(১)
প্রাচীন গ্রীসে ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বে জন্মগ্রহণ করেন একজন বেটে, কদাকার ব্যক্তি। যার নাম ছিল সক্রেটিস। আধুনিক দর্শন এবং নীতিশাস্ত্রের গুরু বলে পরিচিত এই লোকটিকে চেনে না, তার নাম জানে না, শিক্ষিত সমাজে এরকম লোক খুঁজে পাওয়া এই যুগে কঠিন ব্যাপার। তিনি কি ছিলেন? কেমন ছিলেন? মানব সমাজে তার প্রভাব কতটুকু? তিনি পৃথিবীকে কী কী দিয়ে গেছেন? তিনি এমন কি আবিষ্কার করেছেন যার কারণে তাকে নিয়ে এত প্রবন্ধ, এত আলোচনা, এত নাটক, এত সাহিত্য সৃষ্টি করা হয়েছে? তিনি কী তার সময়ে জনপ্রিয় ছিলেন? সাধারণ জনগণ তার সম্পর্কে কী ভাবতো? তিনি কী সে সময়ের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন? তার বন্ধু কারা ছিল, আর কারাই ছিল তার শত্রু?

সক্রেটিস পৃথিবীর মানুষের জন্য কোন বই লিখে যান নি। তার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হচ্ছে প্লাতোর ডায়ালগসমূহ, এরিস্তোফেনিসের নাটকসমূহ এবং জেনোফেনোর ডায়ালগসমূহ থেকে। সক্রেটিসেরর বাবা সফ্রোনিস্কাস পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কর এবং তার মায়ের নাম ফিনারিটি ছিলেন একজন ধাত্রী। তার স্ত্রীর নাম ছিল জানথিপি, তাদের তিন পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যাদের নাম ছিল লামপ্রোক্লিস, সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজেনাস। সক্রেটিস মানুষ হিসেবে অতি সাধারণ মানের ছিলেন। দেখতে কদাকার হওয়ায় এবং কিছুটা অলস প্রকৃতি হবার কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই ছিল, খণ্ডারিণী স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মাঝে মাঝেই তিনি বাসায়ও ফিরতেন না। তাঁর মাথায় বড় টাক ছিল, নাক চ্যাপ্টা ছিল। শোনা যায় সে সময়ে তার একজন গেলমানও ছিল। কিন্তু গেলমান থাকাটা মহান সক্রেটিসের মহত্ব একবিন্দুও কমায় না।

socrates

তিনি আসলে কি করেছেন?

আজকে আমরা যা কিছু জানি, সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান একসময়ে কেন্দ্রীভূত ছিল দর্শন শাস্ত্রে। বলা হয় দর্শন সকল জ্ঞানের জননী। সক্রেটিস মূলত দর্শন চর্চা করে গেছেন, তার ছিল তীক্ষ্ণ যুক্তিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর তার প্রশ্ন করার গুণ ছিল অনন্যমানের। তিনি অত্যন্ত উঁচুমানের তার্কিক ছিলেন, প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি তুলে আনতেন দর্শনের বিভিন্ন দিক। দেখিয়ে দিতেন প্রতিষ্ঠিত ধারণার ত্রুটিসমূহ। অধিকাংশ সময় তিনি সে সময়ের তরুণদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শ্রোতার কাছ থেকে শুনতেন এবং ক্রমাগত পালটা প্রশ্ন করে করে বক্তার বক্তব্যকে অসাড়তা প্রমাণ করতেন। মহান সক্রেটিস হাটে বাজারে, লোক সমাগমে বক্তৃতা করে বেড়াতেন। তার বক্তৃতার অন্যতম বিষয় সমাজে প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, প্রচলিত সব ধর্মের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড যুক্তিতর্ক এবং প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি নগ্ন করে দিতেন প্রচলিত সমাজকে, সামাজিক প্রথা আর ধর্মকে, ধর্মজীবীদেরকে, আইন কানুন আর ব্যবস্থাকে আর সেসময়ের প্রভাবশালীদেরকে।

