের উপর অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো । ১৯৯৫-৯৬ এর কথা । ডাকাতি করে বিশাল দাঁও মেরে তিনি সৌদি চলে গেলেন হজ্জ্ব করতে ! সেখানে গিয়ে কোনো এক “বুযুর্গ” ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করলেন, তার বাইয়াত (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করে সেখানে বছর চারেক মুর্শিদের (গুরু) খেদমত করে দেশে আসলেন ভরপুর ঈমানি জোশ নিতে । এসেই নিজের ফসলি জমিতে একটা মাদ্রাসা (হাফেজী মাদ্রাসা; যেখানে কুরান আদ্যন্ত মুখস্ত করানো হয় ) ও একটি মসজিদ গড়ে তুললেন বাশের চাটাই আর টিন সহযোগে । সাধারণ জনতা তাকে ধরে পুলিশে দিবে কী, উল্টো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো ! তিনি এখন মানুষকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার দাওয়াত দেন । ইয়া লম্বা সফেদ দাঁড়ি, হাতে তসবি, এমন আল্লাওয়ালা মানুষের পিছনেও খারাপ কথা বলা যায় না ! তার উপর আশপাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়লো তিনি আল্লাহর বিশেষ মনোনীত পুরুষ ! তা না হলে তো একটা জলজ্যান্ত ডাকাত এতো ভালো মানুষ হয় কী করে ?!
যাহোক, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেশের বাইরে থেকে টাকা আসতে লাগলো হু হু করে ! কারণ, বাচ্চারা মাটির মেঝেতে বসে, টিন আর বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আল্লাহ পাকের পবিত্র কালাম মুখস্ত করে । মুসল্লিদের পাঞ্জেগানা নামাজ পড়তে বিবিধ সমস্যা হয় । কোনো সহৃদয়বান মুমিন বান্দা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে এমনটা হতে পারে না ! প্রতিষ্ঠাতা বড় হুজুর (অবসরপ্রাপ্ত ডাকাত) পরের বছর ওমরাহ করতে গেলেন আর আল্লাহর অপার রহমতে খোদ সৌদি আরব থেকে রিয়ালের বান্ডিল আসতে থাকলো এবং আড়াই বছরের মাথায় ৫ একর এলাকাব্যপী ২০০০ লোক ধারনক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিরাট গম্বুজওয়ালা, আপাদমস্তক টাইলসে মোড়ানো মসজিদ ও কয়েক হাজার ছাত্র একইসাথে অধ্যয়ন করতে পারবে এমন ৫ তলা বিল্ডিং উঠে গেলো । বড় হুজুর ফি বছর ওমরাহ করতে লাগলেন । দিনকে দিন তার পসার এমনকি অর্থ-বিত্তও বাড়তে থাকলো । নিজের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি ছাড়া আর এদিক ওদিক গিয়ে ওয়াজ (ইসলামি জলসা) করা শরীরে আর কুলোচ্ছে না । আল্লাহর কাছে চাইতে দেরি আল্লাহ মার্সিডিজ নাজেল করতে এতটুকু দেরি করলেন না ! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মাদ্রাসাটি আকার আয়তনে দ্বিগুণ হওয়ার তোরজোর শুরু হয়েছে ।

উপরের ঘটনা থেকে যা শিখলাম:
শিক্ষা-১: যে যত বেশি রিস্ক নিতে পারে আল্লাহ তাকে ততটা ভালোবাসেন । বান্দা যত বেশি পাপ নিয়ে আল্লাহর সামনে তওবা করে লাইনে আসবে, সে তত বড় আল্লাহওয়ালা । খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতির জীবনী থেকে প্রমাণ মিলাইয়া নিতে পারেন ।
শিক্ষা-২: আল্লাহ চান আমরা পাপ করি ! তা না হলে উনি যে অসীম দয়াবান সেটা প্রমাণ হবে কী করে । ডাকাতদের ধরে ধরে আল্লার অলি বানানো অতি অবশ্যই তার অফুরন্ত দয়ার সামান্য নজির ।

এভাবেই বিভিন্ন ওসীলায় (দুর্মুখেরা অবশ্য পেট্রোডলার, ঘুষ কিংবা পুকুরচুরির টাকা জায়েজ করার নিমিত্তের কথা বলে থাকেন) বাংলার দিকে দিকে আজ পবিত্র মসজিদ । কেয়ামতের সময় সবকিছু ধ্বংস হবে কিন্তু মসজিদগুলো নাকি অক্ষত থাকবে । এতো এতো মসজিদ করার সময় আমাদের মুসুল্লীরা নিশ্চয়ই “দুর্যোগকালীন শেল্টার” এর কথা ভেবে থাকবেন ।

“মসজিদের নগরী” বলতে বলতে অনেককেই দেখি গর্বে বুক দুই হাত উঁচু করতে (ইসলামে না গর্ব করা হারাম ;)) , অথচ পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা না থাকায় ঢাকা মহানগরী যে কতটা বাস অনুপযোগী- দুর্গন্ধময় সেটার দায় পুরোটাই সরকারের ! এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর বাংলাদেশ “মসজিদের দেশ” হিসেবে পরিচিতি পাবে । তখন নিশ্চয়ই গর্বে বুক চার হাত ফুলে উঠবে !

মোদ্দা কথা হলো, গাছের গোড়ায় জল ঢেলে আগা যতই ছাঁটান না কেনো, কোনো লাভ হবে না । অথচ আমরা সেটাই করছি ! একজন মানুষ যখন কেবলমাত্র একটা কাজই সূচারুরূপে শিখবে তখন সে সেটা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করবে । এখন সমাজে যদি তার কাস্টোমার কম থাকে তাহলে ক্যামনে হবে ?? সেক্ষেত্রে কাস্টোমার তো তৈরি করতেই হবে । নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী নাহয় ৫-৭ টা নতুন মানুষ পয়দা করা গেলো, কিন্তু তাতে পেটও বাড়বে । তাহলে উপায় ? উপায় হলো মনের মাধুরী মিশিয়ে ধর্মের লোভ আর ভয়ের জায়গাগুলোকে আরো রংচং মাখিয়ে মূলোর মতো করে কাস্টোমারদের সামনে ঘনঘন উপস্থাপন করা । কাস্টোমাররা একই সাথে ভীত ও লোভী হবে আর ফায়দা উঠাবে । আর এদিকে আপনারা কী করছেন ? কাস্টোমারদের ডেকে ডেকে বলছেন, “মূলা খাবেন না প্লিজ, কারণ মূলা খাইলে পশ্চাৎদেশ দিয়া দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু নির্গত হৈবেক..
আর এটার মানে হলো আপনারা ব্যবসায়ীমহলের পেটে ফ্রি কিক বসিয়েছেন; তো তারা নিশ্চয়ই বসে থাকবে না । আপনারা তাদের নবীকে উলঙ্গ করে দিলে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়; আর রক্তের বদলা রক্তের উপর তো ইসলামের ভিত্তিপ্রস্তরই…

তারা কী করবে??

বিশ্বকে অভি’দার মতো ট্যালেন্টেড মস্তিষ্কপ্রসূত নিত্যনতুন কাজ থেকে বঞ্চিত করবে…
তারা জানেনা, অভিরা মরেনা… আলোকবর্তিকা হয়ে বেঁচে থাকে… বেঁচে থাকে প্রত্যেক মুক্তমনার চিত্তে….