তিনি দেখতে কদাকার ছিলেন, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি আর সাহস নিয়ে নিজের ধারণার কথা উচ্চারণ করতেন, সত্য জানাতেন। যুক্তি আর প্রশ্ন ছিল তার প্রধান অস্ত্র, যে অস্ত্রের সামনে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, প্রথা আর রাজনীতি অসহায় বোধ করতো। তার এই ক্যারিশমাটিক অস্ত্রের জোরে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, বিশেষ করে সেসময়ের তরুণদের মাঝে। তরুণরা তার বক্তৃতায় প্রচণ্ডরকম আকৃষ্ট হতে শুরু করলো। তার কথা শোনার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তরুণরা দলে দলে আসতে লাগলো, একটি গণজাগরণের সূচনা হলো। যেই জাগরণ ছিল চিন্তার মুক্তির, বাক-স্বাধীনতা, যুক্তি, দর্শন আর ধর্মবিরোধিতার, যেই জাগরণ ছিল সমস্ত প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে সামনে তুলে নিয়ে আসার।

তার শত্রুদের সংখ্যা মোটেও কম ছিল না। তার শত্রুরা ছিল সে সময়ের রাজনীতিবিদগণ, সে সময়ের ধর্মযাজকগণ, যাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান পন্থা ছিল জনগণের মগজ ধোলাই করে মানুষকে মুর্খতার কুয়ায় শেকল দিয়ে আটকে রাখা। তাদের এতদিনকার প্রথা এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং আইনকানুন নিয়ে, দেবদেবী আর অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন সক্রেটিস। এরপরে যা হবার, যা এখনও হয়ে চলেছে সেটা হল। তৎকালীন শাসক সমাজ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করলো যে সে তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের নৈতিকতা নষ্ট করছে। প্রচলিত ধর্মকে অস্বীকার করছে, প্রচলিত দেবতাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে, তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে তরুণদের নৈতিকতা ধ্বংস করা, ধর্মবিরোধিতা সহ মানুষকে ধর্মের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার অভিযোগ দায়ের করা হয়। বিচারের সভায় সক্রেটিসের কাছে যুক্তিতে ভয়াবহভাবে পরাজিত হবার পরেও সক্রেটিসের শাস্তি হলো হেমলকের বিষে মৃত্যুদণ্ড।

যিনি পাহাড়ের উপর থেকে ছোট্ট একটি পাথর গড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তৎকালীন শাসকেরা ভেবেছিল শাস্তির মাধ্যমেই এই কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু সেই ছোট্ট পাথরে এমন ঢল নামবে এটা তারা কল্পনাও করেনি। এর পরের ইতিহাস সকলেই জানে। সক্রেটিসের যোগ্য শিষ্য প্লেতো, যাকে বলা হয় দর্শন শাস্ত্র যাকে ছাড়া অচল, প্লেতোর যোগ্য শিষ্য আরিস্তোতল, যাকে বলা হয়েছিল সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারক, যেই জ্ঞান আরিস্ততলে নেই সেই জ্ঞানের কোন প্রয়োজন মানব সভ্যতার নেই।

সক্রেটিস সেসময়ের প্রচলিত আইনে অপরাধ করেছিলেন। রীতিমত ব্লাসফেমীর অপরাধে তিনি অপরাধী ছিলেন। প্রথাগত চিন্তায় তিনি মস্তবড় পাপী ছিলেন, ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিশ্বাস স্থাপন না করে সন্দেহ পোষণ করা নিঃসন্দেহে বিশ্বাসীদের কাছে অপরাধ স্বরূপ। তিনি যুক্তি এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান করতেন, স্বর্গের দেবতাদের অস্বীকার করতেন। তিনি বলতেন মৃত্যুর পরে কি হবে কে দেখেছে? তাহলে কেউ কেউ কীভাবে দাবী করছে যে তারা জানে মৃত্যুর পরে কি হবে? তিনি বলতেন যা জানি না তা মানতেও পারবো না, তাকে ভয়ও পাবো না। তিনি বলতেন অজ্ঞানতা আর ভয় সকল পাপ সৃষ্টি করে, এই অজ্ঞানতা আর ভয়ই ধর্মসমূহের চালিকা শক্তি। একমাত্র জ্ঞানই সেই পাপ দূরীভূত করে। শাসকরা মনে করে জনগণকে অন্ধকারে রাখলেই জনগণ ভাল এবং সুখে থাকবে, শাসকরা তাই মিথ্যা শেখায় মিথ্যা জানায়। কিন্তু মিথ্যা কখনও শান্তি নিয়ে আসতে পারে না।

(২)
এর অনেকবছর পরে, ইহুদিরা তখন অপেক্ষা করছিল একজন মহান ত্রাণকর্তার, যে পৃথিবীতে এসে তাদের রক্ষা করবে। অত্যাচার অনাচারে ছেয়ে গিয়েছিল তৎকালীন সমাজ। সে সময়ে জন্ম হয় যীশুর। তিনি প্রচলিত ধর্ম এবং প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করলেন, এবং স্বপ্ন দেখলেন নতুন সমাজের, যেই সমাজে ক্ষুধা থাকবে না, দারিদ্র থাকবে না। যেই সমাজে ব্যভিচারিণীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হবে না, দাসদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হবে না। যেই সমাজ হবে মানুষের, যেই সমাজ হবে মানবতার। সংঘাত তৈরি হলো সে সময়ের শাসকদের সাথে, কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করলো সম্রাটের লোকজন। এরপরে তারাই আবার যীশুকে ঈশ্বরে পরিণত করলেন, যীশু ক্রমশই পরিণত হল তাদের রাজনীতিতে। নিজেরাই নিয়ম কানুন এবং যীশু সম্পর্কে কল্পকাহিনী বানিয়ে বা পুরনো কল্পকাহিনী এদিক সেদিক করে প্রচার করতে লাগলেন, যীশুকে পরিণত করা হলো কুমারী মাতার অলৌকিক সন্তান হিসেবে, তাকে বানানো হলো ঈশ্বরের পুত্র। অথচ, এই কল্পকাহিনীগুলোর প্রায় সবই প্রাচীন মিশরের খুব পুরনো উপকথা, সেখান থেকে চুরি করে নতুন মিথ তৈরি করা হলো, এবং যীশুকে রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করলো তারই কিছু অনুসারী। যেই যীশু সে সময়ের প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে নিহত হলেন, যেই যীশু সেই সময়ের শাসকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিহত হলেন, তিনিই বনে গেলেন শাসকদের সবচাইতে বড় গুটিতে!

যীশু

(৩)
পৃথিবী থেমে থাকে না। নতুন সূর্যের আবার উদয় হয়, পুরনো ধ্যান ধারণা পায়ে দলে নতুন ধারণার জন্ম নেয়, সেই ধারণা থেকে আবার নতুন ধারণার। এভাবেই সভ্যতা এগিয়ে যেতে থাকে। স্থবিরতা কাটিয়ে তরুণরা সৃষ্টি করে গতির, পুরনোকে ভেঙ্গে চুড়ে তারা নতুন সমাজ গঠন করে, পুরনো সমাজ যখন নষ্ট হয়ে উঠতে থাকে, মার্ক্সের সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয় বিপ্লবের, দানা বাধতে থাকে নতুন চেতনার। এই তারুণ্য দমিয়ে রাখা কখনই সম্ভব হয় নি।

কিন্তু একই সাথে সেই সক্রেটিসের মতই চলতে থাকে নির্যাতন। ৪১৫ সালে গণধর্ষণের পরে নির্মমভাবে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হলো দার্শনিক হাইপেশিয়াকে, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি ধর্মান্ধরা, মহাবিশ্বে উপবৃত্তাকার পথ তারা ধ্বংস করতে পারেনি। ১৬০০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানী ব্রুনোকে বাইবেলের বিরুদ্ধে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থন করার অপরাধে উলঙ্গ করে খুঁটির সাথে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। আরজ আলী মাতুব্বরকে কোর্টে তোলা হয় প্রশ্ন করার অপরাধে। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে দ্রোহী পুরুষ ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা মুরতাদ ঘোষণা করেছিল (ইনকিলাব ২৪ অক্টোবর ১৯৯২); হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় প্রথার বিরুদ্ধে লেখনীর জন্য।

হাইপেশিয়া

কিন্তু পৃথিবী সূর্যের চারিদিকেই ঘুরছে। ধর্মান্ধরা পারেনি সূর্যকে পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরাতে। আরজ আলী এবং হুমায়ুন আজাদ এখনও বাঙলাদেশের মুক্তমনাদের হৃদয়ে বিরাজমান, হৃদয় থেকে তাদেরকে মুছে ফেলা যাবে না।

কিন্তু সেই মহান সক্রেটিস আর মহান সব মুক্তমনাদের এত অবদানের পরেও মানুষের বিশ্বাস থেমে থাকে না। মানুষ বিশ্বাস করতেই ভালবাসে, প্রশ্ন করতে, যাচাই করতে ভয় পায়। ভয় পায় নতুনকে, প্রথার বিরুদ্ধে তারা যেতে চায় না। তারা সক্রেটিসদেরও বিশ্বাস করে এক একজন পীরে পরিণত করতে চায়। যেটা আমরা দেখেছি আরিস্ততলের সময়ে। আরিস্ততল পৃথিবী কেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার অনুসারীরা ভুলে গিয়েছিলেন মুক্তচিন্তার বীজমন্ত্র, জ্ঞানের প্রাথমিক দর্শন, অবিশ্বাস এবং সন্দেহ-প্রশ্নের মাধ্যমে অনবরত যাচাই করে যাওয়া পুরনো ধারণাকে। তাই আরিস্ততলের পরবর্তী সময়টাকে ইতিহাসে চিহ্নিত করা হয় অন্ধকার যুগ নামে। আরিস্ততলের আমল থেকে শুরু করে মুসলিমদের জাগরণের আগ পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানে তেমন কোন অগ্রগতিই হয় নি। এর কারণ ছিল আরিস্ততলে মানুষের প্রবল বিশ্বাস।

মানুষের এই “বিষ-শ্বাস” মানুষের অগ্রযাত্রাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে। তারা এক সময়ে বিশ্বাস করেছে সূর্যই ঈশ্বর, একসময়ে বিশ্বাস করেছে প্রাকৃতিক ঈশ্বর ধারণাকে। এক সময়ে বিশ্বাস করেছে বহুঈশ্বর, আবার এক সময়ে এক ঈশ্বরকে। প্রতিটা ধারণা থেকে অন্য ধারণায় উত্তরণ হয়েছে প্রশ্নের মাধ্যমে, সন্দেহের মাধ্যমে। একসময় মানুষ সূর্যের পূজা করতো, আগুনের পূজা করতো। একটি সময়ে তাদের সেই সকল ঈশ্বর সম্পর্কে তারা প্রশ্ন করেছে, তাদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করেছে এবং পুরনো ধারণা বাতিল করে দিয়েছে। এরপরে প্রচলিত হল প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুকে ঈশ্বররুপে পূজা করা। কালক্রমে প্রচলিত এই প্রথাটিকেও মানুষ প্রশ্ন বিদ্ধ করে এবং ছুড়ে ফেলে দেয়। সভ্যতা সামনের দিকে আগায়। এভাবে বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদের দিকে ধাবিত হয় মানুষ।

বহুঈশ্বর থেকে এক ঈশ্বরে “উত্তরণ” অবশ্যই রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত। সভ্যতার অগ্রগতির জন্য সে সময়ে একনায়কতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় একেশ্বরের উদ্ভব ঘটে, মানব ইতিহাসে দারুণ এক অগ্রগতির সূচনা হয়। মিশরে এই একেশ্বরবাদের সূচনা হলেও ইহুদিরা এই ধারণা গ্রহণ করে, এবং তারা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। একসময়ে এই ধারণাতেও কিছু যোজন বিয়োজনের প্রয়োজন পরে, তৈরি করা হয় যীশু নামক এক চরিত্রের। যীশুর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেই সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, তা ইতিহাসে অবশ্যই স্মরনীয়। কিন্তু তাতেই থেমে থাকে না সভ্যতা।

(৪)
একদিন বর্বর আরবদের দেশে একজন সাধারণ মানুষ বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে সেই সময়ের সমাজ, ধর্ম, প্রথা এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন; সেই দেশের প্রচলিত ধর্মের নামে অনাচার, মূর্তিপূজা, মেয়েদের জন্মের সময়ই মাটিতে পুতে ফেলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। তিনি বললেন, এই সব অনাচার বন্ধ হোক, এই সব আইন মানি না। ধর্মের নামে কোন অনাচার চলতে দেয়া হবে না।

এরপরে শুরু হলো তার উপরে নিদারুণ অত্যাচার। তার অনুসারীদের হত্যা করা হলো, তাকে ভয়ভীতি দেখানো হলো। তাকে বলা হলো প্রচলিত দেবতাদের সম্মান করে কথা বলতে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করতে। কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে মুখর হলেন। চেষ্টা চালিয়ে গেলেন বর্বর আরবদের বর্বর সব প্রথার বিরুদ্ধে। শক্তিশালী বক্তব্য দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন সেই সব প্রথা নামের অনাচারের বিরুদ্ধে। পৌত্তলিক ধর্মগুলোকে প্রশ্ন করলেন, সন্দেহ করলেন, এবং অবিশ্বাস করলেন, বাতিল ঘোষণা করলেন। মূর্তিগুলোর বিরুদ্ধে কথা বললেন। তিনি বললেন ঐ মূর্তিগুলোর ক্ষমতা থাকলে তার ক্ষতি করে দেখাক। সে সময়ে এই ধরণের কথা অত্যন্ত ভয়ংকর পাপ বলে বিবেচিত হতো, ঈশ্বরের অবমাননা বলে বিবেচিত হতো, ঠিক এখন যেমন ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে ধার্মিকগণ ক্ষেপে ওঠে, সে সময়েও একই অবস্থা ছিল। প্রথা এবং ধর্মবিরোধিতার অভিযোগে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হলো। তিনি পালিয়ে গেলেন মদিনায়।
তিনি সে সময়ের প্রচলিত ধর্মের কড়া সমালোচক ছিলেন। মূর্তিপুজার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখতেন, প্রচলিত দেবদেবী সম্পর্কে কটাক্ষ করতেন। তৎকালীন আইন অনুসারে সেটাও ছিল ব্লাসফেমী, যেই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন সক্রেটিস, গৌতম বুদ্ধ, যীশু, হাইপেশিয়া সহ আরো অনেকেই। তাকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল মদিনায়, যাকে এখনো মুসলমানরা হিজরত বলে স্মরণ করে থাকে।

সেই লোকটির নামই হযরত মুহাম্মদ। সময়টা ৬০০ সালের কিছু পরে। আজও তার অনুসারীরা তার তৈরি প্রথা পালন করে, তাকে অনুসরণ করে। ঠিক যেমনটা মুহাম্মদের সময়কালের আরবের জনগণও পালন করতো তাদের পূর্বপুরুষের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া ধর্ম। এরপরে ধীরে ধীরে মুহাম্মদের অনুসারীরাও সেই প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রাখলেন। সময়ের সাথে সাথে যে সমস্ত প্রথা এবং ধর্মেরও সংস্কার প্রয়োজন, সব আইনের সংস্কার প্রয়োজন, সেটা বেমালুম ভুলে গেলেন। তাদের কাছে হযরত মুহাম্মদই হয়ে উঠলো আরেক প্রথার নাম। যিনি সমাজ সংস্কার করেছিলেন, যিনি প্রথা ভেঙ্গে ছিলেন, যিনি সে সময়ের ধর্মকে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই হয়ে উঠলেন আরেক মূর্তি!!! আরেক প্রথা!!! আরেক ধর্ম!!!

মুহাম্মদ

ইসলামের মূল আদর্শই ছিল পৌত্তলিক মূর্তি পুজার বিরুদ্ধে। পুরনো দিনের বিখ্যাত মানুষদের ওপর দেবত্ব আরোপ এবং তাদেরকে দেবদেবী জ্ঞান করে, নির্ভুল আর কলঙ্কমুক্ত মনে করে তাদের পুজা করা হতো। ইসলাম সেই সকল মূর্তি পুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। কিন্তু বর্বর আরবদের প্রতিনিধি মুহাম্মদের প্রধান ভুল ছিল নিজেকেই শেষ দাবী করে যাওয়া। তাই মুসলমানরা তাকেই পরবর্তীতে মূর্তিতে পরিণত করে, তার সমস্ত সমালোচনা এবং তার মতবাদ সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। তার সময়ের পরে প্রচণ্ড অগ্রগতি সাধিত হয় এটা অবশ্যই সত্য, সেই সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই যে, সক্রেটিসের সেই বীজমন্ত্র- “সন্দেহ, অবিশ্বাস, যুক্তি, জ্ঞান আর প্রশ্নের মাধ্যমে পুরনো ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন ধারণার সৃষ্টি?”

নতুন ধর্মের প্রেরণার প্রাথমিক ধাক্কায় মুসলিম সম্প্রদায় অনেক এগিয়ে গেলেও ধাক্কার জোর শেষ হয়ে যেতেই ঝিমিয়ে পরে। মানুষের মনে কোন প্রশ্ন নেই, অবিশ্বাস নেই, সন্দেহ নেই, জিজ্ঞাসা নেই। সকল প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এসকল বিষয় আল্লাহ তালা ভাল জানেন। অতএব এতকিছু না ভেবে তার উপাসনাতে মন দেয়াই লাভজনক!

(৫)
মানুষ একের পর এক বিশ্বাস করে যেতে থাকে। কিছু মানুষ সবসময়ই বিশ্বাসের পক্ষে। সক্রেটিসের সময়ে যেই লোকটি বিচারের দায়িত্বে ছিল, সে সেই সময়ের প্রচলিত ধর্ম এবং প্রথায় বিশ্বাসী ছিল। হাইপেশিয়া থেকে ব্রুনো-হুমায়ুন আজাদ সকলেই সেই সব বিশ্বাসীদের দ্বারাই নিহত হয়েছেন। একই ভাবে মুহাম্মদের আমলেও সেই সময়ে প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল আবু জেহেল এবং অন্যান্য কাফেরগণ। হযরত মুহাম্মদ ছিলেন প্রচলিত ধর্ম আর প্রথার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে থাকা এক অসীম সাহসী সৈনিক, যিনি হার মানেন নি। যেমন ছিলেন হুমায়ুন আজাদ, যেমন ছিলেন অভিজিৎ রায়!

হুমায়ুন আজাদ

অভিজিৎ রায়, আধুনিক বাঙলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। অসংখ্য মানবদরদী মানবতাবাদী মুক্তচিন্তকের মতই তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন সমাজের নানা প্রথার, ধর্মীয় মতাদর্শের। তিনি যুক্তির ছুরি চালিয়ে ছিড়ে ফালাফালা করেছেন এক একজন মহামানবকে। দেখিয়ে দিয়েছেন সেই সব কথিত মহাপুরুষ আসমান থেকে নামা কোন প্রেরিত পুরুষ নয়, নিতান্তই সাধারণ মানুষ ছিল। তার যুক্তির সামনে বড় বড় কথিত ঈশ্বর দাঁড়াতে পারে নি, তার কলম কিবোর্ডের সামনে আল্লাহ ভগবান ঈশ্বর সকলেই গলা ধরাধরি করে কেঁদেছে। আল্লাহর আরশ তিনি কাঁপিয়ে লণ্ডভন্ড করে দিয়েছে সামান্য কলমের খোঁচায়। তার কলম থেকে রক্ষা পায় নি কোন ধর্মের ঈশ্বর, কোন ধর্মের অবতার বা পয়গম্বরই। তাই তো তাকে হত্যা করে অসহায় ঈশ্বরকে রক্ষা করতে চেয়েছে ধর্মান্ধরা। কারণ তারা নিজেরাও জানে, সেই সব কথিত ঈশ্বর নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম নয়। এক অভিজিৎ রায়ের কলমই তাদের সমস্ত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরদের চাইতে শক্তিশালী।

অভিজিৎ রায়

(৭)
প্রথাবিরোধীরা এভাবেই প্রথার রক্ষকদের হাতে নিহত হয়েছেন নির্যাতিত হয়েছেন যুগে যুগে। ইসলামে বিশ্বাসীগণ হযরত মুহাম্মদকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ একজন প্রথাবিরোধীর নাম, প্রচলিত ধর্মে অনাস্থাজ্ঞাপনকারী একজন বিপ্লবীর নাম। তিনি সে সময়ের ধর্মান্ধ কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ৩৬০ টা মূর্তি ধ্বংস করেছেন। সমূলে উৎখাত করেছেন সে সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা আর নিয়মকে, তৈরি করে দিয়েছেন নতুন নিয়ম। তার সময়কালে তার বিরুদ্ধে কম ষড়যন্ত্র হয় নি, তার বিরুদ্ধে কম অপপ্রচার চালায় নি কুরাইশরা। কিন্তু তিনি তার মতাদর্শে অটল ছিলেন। তিনি জানতেন তিনি এক বিশাল পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন, প্রচলিত প্রথা আর ধর্মগুলোর শেকড়ে কুঠারাঘাত করায় প্রথার রক্ষকরা তাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

কোন মহাপুরুষের মতবাদকে প্রশ্ন করা যাবে না, আঘাত করা যাবে না, অবিশ্বাস করা যাবে না, যা সেই বীজমন্ত্র-“সন্দেহ, অবিশ্বাসের মাধ্যমে পুরনো ধ্যান ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টি”কেই নস্যাৎ করে দেয়। হযরত মুহাম্মদ নিজেও যে কাজের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সে সময়ের মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করেছেন।

এই আবর্তন আর দুষ্টচক্রকে ভাঙ্গতে হলে দরকার নতুন জাগরণ, নতুন ধারণা। প্রয়োজন প্রথা বিরোধী যৌক্তিক মননশীল মানুষের। যা সৃষ্টির জন্য দরকার পুরনো ধারণাকে প্রশ্ন করা, সন্দেহ করা, অবিশ্বাস করা, অনাস্থা-জ্ঞাপন করা। কিন্তু কে করবে? আজকের তরুণরা সবাই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার ধারণায় প্রবল ভাবে বিশ্বাসী, নতুন নতুন দেবতা এবং পীর সৃষ্টি করে, মুজিব বা জিয়ার মাজার তৈরি করে নতজানু হতে উৎসাহী এবং নিজ নিজ অবস্থানে সন্তুষ্ট। তারা ভুলে গেছে সভ্যতা আর অগ্রগতির সেই বীজমন্ত্র-সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রশ্ন আর যুক্তির মাধ্যমে পুরনো ধারণাকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টি।

এজন্য প্রয়োজন সামগ্রিক বিপ্লবী চেতনার। ব্রিটিশ আমলে খণ্ড খণ্ড বিপ্লবের মাধ্যমে চলে যেতে বাধ্য হল, এরপরে সৃষ্টি হল পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অনেক বিপ্লবী চেতনার মানুষ বিদ্রোহ করলেন, প্রতিবাদ করলেন, শাসকশ্রেণীর কাছে তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহীতা। স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি বাঙালির জন্য ছিল অধিকার আদায় এবং নিজ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে তা পাকিস্তানের জন্য ছিল সেই রাষ্ট্রের প্রতি চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। কারণ বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন তার সময়ের প্রথা এবং নিজ রাষ্ট্রের বিরোধী একজন বিপ্লবী, স্বাধীন বাঙলাদেশের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা।

প্রথার রক্ষকেরা অবিশ্বাস করতে ভয় পায়, সন্দেহ করতে ভয় পায়, প্রশ্ন করতে ভয় পায়। এভাবেই তারা জ্ঞানের বিপক্ষে, সভ্যতার বিপক্ষে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। আর নতুন চিন্তা, যুক্তি আর জ্ঞান সামনে এসে দাঁড়ালেই ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। বন্ধ করতে বলে সবকিছু। স্থবিরতায় সুখ খুঁজে পায়, বিপ্লবকে ভয় পায়। কর্তৃপক্ষকে চিৎকার দিয়ে বলে প্রগতির পথ বন্ধ করে দিতে, প্রশ্নকে বন্ধ করতে। প্রশ্ন তার বিশ্বাসানুভূতিকে আঘাত করে, সন্দেহ-অবিশ্বাস তার প্রাচীন ধারণাগুলোকে রক্তাক্ত করে।

কিন্তু এর মাঝেও নতুন সূর্য ওঠে। এই সূর্যকে তারা থামাতে পারি নি কখনই, হেমলক দিয়েও না, যীশুর কাঁটার মুকুট দিয়েও না, মুহাম্মদের উপরে অত্যাচার দিয়েও না, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেও না। যারা সকলেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। প্রথার বিরোধীতার দায়ে অভিযুক্ত। কিন্তু তারা ফিনিক্সের মত ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার জন্ম নেয়, বারবার নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় পৃথিবীকে। কারণ তারুণ্য এসবের পরোয়া করে না, তারা যেমন ধ্বংস করতে সক্ষম, সৃষ্টি করতেও সক্ষম।

পুরনো একটি লেখার পরিমার্জিত রুপ।